ইঙ্গুশেতিয়া বর্তমান রুশ ফেডারেশনের দক্ষিণাঞ্চলীয় একটি প্রজাতন্ত্র, যেটি আয়তনে রাশিয়ার ‘কেন্দ্রীয় শহর’গুলো বাদে অন্য সকল প্রশাসনিক অঞ্চল অপেক্ষা ক্ষুদ্রতর। আনুষ্ঠানিকভাবে ‘ইঙ্গুশেতিয়া প্রজাতন্ত্র’ (ইঙ্গুশ: Гӏалгӏай Мохк, ‘ঘালঘাই মোখক’; রুশ: Респу́блика Ингушетия, ‘রেসপুবলিকা ইঙ্গুশেতিয়া’) নামে পরিচিত এই প্রজাতন্ত্রটির আয়তন ৩,১২৩ বর্গ কি.মি. এবং বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ৫ লক্ষ ৭ হাজার। প্রজাতন্ত্রটির জনসংখ্যার প্রায় ৯৪.১% জাতিগত ইঙ্গুশ, ৪.৬% জাতিগত চেচেন, ০.৮% জাতিগত রুশ এবং ০.৫% অন্যান্য জাতিভুক্ত। ইঙ্গুশরা জাতিগতভাবে ‘উত্তর–পূর্ব ককেশীয়’ জাতিসমূহের অংশ এবং তাদের মাতৃভাষা ইঙ্গুশ। ইঙ্গুশদের (যারা ইঙ্গুশ ভাষায় ‘ঘালঘাজ’ নামে পরিচিত) সিংহভাগই সুন্নি ইসলাম ধর্মের অনুসারী, তবে তাদের মধ্যে কিছু খ্রিস্টানও রয়েছে। ইঙ্গুশেতিয়ার জনসংখ্যার প্রায় ৯৬% মুসলিম, ২% খ্রিস্টান এবং বাকি ২% অন্যান্য ধর্মের অনুসারী।
ইঙ্গুশেতিয়া ভৌগোলিকভাবে উত্তর ককেশাস অঞ্চলে অবস্থিত এবং প্রশাসনিকভাবে রুশ ফেডারেশনের ‘উত্তর ককেশীয় কেন্দ্রীয় জেলার অন্তর্ভুক্ত। ককেশাস পর্বতমালার ১৫০ কি.মি. ইঙ্গুশেতিয়ার অভ্যন্তরে অবস্থিত। প্রজাতন্ত্রটির পূর্বে চেচেন প্রজাতন্ত্র, উত্তর ও পশ্চিমে উত্তর ওসেতিয়া–আলানিয়া প্রজাতন্ত্র এবং দক্ষিণে জর্জিয়া অবস্থিত। জর্জিয়ার সঙ্গে সীমান্ত থাকায় ইঙ্গুশেতিয়া পুরোপুরিভাবে রুশ ভূখণ্ড দ্বারা বেষ্টিত নয় এবং প্রজাতন্ত্রটির আন্তর্জাতিক সীমান্ত রয়েছে। প্রজাতন্ত্রটির বৃহত্তম শহর ও প্রাক্তন রাজধানী নাজরান, কিন্তু ১৯৯৫ সালে রাজধানী মাগাস শহরে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। প্রজাতন্ত্র প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ এবং সেখানে খনিজ তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস, মার্বেল, ডলোমাইট ও কাঠসহ নানাবিধ খনিজ ও বনজ সম্পদ রয়েছে। প্রজাতন্ত্রটির প্রধান শিল্প হচ্ছে তেল উত্তোলন ও পরিশোধন। প্রজাতন্ত্রটিতে প্রায় ১ কোটি ১০ লক্ষ টন খনিজ তেলের মজুদ আবিষ্কৃত হয়েছে এবং আরো প্রায় ৬ কোটি টন খনিজ তেলের মজুদ রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। প্রজাতন্ত্রটির পর্যটন খাতকেও সম্প্রতি উন্নত করার প্রচেষ্টা চলছে।
রুশ ফেডারেশনে অল্প কিছু প্রশাসনিক অঞ্চল রয়েছে যেগুলোতে জাতিগত রুশদের সংখ্যা অত্যন্ত কম, এবং সেই অঞ্চলগুলোর মধ্যে ইঙ্গুশেতিয়া অন্যতম। বর্তমানে প্রজাতন্ত্রটিতে বসবাসকারী জাতিগত রুশদের সংখ্যা ১ শতাংশেরও কম। প্রায় সম্পূর্ণভাবে মুসলিম–অধ্যুষিত এই প্রজাতন্ত্রটি আধা–স্বায়ত্তশাসিত এবং প্রজাতন্ত্রটির নিজস্ব রাষ্ট্রীয় পতাকা, প্রতীক, সঙ্গীত, আইনসভা, সংবিধান ও আদালত রয়েছে। প্রজাতন্ত্রটির রাষ্ট্রভাষা দুইটি – ইঙ্গুশ এবং রুশ। প্রজাতন্ত্রটির ৩২ সদস্যবিশিষ্ট আইনসভার নাম ‘ইঙ্গুশেতিয়া প্রজাতন্ত্রের গণপরিষদ’ (Гӏалгӏай Республика Халкъа Гуллам, ‘ঘালঘাই রেসপুবলিকা খালকা গুল্লাম’)। প্রজাতন্ত্রটির বর্তমান রাষ্ট্রপ্রধান মাখমুদ–আলী কালিমাতভ একজন জাতিগত ইঙ্গুশ, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কনস্তান্তিন সুরিকভ একজন জাতিগত রুশ এবং আইনসভার বর্তমান স্পিকার মাগোমেদ ইয়ান্দিয়েভ একজন জাতিগত ইঙ্গুশ। উক্ত তিনজনই রুশ রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিনের ‘সংযুক্ত রাশিয়া’ দলের সমর্থক।
ইঙ্গুশেতিয়া রাশিয়ার দরিদ্রতম অঞ্চলগুলোর একটি এবং প্রজাতন্ত্রটির বেকারত্বের হারও তুলনামূলকভাবে বেশি। প্রজাতন্ত্রটির বার্ষিক বাজেটের প্রায় ৮০% রুশ কেন্দ্রীয় সরকার সরবরাহ করে, এবং প্রজাতন্ত্রটিতে দুর্নীতির মাত্রাও বেশি। এজন্য রুশ জনসাধারণের বৃহদাংশ ইঙ্গুশেতিয়া ও পার্শ্ববর্তী কয়েকটি উত্তর ককেশীয় প্রজাতন্ত্রকে বিরাট এক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বোঝা হিসেবে বিবেচনা করে। কিন্তু অন্যদিকে, ইঙ্গুশেতিয়ায় মদ্যপানের হার সমগ্র রাশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে কম, প্রজাতন্ত্রটির জনসাধারণ প্রতিবেশী চেচেনদের তুলনায় মস্কোর প্রতি অধিক অনুগত এবং প্রজাতন্ত্রটির অর্থনৈতিক উন্নয়নের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ইঙ্গুশ ও চেচেনরা জাতিগত, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিকভাবে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হলেও তারা দুটি পৃথক জাতি।
