চাকাবিহীন চকচকে গাড়ি, মাটি স্পর্শ না করে হাওয়ায় ভেসে ছুটে চলেছে রাস্তা ধরে। প্রয়োজনে ডাঙ্গার রাস্তা ছেড়ে সে গাড়ি দিব্যি নেমে পড়ছে জলাশয়ে। সেখানেও সমান গতিতে ছুটে যাচ্ছে সে গাড়ি। শুনতে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর অতি কাল্পনিক কোনো যন্ত্রের কথা মনে হলেও সত্যিই এমন গাড়ি তৈরি করা হয়েছিল এখন থেকে প্রায় ষাট বছর আগে।
নিত্য-নতুন যানবাহন তৈরির প্রতিযোগিতা বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর মাঝে চলে আসছে বহু যুগ ধরেই। সেইসাথে উভচর ধরনের গাড়ি তৈরিতে মানুষের আগ্রহও খুব নতুন কিছু নয়। পাখা মেলে আকাশে উড়ে যাবার মতন গাড়ি, পানিতে স্পিডবোটের মতন ভেসে বেড়ানোর গাড়ি, এমনকি সাবমেরিনের মতন গভীর জলে ডুব দেবার মতন গাড়ি তৈরির চেষ্টার কথাও শোনা যায়। তবে সবাই যে তাদের কাজ সফলতার সাথে শেষ করতে পেরেছে, এমনটা নয়। কিছু কাজ আটকে গেছে হয়তো ডিজাইনিং বোর্ডেই, কিছু বাতিল হয়েছে নির্মাণ জটিলতায়। কিছু আবার মুখ থুবড়ে পরেছে যে কাজের জন্যে বানানো হয়েছে, সে কাজের কোনটাই করতে না পারার কারণে। সেসব দিক দিয়ে কার্টিস রাইট কোম্পানির তৈরি এয়ার কার বেশ কিছুটা এগিয়ে থাকে। কারণ তারা সে গাড়ি কেবল তৈরি করেই ক্ষান্ত হয়নি, সাধারণ মানুষকে দেখানোর জন্যে রাস্তায় রীতিমতো প্রদর্শনীর আয়োজনও করেছিল।
উভচর গাড়ি তৈরির চিন্তাকে বাস্তবে রূপ দেয় আমেরিকান প্রযুক্তি ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান কার্টিস রাইট কর্পোরেশন। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাথে বিভিন্ন ধরনের যানবাহন সরবরাহকারী হিসেবে আগে থেকেই কাজ করত তারা। তাছাড়া বিমান নির্মাণেও তারা ছিল বেশ প্রসিদ্ধ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে অন্যান্য দেশের মতোই আমেরিকান সামরিক বাহিনীও উভচর যানবাহনের উন্নতি সাধনের দিকে নজর দেয়। সে কারণে নতুন ধরনের উভচর বাহন নির্মাণে আগ্রহী হয়ে ওঠে কার্টিস রাইট কর্পোরেশন।
মাটি থেকে কিছুটা উপরে ভেসে থাকতে এবং চলতে সক্ষম গাড়ি নির্মাণের জন্যে গ্রাউন্ড ইফেক্টস মেশিন বা জি ই এম প্রযুক্তি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয় কার্টিস রাইট কর্পোরেশন। মূলত হোভার ক্রাফটের মতন বিরাট আকারের ফ্যানের মাধ্যমে বাতাসের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে জলে-স্থলে চলার মতন গাড়ি নির্মাণ করতে চেয়েছিল তারা। তবে সে সময়কার হোভারক্রাফটের সাথে এর একটি মূল পার্থক্য ছিল। হোভার ক্রাফটের বিশাল পাখা এর পেছনের দিকে বসানো থাকে, আর কার্টিস রাইটটের এয়ার কারে পাখাগুলো বসায় উপর থেকে নিচে, খাড়াভাবে। ভালো ভারসাম্য রক্ষা করতে এবং গাড়িটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে এ উদ্যোগ সে সময় বেশ ভালোই মনে হয়েছিল।
