বারবার গ্রেফতার হয়ে, তার উপর জেল থেকে পালিয়ে স্ট্যালিন পুলিশের চক্ষুশূলে পরিণত হন। এ পরিস্থিতির বিকল্প হিসেবে, তিনি কিছুদিনের জন্য রাশিয়ার বাইরে যাওয়ার কথা ভাবেন। ১৯১৩ সালের জানুয়ারিতে স্ট্যালিন ভিয়েনায় (অস্ট্রিয়ার রাজধানী) চলে যান। ভিয়েনায় এসে প্রথমবারের মতো ট্রটস্কি, ও বুখারিনসহ কয়েকজন প্রভাবশালী সমাজতান্ত্রিক নেতার সঙ্গে স্ট্যালিনের পরিচয় ঘটে। আশ্চর্যের বিষয় হলো— এই একই সময়ে ভিয়েনায় বসবাস করতেন পরবর্তীকালে স্ট্যালিনের প্রধান শত্রু অ্যাডলফ হিটলার। ভিয়েনায় অবস্থানকালে স্ট্যালিন রাশিয়ান সাম্রাজ্যের সংখ্যালঘু জাতি ও সম্প্রদায়ের সাথে বলশেভিকদের কী ধরনের ব্যবহার করা উচিত, এই বিষয়ে একটি গবেষণা শুরু করেন।
স্ট্যালিনের এই চেষ্টাকে লেনিন অত্যন্ত উৎসাহিত করেন। কয়েকমাস পর স্ট্যালিন ‘মার্ক্সবাদ ও জাতিগত সমস্যা’ শিরোনামে কয়েকটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। এটি ছিল স্ট্যালিনের জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম। এই কাজের মাধ্যমে সমগ্র রাশিয়ান সাম্রাজ্যের সমাজতন্ত্রীদের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠেন স্ট্যালিন। সেখানে তিনি নিজের নাম হিসেবে স্ট্যালিন নামটি ব্যবহার করেন। বলশেভিকদের মধ্যে তার প্রবন্ধগুলো ও স্ট্যালিন নামটি বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। এরপর থেকে স্ট্যালিন নামেই তিনি পরিচিতি পান।
কিছুদিন পর স্ট্যালিন ভিয়েনা থেকে সেইন্ট পিটার্সবার্গে ফেরেন। কিন্তু, পিটার্সবার্গে আসার পর জারের সিক্রেট পুলিশ তাকে পুনরায় গ্রেফতার করে। এবার তাকে চার বছরের সাজা দিয়ে সাইবেরিয়ায় পাঠানো হয়। এর কিছুদিন পরেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধে রাশিয়ান সাম্রাজ্যও অংশগ্রহণ করে। হাজার হাজার কারাবন্দিকে যুদ্ধ করতে রণক্ষেত্রে পাঠানো হয়। স্ট্যালিন বেঁচে যান নিজের অকেজো হাতের উছিলায়। সামরিক বাহিনীর ডাক্তাররা স্ট্যালিনকে যুদ্ধ করতে অক্ষম ঘোষণা করে। যুদ্ধের পরিবর্তে তাকে আরো কয়েকমাস কারাভোগের আদেশ দেওয়া হয়।
১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে (গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী মার্চ মাস) রাশিয়ায় বিপ্লব শুরু হয়। ইতিহাসে একে ‘ফেব্রুয়ারি বিপ্লব’ বলে অভিহিত করা হয়। জেলে থাকার কারণে স্ট্যালিন ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের অংশ হতে পারেননি। এই বিপ্লবের মাধ্যমে রোমানভ রাজবংশের শেষ শাসক জার দ্বিতীয় নিকোলাসকে পদচ্যুত করা হয়। এর মাধ্যমে রাশিয়ান সাম্রাজ্যে রোমানভ রাজবংশের তিনশত বছরের শাসনের সমাপ্তি ঘটে। তবে, লেনিনসহ পার্টির প্রধান নেতাদের প্রবাসে অবস্থান এবং স্ট্যালিনের মতো দক্ষ সংগঠক জেলে অবস্থান করায় এই বিপ্লবে বলশেভিকরা সুবিধা করতে পারেনি।
ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের মাধ্যমে জারকে ক্ষমতা থেকে সরানোর পর, রাশিয়ায় নতুন লিবারেল সরকার (অস্থায়ী সরকার) ক্ষমতায় বসে। কিছুদিন পর জেল থেকে মুক্ত হন স্ট্যালিন এবং লেনিনসহ বলশেভিক নেতারা প্রবাস থেকে রাশিয়ায় ফিরে আসেন। জেল থেকে ছাড়া পেয়েই পেট্রোগ্রাদে (সেইন্ট পিটার্সবার্গের নতুন নাম) এসে পুনরায় প্রাভদা পত্রিকার নিয়ন্ত্রণ নেন স্ট্যালিন। পেট্রোগ্রাদ বা সেইন্ট পিটার্সবার্গ ছিল তখন রাশিয়ান সাম্রাজ্যের রাজধানী ও বিপ্লবের কেন্দ্রবিন্দু। এবার লেনিনের সঙ্গে পথচলা শুরু হয় স্ট্যালিনের।
বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে শ্রমিকদের মধ্যে তিনি ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকেন। এ সময় রাশিয়ান সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক লেবার পার্টির (বলশেভিক) নাম পরিবর্তন করে ‘কমিউনিস্ট পার্টি’ রাখা হয়। রাশিয়ার নতুন সরকার বলশেভিকদের পছন্দ ছিল না। বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে কমিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করে বলশেভিকরা। বলশেভিকরা আবারো বিপ্লবের জন্য সংগঠিত হতে থাকে। এ সময় স্ট্যালিন পত্রিকায় লেখালেখির মাধ্যমে বলশেভিক পার্টির প্রতি জনসমর্থন বৃদ্ধি করতে থাকেন।
১৯১৭ সালের অক্টোবরে প্রাভদা পত্রিকার সম্পাদকীয়তে তিনি লিখেন, “বর্তমান জমিদার ও পুঁজিবাদীদের সরকারকে অবশ্যই নতুন সরকার দ্বারা প্রতিস্থাপন করতে হবে এবং সেই সরকার হবে কৃষক ও শ্রমিকদের। বর্তমান অনির্বাচিত, অবৈধ সরকারকে জনগণ স্বীকৃত কৃষক ও শ্রমিকদের প্রতিনিধিদের সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।”
স্ট্যালিন অভ্যুত্থানের অভিপ্রায়ে বিদ্রোহীদের সংগঠিত করতে থাকেন। বলশেভিকদের অনেকেই সশস্ত্র অভ্যুত্থানের বিরোধীতা করলেও স্ট্যালিন দৃঢ়ভাবে এর সমর্থন করেন। কিছুদিন পর ১৯১৭ সালের ২৫ অক্টোবর ভোরে, বলশেভিক কেন্দ্রীয় কমিটির শীর্ষ নেতাদের বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন স্ট্যালিন, যেখান থেকে অভ্যুত্থান পরিচালিত হয়েছিল। সেখানে স্ট্যালিন ও লেনিনসহ বলশেভিক নেতারা অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা সাজাতে থাকেন।
সেদিন, ১৯১৭ সালের ২৫ অক্টোবর (গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ৭ নভেম্বর) বলশেভিকরা এক সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাশিয়ার তৎকালীন অস্থায়ী সরকারকে পদচ্যুত করে ক্ষমতা দখল করে নেয়। ইতিহাসে একে ‘অক্টোবর বিপ্লব’ বা ‘বলশেভিক বিপ্লব’ নামে অভিহিত করা হয়। এই বিপ্লবে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং বলশেভিকদের প্রধান পত্রিকা প্রাভদার সম্পাদক হিসেবে স্ট্যালিন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
১৯১৭ সালের ২৬ অক্টোবর (গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে ৮ নভেম্বর) লেনিন নিজেকে নতুন সরকারের চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন। বলশেভিক বিরোধীরা এই সরকারকে সমর্থন করেনি। বলশেভিকদের ক্ষমতা দখলের পর তাদের বিরুদ্ধে ডানপন্থী, লিবারেল এবং সাম্রাজ্যবাদীরা একজোট হয়ে গঠন করে ‘হোয়াইট আর্মি’। শুরু হয় রাশিয়ান সিভিল ওয়ার। রেড আর্মি আর হোয়াইট আর্মি একে অপরের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এমন অস্থিতিশীল অবস্থায় স্ট্যালিন ক্রমশই লেনিন, ট্রটস্কির মতো প্রভাবশালী হতে থাকেন। স্ট্যালিন হয়ে উঠলেন বলশেভিকদের তৃতীয় প্রধান নেতা।