অতি প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান ইঙ্গুশেতিয়ার ভূখণ্ডে মানুষের বসবাস ছিল। নবম শতাব্দীতে বর্তমান ইঙ্গুশেতিয়াসহ উত্তর ককেশাসের একটি বড় অংশ জুড়ে ‘আলানিয়া’ রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ১২৩৮–১২৩৯ সালে মোঙ্গল নেতা বাতু খানের নেতৃত্বে মোঙ্গল বাহিনী আলানিয়া আক্রমণ করে রাজ্যটিকে ধ্বংস করে দেয় এবং বর্তমান ইঙ্গুশেতিয়ার ভূখণ্ড আনুষ্ঠানিকভাবে মোঙ্গল ‘গোল্ডেন হোর্ড’ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৩৯৫ সালে সমরখন্দের সুলতান তৈমুর অঞ্চলটি আক্রমণ করে বিধ্বস্ত করে দেন। তৈমুরের আক্রমণের পর থেকেই ইঙ্গুশ জাতির গঠনপ্রক্রিয়া আরম্ভ হয়। এসময় ইঙ্গুশরা ছিল মূলত পৌত্তলিক এবং তারা বিভিন্ন দেবতার উপাসনা করত। পরবর্তীতে তাদের মধ্যে ইসলাম ধর্মের বিস্তার ঘটে এবং ইঙ্গুশরা একটি মুসলিমপ্রধান জাতিতে পরিণত হয়, যদিও ঊনবিংশ শতাব্দীতেও ইঙ্গুশদের সংস্কৃতিতে পৌত্তলিকতার উল্লেখযোগ্য প্রভাব বজায় ছিল।
ইঙ্গুশরা একটি অত্যন্ত যুদ্ধবাজ ও সাহসী জাতি হিসেবে পরিচিতি অর্জন করে এবং তারা বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত ছিল। বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভেও ইঙ্গুশদের অন্যতম প্রধান পেশা ছিল দস্যুবৃত্তি। ষোড়শ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে ইঙ্গুশদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তাদের প্রতিবেশী কাবার্দীয়রা রাশিয়ার জার চতুর্থ ইভানের সঙ্গে মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ হয় এবং এসময় প্রথমবারের মতো রুশদের সঙ্গে ইঙ্গুশদের সংঘর্ষ হয়। পরবর্তী দুই শতাব্দী জুড়ে রুশরা ক্রমে ক্রমে ককেশাস অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করতে থাকে। ১৭৭০ সালে ২৪ জন ইঙ্গুশ গোত্রীয় নেতা রুশ সম্রাজ্ঞী দ্বিতীয় একাতেরিনার (‘ক্যাথেরিন দ্য গ্রেট’) প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন এবং এর মধ্য দিয়ে ইঙ্গুশ জাতির রাশিয়ার অংশে পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়া আরম্ভ হয়। ১৮১০ সালে ৬টি ইঙ্গুশ গোত্র রুশ সম্রাট প্রথম আলেক্সান্দরের প্রতি আনুগত্যের ঘোষণা দিলে অঞ্চলটি আনুষ্ঠানিকভাবে রুশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।
১৮২০–এর দশক থেকে ১৮৫০–এর দশক পর্যন্ত উত্তর ককেশাসে রুশ সাম্রাজ্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে রাশিয়া ও ককেশাস ইমামতের মধ্যে যে তীব্র সংঘর্ষ হয়, তাতে ইঙ্গুশদের একাংশ রুশদের পক্ষে এবং আরেক অংশ ককেশাস ইমামতের পক্ষে যুদ্ধ করে। ১৮৫৮ সালে ইঙ্গুশদের ভূমিতে রুশ সরকার কসাকদের বসতি স্থাপন করার সিদ্ধান্ত নিলে ইঙ্গুশদের একাংশ বিদ্রোহ করে, কিন্তু রুশ সৈন্যরা এই বিদ্রোহ দমন করে। এই বিদ্রোহের পর রুশ সরকার ইঙ্গুশ জনসাধারণের একাংশকে রাশিয়া থেকে বহিষ্কার করে এবং বহিষ্কৃত ইঙ্গুশরা ওসমানীয় সাম্রাজ্যে আশ্রয় গ্রহণ করে। পরবর্তীতে রুশ সরকারের নীতিতে পরিবর্তন আসে। ১৮৭৭–১৮৭৮ সালের রুশ–ওসমানীয় যুদ্ধে এবং ১৯০৪–১৯০৫ সালের রুশ–জাপানি যুদ্ধে প্রচুর ইঙ্গুশ রুশ সেনাবাহিনীর অংশ হিসেবে যথাক্রমে ওসমানীয় সাম্রাজ্য ও জাপানের বিরুদ্ধে কৃতিত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালেও ইঙ্গুশ সৈন্যরা সাহসিকতার সঙ্গে জার্মানি, অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরি ও ওসমানীয় সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে।
