টিনসলি লুইসের বয়স যখন সবে দশ মাস, চিকিৎসকরা তার ব্যাপারে জবাব দিয়ে দেন। বলেন, যে ধরনের চিকিৎসা তাকে দেয়া হচ্ছে, সেটি তার জন্য অত্যন্ত কষ্টদায়ক হয়ে উঠছে। তাই তাদের উচিত অতিসত্ত্বর ওই প্রক্রিয়া বন্ধ করা। হৃদপিণ্ড ও ফুসফুসে সমস্যা নিয়ে জন্মানো বাচ্চাটিকে কোনোভাবেই সুস্থ করে তোলা সম্ভব না, এই কথাও জানান চিকিৎসকরা।
কিন্তু চিকিৎসকদের কথা শোনেনি টিনসলির পরিবার। তারা ব্যাপারটিকে আদালত অবধি নিয়ে গেছেন। এবং দুই বছর যাবত আদালতে বেশ কয়েকটি শুনানি ও রায়ের পরও, এখনো টিনসলি রয়েছে টেক্সাসের একটি লাইফ সাপোর্টে।
এ বছরের এপ্রিল মাসে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আবেদন করেছে, আগামী জানুয়ারিতে টিনসলির ব্যাপারে আদালতের যে চূড়ান্ত রায় দেয়ার কথা রয়েছে, সেটির দিনক্ষণ যেন এগিয়ে আনা হয়। এর কারণ হিসেবে তারা বলেছে, দিনের পর দিন ইনভেসিভ ট্রিটমেন্টের (যে ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতিতে চামড়া ছিদ্র করে দেহের অভ্যন্তরে বিভিন্ন যন্ত্র প্রবেশ করানো হয়) ফলে শিশুটির শরীর একদমই ভেঙে পড়েছে।
তবে শিশুটির মা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কথা মানতে নারাজ। তিনি দাবি করছেন, বিগত দুই বছরের চিকিৎসার ফলে শিশুটির মাঝে বিভিন্ন উন্নতির চিহ্ন দেখা দিতে শুরু করেছে। তাই অবশ্যই তার চিকিৎসা অব্যাহত রাখার যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে।
চিকিৎসক বা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে রোগীর পরিবারের যে লড়াই, সেটি আসলে লড়াইয়ের চেয়েও বেশি কিছু। টেক্সাস রাইট টু লাইফ নামের একটি প্রাণবাদী সংগঠন টিনসলির পরিবারকে আইনি লড়াই চালিয়ে যাওয়ার জন্য আর্থিকভাবে সহায়তা করছে, এবং তারা আশা করছে, এই লড়াইয়ের ফলে চিকিৎসকদের ‘নন-বেনিফিসিয়াল কেয়ার’-এর অধিকার রহিত হবে। বর্তমানে বিদ্যমান এই আইনি অধিকারবলে, চিকিৎসকরা খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন যে তারা যে রোগীর ব্যাপারে শেষ জবাব দিয়ে দিয়েছেন, তাকে অন্য কোনো হাসপাতাল গ্রহণ করতে রাজি হবে কি না। যদি না হয়, তাহলে চিকিৎসকরা চাইলে দশদিন বাদে সে রোগীর চিকিৎসা বন্ধ করে দিতে পারবেন।
এই যে চিকিৎসকরা চাইছেন যেসব রোগীকে আর বাঁচানো সম্ভব না তাদের চিকিৎসা বন্ধ করে দিতে, আবার রোগীর পরিবারের সদস্যরা চাইছেন যেভাবেই হোক রোগীকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে, এই দৃশ্যপট যুক্তরাষ্ট্রে এখন এক নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। প্রতিনিয়ত এ ধরনের ঘটনার পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আধুনিক চিকিৎসা প্রযুক্তির একটি আশীর্বাদ অথবা অভিশাপ হলো এই যে, আজকাল আইসিইউ তথা ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে রাখা কোনো রোগীর মৃত্যুর সম্ভাবনা খুবই কম। অর্থাৎ চাইলে কোনো রোগীকে দিনের পর দিন আইসিইউতে ‘বাঁচিয়ে’ রাখা সম্ভব। আর এর ফলেই, রোগীর পরিবারের সদস্যরা আর মানতে চাইছেন না যে তাদের আত্মীয়কে কোনোভাবেই আর সুস্থ-স্বাভাবিক করে তোলা সম্ভব হবে না।
রোগীর পরিবারের সদস্যদের আশার জ্বালানি হিসেবে কাজ করছে অনলাইনের বিভিন্ন ওয়েবসাইটও, যেখানে লেখা হয়ে থাকে যে বিভিন্ন নিরীক্ষামূলক চিকিৎসার মাধ্যমে নিতান্তই মুমূর্ষু রোগীকেও বাঁচিয়ে বা সুস্থ করে তোলা সম্ভব। এক্ষেত্রে প্রয়োজন কেবলই চিকিৎসক বা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা।
সব মিলিয়ে অবস্থা এতটাই সঙ্গীন হয়ে পড়েছে যে, ইতোঃপূর্বে যেসব হাসপাতালে বছরে এক বা দুজন রোগীকে চিকিৎসকদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে আইসিইউতে বাঁচিয়ে রাখা হতো, সেখানে এখন যেকোনো সময়েই এমন দুই বা তিনজন রোগীর দেখা মেলে।
অনেকেই হয়তো এই তথ্যে যারপরনাই অবাক হবেন, কেননা সব কেস তো আর টিনসলি লুইসের মতো নয় যে সেগুলো নিয়ে গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার হবে, আদালতে দিনের পর দিন ধরে মামলা চলবে। বরং চিকিৎসকরা সাধারণত নিজেদের গোপনীয়তার ব্যাপারে অত্যন্ত সংবেদনশীল হন এবং ‘সোশ্যাল মিডিয়া ফিগারে’ পরিণত হতে চান না বিধায়, অহেতুক ঝামেলায় না জড়িয়ে, রোগীর পরিবারের আবদার মেনে নেন।
এ ধরনের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব সব বয়সের রোগীদের উপরই প্রভাব ফেলে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এক্সট্রাকরপোরিয়াল মেমব্রেন-অক্সিজেনেশন মেশিনের ব্যবহার ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, যার সাহায্যে হৃদপিণ্ড বা ফুসফুস অথবা উভয়ই কাজ না করলেও রোগীকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হয়। তাই রোগীর পরিবারও চিকিৎসা অব্যাহত রাখার আবদার করার সুযোগ পাচ্ছে অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি।
খেয়াল করলে দেখা যাবে, এ ধরনের ঘটনায় প্রধান তিনটি বিষয় কাজ করছে। প্রথমত, চিকিৎসাবিজ্ঞানের অভূতপূর্ব উন্নতি, যার ফলাফল হলো অবিশ্বাস্য ক্ষমতাধর লাইফ-সাপোর্ট সিস্টেম। দ্বিতীয়ত, ধর্মীয় বিশ্বাস, যা রোগীর পরিবারকে উদ্বুদ্ধ করে চিকিৎসকদের কথা শুনে রোগীকে ‘মেরে ফেলার’ কথায় সায় না দিতে। তৃতীয়ত, আদি ও অকৃত্রিম মানবিক আবেগ, যার কারণে কোনো মানুষই সহজে মেনে নিতে পারে না যে তার খুব কাছের মানুষটি মারা যাবে, এবং সেখানেও থাকবে তার নিজস্ব সম্মতি।
মিনেসোটার মিচেল হ্যামলিন স্কুল অভ ল’র অধ্যাপক ও জৈবনীতিবিদ থাডিয়াস পোপ বলছেন ভাইটালিজম বা প্রাণবাদের প্রভাবের কথা। এই প্রাণবাদের সারকথা হলো, যেকোনো মূল্যে একটি প্রাণ বা জীবনকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। এবং এই প্রাণবাদের কারণেই, দিন দিন হাসপাতালগুলোতে ‘ব্রেইন-ডেড’ রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তা সে চিকিৎসকরা যতই এ ধরনের রোগীকে বাঁচিয়ে রাখার বিরুদ্ধে অবস্থান নেন না কেন।
এ ধরনের ব্যাপার মেডিক্যাল স্টাফদের উপর চরম প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষত যেসব নার্সরা প্রতি ঘণ্টায় ঘণ্টায় রোগীদের সেবাযত্ন করেন, তাদের জন্য আপাতদৃষ্টিতে মৃত রোগীদের সেবা চালিয়ে যাওয়াটা মনস্তাত্ত্বিকভাবে খুবই দুরূহ একটি কাজ।
চিন্তা করে দেখুন, আপনি এমন কারো শরীর ধুয়ে-মুছে দিচ্ছেন কিংবা তাকে প্রতিবেলায় খাইয়ে দিচ্ছে, যে এসব সেবার বিন্দুমাত্রও অনুভব করতে পারছে না। বিষয়টি কি তার মনের উপর অনেক চাপ ফেলবে না? নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে না?
