বিখ্যাত টিভি সিরিজ গেইম অফ থ্রোন্সের এক উল্লেখযোগ্য অংশের শ্যুটিং করা হয়েছে ক্রোয়েশিয়ার ডুব্রোভনিক শহরে। ২০১৬ সালে এই সিরিজের জনপ্রিয়তা যখন তুঙ্গে, সেই শহরে গিয়ে জমা হন প্রায় ১ কোটি ৬০ লক্ষ পর্যটক, যা ক্রোয়েশিয়ার জনসংখ্যারই প্রায় ৪ গুণ! যেকোনো সিনেমা কিংবা সিরিজ দেখার সময়ে লোকেশন দেখে বা সেই লোকেশনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে মাঝে মাঝে দর্শকদের মনেও সেসব জায়গায় যাবার ইচ্ছা জাগে। একটি সিনেমা কিংবা সিরিজের লোকেশন কতটা প্রভাব ফেলে তা তো মোটামুটি জানা গেল, এবার আসুন চিন্তা করা যাক- যদি শুধুমাত্র একটি লোকেশনে সিনেমার দৃশ্যায়ন হয় তাহলে ব্যাপারটা কেমন হবে? তবে কি প্রাকৃতিক শোভার অভাবে সিনেমায় ভাটা পড়বে?
চলুন পাঠক, আজ এমন কয়েকটি সিনেমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া যাক যেগুলোর শ্যুটিং শুধুমাত্র এক লোকেশনেই হয়েছে।
টুয়েল্ভ অ্যাংরি মেন (১৯৫৭)
এই সিনেমা নিয়ে কথা বলার আগে আমেরিকান একটি আইন নিয়ে কিছুটা ধারণা দেয়া যাক। বিভিন্ন সময়ে আমেরিকান আদালতে জুরি বোর্ড বসানো হয়। এই জুরি বোর্ডে বিভিন্ন পেশার মানুষ থাকেন, যাদের কাজ আসামী পক্ষ ও সরকার পক্ষ কিংবা বিপরীত পক্ষের প্রমাণ ও তর্ক-বিতর্ক পর্যবেক্ষণ করে নিজেদের মত প্রকাশ করা। তাদের মতামতের ওপর ভিত্তি করেই আসামীর শাস্তি কিংবা খালাস করার সিদ্ধান্তে আসে আদালত।
টুয়েল্ভ অ্যাংরি মেন সিনেমার গল্পও এমন এক জুরি বোর্ডের বারো সদস্যকে নিয়েই। নিজের বাবাকে খুনের অভিযোগে এক ছেলেকে দাঁড় করানো হয় কাঠগড়ায়। জুরি বোর্ডের হাতে সিদ্ধান্ত দেন আদালত। বেশিরভাগ সাক্ষ্য-প্রমাণ অভিযুক্তের বিরুদ্ধে। একটি কামড়ায় গিয়ে জড়ো হলেন বোর্ডের ১২ সদস্য। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানানোর আগে এক গোলটেবিল বৈঠকে বসেন সবাই।
১২ জন সদস্যের মাঝে ১১ জনই ছেলের মৃত্যুদন্ডের পক্ষে। শুধুমাত্র একজন সদস্যের মনে সন্দেহ দানা বাঁধে। তিনি তার মতামত প্রকাশ করেন বাকি ১১ জনের সামনে। শুরু হয় তর্ক-বিতর্ক। ১১ জনের বিপক্ষে ১ জনের মত। একটি ছোট কামরা, টেবিল আর ১২ জন অভিনেতা। এভাবেই সিনেমা এগোতে থাকে।
টুয়েল্ভ অ্যাংরি মেন এর ঝুলিতে অস্কার না জুটলেও এই সিনেমাকে এখনও আইকোনিক সিনেমা হিসেবে ধরা হয়। সিনেমা মুক্তির ৬৪ বছর পর এসেও বলা যায় একজন সিনেমাখোরের জন্য এই সিনেমা অবশ্যই দেখার মতো।
১২৭ আওয়ার্স (২০১০)
কাউকে না জানিয়ে আমেরিকার উটাহ শহরে এক ইঞ্জিনিয়ার ভ্রমণে বের হন। উটাহর মরুভূমির মাঝে ঘুরতে গিয়ে এক গিরিখাঁদে আটকা পড়েন তিনি। সাহায্যের জন্য এখানে কেউই নেই। সাথে একটি হ্যান্ডিক্যাম, পানি আর একটি ছুরি।
সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত এই সিনেমার মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন জেমস ফ্র্যাঙ্কো। তার সবচেয়ে ভাল অভিনয় সম্ভবত এই সিনেমাতেই করেছেন। সিনেমার প্রায় আশি শতাংশ শুধুমাত্র এক গিরিখাঁদেই চিত্রায়িত। এই সিনেমায় মূল চরিত্রে অভিনয়ের জন্য ফ্র্যাঙ্কো সেরা অভিনেতা হিসেবে মনোনীতও হন অস্কারে।
রিয়ার উইন্ডো (১৯৫৪)
বিখ্যাত নির্মাতা আলফ্রেড হিচককের এই সিনেমাটি চিত্রায়িত হয়েছে শুধুমাত্র মূল চরিত্রের কক্ষেই!