রুশ বিপ্লবের পর ১৯১৭ সালের নভেম্বরে উত্তর ককেশাসের বিভিন্ন জাতির প্রতিনিধিরা মিলে ‘পার্বত্য প্রজাতন্ত্র’ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করেন এবং ইঙ্গুশরাও এই রাষ্ট্রে যোগদান করে। এই রাষ্ট্রটি জার্মানি, অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরি, ওসমানীয় সাম্রাজ্য, ব্রিটেন ও আরো কয়েকটি রাষ্ট্রের কাছ থেকে স্বীকৃতি লাভ করে এবং ওসমানীয় সাম্রাজ্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলে। বলশেভিকরা এর প্রত্যুত্তরে ‘তেরেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র’ ও ‘উত্তর ককেশীয় সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র’ গঠন করে। ১৯১৯ সালের মার্চে পার্বত্য প্রজাতন্ত্রের একটি প্রতিনিধিদল ভার্সাই শান্তি সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে এবং রুশ সেনাবাহিনীর প্রাক্তন কর্মকর্তা জাউরবেক আখুশকভ এই সম্মেলনে ইঙ্গুশদের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। এদিকে ১৯১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে জেনারেল আন্তন দেনিকিনের নেতৃত্বাধীন বলশেভিকবিরোধী ‘দক্ষিণ রাশিয়ার সশস্ত্রবাহিনী’ পার্বত্য প্রজাতন্ত্র আক্রমণ করে রাষ্ট্রটির অধিকাংশ স্থান দখল করে নেয় এবং এর ফলে রাষ্ট্রটির বিলুপ্তি ঘটে। এসময় ইঙ্গুশরা চলমান রুশ গৃহযুদ্ধে বলশেভিকদের পক্ষাবলম্বন করে এবং লাল ফৌজের অংশ হিসেবে শ্বেত ফৌজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। ১৯২০ সালের মার্চে লাল ফৌজ ইঙ্গুশেতিয়ার ভূমি থেকে দেনিকিনের সৈন্যদের বিতাড়িত করে।
বলশেভিকরা উত্তর ককেশাসের জাতিগুলোকে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং এর অংশ হিসেবে ১৯২০ সালের ১৭ নভেম্বর ‘পার্বত্য সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র’ গঠন করে, ইঙ্গুশেতিয়াও যার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯২১ সালের ২০ জানুয়ারি এটিকে ‘পার্বত্য স্বায়ত্তশাসিত সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে’ রূপান্তরিত করা হয়। পরবর্তীতে মস্কো উত্তর ককেশাসের জাতিগুলোর প্রতিটির জন্য স্বতন্ত্র স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেয় এবং এর অংশ হিসেবে ১৯২৪ সালের ৭ নভেম্বর ‘ইঙ্গুশ স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ’ গঠন করে। পরবর্তী এক দশক ছিল ইঙ্গুশ জাতির জন্য তুলনামূলকভাবে ভালো সময়। এসময় ইঙ্গুশ ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়, প্রদেশটিতে ব্যাপক হারে শিল্পায়নের উদ্যোগ গৃহীত হয় এবং স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতের উন্নতিসহ প্রজাতন্ত্রটির অধিবাসীদের জীবনযাত্রার মানের প্রভূত উন্নতি হয়।
ইঙ্গুশ ও চেচেন জাতির মধ্যেকার ঘনিষ্ঠ সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে ১৯৩৪ সালের ১৫ জানুয়ারি সোভিয়েত সরকার ‘ইঙ্গুশ স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ’ এবং ‘চেচেন স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ’কে একত্রিত করে ‘চেচেন–ইঙ্গুশ স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ’ গঠন করে। ১৯৩৬ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের নতুন সংবিধান গৃহীত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ৫ ডিসেম্বর প্রদেশটিকে ‘স্বায়ত্তশাসিত প্রজাতন্ত্রে’র মর্যাদা প্রদান করা হয় এবং ‘চেচেন–ইঙ্গুশ স্বায়ত্তশাসিত সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র’ নামকরণ করা হয়। ১৯৩৭–১৯৩৮ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন জুড়ে যে ব্যাপক শুদ্ধি অভিযান শুরু হয়, চেচেন–ইঙ্গুশ প্রজাতন্ত্রেও তার প্রভাব পড়ে এবং বহুসংখ্যক ইঙ্গুশ রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ মানুষ এর ভুক্তভোগীতে পরিণত হয়। এর ফকে স্বভাবতই ইঙ্গুশ ও চেচেন জনসাধারণের একাংশের মধ্যে অসন্তোষের সৃষ্টি হয়।
১৯৩৯–১৯৪০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ফিনল্যান্ড আক্রমণ করে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয় এবং এটিকে সোভিয়েত সামরিক দুর্বলতার লক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করে চেচেন ও ইঙ্গুশদের একাংশ ১৯৪০ সালে সোভিয়েত শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। বিদ্রোহীদের সঙ্গে জার্মান গোয়েন্দা সংস্থার যোগাযোগ ছিল এবং ১৯৪১ সালের ২২ জুন জার্মানির নেতৃত্বে অক্ষশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করার পর জার্মানরা সরাসরি এই বিদ্রোহীদের সমর্থন করতে শুরু করে। জার্মানরা এই বিদ্রোহীদের প্রশিক্ষণ প্রদান করে এবং কিছুসংখ্যক জার্মান সৈন্যকে সোভিয়েতবিরোধী ‘অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ড’ পরিচালনার জন্য তাদের মধ্যে প্রেরণ করা হয়। কিন্তু এই জার্মান–সমর্থিত বিদ্রোহের প্রতি ইঙ্গুশ ও চেচেনদের নিরঙ্কুশ সমর্থন ছিল না। হাজার হাজার ইঙ্গুশ ও চেচেন সৈন্য বীরত্বের সঙ্গে লাল ফৌজের অংশ হিসেবে অক্ষবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং তাদের অনেকেই সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বোচ্চ সামরিক পদক অর্জন করে। ইঙ্গুশ ও চেচেন শ্রমিকরা যুদ্ধাস্ত্র ও আনুষঙ্গিক রসদপত্র উৎপাদনে বিশেষ ভূমিকা রাখে এবং এমনকি ইঙ্গুশ ও চেচেন ধর্মীয় নেতারাও যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে জনমত সৃষ্টির জন্য বিশেষ অবদান রাখেন। ১৯৪২ সালের আগস্টে ককেশাসের তেলক্ষেত্রগুলো দখল করার উদ্দেশ্যে জার্মান সৈন্যরা দক্ষিণ দিকে ধাবিত হয় এবং বর্তমান ইঙ্গুশেতিয়ার মাল্গোবেক অঞ্চল দখল করে নেয়, কিন্তু স্থানীয় জনসাধারণ ও লাল ফৌজের তীব্র প্রতিরোধের মুখে পশ্চাৎপসরণ করতে বাধ্য হয়।
১৯৪৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে সোভিয়েত সরকার ইঙ্গুশ ও চেচেন জাতিদ্বয়কে ‘জার্মানদের সঙ্গে সহযোগিতা’, ‘সোভিয়েতবিরোধী কার্যক্রম’ এবং ‘দস্যুবৃত্তি’র দায়ে অভিযুক্ত করে এবং মধ্য এশিয়ায় নির্বাসিত করার সিদ্ধান্ত নেয়। ইতিহাসবিদদের মতে, এই অভিযোগগুলো ছিল প্রায়শই ভিত্তিহীন। যদিও ১৯৪০ সাল থেকে ইঙ্গুশ ও চেচেনদের একাংশ সোভিয়েত শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে লিপ্ত ছিল এবং জার্মানদের সঙ্গে সহায়তা করেছিল, তথাপি ইঙ্গুশ ও চেচেন জনসাধারণের সিংহভাগ ছিল সোভিয়েত সরকারের প্রতি অনুগত এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সোভিয়েত বিজয়ে তাদেরও যথেষ্ট অবদান ছিল। প্রকৃতপক্ষে ঠিক কী কারণে ইঙ্গুশ ও চেচেনদের নির্বাসিত করা হয়েছিল সেটি নিয়ে এখনো ইতিহাসবিদদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। কারো কারো মতে, স্তালিন সেসময় তুরস্কের বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন এবং ইঙ্গুশ ও চেচেনরা তুর্কিদের সঙ্গে তাদের ধর্মীয় সাদৃশ্যের কারণে এর বিরোধিতা করতে পারে এই আশঙ্কা থেকে তাদেরকে নির্বাসিত করা হয়েছিল। আবার অনেক ইতিহাসবিদের ধারণা, জাতিগত বিদ্বেষ থেকেই ইঙ্গুশ ও চেচেনদের নির্বাসিত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল।
কারণ যাই হোক, এই নির্বাসনের ফলাফল ছিল ইঙ্গুশ ও চেচেনদের জন্য অত্যন্ত ভয়াবহ। সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা ‘এনকেভিডি’র তথ্য অনুযায়ী, মোট ৯১,২৫০ জন জাতিগত ইঙ্গুশকে নির্বাসিত করা হয়। এদের মধ্যে ৭৮,৪৭৯ জনকে কাজাখ প্রজাতন্ত্রে, ২,২৭৮ জনকে কিরঘিজ প্রজাতন্ত্রে এবং বাকিদেরকে উজবেক, তাজিক ও রুশ প্রজাতন্ত্রে প্রেরণ করা হয়েছিল। নির্বাসনে যাওয়ার পথে বা নির্বাসনস্থলে পৌঁছানোর পর রোগ-ব্যাধিসহ নানা কারণে মোট ২০,৩০০ জন ইঙ্গুশ নারী-পুরুষ প্রাণ হারায়। ১৯৪৪ সালের ৩ মার্চ চেচেন–ইঙ্গুশ প্রজাতন্ত্রটিকে বিলুপ্ত করা হয় এবং প্রজাতন্ত্রটির ভূমি পার্শ্ববর্তী স্তাভ্রোপোল সীমান্ত প্রদেশ, দাগেস্তান স্বায়ত্তশাসিত সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র, উত্তর ওসেতীয় স্বায়ত্তশাসিত সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র ও জর্জীয় সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের মধ্যে বণ্টন করে দেয়া হয়। এই অঞ্চলগুলোতে জাতিগত রুশ, ইউক্রেনীয়, ওসেতীয় ও অন্যান্য জাতিভুক্ত মানুষদের বসতি স্থাপনে উৎসাহিত করা হয়। ১৯৪৮ সালের ২৬ নভেম্বর সোভিয়েত মন্ত্রিসভা ইঙ্গুশ ও চেচেনদেরকে ‘চিরস্থায়ী নির্বাসন’ প্রদান করে এবং তাদের মাতৃভূমিতে প্রত্যাবর্তনের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
