ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে চেঙ্গিস খানের নেতৃত্বে মোঙ্গল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয় এবং চীন, উত্তর এশিয়া, মধ্য এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও রাশিয়ার বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে মোঙ্গল শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। ১২২৩ সালে চেঙ্গিস খানের সৈন্যরা কালকা নদীর যুদ্ধে রুশ রাষ্ট্রগুলোর সম্মিলিত সৈন্যবাহিনীকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে এবং ১২৩৬–১২৪০ সালে চেঙ্গিসের নাতি বাতু খান সমগ্র রাশিয়া দখল করে নিয়ে রুশ রাষ্ট্রগুলোকে মোঙ্গলদের করদ রাজ্যে পরিণত করেন। পরবর্তী প্রায় ২৪০ বছর রুশ ভূমি মোঙ্গল–কর্তৃত্বাধীন গোল্ডেন হোর্ড সাম্রাজ্যের শাসনাধীনে ছিল। ১৪৮০ সালে উগ্রা নদীর যুদ্ধের পর রাশিয়া মোঙ্গলদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।
রুশদের কাছে মোঙ্গলরা ‘তাতার’ নামে পরিচিত ছিল এবং রুশ ইতিহাসে মোঙ্গল শাসনামল ‘মোঙ্গল–তাতার জোয়াল’ নামে পরিচিত। এই সুদীর্ঘ শাসনামল ছিল রাশিয়ার জন্য, বা আরো স্পষ্টভাবে বলতে গেলে, রুশ জনসাধারণের জন্য এক অবর্ণনীয় দুর্ভোগের অধ্যায়। ১২৩৬–১২৪০ সালে রাশিয়া দখলের সময় এবং এর পরবর্তীকালে মোঙ্গলরা রুশ জনসাধারণের ওপর অবর্ণনীয় অত্যাচার চালিয়েছিল। গণহত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ– এগুলো ছিল মোঙ্গলদের যুদ্ধবিগ্রহের অবিচ্ছেদ্য অংশ। মোঙ্গলদের বর্বরতা সম্পর্কে রুশ কৃষকদের মধ্যে একটি প্রবাদ প্রচলিত ছিল, ‘তাতাররা যেখান দিয়ে যায়, সেই জায়গা মরুভূমি হয়ে যায়’!
মোঙ্গল–নিয়ন্ত্রিত গোল্ডেন হোর্ড সাম্রাজ্যের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জনের পরেও রুশরা মোঙ্গলদের অত্যাচার থেকে মুক্তি লাভ করেনি। মোঙ্গল সাম্রাজ্যের ভাঙনের পরও ক্রিমিয়া, অস্ত্রাখান, কাজান, বুখারা, খিভা, খোকান্দ ও কুন্দুজে চেঙ্গিস খানের বংশধররা শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল, এবং সেই হিসেবে এগুলোকেও মোঙ্গল (বা রুশদের দৃষ্টিকোণ থেকে, তাতার) রাষ্ট্র হিসেবেই আখ্যায়িত করা যায়। ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত এই মোঙ্গল/তাতার রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে রাশিয়া সংঘর্ষে লিপ্ত ছিল। প্রায়ই এই রাষ্ট্রগুলো রাশিয়ার সীমান্ত প্রদেশগুলোতে আক্রমণ চালাতো এবং মোঙ্গল যুদ্ধবিগ্রহের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নির্বিচার হত্যা-ধর্ষণ-লুণ্ঠন চালাতো। তদুপরি, লক্ষ লক্ষ রুশ নরনারীকে বন্দি করে নিয়ে তারা ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করত। মোঙ্গলদের সঙ্গে এই তিক্ত অভিজ্ঞতা রুশদের মধ্যে প্রবল ‘পীত আতঙ্ক’ (Yellow Peril) সৃষ্টি করে। উল্লেখ্য, যেসব জাতির মানুষ মঙ্গোলয়েড মহাজাতির অংশ, তাদেরকে ‘পীত বর্ণ’ (yellow race) হিসেবে অভিহিত করা হয়।