ফটোগ্রাফার জেফ এক দুর্ঘটনায় পায়ে আঘাত পেয়ে ঘরবন্দি হয়ে আছেন। তার দেখভালের জন্য নার্স এবং তার বান্ধবী লিসা প্রায়ই যাতায়াত করেন তার বাড়িতে। এক কক্ষে বন্দি জেফের সময় কাটতে থাকে জানালার বাইরে তার প্রতিবেশীদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা দেখতে দেখতেই। কখনো কারো ঝগড়া, কখনো কুকুর নিয়ে আহ্লাদ- এসব দেখেই দিন শুরু এবং শেষ করে জেফ। এক মাঝরাতে হঠাৎ তার প্রতিবেশীদের মধ্যে এক খিটখিটে মহিলার চিৎকার শুনতে পায়। পরদিন জানতে পারেন সেই প্রতিবেশী খুন হয়েছেন। খুনী হিসেবে সবাই মহিলার স্বামীর দিকে আঙুল তুলতে থাকে। কিন্তু স্ত্রীভক্ত সেই স্বামী কি আসলেই খুনি? নাকি অন্য কেউ? এই প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে দেখতে হবে এই ক্ল্যাসিক মাস্টারপিস সিনেমাটি।
একবারও কক্ষের বাইরে ক্যামেরা না নিয়ে সম্পূর্ণ সিনেমার চিত্রায়ন শেষ করেছেন পরিচালক। রহস্যে ভরা এই গল্পের মূল স্বাদ পেতে কিচ্ছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়। প্রত্যেকটি চরিত্রের সাথে মিশে যাওয়ার পরই রহস্যের মসলার স্বাদে পরিবর্তন আসে।
ডগ ডে আফটারনুন (১৯৭৫)
এই সিনেমার জন্য সেরা চিত্রনাট্যকার হিসেবে অস্কার পেয়েছিলেন ফ্র্যাঙ্ক পিয়ার্সন। সেরা অভিনেতার মনোনয়ন পেয়েছিলেন আল পাচিনো। সিনেমার বেশিরভাগ অংশই একটি ব্যাংকের ভেতরে চিত্রায়িত। তিন যুবক একটি ছোটখাট ব্যাংকে যায় সেখানে ডাকাতির উদ্দ্যেশ্যে। কিন্তু ডাকাতির শুরুতেই একজন বলে ওঠে, তাকে দিয়ে এহেন কর্মকান্ড সম্ভব না। সাথে আনা অস্ত্র সাথীদের কাছে জমা রেখেই বেরিয়ে যায় সে। সঙ্গীর অভাবে হতবিহবল না হয়ে বাকি দুজন নিজেদের উদ্দেশ্য সফল করেই যাবার পণ করে। ব্যাংকের কর্মচারি বাদে সকলকে বের করে দিয়ে অবস্থান নেয় ভেতরেই। কর্মচারিদের মাধ্যমে একপর্যায়ে তারা বুঝতে পারে, ব্যাংকে তেমন ক্যাশ নেই। এদিকে চারপাশ থেকে পুলিশ ঘিরে ফেলেছে। এবার উদ্দেশ্য নিজেদের অক্ষত রেখে বেরিয়ে আসা। ডিটেক্টিভের সাথে চলতে থাকে ডাকাতদের সন্ধিচুক্তি।
এই স্বল্প সময়েই আবার পুলিশের হাতে এই ডাকাতদের নিয়ে একটার পর একটা তথ্য আসতে থাকে। অনেকটা জনপ্রিয় টিভি সিরিজ ‘মানি হাইস্ট’ এর অনুভূতি পাওয়া যাচ্ছে কি? ডগ ডে আফটারনুন মূলত জন স্ট্যানলি জোসেফ নামে এক কুখ্যাত আমেরিকান ব্যাংক ডাকাতের জীবনকাহিনি থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই নির্মিত। আল পাচিনো তার অভিনয় দিয়ে দর্শককে ধরে রাখেন পুরোটা সময় জুড়েই। ব্যাংক ডাকাতির কনসেপ্টে অনেক সিনেমা বা সিরিজ থাকলেও এই সিনেমা সেই তালিকার বেশ উপরের দিকেই অবস্থান করবে।
ওত্থা সেরুপ্পু সাইজ ৭ (২০১৯)
তেলেগু ভাষার, থ্রিলার জনরার এই সিনেমার আইএমডিবি রেটিং ৮.৫। সম্পূর্ন সিনেমা এক লোকেশনে এবং অভিনেতাও একজনই। আশপাশ থেকে সহ-অভিনেতাদের সাথে মূল চরিত্রের কথোপকথন আছে, কিন্তু দৃশ্যায়ন করা হচ্ছে একজনকেই। তিনি সিনেমার একমাত্র অভিনেতা আর. পার্থিবান। এই সিনেমার পরিচালক, লেখক ও অভিনেতাও তিনি নিজেই।
কয়েকটি খুনের অভিযোগে অভিযুক্ত মানসিক ভারসাম্যহীন এক সন্তানের বাবা, মাসিলামানিকে পুলিশ থানায় নিয়ে আসে। বাইরে নিজের ছোট্ট ছেলেকে বসিয়ে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষে প্রবেশ করে মাসিলামানি। এখানেই তার রাজ্যের গল্প আর খুনের বর্ণনা শুনতে থাকে পুলিশের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা। গল্পের সাথে সাথে খুনের অভিনয় করেও দেখাচ্ছে অভিযুক্ত। আবার পরমূহুর্তে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করে ফেলছে।
পার্থিবানের এই সিনেমাকে ওয়ান ম্যান শো বলা যায়। দুই ঘন্টার পুরোটা সময় স্ক্রিনে এই একজনকে দেখলেও তার অনবদ্য অভিনয় চুম্বকের মতো টেনে ধরে রাখে দর্শককে।