“উইন্টার ইজ কামিং… শীত আসছে…”
বিশ্বখ্যাত টিভি সিরিজ ‘গেম অভ থ্রোন্স’ এর এই সংলাপটির কথা কে না জানেন! এতদিন এই সংলাপের মাধ্যমে এক গভীর বিপদসঙ্কুল সময় আগমনের আশঙ্কাকে ব্যক্ত করা হতো। কিন্তু কে জানত, চলমান করোনাভাইরাস মহামারিতে অতি পরিচিত এই সংলাপটিই এক নতুন ব্যাঞ্জনা লাভ করবে? অথচ বাস্তবে হতে চলেছে সেটিই। সামনেই আসছে শীতকাল, এবং সেই শীতকাল মহামারির প্রকোপ আরো বাড়িয়ে দেবে বলেই বিশেষজ্ঞদের পূর্বাভাস।
আর্দ্রতা, সূর্যের তাপ, ভিটামিন ডি এর অভাব এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া প্রভৃতি কারণে প্রতি বছরই শীতকালে বিভিন্ন ভাইরাস ও ফ্লু জাতীয় শ্বাসকষ্টের রোগের লক্ষণ দেখা দেয়। এবার যেহেতু পৃথিবীর বুকে রয়েছে করোনাভাইরাস নামক এক শত্রুর অস্তিত্ব, তাই এবারের শীতে বিশ্বব্যাপী মানুষ হয়ে উঠতে পারে আরো বেশি সংবেদনশীল। তারা হতে পারে তুলনামূলক আরো বেশি রোগাক্রান্ত।
ঠিক একই রকম সাবধানবাণী শুনিয়েছেন সুইস জীবাণু বিজ্ঞানী ও সংক্রামক ব্যাধি বিশেষজ্ঞ ক্লাউস স্টোহর। ২০০৩ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় কর্মরত এই মানুষটির নেতৃত্বেই করোনাভাইরাস গোত্রের আরেকটি জীবাণু সার্স ভাইরাস অল্প সময়ের মধ্যেই শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছিল। ২০০৭ সালে তিনি সুইস ফার্মাসিটিক্যাল কোম্পানি নোভারটিস এজি-র ইনফ্লুয়েঞ্জা ভ্যাকসিন গবেষণার প্রধান পরিচালকের পদ গ্রহণ করেন। এরপর বছরখানেক আগে অবসর নিয়েছেন তিনি।
সম্প্রতি ব্লুমবার্গকে দেয়া এক টেলিফোন সাক্ষাৎকারে তিনি কথা বলেছেন চলমান করোনাভাইরাস মহামারি এবং ভ্যাকসিন আবিষ্কার প্রসঙ্গে। তার কথার মাধ্যমে এই দুই বিষয়ে উঠে এসেছে অনেক নতুন তথ্য ও অন্তর্দৃষ্টি। রোর বাংলার পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো ব্লুমবার্গের সাথে তার আলাপচারিতার বাংলা অনুবাদ।
ব্লুমবার্গ: একটি সম্ভাব্য ভ্যাকসিন এসে যাওয়ার আগে এই মহামারি কোনদিকে এগোবে বলে আপনার মনে হয়?
স্টোহর: এই ভাইরাসের আচরণ অন্যান্য শ্বাসযন্ত্রীয় রোগের তুলনায় খুব একটা ব্যতিক্রম হবে না। শীতকালে তারা ফিরে আসবে।
আমার মনে হয় সংক্রমণের আরেকটি জোয়ার আসবে, এবং সেটি হবে খুবই গুরুতর। বিশ্বের ৯০ শতাংশ জনসংখ্যা এতে আক্রান্ত হতে পারে। আমরা যদি পুনরায় একটি জোরালো লকডাউন কিংবা সমপরিমাণ সতর্কতায় ফিরে না যাই, তাহলে ভাইরাসটির সংক্রমণ হয়ে উঠবে আরো মারাত্মক। ভ্যাকসিন আসার আগেই শীত আসছে। ওই সময়ে সংক্রমণের পরিমাণ আরো বেড়ে যাবে, এবং এটির বিস্তার রোধ করায় বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেবে। কারণ মানুষজন এখন আর চায় না তাদের চলাফেরার স্বাধীনতায় নতুন করে বাধা আসুক।
ব্লুমবার্গ: কবে নাগাদ ভ্যাকসিন আসবে বলে আপনি অনুমান করছেন?