১৮০ অশ্বশক্তির বিমানের দু’টি ইঞ্জিন বসানো হয় এই এয়ার কারের বিশাল পাখাগুলোকে চালানোর জন্যে। চার ব্লেডের বিশাল সেই পাখাগুলোকে যুক্ত করা হয় গাড়ির যাত্রী বসার অংশের সামনে আর পেছনে। পূর্ণ শক্তিতে ইঞ্জিনগুলো ব্যবহার করলে গাড়িটি মাটি থেকে প্রায় ৬ থেকে ১২ ইঞ্চি উপরে ভাসতে এবং চলতে পারত। এয়ার কারের পরিবহন ক্ষমতার দিকেও বিশেষভাবে নজর দিতে হয় কার্টিস রাইট কর্পোরেশনকে। চারজন যাত্রী পরিবহনের মতো করে তৈরি করা হয় এর অভ্যন্তরীণ অংশ। নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা জোরদার করার জন্যে এয়ার কারের বডিতে দু’পাশে আর পেছনের দিকে রাখা হয় বায়ু চলাচলকারী শ্যাফট।
শুধু চলনসই ধরনের বাহন নয়, বরং সে সময়কার বিলাসবহুল যেকোনো গাড়িকে পাল্লা দেবার জন্যেই প্রস্তুত করা হয়েছিল এয়ার কারটিকে। ২৭৭০ এল বি এস বা ১২২৫ কেজি ওজনের গাড়িটিকে আকর্ষণীয় করতে এতে যুক্ত করা হয় বিশেষ ধরনের বাম্পার, ডিজাইন করা হেড লাইট, ব্রেক লাইট এবং ইন্ডিকেটর লাইট। কনভার্টেবল গাড়ির আদলে এতে বসানো হয় ভাঁজ করে রাখার মতো বিশেষ কাপড়ের ছাদ। গাড়ির নিয়ন্ত্রণের জন্যে বসানো ড্যাশবোর্ডও তৈরি করা হয় সে সময়কার প্রচলিত গাড়ির আদলেই। সেইসাথে এতে গোল স্টিয়ারিং হুইলের ব্যবস্থাও রেখেছিল কার্টিস রাইট কর্পোরেশন।
এয়ার কারের নির্মাণ শেষ হয় ১৯৬০ সালে। প্রটোটাইপ গাড়িটি লম্বায় ছিল ২১ ফুট, চওড়ায় ৮ ফুট আর উচ্চতায় ৬ ফুট ১ ইঞ্চি। নির্মাণকারীদের দাবি অনুযায়ী, তাদের এয়ার কারের গতি ধরা হয় ঘণ্টায় ২০ থেকে ৩৮ কিলোমিটার। সে বছরই আর্মি ট্রান্সপোর্টেশন রিসার্চ কমান্ডের কাছে পরীক্ষা-নিরীক্ষা জন্যে গাড়িটি হস্তান্তর করে কার্টিস রাইট কর্পোরেশন। প্রায় এক বছর ধরে এয়ার কারের উপর বিভিন্ন পরীক্ষা করে সামরিক বাহিনীর বিশেষ ইঞ্জিনিয়ারিং টিম।
সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি কার্টিস রাইট কর্পোরেশনের এয়ার কার। এর মূল ত্রুটি ধরা পড়ে চলাচল ক্ষমতায়। এয়ার কার সমান্তরাল মাটিতে কিংবা শান্ত জলে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে চলতে পারলেও, পথে কোথাও উঁচু-নিচু থাকলে বা কোনো বাধা পেরোতে হলে সেখানে বিভিন্ন সমস্যায় পড়তে হয় একে। সামরিক কাজের জন্যে ব্যবহৃত বাহন যদি চলাচলে নিজেই বাধার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, সেক্ষেত্রে তার উত্তীর্ণ হবার কোনো সম্ভাবনা আসলেই থাকে না। ১৯৬১ সালে সামরিক কর্তৃপক্ষ তাদের সিদ্ধান্তে জানায়, তারা এ প্রজেক্টে আর কোনো ধরনের বিনিয়োগ করতে রাজি নয়।