রুশদের এই ‘পীত আতঙ্ক’কে ভিত্তি করে বিশ্ববিখ্যাত ফরাসি সাহিত্যিক জুল ভার্ন রচনা করেছেন রোমাঞ্চকর উপন্যাস ‘মিশেল স্ত্রোগোফ’। ফরাসি ভাষায় রচিত এই উপন্যাসটিকে ইংরেজি ভাষায় ‘মাইকেল স্ত্রোগোফ: দ্য কুরিয়ার অফ দ্য জার’ শিরোনামে এবং রুশ ভাষায় ‘মিখাইল স্ত্রোগভ’ শিরোনামে প্রকাশ করা হয়েছে। ১৮৭৬ সালে প্রকাশিত এই উপন্যাসটিকে সাহিত্য সমালোচকরা জুল ভার্নের ‘অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী রচনার ক্ষেত্রে অগ্রদূত হিসেবে পরিচিত জুল ভার্নের এই উপন্যাসটি কিন্তু বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী নয়, যদিও ‘লেইডেনফ্রস্ট ইফেক্ট’ (Leidenfrost Effect) নামে পরিচিত একটি বৈজ্ঞানিক বিষয় এই উপন্যাসটিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে মধ্য এশিয়ার মোঙ্গল–শাসিত রাষ্ট্রগুলো (বুখারা, খিভা, খোকান্দ ও কুন্দুজ) বুখারার আমির ফেওফার খানের নেতৃত্বে একটি রুশবিরোধী জোট গঠন করে। এই রাষ্ট্রগুলোর উৎসাহে রুশ নিয়ন্ত্রণাধীন ‘বৃহৎ’, ‘মধ্যম’ ও ‘ক্ষুদ্র’ হোর্ডে বিভক্ত কাজাখরা রাশিয়ার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং মোঙ্গল–শাসিত রাষ্ট্রগুলোর সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগদান করে। এই সম্মিলিত মোঙ্গল–পরিচালিত বাহিনী সাইবেরিয়া আক্রমণ করে এবং এশীয় রাশিয়ার সুবৃহৎ অঞ্চল দখল করে নেয়ার জন্য অগ্রসর হয়। মোঙ্গল–পরিচালিত বাহিনী কাজাখ স্তেপভূমি অতিক্রম করে স্বল্পসংখ্যক রুশ সৈন্যকে পরাজিত করে সেমিপালাতিনস্ক দখল করে নেয় এবং বালখাশ হ্রদ পর্যন্ত অগ্রসর হয়।
কাজাখদের বিদ্রোহ ও মোঙ্গল–নেতৃত্বাধীন বাহিনীর সাইবেরিয়া আক্রমণের সংবাদ যখন মস্কোয় পৌঁছে, তখন রুশ সম্রাট মস্কো ক্রেমলিনে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে ছিলেন। তিনি গুপ্তচর মারফত জানতে পারেন যে, রুশ সেনাবাহিনীর প্রাক্তন কর্নেল ইভান ওগারভ মোঙ্গল–নেতৃত্বাধীন বাহিনীর সঙ্গে যোগ দিয়েছে এবং তার উৎসাহেই মধ্য এশীয় রাষ্ট্রগুলো এই আক্রমণ পরিচালনা করেছে। ওগারভ সেনাবাহিনীতে থাকা অবস্থায় সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার কারণে রুশ সম্রাটের ভাই গ্র্যান্ড ডিউকের নির্দেশে তাকে পদচ্যুত করা হয়েছিল। গ্র্যান্ড ডিউক এসময় পূর্ব সাইবেরিয়ার রাজধানী ইর্কুতস্কে অবস্থান করছিলেন এবং মধ্য এশীয় সৈন্যরা টেলিগ্রাফ লাইন কেটে দেয়ার ফলে ইর্কুতস্কের সঙ্গে মস্কোর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। এমতাবস্থায় ওগারভ ছদ্মবেশে ইর্কুতস্কে গিয়ে গ্র্যান্ড ডিউকের বিশ্বাস অর্জন করে শহরটিকে মধ্য এশীয় সৈন্যদের হাতে তুলে দেয়ার এবং গ্র্যান্ড ডিউককে হত্যা করার পরিকল্পনা করছিল।