স্তালিনের মৃত্যুর পর সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ ‘বিস্তালিনীকরণ’ (De-Stalinization) প্রক্রিয়া আরম্ভ করেন এবং এর অংশ হিসেবে স্তালিন কর্তৃক নির্বাসিত বিভিন্ন জাতিকে নির্দোষ ঘোষণা করেন। প্রাথমিকভাবে নতুন সোভিয়েত নেতৃবৃন্দ মধ্য এশিয়ার মাটিতেই ইঙ্গুশ ও চেচেনদের জন্য একটি ‘স্বায়ত্তশাসিত প্রজাতন্ত্র’ গঠনের পরিকল্পনা করছিল, কিন্তু এ ধরনের প্রস্তাবনার প্রতি মধ্য এশীয় জাতিগুলোর সম্ভাব্য বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কথা চিন্তা করে তারা এই পরিকল্পনা পরিত্যাগ করে। ১৯৫৬ সালের ১৬ জুলাই সোভিয়েত মন্ত্রিসভা নির্বাসিত ইঙ্গুশ ও চেচেনদের চলাচলের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় এবং ১৯৫৭ সালের জানুয়ারিতে তাদের মাতৃভূমিতে প্রত্যাবর্তনের অনুমতি প্রদান করে। ১৯৫৮ সালে সোভিয়েত সরকার ‘চেচেন–ইঙ্গুশ স্বায়ত্তশাসিত সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র’ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে।
ইঙ্গুশ ও চেচেনরা নিজেদের মাতৃভূমিতে ফিরে নতুন ধরনের এক সমস্যার মুখোমুখি হয়। তাদের আবাসস্থলগুলোতে অন্যান্য অঞ্চল থেকে আগত অভিবাসীরা বসতি স্থাপন করেছিল এবং প্রজাতন্ত্রটির কর্মসংস্থানের সবচেয়ে ভালো অংশগুলো তাদের কর্তৃত্বে ছিল। ফলে ইঙ্গুশ ও চেচেনরা অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্যের শিকার হতে থাকে। তদুপরি, প্রাক্তন ইঙ্গুশ–অধ্যুষিত প্রিগরোদনি জেলা (১,৪১০ বর্গ কি.মি.) পার্শ্ববর্তী উত্তর ওসেতিয়ার নিকট হস্তান্তর করা হয়েছিল, যেগুলো ইঙ্গুশদেরকে ফিরিয়ে দেয়া হয় নি। ফলে ওসেতীয়দের সঙ্গে ইঙ্গুশদের দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। ১৯৭০–এর দশকে ইঙ্গুশ বুদ্ধিজীবীরা প্রিগরোদনিকে ইঙ্গুশদের নিকট ফিরিয়ে দেয়ার জন্য দাবি জানান এবং ইঙ্গুশ জনসাধারণ এই দাবিতে বিক্ষোভ করে, কিন্তু তাদের এই দাবি অগ্রাহ্য করা হয়।
১৯৯১ সালের ১ অক্টোবর প্রাক্তন সোভিয়েত মেজর জেনারেল ঝোখার দুদায়েভের (‘জওহর দুদায়েভ’) নেতৃত্বে চেচেন বিচ্ছিন্নতাবাদীরা চেচেন–ইঙ্গুশ প্রজাতন্ত্রের শাসনক্ষমতা দখল করে নেয়। ইঙ্গুশরা সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের বিরোধী ছিল এবং চেচেন–নিয়ন্ত্রিত একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে সংখ্যালঘু হয়ে থাকার কোনো ইচ্ছে তাদের ছিল না। তদুপরি, রাশিয়া থেকে বেরিয়ে একটি পৃথক রাষ্ট্রে পরিণত হলে প্রিগোরদনি অঞ্চলটি ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে – এরকম আশঙ্কাও তাদের ছিল। ফলে তারা চেচেন–ইঙ্গুশ প্রজাতন্ত্র থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবং ১৯৯২ সালে ‘ইঙ্গুশেতিয়া প্রজাতন্ত্র’ হিসেবে রুশ ফেডারেশনে যোগদান করে।
১৯৯২ সালের প্রথম থেকেই প্রিগরোদনি অঞ্চলে ইঙ্গুশ ও ওসেতীয়দের মধ্যে জাতিগত সংঘাত শুরু হয় এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য অঞ্চলটিতে রুশ সৈন্য মোতায়েন করা হয়। তা সত্ত্বেও ৩০ অক্টোবর ইঙ্গুশ মিলিশিয়া সদস্যরা প্রিগরোদনি দখলের চেষ্টা করলে ওসেতীয় মিলিশিয়া সদস্যদের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ শুরু হয় এবং এক সপ্তাহব্যাপী প্রিগরোদনিতে জাতিগত দাঙ্গা চলে। অবশেষে রুশ সৈন্যদের হস্তক্ষেপে এই সংঘাত বন্ধ হয়, কিন্তু ইঙ্গুশরা রুশ সৈন্যদেরকে ওসেতীয়দের প্রতি পক্ষপাতমূলক আচরণের দায়ে অভিযুক্ত করে। এই সংঘর্ষে ৩৫০ জন ইঙ্গুশ নিহত ও ৪৫৭ জন আহত হয় এবং প্রিগোরদনি ও উত্তর ওসেতিয়ার অন্যান্য অঞ্চল থেকে প্রায় ৩০,০০০ ইঙ্গুশ শরণার্থী ইঙ্গুশেতিয়ায় আশ্রয় নেয়। অন্যদিকে, এই সংঘর্ষে ১৯২ জন ওসেতীয় নিহত ও ৩৭৯ জন আহত হয় এবং প্রায় ৯,০০০ ওসেতীয় শরণার্থীতে পরিণত হয়। এই সংঘর্ষের পর ইঙ্গুশ আর ওসেতীয়দের মধ্যে বড় ধরনের কোনো সংঘর্ষ হয় নি, কিন্তু মাঝে মাঝে বিক্ষিপ্ত সংঘাত চলতে থাকে। ১৯৯২ সালে রুশ কেন্দ্রীয় সরকার প্রিগরোদনিকে উত্তর ওসেতিয়ার অংশ হিসেবে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়।
শুধু উত্তর ওসেতিয়া নয়, পার্শ্ববর্তী ‘ইচকেরিয়া চেচেন প্রজাতন্ত্রে’র সঙ্গেও সীমান্ত নিয়ে ইঙ্গুশেতিয়ার বিরোধ দেখা দেয়৷ ১৯৩০–এর দশকের মানচিত্র অনুযায়ী চেচেনরা পূর্ব ইঙ্গুশেতিয়ার অংশবিশেষ দাবি করছিল। ১৯৯৩ সালে ইঙ্গুশেতিয়া ও চেচনিয়ার মধ্যে একটি সীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং উভয় প্রজাতন্ত্র তৎকালীন সীমান্ত অপরিবর্তিত রাখতে সম্মত হয়। একই বছর আফগান যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ইঙ্গুশ বীর লেফটেন্যান্ট জেনারেল রুসলান আউশেভ ইঙ্গুশেতিয়ার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। বিপুল জনপ্রিয়তার অধিকারী এই রাষ্ট্রনায়ক ১৯৯০–এর দশকের নৈরাজ্য ও অস্থিতিশীলতার মধ্যে ইঙ্গুশেতিয়ায় শান্তি বজায় রাখতে সক্ষম হন।