স্ট্যালিন যদিও লেনিন কিংবা ট্রটস্কির মতো দার্শনিক গোছের ছিলেন না এবং উচ্চ শিক্ষিতও ছিলেন না, তথাপি তিনি তার সাংগঠনিক দক্ষতার মাধ্যমে বলশেভিকদের মধ্যে ক্রমশই প্রভাব বিস্তার করতে থাকেন। লেনিন অনেক সময়ই স্ট্যালিনের পরামর্শে কাজ করেছেন। স্ট্যালিনের সাংগঠনিক দক্ষতার প্রতি লেনিনের প্রগাঢ় বিশ্বাস ছিল। স্ট্যালিন বিপ্লবোত্তর রাশিয়ার সংবিধান প্রণয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। বিপ্লবের পর লেনিনের দেওয়া বৈরী সংবাদপত্রগুলো বন্ধ করার আদেশে স্ট্যালিনের সমর্থন ছিল।
অনেক শীর্ষস্থানীয় বলশেভিক নেতা লেনিনের চেকা সিকিউরিটি সার্ভিস (গুপ্ত পুলিশ বাহিনী) গঠন ও রেড টেররের (বিরোধীমতের উপর নিষ্পেষণ) বিরোধীতা করলেও, স্ট্যালিন এর তীব্র সমর্থন করেন। নবগঠিত প্রশাসনে স্ট্যালিনকে ‘পিপলস কমিসারিয়েট ফর ন্যাশনালিটিস’ বা জাতি সমস্যা বিষয়ক দপ্তরের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
১৯১৭ সালের নভেম্বরে, স্ট্যালিন রাশিয়ান সাম্রাজ্যের অন্তর্গত যে সংখ্যালঘু জাতিসমূহ ছিল, তাদের অধিকার ও ক্ষমতার বিষয়ে ‘ডিক্রি অন ন্যাশনালিটি’ প্রকাশ করেন। এর মাধ্যমে তিনি সংখ্যালঘু জাতিসমূহকে বলশেভিকদের প্রতি আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেন। এর ফলে সংখ্যালঘু জাতিসমূহ আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার পায়, সেই সঙ্গে রাশিয়ার সাথে থাকতে অথবা স্বাধীন হয়ে যাওয়ার অধিকার পায়। এই সুযোগে অনেকগুলো জাতি স্বাধীনতা ঘোষণা করে দেয়। কিছুদিন পর, গৃহযুদ্ধ চলাকালে লেনিন আট সদস্যের একটি পলিটব্যুরো গঠন করেন, যেখানে স্ট্যালিন ছিলেন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। কয়েকমাস পর রাশিয়ার রাজধানী পেট্রোগ্রাদ বা সেইন্ট পিটার্সবার্গ থেকে সরিয়ে মস্কোতে স্থানান্তরিত করা হয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ তখনো চলছে। এসময় লেনিন সেন্ট্রাল পাওয়ারের সাথে ‘ব্রেস্ট-লিটোভস্ক’ চুক্তির মাধ্যমে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে সরে দাঁড়ায়। ব্রেস্ট-লিটোভস্ক চুক্তির ফলে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো বলশেভিক রাশিয়ার উপর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো রাশিয়ার গৃহযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়ে।
ইতোমধ্যে বলশেভিকদের বিরুদ্ধে ডানপন্থী, লিবারেল, এবং সাম্রাজ্যবাদীদের জোটবদ্ধ ‘হোয়াইট আর্মি’ যুদ্ধ শুরু করেছে। গৃহযুদ্ধে বলশেভিকদের বিরুদ্ধে শ্বেত বাহিনীর হয়ে যুক্তরাজ্যসহ কয়েকটি সাম্রাজ্যবাদী বিদেশী শক্তিও ব্যাপকভাবে জড়িয়ে পড়ে। ফলে রেড আর্মি (বলশেভিক আর্মি) ও হোয়াইট আর্মির (বলশেভিক বিরোধী আর্মি) মধ্যে শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ। গৃহযুদ্ধে সেনা অফিসার হিসেবে যোগদান করেন স্ট্যালিন।
যুদ্ধে বলশেভিকদের পক্ষে সেনাপতি হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন স্ট্যালিন। যদিও এর আগে স্ট্যালিনের কোনো সামরিক অভিজ্ঞতা ছিল না। গৃহযুদ্ধের অধিকাংশ সময়ই স্ট্যালিন বিভিন্ন মিশনে মস্কোর বাইরে থাকতেন। সেনাপতি হিসেবে স্ট্যালিন সাফল্য ও ব্যর্থতা উভয়ের দেখা পান। গৃহযুদ্ধকালীন স্ট্যালিনের নিষ্ঠুরতা প্রকাশিত হয়ে ওঠে। অধিকাংশ বলশেভিক নেতার অনুমোদন ব্যতিরেকেই বা তাদেরকে তোয়াক্কা না করেই স্ট্যালিন রাষ্ট্রীয় সহিংসতা ও সন্ত্রাসের আশ্রয় নেন।