এই পরিকল্পনার কথা জানতে পেরে সম্রাট একজন বিশেষ দূতকে একটি সতর্কবার্তাসহ ইর্কুতস্কে প্রেরণের সিদ্ধান্ত নেন। এই দূত ছিল ওমস্ক থেকে আসা ৩০ বছর বয়সী একজন সাইবেরীয়, ক্যাপ্টেন মিখাইল স্ত্রোগভ। যেহেতু ইউরোপীয় রাশিয়ার সঙ্গে এশীয় রাশিয়া বা সাইবেরিয়ার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল এবং সাইবেরিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল মোঙ্গল–নেতৃত্বাধীন সৈন্যদের দখলে চলে গিয়েছিল, এজন্য ইর্কুতস্ক পর্যন্ত রুশ সম্রাটের বার্তা পৌঁছানো ছিল অত্যন্ত কঠিন কাজ। স্ত্রোগভকে এই গুরুদায়িত্ব প্রদান করা হয়। সম্রাটের সেই অনুষ্ঠানে দুইজন বিদেশি সাংবাদিকও উপস্থিত ছিল। হাসিখুশি, প্রখর দৃষ্টিশক্তির অধিকারী ফরাসি সাংবাদিক আলসিদ জোলিভে এবং গম্ভীর, তীক্ষ্ণ শ্রবণশক্তির অধিকারী ব্রিটিশ সাংবাদিক হ্যারি ব্লাউন্ট স্ত্রোগভের অভিযান সম্পর্কে কিছুই জানত না, কিন্তু মধ্য এশীয় সৈন্যদের আক্রমণ সম্পর্কে তাদের নিজ নিজ সংবাদপত্রের জন্য তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তারা যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে রওনা হয়।
স্ত্রোগভ ‘নিকোলাই কর্পানভ’ ছদ্মনাম ধারণ করে ট্রেনযোগে মস্কো থেকে নিঝনি নভগরোদ শহরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। ট্রেনে সে ১৭ বছর বয়সী এক দৃঢ়চেতা মেয়েকে দেখতে পায়, যার প্রতি সে আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। কিন্তু নিঝনি নভগরোদে ট্রেন থেকে নামার পর ভিড়ের মধ্যে সে মেয়েটিকে হারিয়ে ফেলে। রাতে ভোলগা নদীর তীরে ঘোরাঘুরি করার সময় সে সন্দেহভাজন দুই জিপসির সাক্ষাৎ লাভ করে। পরবর্তী দিন সে সময় কাটানোর জন্য নিঝনি নভগরোদের বিখ্যাত বাণিজ্য মেলায় ঢুকে পড়ে। জমজমাট এই মেলাটিতে রুশ, আর্মেনীয়, ইহুদি ও কালমিক বণিকদের পাশাপাশি ইরানি, মধ্য এশীয়, চীনা ও ভারতীয় বণিকদের উপস্থিতি ছিল। কিন্তু যুদ্ধের কারণে ঐদিনই নিঝনি নভগরোদের গভর্নর জেনারেলের নির্দেশে বিদেশিদের শহর ত্যাগ করার নির্দেশ দেয়া হয়, আর রুশদের শহর ত্যাগ না করার জন্য বলা হয়৷
দুপুরে নিঝনি নভগরোদের পুলিশ বিভাগে গিয়ে স্ত্রোগভ তার বিশেষ অনুমতিপত্র দেখিয়ে শহর ছাড়ার অনুমতি লাভ করে। এসময় সে ট্রেনে দেখা সেই মেয়েটির সাক্ষাৎ লাভ করে এবং মেয়েটিকে সহায়তা করার জন্য তাকে নিজের বোন হিসেবে পরিচয় দেয়। এরপর একটি স্টিমারে করে স্ত্রোগভ মেয়েটির সঙ্গে পার্মের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। মেয়েটির নিজেকে নাদিয়া ফিয়োদোরোভা নামে পরিচয় দেয় এবং জানায় যে, সে বাল্টিক সাগরের তীরবর্তী রিগা থেকে ইর্কুতস্কে যাচ্ছে সেখানে থাকা তার নির্বাসিত পিতার সঙ্গে যোগ দিতে। দুজনের গন্তব্যস্থল একই হওয়ায় তারা একসঙ্গে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