স্টোহর: জার্মানির মতো দেশগুলোতে আগামী বছরের শুরুর দিক থেকেই হয়তো উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ভ্যাকসিন পাওয়া যাবে। আর বয়স্কদের জন্য ভ্যাকসিন আসতে চার, পাঁচ বা ছয় মাস সময় লাগতে পারে। কিন্তু ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা কিংবা চিলির মতো দেশগুলোতে বোধহয় ভিন্ন কৌশল দেখা যাবে। এসব দেশগুলো হয়তো কখনোই এক ডোজ ভ্যাকসিনও পাবে না, তবু তাদেরকে এই বিপদ কাটিয়ে উঠতে হবে।
সব মিলিয়ে গোটা বিশ্ব দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যাবে। এক দলে থাকবে যারা ভ্যাকসিন পেয়েছে, আরেক দলে থাকবে যারা ভ্যাকসিন পায়নি।
ব্লুমবার্গ: যে সময়টায় একাধারে ভ্যাকসিন আসা শুরু হবে আবার রোগের বিস্তারও আরো ছড়িয়ে পড়তে থাকবে, তখন বিশ্বব্যাপী রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কতটা বাড়বে বলে আপনি মনে করেন?
স্টোহর: আমার মনে হয় আগামী বছরের মাঝামাঝি সময় নাগাদই মোট বৈশ্বিক জনসংখ্যার একটি তাৎপর্যপূর্ণ অংশের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে যাবে। সময়ের সাথে সাথে এই পরিমাণ আরো বাড়তে থাকবে। আর তারপরই আসবে সংক্রমণের তৃতীয় জোয়ার (থার্ড ওয়েভ)। এবং যতদিনে সেটির সমাপ্তি ঘটবে, আমার সন্দেহ মোতাবেক লকডাউন প্রতিষ্ঠিত না হলে বিশ্বের ৮০ শতাংশ মানুষের শরীরেই অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে যেতে পারে।
ব্লুমবার্গ: চলমান ভ্যাকসিন গবেষণাকে এগুলো কী বার্তা দেয়?
স্টোহর: আমরা এখন এক গভীর সঙ্কটের মধ্যে রয়েছি। আমাদেরকে এখন সমস্ত শক্তি আর সর্বাত্মক প্রচেষ্টার সমন্বয়ে ভ্যাকসিন তৈরির কাজ চালিয়ে যেতে হবে। অপরদিকে আমার বিশ্বাস আমরা আমাদের সাধারণ জ্ঞান থেকেই বুঝতে পারছি যে বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই ভ্যাকসিন পাবে না।
হতে পারে এই বছরের শেষ দিকে অথবা পরের বছরের শুরুর দিকেই অর্ধ বিলিয়ন ডোজ প্রস্তুত হয়ে যাবে। বিশ্বের জনসংখ্যা এখন ৭.৫ বিলিয়ন। বিশেষত যেসব দেশের অবকাঠামো অপর্যাপ্ত এবং যারা ইতোমধ্যেই বিশাল জনসংখ্যা ও ভঙ্গুর স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার সাথে লড়াই করছে, তারা কীভাবে ভ্যাকসিন পাবে?
ব্লুমবার্গ: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ কয়েকটি গোষ্ঠী ভ্যাকসিনের ন্যায্য ও সুষম বণ্টন নিশ্চিতের উপর গুরুত্বারোপ করছে। এর মাধ্যমে কি চিন্তা কিছুটা কমিয়ে আনা যাবে না?