এ সময় রেড আর্মি খাদ্য সংকটে পড়ে। যুদ্ধকালীন খাদ্য সরবরাহকে নিরাপদ রাখতে স্টালিনকে দক্ষিণ রাশিয়ার খাদ্য সংগ্রহের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য জারিৎসিনে (পরবর্তীতে স্ট্যালিনগ্রাদ, বর্তমান ভলগোগ্রাদ) পাঠানো হয়। জারিৎসিনে স্ট্যালিন স্থানীয় চেকা শাখাকে নেতৃত্ব দেন, এবং বেশ কিছু সন্দেহভাজন প্রতিবিপ্লবীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেন। কখনো কখনো বিনা বিচারে, এমনকি সরকারি আদেশ লঙ্ঘন করে কয়েকজনকে তিনি মৃত্যুদণ্ড দেন। কোনো কোনো তথ্যসূত্র বলে, স্ট্যালিন এ সময় প্রায় ১০২ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেন, যাদের অর্ধেকই প্রাক্তন জারের সেনাবাহিনীর অফিসার অথবা জারের গুপ্ত পুলিশ বাহিনীর সদস্য ছিল। তিনি তার খাদ্য সংগ্রহ কর্মসূচি নিশ্চিত করার জন্য বেশ কয়েকটি গ্রামে অগ্নিসংযোগেরও নির্দেশ দেন।
এদিকে ক্রমেই স্ট্যালিন ও ট্রটস্কি একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে থাকে। বিভিন্ন বিষয় কেন্দ্র করে স্ট্যালিন ও ট্রটস্কির মধ্যে মতবিরোধ তৈরি হয়। ট্রটস্কি ছিলেন গৃহযুদ্ধকালীন সামরিক বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রধান। জারিৎসিনে বিশৃঙ্খলা তৈরি ও নিষ্ঠুরতার অভিযোগে ১৯১৮ সালের অক্টোবরে স্ট্যালিনকে জারিৎসিন থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। সেই সঙ্গে, স্ট্যালিনের অন্যান্য মিত্রদেরও জারিৎসিন থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এরপর থেকে স্ট্যালিন ট্রটস্কির বিরুদ্ধে ফন্দি আটতে থাকেন এবং জারিৎসিনে তার মিত্রদের, বিশেষ করে সামরিক মিত্রদের পদোন্নতি দেওয়ার প্রতিটি সুযোগ কাজে লাগান। স্ট্যালিন ট্রটস্কিকে মোকাবিলা করার জন্য তখন থেকে প্রস্তুতি শুরু করেন।
স্ট্যালিন ছিলেন সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী কমিটির (পলিটব্যুরো) গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। বিভিন্ন যুদ্ধে ব্যস্ত থাকার কারণে স্ট্যালিন কেন্দ্রীয় কমিটির অধিকাংশ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করতে পারতেন না। তবে, ব্যস্ততার মধ্যেও স্ট্যালিন মস্কোতে কমিউনিস্ট পার্টির কয়েকটি সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন।
জারিৎসিন থেকে সরিয়ে এনে স্ট্যালিনকে পার্মে পাঠানো হয় সেখানকার রেড আর্মির ব্যর্থতা তদন্তের জন্য। কয়েকমাস পর, ১৯১৯ সালের শুরুতে, স্ট্যালিন পার্ম থেকে ফিরে এসে পেট্রোগ্রাদে ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টে যোগ দেন। গৃহযুদ্ধের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ফ্রন্টে তিনি তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখেন। স্ট্যালিন কখনো ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টে, কখনো সাউদার্ন ফ্রন্টে, আবার কখনো অন্যান্য অঞ্চলে যুদ্ধ করেছেন।