স্টিমারযোগে পার্ম শহরে পৌঁছানোর পর স্ত্রোগভ ও নাদিয়া একটি ঘোড়ায় টানা যানে চড়ে উরাল পর্বতমালা অতিক্রম করে। এ সময় তারা প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টির মধ্যে পড়ে এবং একটি গুহায় আশ্রয় নেয়। ফরাসি ও ব্রিটিশ সাংবাদিকদ্বয়ও এ সময় উরাল পর্বতমালা অতিক্রম করছিল এবং দুর্ঘটনার কবলে পড়েছিল। স্ত্রোগভ তাদেরকে সহায়তা করে এবং তারা বহু কষ্টে উরাল পর্বতমালা অতিক্রম করে ইশিম শহরে পৌঁছে। সেখানে স্ত্রোগভ ও নাদিয়ার সঙ্গে সাংবাদিক দু’জনের বিচ্ছেদ ঘটে। সেখান থেকে তারা আরো পূর্বদিকে অগ্রসর হয় এবং নৌকাযোগে ইরতিশ নদী অতিক্রম করে ওমস্ক শহরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, যেখানে স্ত্রোগভের বৃদ্ধা মা মার্ফা স্ত্রোগোভা বসবাস করতেন। কিন্তু নদী অতিক্রমের সময় মধ্য এশীয় সৈন্যরা তাদেরকে আক্রমণ করে এবং তাদের নিক্ষিপ্ত বল্লমের আঘাতে স্ত্রোগভ আহত হয়ে নদীতে পড়ে ডুবে যায়। মধ্য এশীয় সৈন্যরা নৌকাটির মাঝিদেরকে হত্যা করে এবং নাদিয়াকে বন্দি করে নিয়ে যায়।
আহত ও সংজ্ঞাহীন স্ত্রোগভ নদীর স্রোতে ভেসে ওমস্ক শহরের তীরে পৌঁছায়। সেখানে একজন কৃষক তাকে উদ্ধার করে এবং তাকে সুস্থ করে তোলে। ইতোমধ্যে মধ্য এশীয় সৈন্যরা পশ্চিম সাইবেরিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল দখল করে ফেলেছে এবং ওমস্ক শহরও তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। স্ত্রোগভ ওমস্ক শহরে প্রবেশ করে এবং ঘটনাচক্রে তার মা মার্ফার সঙ্গে তার দেখা হয়ে যায়। মার্ফা তার নাম ধরে ডেকে উঠেন, কিন্তু আশেপাশে মোঙ্গল–নেতৃত্বাধীন বাহিনীর গুপ্তচর থাকলে তার পরিচয় ফাঁস হয়ে যেতে পারে এই আশঙ্কায় স্ত্রোগভ তার মাকে না চেনার অভিনয় করে। স্ত্রোগভ দ্রুত শহর থেকে বের হয়ে ইর্কুতস্কের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। এদিকে মধ্য এশীয় গুপ্তচররা মার্ফার সঙ্গে তার ছেলের অপ্রীতিকর এই সাক্ষাৎকার দেখে এবং ইভান ওগারভকে জানায়। ওগারভ খোঁজ নিয়ে জানতে পারে যে, মার্ফার ছেলে রুশ সম্রাটের বার্তাবাহক হিসেবে কাজ করে। সে মার্ফাকে বন্দি করার নির্দেশ দেয় এবং তার কাছ থেকে তার ছেলের সম্পর্কে জানার চেষ্টা করে। মার্ফা তার ছেলের অস্বাভাবিক আচরণের কারণ বুঝতে পারে এবং ওগারভকে বলে যে, সে ভুল করে অন্য একজনকে নিজের ছেলে মনে করেছিল। ওগারভ তার কথা বিশ্বাস করেনি।
এদিকে স্ত্রোগভে ঘোড়ায় চড়ে ওমস্ক থেকে ইর্কুতস্কের দিকে যাত্রা করে। পথিমধ্যে সে মধ্য এশীয় সৈন্যদের চালানো ধ্বংসযজ্ঞের নিদর্শন দেখতে পায়। দুর্গম বারাবা জলাভূমি অঞ্চল পাড়ি দিয়ে, মধ্য এশীয় সৈন্যদের সঙ্গে লড়াই করে, ওব নদী পার হওয়ার সময় সঙ্গী ঘোড়াটিকে হারিয়ে সে কোলিভান শহরের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছায়। সেখানে মধ্য এশীয় আক্রমণকারীদের সঙ্গে রুশ সৈন্যদের তীব্র যুদ্ধ চলছি। স্ত্রোগভ কোলিভানের টেলিগ্রাফ অফিসে প্রবেশ করে সেই দুই ইউরোপীয় সাংবাদিকের সাক্ষাৎ পায়। কিন্তু ইতোমধ্যে মোঙ্গল–নেতৃত্বাধীন সৈন্যরা শহরটি দখল করে নিতে সক্ষম হয় এবং স্ত্রোগভ ও ইউরোপীয় সাংবাদিকদ্বয় তাদের হাতে বন্দি হয়। তখনো স্ত্রোগভ ইর্কুতস্ক থেকে ১,৮০০ কি.মি. দূরে!