স্টোহর: কোনো চেষ্টা না করে বসে থাকা তো দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় হবে। কিন্তু যা-ই করা হোক না কেন, বৈশ্বিক জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগই ভ্যাকসিন পাবে না। ভাইরাসটি বিস্তার লাভ অব্যাহত রাখবে, এবং দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে এটি একটি বিশাল জনগোষ্ঠীকে সংক্রমিত করে ফেলবে।
আসলে ভ্যাকসিনের মাধ্যমে এই মহামারির ইতি ঘটবে না। এই ভাইরাস হলো সেই দাবানলের মতো যা সবগুলো শুকনো কাঠকে খুঁজে খুঁজে পুড়িয়ে খাক করে দেয়। এরপরই এই মহামারির সমাপ্তি ঘটবে। বিশ্বের সর্বশেষ সংক্রমণযোগ্য মানুষটিকেও আক্রান্ত না করে এই দাবানল থামবে না। এখন প্রশ্ন হলো, এরপর ভ্যাকসিন কোন ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে।
ব্লুমবার্গ: আপনাকে বেশ আশাবাদী মনে হচ্ছে যে গবেষকরা ভ্যাকসিন আবিষ্কার করতে সক্ষম হবেন। কিন্তু এক্ষেত্রে সম্ভাবনা ও আশঙ্কাগুলোকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করছেন?
স্টোহর: করোনাভাইরাস এমন কোনো ভাইরাস নয় যেটিকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। এমনকি প্রচলিত ভ্যাকসিনগুলোও একটি ব্যবধান গড়ে দিতে পারে। তাছাড়া আমাদের বিভিন্ন ধরনের পদ্ধতি রয়েছে, যেমন ভেক্টর ভ্যাকসিন, এমআরএনএ ইত্যাদি। এগুলো খুবই সম্ভাবনাময়।
ইতোপূর্বে যখনই একটি নতুন ভ্যাকসিন এসেছে, ক্রমশ সেটির ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে, এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা জন্মানো মানুষের সংখ্যাও বেড়েছে। যদি সেরকম কিছু আবারো পাওয়া যায়, সেটি যত বিরলই হোক না কেন, একদম শুরুর দিকেই সেটি চিহ্নিত হয়ে যাবে। তবে এক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় হলো, একইসাথে প্রচুর সংখ্যক ভ্যাকসিন ব্যবহৃত হবে খুব কম সময়ের মধ্যে। কয়েক বিলিয়ন ভ্যাকসিন হয়তো প্রয়োগ করা হবে ছয় মাস থেকে এক বছরেই। তাই এখন আমাদের সামনে বড় প্রশ্ন হলো, ভ্যাকসিনের ভেতর এমন কোনো কিছুর অস্তিত্ব থাকবে কি না, যেটি অনুমোদনপূর্বক বড় পরিসরে নিরাপত্তা পরীক্ষণের সময়ে নির্ণয় করা সম্ভব হবে না।
অনেক, অনেক মানুষ আক্রান্ত হতে পারে। আপনি যদি ৫০০ মিলিয়ন মানুষের মধ্যেও প্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টি করেন, বিপরীতে মাত্র এক মিলিয়ন মানুষও আক্রান্ত হয়, তারপরও কিন্তু আপনার সামনে এক বিশাল জনগোষ্ঠী থাকবে নিরাপত্তার ঝুঁকিতে। তাই এটি একটি বিষয় যেটির ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হবে। তবে বিদ্যমান রোগের প্রভাবের বিপরীতে ভ্যাকসিন ব্যবহারের সম্ভাব্য প্রভাব কতটা হতে পারে, সেটি বিবেচনার ক্ষেত্রেও একটি ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে।
ব্লুমবার্গ: আপনি বলেছেন কয়েকটি দেশের কৌশলগত পরিবর্তনের কথা। এক্ষেত্রে সরকারগুলো সম্ভাব্য শ্রেষ্ঠ কোন পথ বেছে নিতে পারে?