যেখানেই লাল ফৌজ বিপদে পড়েছে, সেখানেই স্ট্যালিন তাদেরকে উদ্ধার করেছেন, এবং চরম নিষ্ঠুরতার মাধ্যমে শ্বেত বাহিনী ও প্রতিবিপ্লবীদের প্রতিহত করেছেন। কোনো সামরিক নেতা না হওয়া সত্ত্বেও তার বড়সড় ক্ষমতা ছিল— তিনি অত্যন্ত দ্রুত পরিস্থিতি বুঝে নিতে পারতেন এবং পরিস্থিতি আয়ত্তে আনার জন্য দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারতেন। যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের জন্য ১৯১৯ সালের নভেম্বর মাসে স্ট্যালিনকে ‘অর্ডার অব দ্য রেড ব্যানার’ পদকে ভূষিত করা হয়।
অনেকদিন ধরেই সংসারবিহীন ছিলেন স্ট্যালিন। ১৯০৭ সালে তার প্রথম স্ত্রী সানিদজে মারা যাওয়ার পর তিনি আর বিয়ে করেননি। এ সময় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য নাদেজদা অলিলুয়েভার প্রতি বেশ আকৃষ্ট হন তিনি। নাদেজদা ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য এবং স্ট্যালিনের সেক্রেটারি। ১৯১৯ সালে স্ট্যালিন ও নাদেজদা অলিলুয়েভা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।
১৯২০ সালের শুরুর দিকে পোল্যান্ড সাম্রাজ্যবাদীদের প্ররোচনায় ইউক্রেন আক্রমণ করে কিয়েভ দখল করে নেয়। এবার এই বাহিনী মোকাবিলা করার দায়িত্ব এসে পড়ল স্ট্যালিনের উপর। মে মাসের শেষের দিকে স্ট্যালিনকে সাউদার্ন ফ্রন্টে যোগ দিতে ইউক্রেনে পাঠানো হয়। স্ট্যালিনের নেতৃত্বে লাল ফৌজ কয়েকদিনের মধ্যেই কিয়েভ পুনরুদ্ধার করে এবং সেখান থেকে পোলিশ বাহিনীকে বিতাড়িত করে।
স্ট্যালিনের নেতৃত্বে রেড আর্মি অনেকগুলো যুদ্ধে জয়লাভ করে। তবে এর পাশাপাশি তার নিষ্ঠুরতার জন্য অনেকের কাছে নিন্দিত হয়েছেন। কেন্দ্রীয় কমিটি কয়েকটি বৈঠকে কিছু যুদ্ধে ব্যর্থতার জন্য ট্রটস্কি স্ট্যালিনকে সরাসরি দায়ী করেন এবং স্ট্যালিনের সমালোচনা করেন। ট্রটস্কির সঙ্গে লেনিনও স্ট্যালিনের অনেক সিদ্ধান্তের নিন্দা করেন। তবে পরিস্থিতি বিবেচনায় স্ট্যালিন অধিকাংশ সময়ই সঠিক ছিল বলে ধারণা করা হয়।
স্ট্যালিন কঠোরভাবে বিভিন্ন অঞ্চলের ‘শ্বেত বাহিনী’ বা বলশেভিকবিরোধীদের উৎখাত করেন। সেই সঙ্গে বলশেভিকদের দারুণভাবে সংগঠিত করেন। ১৯২০ সালে স্ট্যালিনকে ‘ওয়ার্কার্স এন্ড পেজেন্টস ইন্সপেক্টরেট’ বা শ্রমিক-কৃষকের অবস্থা পরিদর্শন দপ্তরের প্রধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
কিছুদিন পর স্ট্যালিন ককেশীয় ফ্রন্টে যোগ দেন। ১৯২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে বলশেভিকরা ম্যানশেভিক নিয়ন্ত্রিত জর্জিয়াতে হামলা করে। স্ট্যালিন ককেশাস অঞ্চলে ব্যাপক নিষ্ঠুরতা চালান। বহুজাতিক ককেশীয় অঞ্চলকে তিনি আলাদা আলাদা (জর্জিয়ান, আর্মেনিয়ান, আজারবাইজানী) অটোনমাস রিপাবলিকের পরিবর্তে পুরো অঞ্চলকে একত্রে একটি রিপাবলিক গঠন করেন, যার নাম দেওয়া হয়, ‘ট্রান্সককেশীয়ান সোশালিস্ট ফেডারেটিভ সোভিয়েত রিপাবলিক’।
‘পিপলস কমিসারিয়েট ফর ন্যাশনালিটিস’ এর প্রধান হিসেবে সংখ্যালঘু জাতিসমূহকে নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠনে স্ট্যালিনের অবদান ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্ট্যালিন নিজেও ছিলেন একজন সংখ্যালঘু। স্ট্যালিন নিজের জর্জিয়ান পরিচয়ে গর্বিত ছিলেন এবং সবসময় জর্জিয়ান উচ্চারণেই কথা বলতেন।