স্ত্রোগভ কি শেষ পর্যন্ত তার দায়িত্ব পালনে সফল হয়েছিল? ইর্কুতস্ক ও গ্র্যান্ড ডিউককে রক্ষা করতে সে কি সক্ষম হয়েছিল? স্ত্রোগভের মা মার্ফা কি তার ছেলের পরিচিতি প্রকাশ করতে বাধ্য হয়েছিল? নাদিয়ারই বা কী পরিণতি হলো? সর্বোপরি, মোঙ্গল–নিয়ন্ত্রিত সৈন্যরা কি সাইবেরিয়া দখল করতে পেরেছিল? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানতে হলে পাঠককে পড়তে হবে জুল ভার্নের লিখিত অত্যন্ত চমৎকার এই উপন্যাসটি।
‘মিশেল স্ত্রোগোফ’ উপন্যাসটিকে সাহিত্য সমালোচকরা বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রোমাঞ্চকর উপন্যাস হিসেবে বিবেচনা করেন। উপন্যাসে বর্ণিত স্ত্রোগভের প্রখর দায়িত্ববোধ, নাদিয়ার একনিষ্ঠতা, মার্ফার মাতৃস্নেহ, ওগারেভের বিশ্বাসঘাতকতা কিংবা ইউরোপীয় সাংবাদিকদ্বয়ের পেশাদারিত্ব – পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধ করে। মস্কো ক্রেমলিনের রমরমা অনুষ্ঠান, নিঝনি নভগরোদের জমজমাট মেলা, সুবিশাল সাইবেরিয়ার বিচিত্র প্রকৃতি, মধ্য এশীয় খানদের দরবারের জাঁকজমকপূর্ণ উৎসব – জুল ভার্নের বর্ণনায় এই ঘটনাগুলো যেন পাঠকের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সর্বোপরি, অজস্র বাধার মুখোমুখি স্ত্রোগভের এই অভিযান পাঠককে শেষ পর্যন্ত রোমাঞ্চিত করে রাখে।
উপন্যাসটি যখন ১৮৭৬ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়, তখন এতে এশীয় রাশিয়া সম্পর্কে জুল ভার্নের সুস্পষ্ট ও নিখুঁত বর্ণনা সকলকেই হতবাক করেছিল। উপন্যাসটিতে প্রদত্ত কিছু তথ্য সম্পর্কে অবশ্য একবিংশ শতাব্দীর পাঠকের স্পষ্ট ধারণা থাকা উচিত।
প্রথমত, উপন্যাসটিতে রুশ নামগুলোকে ল্যাটিন সংস্করণে বা ল্যাটিন রূপে লেখা হয়েছে। এজন্য স্ত্রোগভ হয়ে গেছে ‘স্ত্রোগোফ’, ‘ফিয়োদোরোভা’ হয়ে গেছে ‘ফেদর’ আর ‘ওগারেভ’ হয়ে গেছে ওগারেফ।
দ্বিতীয়ত, রুশরা মোঙ্গলদেরকে ‘তাতার’ নামে অভিহিত করত এবং উপন্যাসটিতে তাই জুল ভার্ন মোঙ্গল–নেতৃত্বাধীন মধ্য এশীয়দেরকে ‘তাতার’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন এবং সর্বত্র এই শব্দটি দিয়েই মধ্য এশীয়দেরকে বুঝিয়েছেন। কিন্তু এক্ষেত্রে এটি বোঝা প্রয়োজন যে, বুখারা, খিভা, খোকান্দ ও কুন্দুজ খানাতগুলোর শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাজবংশগুলো উৎপত্তিগতভাবে মোঙ্গল, কিন্তু তাদের প্রজারা ছিল জাতিগতভাবে উজবেক, তাজিক, তুর্কমেন, পারসিক ও কাজাখ। এজন্য উপন্যাসে বর্ণিত ‘তাতার সৈন্যবাহিনী’ মূলত মোঙ্গল–বংশোদ্ভূত খানদের দ্বারা পরিচালিত উজবেক, তাজিক, তুর্কমেন, কাজাখ ও পারসিকদের দ্বারা গঠিত সৈন্যদল ছিল৷ প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ভোলগা নদীর অববাহিকায় (বর্তমান তাতারস্তানে) বহুসংখ্যক জাতিগত তাতার বসবাস করে, কিন্তু এই উপন্যাসে ‘তাতার’ বলতে তাদেরকে বোঝানো হয়নি।