নিষ্ফল চিকিৎসা প্রদান আরো নানা ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। যেমন এর ফলে অন্যান্য আশঙ্কাজনক রোগীদের আইসিইউতে ভর্তি হতে বিলম্ব হতে পারে। এদিকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যতই বলুক না কেন যে তারা টিনসলি লুইসের চিকিৎসার পেছনে ব্যয়িত অর্থের কথা নিয়ে একেবারেই ভাবিত নয়, কেননা সেই অর্থ মেডিকেইডের মাধ্যমে প্রদান করা হচ্ছে; কিন্ত বাস্তবতা হলো, অর্থ যে-ই প্রদান করুক, তারপরও ব্যাপারটি অত্যন্ত খরচসাপেক্ষ। হাসপাতালটি সর্বশেষ আদালতে যে প্রতিবেদন পেশ করেছে, সেখানে বলা হয়েছে যে টিনসলির চিকিৎসার পেছনে ইতোমধ্যেই খরচ হয়ে গেছে ২৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার!
বস্তুত, যেসব স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় একই সঙ্গে চিকিৎসকদের দক্ষতা ও রোগীর পরিবারের মর্জি, দুটোকেই সমান গুরুত্ব দিতে চাওয়া হয়, সেখানে জীবন বাঁচিয়ে রাখা না-রাখা সংক্রান্ত দ্বন্দ্বের উদ্ভব ঘটা অনিবার্য ব্যাপার। আবার বিকেন্দ্রীকৃত স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় এই অনিবার্যতা কমানোর মতো নীতিমালা তৈরি করা আরো অনেক বেশি দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে।
টেক্সাস হলো যুক্তরাষ্ট্রের সেই তিনটি রাজ্যের একটি (অন্য দুটো ক্যালিফোর্নিয়া ও ভার্জিনিয়া), যাদের আইন অনুযায়ী চিকিৎসকরা চাইলে রোগীর পরিবারের সম্মতি ছাড়াই চিকিৎসা প্রদান থেকে হাত গুটিয়ে নিতে পারেন। অন্যান্য রাজ্যে আইনে চিকিৎসকদের এ অধিকার নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
মূলত, একবার যখন চিকিৎসকরা বলে দেনই যে তাদের হাতে আর কিছু নেই, এরপর যে চিকিৎসাই হোক না কেন তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে, তখন রোগীকে বাঁচিয়ে রাখা না-রাখার প্রসঙ্গটি চিকিৎসাবিজ্ঞানকে ছাপিয়ে নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধের আওতায় চলে যায়।
টেক্সাস রাইট টু লাইফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জন সিয়াগো যেমনটি বলেন, “সে (টিনসলি) যে জীবনটি যাপন করছে, আমরা আমাদের সন্তানদের জন্য অবশ্যই সেরকম জীবন কামনা করি না। কিন্তু কে কেমন জীবন পাবে, সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণের মালিকও তো আমরা নই… হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ একটি নৈতিক সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। বাচ্চাটি এখনো বেঁচে রয়েছে, তার অর্থ হলো, তাকে যে সেবা দান করা হচ্ছে, তা কোনোভাবেই নিরর্থক নয়।”
তবে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, এমন অনেক প্রাণবাদী সংগঠনও কিন্তু রয়েছে, যারা এভাবে কোনো মুমূর্ষু রোগীর জীবনকে প্রলম্বিত করার ঘোর বিরোধী। তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী, কৃত্রিম উপায়ে জোর করে কাউকে বাঁচিয়ে রাখা অনুচিত। সৃষ্টিকর্তা যদি ইচ্ছা করেন যে স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিকভাবে কোনো মানুষের পক্ষে আর বেঁচে থাকা সম্ভব নয়, তাহলে মানুষের কী অধিকার আছে তাকে জীবন-মৃত্যুর মাঝামাঝি ফেলে রাখার?