স্টোহর: আমাদেরকে এমন একটি রাস্তা খুঁজে বের করতে হবে, যেটি আমাদের জনগণকে দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসাসেবার লক্ষ্য অর্জনে সাহায্য করবে। এছাড়াও যেহেতু সংক্রমণকে পুরোপুরি এড়ানোর কোনো উপায় নেই, তাই দেখতে হবে যে কীভাবে সবচেয়ে কম মানুষের মৃত্যুর মাধ্যমেই এই সঙ্কট থেকে উত্তরণ ঘটানো যায়। এছাড়া আর কোনো উপায় এই মুহূর্তে আমাদের সামনে নেই। আপনার যখন কোনো শারীরিক সমস্যা হয়, যেমন আপনি স্কিইং করতে গিয়ে পা ভেঙে ফেলেন, আপনার হাঁটুর লিগামেন্ট ছিঁড়ে যায়, তাতে চিন্তার কিছু থাকে না। কারণ আপনি চিকিৎসকের কাছে গেলেই তিনি সব ঠিক করে দেবেন। কিন্তু এক্ষেত্রে সবকিছু ঠিক করে দেয়ার কোনো নিশ্চিত পদ্ধতি আমাদের জানা নেই।
আমাদেরকে এই ভাইরাসের সাথেই বাঁচতে হবে, এবং যখন আমরা একটি পথ খুঁজে পাব এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার, তখন যেন আমরা পেছনে ফেলে সবকিছু দেখে বলতে পারি যে, “হ্যাঁ, আমরা মৃত্যুর পরিমাণ ও রোগের সংক্রমণ হ্রাসের জন্য আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টাটুকু করেছি।” কিন্তু আমরা উটপাখির মতো বালিতে মুখ গুঁজে রেখে আশা করতে পারি না যে কোনো একটি মিরাকেল হয়ে যাবে আর ভাইরাসটি উধাও হয়ে যাবে।
ব্লুমবার্গ: আপনি এর আগে সার্স থেকে শুরু করে বার্ড ফ্লুর মতো বিভিন্ন ভাইরাস সামলেছেন। সেখান থেকে কি আপনি এমন কোনো শিক্ষা অর্জন করেছেন যা আজকের দিনেও প্রাসঙ্গিক?
স্টোহর: ২০০৩ সাল থেকেই আমরা মহামারি পরিকল্পনার ব্যাপারে কথা বলে আসছি। কিছু দেশ সেসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ হাতে নিয়েছে এবং সেগুলো করেও দেখিয়েছে। আমার বিশ্বাস যাদের একটি ভালো মহামারি পরিকল্পনা ছিল, তারা অন্যান্য দেশের থেকে কয়েক ধাপ এগিয়েছে রয়েছে। কিন্তু তারপরও এখনো অনেক দেশই আছে, যাদের কোনো ধরনের পরিকল্পনাই নেই। আমার শিক্ষাটা ছিল এই যে আপনাকে একটি মহামারি পরিকল্পনা প্রস্তুত রাখতে হবে।
একটি বিষয় হয়তো পরিষ্কার হয়ে গেছে যে যেসব দেশের মাটিতে ভ্যাকসিন উৎপাদন হবে, তারাই মহামারির সময় ভ্যাকসিনের নাগাল পাবে। আমি আশা করি এরকম কিছু যেন না ঘটে, কিন্তু আমার আশঙ্কা এরকম কিছুই ঘটতে চলেছে। আশা করি ভবিষ্যত বছরগুলোতে মহামারির জন্য প্রস্তুত থাকার জন্য আরো অনেক বেশি বিনিয়োগ করা হবে, যাতে করে পরবর্তী মহামারিটিকে এবারের চেয়ে অনেক ভালোভাবে সামলানো সম্ভব হয়।