তৃতীয়ত, সোভিয়েত শাসনামলের আগ পর্যন্ত রুশরা জাতিগত কাজাখদেরকে ‘কিরঘিজ’ নামে অভিহিত করত এবং জুল ভার্ন উপন্যাসে এদেরকে এই নামেই বর্ণনা করেছেন। বস্তুত উপন্যাসে বর্ণিত ‘কিরঘিজ’রা জাতিগত কাজাখ এবং বর্তমান কাজাখস্তানের অধিবাসী। বর্তমান কিরগিজস্তানে বসবাসকারী জাতিগত ‘কিরগিজ’রা আর উপন্যাসে বর্ণিত ‘কিরঘিজ’রা এক নয়।
সর্বোপরি, উপন্যাসটি একটি কাল্পনিক ঘটনা নিয়ে রচিত। ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে মধ্য এশীয় রাষ্ট্রগুলো সাইবেরিয়ায় এরকম কোনো আক্রমণ পরিচালনা করেনি এবং সেসময় তাদের এরকম আক্রমণ পরিচালনা করার কোনো সামর্থ্যও ছিল না। তদুপরি, এসময় কাজাখরাও রুশ শাসনের বিরুদ্ধে কোনো বিদ্রোহ করেনি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের মধ্যে রুশরা জাতিগত কাজাখ ও কিরগিজদের দ্বারা অধ্যুষিত অঞ্চলগুলো দখল করে নিয়েছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে রাশিয়া খোকান্দ খানাত ও জাতিগত তুর্কমেনদের অধ্যুষিত অঞ্চলগুলো দখল করে নেয় এবং বুখারা আমিরাত ও খিভা খানাতের বিস্তীর্ণ অঞ্চল দখল করে রাষ্ট্র দুইটিকে রুশ আশ্রিত রাষ্ট্রের পরিণত করে। একই সময়ে আফগানিস্তান কুন্দুজ খানাত দখল করে নেয়।
ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে রাশিয়া ও ব্রিটেনের মধ্যে মধ্য এশিয়ায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে তীব্র দ্বন্দ্ব চলছিল, যেটি ‘গ্রেট গেম’ বা ‘টুর্নামেন্ট অফ শ্যাডোজ’ নামে পরিচিত। স্বভাবতই এমন এক সময়ে জুল ভার্নের উপন্যাসে মধ্য এশীয় রাষ্ট্রগুলো কর্তৃক এশীয় রাশিয়া আক্রমণের বিবরণ ছিল অনেকটা ‘রাজনৈতিক ডিনামাইট’–এর মতো। সতর্কতাস্বরূপ জুল ভার্ন বইটিতে প্রদত্ত তথ্যগুলোর সঠিকতা যাচাইয়ের জন্য প্রখ্যাত রুশ সাহিত্যিক ইভান তুর্গেনেভের কাছে পাঠিয়েছিলেন। তুর্গেনেভের পরামর্শে বইটিতে প্রয়োজনীয় সংশোধন করার পরই কেবল জুল ভার্ন বইটি প্রকাশ করেন। ১৮৭৬ সালে ফরাসি ভাষায় বইটি প্রকাশিত হয় এবং একই বছর ইংরেজি ও কয়েক বছর পর রুশ ভাষায় অনূদিত হয়। উপন্যাসটির ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন রাষ্ট্রে বহু নাটক, টিভি সিরিজ ও চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে।
বইয়ের নাম: মিশেল স্ত্রোগোফ || লেখক: জুল ভার্ন
মূল ভাষা: ফরাসি || প্রকাশক: পিয়েরে-জুল হেৎজেল || প্রকাশকাল: ১৮৭৬