১৯৯৪ সালে রাশিয়া ও চেচনিয়ার মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে আউশেভ ইঙ্গুশেতিয়ার ওপর এই যুদ্ধের প্রভাব যথাসম্ভব সীমিত রাখার প্রয়াস পান। কিন্তু কাজটি মোটেও সহজসাধ্য ছিল না, কারণ দেড় লক্ষাধিক শরণার্থী যুদ্ধবিধ্বস্ত চেচনিয়া থেকে ইঙ্গুশেতিয়ায় আশ্রয় গ্রহণ করেছিল এবং প্রায়ই চেচেন যোদ্ধাদের পশ্চাদ্ধাবন করে রুশ সৈন্যরা ইঙ্গুশেতিয়ার অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ত। কিছুসংখ্যক ইঙ্গুশ চেচেন গেরিলাদের সঙ্গে যোগদান করেছিল, আবার চেচনিয়ায় মোতায়েনকৃত রুশ বাহিনীতেও বহুসংখ্যক ইঙ্গুশ সৈন্য ছিল। এসময় রুশ সশস্ত্রবাহিনীতে শৃঙ্খলা একেবারে ভেঙে পড়েছিল এবং যুদ্ধের কারণে ইঙ্গুশেতিয়ায় অবস্থানরত রুশ সৈন্যরা বেসামরিক জনসাধারণের বিরুদ্ধে নানারকম অপরাধে লিপ্ত হয়ে পড়েছিল। ক্ষিপ্ত আউশেভ এর তীব্র প্রতিবাদ জানান এবং রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে মামলা করারও হুমকি দিয়েছিলেন। ১৯৯৬ সালে প্রথম চেচেন যুদ্ধে পরাজয়ের পর চেচনিয়া থেকে রুশ সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়া হলে এই পরিস্থিতির অবসান ঘটে।
কিন্তু শরণার্থী সমস্যার চাপে ইঙ্গুশেতিয়ার অর্থনীতি প্রায় ভেঙে পড়েছিল এবং পার্শ্ববর্তী চেচনিয়ায় (এবং অংশত দাগেস্তানে) অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ও ধর্মীয় উগ্রপন্থার বিস্তারের প্রভাব ইঙ্গুশেতিয়ায়ও ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৯৯ সালে চেচনিয়াভিত্তিক মিলিট্যান্টদের দাগেস্তান আক্রমণ এবং রাশিয়া জুড়ে সন্ত্রাসবাদী আক্রমণের বিস্তারের প্রেক্ষাপটে রাশিয়া দ্বিতীয় বারের মতো চেচনিয়া আক্রমণ করে এবং পূর্বের তুলনায় তুলনামূলকভাবে সুশৃঙ্খল রুশ সৈন্যরা চেচনিয়া পুনর্দখল করে নিতে সমর্থ হয়, কিন্তু উত্তর ককেশাস জুড়ে মিলিট্যান্টদের আক্রমণ অব্যাহত থাকে। ২০০১ সালের ডিসেম্বরে আউশেভ পদত্যাগ করেন এবং পরবর্তী নির্বাচনে ক্রেমলিন–সমর্থিত প্রাক্তন কেজিবি/এফএসবি জেনারেল মুরাত জিয়াজিকভ ইঙ্গুশেতিয়ার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। এই নির্বাচনে জিয়াজিকভকে বিজয়ী করার জন্য মস্কো নির্বাচনে অবৈধভাবে হস্তক্ষেপ করেছিল বলে অভিযোগ ওঠে এবং জিয়াজিকভ ইঙ্গুশ জনসাধারণের মধ্যে অজনপ্রিয় ছিলেন।
২০০২ সালে ইঙ্গুশেতিয়া ও উত্তর ওসেতিয়ার মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং এর মধ্য দিয়ে প্রজাতন্ত্র দুইটি তাদের মধ্যেকার বর্তমান সীমান্ত বজায় রাখতে সম্মত হয়। এর মধ্য দিয়ে অন্তত সাময়িকভাবে হলেও ইঙ্গুশেতিয়া প্রিগরোদনির ওপর তাদের দাবিকে স্থগিত রাখে। ২০০৩ সালে ইঙ্গুশেতিয়া ও চেচনিয়ার মধ্যেও অনুরূপ একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২০০৪ সালের ৬ এপ্রিল চেচেন মিলিট্যান্টদের দ্বারা পরিচালিত একটি গাড়ি বোমা বিস্ফোরণে ইঙ্গুশ রাষ্ট্রপতি জিয়াজিকভ আহত হন এবং ২০০৪ সালের জুনে ইঙ্গুশেতিয়ার বৃহত্তম শহর নাজরানে চেচেন মিলিট্যান্টদের আক্রমণে সামরিক বেসামরিক মিলিয়ে প্রায় ১০০ মানুষ নিহত হয়। ২০০৭ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে ইঙ্গুশেতিয়ায় ‘ককেশাস আমিরাত’ মিলিট্যান্টরা বড়মাত্রার একটি বিদ্রোহ শুরু করে এবং ২০০৮ সালের ৩০ অক্টোবর রুশ রাষ্ট্রপতি দিমিত্রি মেদভেদেভ দুর্নীতি ও ইঙ্গুশেতিয়ায় বিরাজমান অস্থিতিশীলতা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার অভিযোগে জিয়াজিকভকে অপসারণ করেন। তাঁর স্থলে কসোভো সঙ্কট ও দ্বিতীয় চেচেন যুদ্ধের বীর এবং রুশ প্যারাট্রুপার বাহিনীর ইঙ্গুশ মেজর জেনারেল ইউনুস–বেক ইয়েভকুরভকে ইঙ্গুশেতিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান নিযুক্ত করা হয়।