কিন্তু কার্টিস রাইট কর্পোরেশন এত সহজে দমে যাবার জন্যে রাজি ছিল না। সাধারণ মানুষের কাছে সাধারণ চার চাকার গাড়ির বদলে কীভাবে এই হাওয়ায় ওড়া চাকাবিহীন গাড়িকে জনপ্রিয় করা যায়, সে বিষয়ে ভাবতে শুরু করে তারা। বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হয় আগের ডিজাইনে। যাত্রী সুরক্ষা, চালানোর কৌশল, বাহ্যিক চেহারা- সবকিছুতেই কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়। যাত্রী ধারণক্ষমতা কমিয়ে নিয়ে আসা হয় দুইয়ে। নতুন এই উভচর গাড়ির নাম দেয়া হয় ‘মডেল ২৫০০’। সাধারণ জনগণের জন্যে উন্মুক্ত রাস্তায় প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। এয়ার কারের উপর নির্মাণ করা হয় তথ্যচিত্র। সে ভিডিও ইউটিউব সহ আরো অনেক ওয়েব সাইটে অনায়াসেই খুঁজে পাওয়া যায়।
সম্পূর্ণ নতুন ধরনের বিস্ময়কর আর সময় থেকে এগিয়ে থাকা উভচর এয়ার কারের বিষয়ে মানুষের আগ্রহের কমতিও ছিলনো না। কিন্তু দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্যে চার চাকার গাড়ির বদলে পেল্লাই ফ্যান বসানো, জটিল নিয়ন্ত্রন ব্যবস্থা এবং ভয়াবহ শব্দকরা এই গাড়ি কিনতে আগ্রহী ছিলনো না কেউই। তা ছাড়া ১৯৬১ সালের হিসেবে এই এয়ার কারের দাম ধরা হয়েছিল আনুমানিক ১৫০০০ ডলার। যা কিনা সেই সময়ের জন্যে ছিল সাধারন মানুষের ক্রয় ক্ষমতার অনেক উপরে।
এত কিছু করে কারো কাছ থেকে সাড়া না পেয়ে অবশেষে এয়ার কারের প্রজেক্ট বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেয় কার্টিস রাইট কর্পোরেশন। বিগত ষাট বছরে ধীরে ধীরে মানুষের স্মৃতির অতলে হারিয়ে যায় এই গাড়ি। তবে অনেকের হয়তো মনে আসতে পারে, কার্টিস রাইট কর্পোরেশনের তৈরি করা প্রোটোটাইপ দু’টির কী হয়েছিল শেষ পর্যন্ত?
অবাক করা বিষয় হচ্ছে, এত বছর পরও খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দুটো গাড়িই এখনো নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করে রাখতে সক্ষম হয়েছে। সামরিক বাহিনীর জন্যে নির্মিত এয়ার কারটি রয়েছে ভার্জিনিয়ার সামরিক জাদুঘরে। সেখানে থাকার ফলে এত বছর পরেও দুষ্প্রাপ্য সে এয়ার কার রয়েছে বেশ বহাল তবিয়েতেই। তবে সাধারণ জনগণের জন্যে নির্মিত গাড়িটির ভাগ্য সেরকম ভালো ছিলো না। নানান হাত বদলে সময়ের সাথে যুদ্ধ করে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারলেও, প্রাক্তন জৌলুস আর সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা আবহের কিছুই আর টিকে নেই তাতে। মরচে পড়া ভাঙা শরীর আর হারিয়ে যাওয়া যন্ত্রাংশ ছাড়াই ২০১৫ সালে ই’বে-তে বিক্রির জন্যে তোলা হয় গাড়িটি।
সাফল্যের মুখ না দেখলেও আবিষ্কারের দিক থেকে অবশ্যই এয়ার কারের ধারণাটি ছিল সময়ের তুলনায় বেশ আধুনিক। হয়তো সুদূর ভবিষ্যতে সত্যি সাধারণ মানুষ চড়ে বেড়াবে চাকাহীন শূন্যে ভেসে চলা এয়ার কারে!