এ ধরনের মোরাল ডিলেমার ক্ষেত্রে শেষ সমাধান যে কী হতে পারে, সে ব্যাপারে নিরপেক্ষভাবে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো অসম্ভব। তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের যে এথিকস কমিটি রয়েছে, তাদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে থাকে অনেকেই। তাদের কথা হলো, এথিকস কমিটির সদস্যরা তো একটি হাসপাতালেরই নিয়োগকৃত কর্মকর্তা। সুতরাং তারা তো নিরপেক্ষ নয়, বরং ওই হাসপাতালের পক্ষে। তাই তারা কোনো বস্তুনিষ্ঠ ও সর্বজনসম্মত সিদ্ধান্ত নিতে অক্ষম। তাই এক্ষেত্রে প্রয়োজন স্বাধীন প্যানেল সৃষ্টি করা, যে দায়ভার গ্রহণ করতে পারে স্বয়ং রাজ্যের প্রশাসন।
এদিকে যারা টিনসলির মতো অপ্রাপ্তবয়স্ক নয়, তাদের ক্ষেত্রে ‘অ্যাডভান্সড ডিরেকটিভস’ও কার্যকর হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। আর তাই যদি হয়, সেক্ষেত্রে সম্ভব হলে সরাসরি প্রাপ্তবয়স্ক রোগীদের কাছ থেকেই শুনে নেয়া যেতে পারে যে তারা কি কৃত্রিম উপায়ে বেঁচে থাকতে চায় নাকি চায় না।
কী হবে তাদের উত্তর? ধারণা করা যেতে পারে, রোগীর পরিবারের সদস্যরা রোগীকে বাঁচিয়ে রাখতে যতটা মরিয়া, রোগী নিজে তারচেয়ে অনেক কম মরিয়া থাকবেন। কেননা, রোগীর পরিবারের সদস্যদের মনে একধরনের অপরাধবোধ কাজ করে, যদি তারা রোগীর মৃত্যু ত্বরান্বিত করায় ‘হ্যাঁ’ বলে দেন। কিন্তু রোগীর নিজের বেলায় সে ধরনের মনস্তাপের আশঙ্কা নেই। বরং রোগীর নিজের শরীরের উপর দিয়ে যেহেতু অনেক ধকল যায়, তাই সে মনে করতে পারে যে এসব কষ্ট সহ্য না করে সবকিছুকে একবারে শেষ করে দেয়াই মঙ্গল।
শেষ কথা হলো, মাঝেমধ্যে সবচেয়ে সহজ সমাধানটিই শ্রেষ্ঠ সমাধান। এ ধরনের নৈতিক সিদ্ধান্তহীনতার ক্ষেত্রেও একই কথাই প্রযোজ্য। ‘ক্লিনিক্যাল ডিটেইলস’-এর বাইরে গিয়েও রোগী বা রোগীর পরিবারের সঙ্গে মৃত্যু বিষয়ে আলাপ করতে পারেন এ ব্যাপারে দক্ষ পেশাদাররা। এরপর যে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে, সেটিই হতে পারে চূড়ান্ত। কিন্তু একবার যদি দ্বন্দ্ব বা বচসার উদয় ঘটেই বসে, তাহলে আর এই সিদ্ধান্তহীনতা থেকে বেরিয়ে আসা খুব সহজ কাজ হবে না।