ইয়েভকুরভের শাসনামলের প্রথম বছরগুলোতে ককেশাস আমিরাত মিলিট্যান্টদের সঙ্গে ইঙ্গুশ নিরাপত্তারক্ষীদের তীব্র সংঘর্ষ হয় এবং ইঙ্গুশেতিয়া জুড়ে মিলিট্যান্টদের আক্রমণ বৃদ্ধি পায়। ২০০৯ সালের ১০ জুন ইঙ্গুশেতিয়ার সুপ্রিম কোর্টের উপপ্রধান বিচারপতি আজা গাজগিরেইয়েভা এবং ১৩ জুন প্রাক্তন উপপ্রধানমন্ত্রী বশির আউশেভ মিলিট্যান্টদের হাতে নিহত হন। ২২ জুন একটি গাড়ি বোমা বিস্ফোরণে ইয়েভকুরভ নিজেই গুরুতরভাবে আহত হন, কিন্তু প্রাণে বেঁচে যান। সুস্থ হওয়ার পর ইয়েভকুরভ ঘোষণা করেন যে, যারা এই আক্রমণগুলোর সঙ্গে জড়িত, তাদের সবাইকে মেরে ফেলা হবে। এসময় ইঙ্গুশেতিয়ায় বিদ্রোহ দমনে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়, মিলিট্যান্টদের নেতারা একে একে ইঙ্গুশ নিরাপত্তারক্ষীদের হাতে নিহত হয় এবং এফএসবি সদস্যরা মিলিট্যান্টদের অর্থ ও অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহের ‘নেটওয়ার্ক’গুলোকে ধ্বংস করতে সক্ষম হয়। ২০১৫ সালের মে মাসে ইয়েভকুরভ আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেন যে, ইঙ্গুশেতিয়ায় মিলিট্যান্টরা পরাজিত হয়েছে৷ ৮ বছরব্যাপী এই সংঘর্ষ মিলিট্যান্টদের আক্রমণে প্রায় ৫০০ ইঙ্গুশ নিরাপত্তারক্ষী ও ৭১ জন বেসামরিক মানুষ নিহত হয়।
২০১৩ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে ইয়েভকুরভ পুনর্নিবাচিত হন এবং ইঙ্গুশেতিয়ায় স্থিতিশীলতা আনয়নের জন্য তাঁকে কৃতিত্ব প্রদান করা হয়। কিন্তু ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে ইঙ্গুশেতিয়া ও চেচনিয়ার মধ্যে বিদ্যমান সীমান্ত সমস্যা সমাধানের জন্য প্রজাতন্ত্র দুইটির মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী ইঙ্গুশেতিয়া ৩৪০ বর্গ কি.মি. বা প্রায় ২৬,৮০০ হেক্টর ভূমি (যা ইঙ্গুশেতিয়ার মোট আয়তনের প্রায় ৯%) চেচনিয়ার কাছে হস্তান্তর করে এবং বিনিময়ে চেচনিয়ার কাছ থেকে প্রায় ১,০০০ হেক্টর ভূমি লাভ করে। উভয় প্রজাতন্ত্রের আইনসভায় চুক্তিটি অনুমোদিত হয়। কিন্তু ইঙ্গুশ জনসাধারণ ইঙ্গুশেতিয়ার ভূমি চেচনিয়াকে হস্তান্তরের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানায় এবং দুই সপ্তাহব্যাপী এর বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। ২০১৮ সালের অক্টোবরে ইঙ্গুশেতিয়ার সাংবিধানিক আদালত চুক্তিটিকে অবৈধ বলে রায় প্রদান করে। ইয়েভকুরভ রাশিয়ার কেন্দ্রীয় সাংবিধানিক আদালতে আপিল করলে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে সেই আদালত চুক্তিটিকে বৈধতা প্রদান করে।
কিন্তু এর প্রতিক্রিয়ায় ইঙ্গুশেতিয়ায় আবার বিক্ষোভ শুরু হয় এবং ২০১৯ সালের মার্চে বিক্ষোভ তীব্র রূপ ধারণ করে। বিক্ষোভকারীরা চেচনিয়ার সঙ্গে স্বাক্ষরিত সীমান্ত চুক্তিটি বাতিল করার এবং ইয়েভকুরভের পদত্যাগের দাবি জানায়। ইঙ্গুশ নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ হয় এবং বেশ কয়েকজন বিক্ষোভকারী গ্রেপ্তার হয়। মস্কো এই সংঘর্ষে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকে, কারণ এই বিক্ষোভ দমনে বলপ্রয়োগ করলে তার তীব্র প্রতিক্রিয়া হতে পারত। অবশেষে ২০১৯ সালের ২৬ জুন ইয়েভকুরভ ‘প্রজাতন্ত্রের স্বার্থে’ পদত্যাগ করেন এবং এর মধ্য দিয়ে ইঙ্গুশেতিয়ায় বিক্ষোভের আপাত অবসান ঘটে। রুশ কেন্দ্রীয় সরকার ইয়েভকুরভের সামরিক পদমর্যাদা লেফটেন্যান্ট জেনারেলে উন্নীত করে এবং তাঁকে রাশিয়ার উপপ্রতিরক্ষামন্ত্রী নিযুক্ত করে। কাজাখ সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র ও সামারা প্রদেশে বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করা ইঙ্গুশ রাজনীতিবিদ মাখমুদ–আলী কালিমাতভ ইঙ্গুশেতিয়ার নতুন রাষ্ট্রপ্রধান নিযুক্ত হন।
ইঙ্গুশেতিয়ার সাম্প্রতিক বিক্ষোভ থেকে বেশ কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, যেগুলোর কোনো কোনোটি মস্কোর জন্য অস্বস্তিকর।
প্রথমত, ইঙ্গুশ জাতীয়তাবাদ মূলত রুশবিরোধী নয় এবং ঐতিহাসিকভাবে চেচেন বা ক্রিমিয়ান তাতারদের মতো ইঙ্গুশদের মধ্যে রুশবিরোধিতার ঐতিহ্য নেই। ইঙ্গুশ জাতীয়তাবাদ মূলত আঞ্চলিকতা–ভিত্তিক। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে ইঙ্গুশ জাতীয়তাবাদের লক্ষ্যবস্তু ছিল দূরবর্তী মস্কো নয়, নিকটবর্তী উত্তর ওসেতিয়া ও চেচনিয়া। কিন্তু প্রিগরোদনি অঞ্চলের প্রতি ইঙ্গুশদের ন্যায়সঙ্গত দাবি উপেক্ষা করে এবং সাম্প্রতিক ইঙ্গুশেতীয়–চেচনীয় সীমান্ত চুক্তির প্রতি মৌন সমর্থন জ্ঞাপন করে মস্কো ইঙ্গুশদের বিরাগভাজন হয়েছে। ইঙ্গুশ জনসাধারণের একাংশের ধারণা, মস্কো ইঙ্গুশেতিয়ার বাইরে থেকে আসা রাজনীতিবিদদের (যদিও তারাও জাতিগতভাবে ইঙ্গুশ) প্রজাতন্ত্রটির ক্ষমতায় বসাচ্ছে এবং এই ‘বহিরাগত’ রাজনীতিবিদরা ইঙ্গুশেতিয়ার ‘রাষ্ট্রীয় স্বার্থে’র প্রতি সংবেদনশীল নন। এজন্য ইঙ্গুশেতিয়ার বিরোধী দলগুলো এবং গোত্রীয় নেতারা ইঙ্গুশেতিয়ার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রচলিত পরোক্ষ নির্বাচন পদ্ধতির (রুশ রাষ্ট্রপতি কর্তৃক মনোনয়ন ও স্থানীয় আইনসভা কর্তৃক অনুমোদন) পরিবর্তে প্রত্যক্ষ নির্বাচন পদ্ধতি (সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচন) পুনঃপ্রবর্তনের দাবি জানিয়েছে। কিন্তু সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত আঞ্চলিক রাষ্ট্রপ্রধানরা উগ্র জাতীয়তাবাদী হতে পারেন এবং মস্কোর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারেন। স্বভাবতই এই দাবি মেনে নিতে মস্কো আগ্রহী নয়।
দ্বিতীয়ত, ইঙ্গুশ–চেচেন দ্বন্দ্ব অনিয়ন্ত্রিত থাকলে উত্তর ককেশাসে ও রুশ ফেডারেশনের অন্যান্য অঞ্চলে বিভিন্ন জাতির মধ্যে সংঘাত ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং পুরনো জাতিগত দ্বন্দ্বগুলো (যেমন: ইঙ্গুশ–ওসেতীয় দ্বন্দ্ব, বাশকির–চুভাশ দ্বন্দ্ব, তাতার–বাশকির দ্বন্দ্ব প্রভৃতি) আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। এই ধরনের দ্বন্দ্ব রুশ ফেডারেশনের স্থিতিশীলতা ও ভৌগোলিক অখণ্ডতার প্রতি মারাত্মক হুমকি হয়ে উঠতে পারে।
তৃতীয়ত, রাশিয়ার জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য নির্ধারিত প্রান্তিক প্রজাতন্ত্রগুলো ক্রমশ অধিকতর স্বায়ত্তশাসন অর্জন করছে এবং সাম্প্রতিক ইঙ্গুশ–চেচেন চুক্তির সময় এটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ইঙ্গুশেতিয়া ও চেচনিয়া একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে এবং চুক্তিটি নিয়ে ইঙ্গুশেতিয়ায় জনবিক্ষোভের পরিপ্রেক্ষিতে প্রজাতন্ত্রটির রাষ্ট্রপতিকে পদত্যাগ করতে হয়েছে। পুরোটা সময় মস্কো নিরাপদ দূরত্বে থেকে ঘটনাবলি পর্যবেক্ষণ করেছে, যেন দুইটি স্বাধীন রাষ্ট্রের মধ্যে চুক্তি হয়েছে এবং একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে বিক্ষোভের ফলে সরকারের পতন ঘটেছে! মস্কোর এই মনোভাব আপাতদৃষ্টিতে গঠনমূলক, কারণ মস্কো হস্তক্ষেপ করলে পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটতে পারত। কিন্তু প্রান্তিক প্রজাতন্ত্রগুলোর স্বাধীন রাষ্ট্রসুলভ আচরণ ক্রমে প্রজাতন্ত্রগুলোর ওপর মস্কোর নিয়ন্ত্রণকে হুমকিগ্রস্ত করতে পারে, এরকম একটি সম্ভাবনা রয়েছে।
চতুর্থত, ইঙ্গুশ ও চেচেনরা ধর্মীয় ও জাতিগতভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং তাদের দীর্ঘদিন একক রাজনৈতিক কর্তৃত্বাধীনে থাকার ইতিহাস রয়েছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের মধ্যে সাম্প্রতিক দ্বন্দ্ব উত্তর ককেশাসে বিচিত্রধর্মী ও অনিশ্চিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিরই ইঙ্গিতবহ। দুইটি মুসলিম–অধ্যুষিত প্রজাতন্ত্রের মধ্যে এই দ্বন্দ্ব উত্তর ককেশাসে ‘বৃহত্তর ইসলামি সম্প্রদায়ে’র ক্রমবর্ধমান দুর্বলতা এবং ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের বিস্তারের নির্দেশক বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
সর্বোপরি, এখন পর্যন্ত ইঙ্গুশ জনসাধারণ সাধারণভাবে মস্কোর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে এসেছে। কিন্তু প্রিগরোদনি দ্বন্দ্বে ওসেতীয়দের প্রতি মস্কোর সমর্থন এবং সাম্প্রতিক ইঙ্গুশ–চেচেন চুক্তি (যেটি ইঙ্গুশদের দৃষ্টিতে অন্যায্য) সম্পর্কে মস্কোর নীরবতা ইঙ্গুশদেরকে মস্কোর প্রতি ক্ষুব্ধ করেছে। ওসেতীয় ও চেচেনদের তুলনায় ইঙ্গুশদের প্রতি মস্কোর এই ‘আপাত’ বৈষম্য এবং প্রজাতন্ত্রটির চলমান নেতিবাচক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ইঙ্গুশ জনসাধারণকে ভবিষ্যতে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন অথবা বিচ্ছিন্নতাবাদ/স্বাধীনতার প্রতি আকৃষ্ট করে তুলতে পারে।