আপনি কি টুথপেস্ট দিয়ে দাঁত মাজেন? ডিওডোরেন্ট ব্যবহার করেন? ঝালর দেওয়া চুল রাখেন? ভিন্ন ভিন্ন ঋতুতে ভিন্ন ভিন্ন ফ্যাশনের পোশাক পরেন? আনুষ্ঠানিক ভোজে তিন কোর্সের খাবার খান? তাহলে এ সব কিছুর জন্য যে ব্যক্তিটির কাছে আপনাকে কৃতজ্ঞ থাকতে হবে, তিনি হলেন নবম শতকের আরব পলিম্যাথ, আবুল হাসান আলি ইবনে নাফি, যিনি তার সুমধুর কণ্ঠের জন্য জিরিয়াব তথা কৃষ্ণকোকিল নামেই বেশি পরিচিত।
জিরিয়াবের জন্ম আনুমানিক ৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে বা এর কাছাকাছি সময়ে, বর্তমান ইরাকের বাগদাদ অথবা মসুলে। ধারণা করা হয় তিনি ছিলেন আফ্রিকান অথবা কুর্দি বংশোদ্ভূত দাস, যিনি পরবর্তীতে মুক্তিলাভ করেন। অনেক ইতিহাসবিদের বর্ণনা অনুযায়ী, তার পরিবার ছিল ৭৫ সাল থেকে ৭৮৫ সাল পর্যন্ত মুসলিম বিশ্বের খলিফা আব্বাসীয় খলিফা আল-মাহদির পারিবারিক সেবক।
জিরিয়াব যখন বড় হয়ে উঠছিলেন, তখন বাগদাদের শাসক ছিলেন খলিফা হারুনুর রশিদ। আর বাগদাদ ছিল বিজ্ঞান, শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র। খলিফা হারুন ছিলেন অত্যন্ত সঙ্গীতানুরাগী। তার সভার প্রধান সঙ্গীতশিল্পী ছিলেন প্রথমে ইবরাহিম আল-মৌসুলি এবং পরবর্তীতে ইসহাক আল-মৌসুলি। আর জিরিয়াব ছিলেন এই ইসহাকের শিষ্য।
জিরিয়াব ছিলেন অসাধারণ প্রতিভাবান। তিনি শীঘ্রই সঙ্গীত প্রতিভায় তার গুরুকেও ছাড়িয়ে যেতে শুরু করেন। আন্দালুসীয় ইতিহাসবিদ ইবনে হাইয়ানের বর্ণনানুযায়ী, একদিন খলিফা হারুনুর রশিদের (মতান্তরে হারুনুর রশিদের মৃত্যুর পর তার পুত্র, খলিফা আল-আমিন কিংবা আল-মামুনের) দরবারে জিরিয়াবের ডাক পড়ে। খলিফা তাকে ইসহাকের গিটারজাতীয় বাদ্যযন্ত্র ‘উদ’ দিয়ে গান শোনাতে বললে জিরিয়াব তার নিজের তৈরি আরো উন্নতমানের এবং নিখুঁত সুর তৈরিতে সক্ষম বাদ্যযন্ত্র নিয়ে এসে নিজের লেখা এবং সুর করা একটি গান গেয়ে শোনান।
জিরিয়াবের গান খলিফাকে অত্যন্ত মুগ্ধ করে, কিন্তু একইসাথে তা তার গুরু ইসহাককে ক্ষুদ্ধ করে। কারণ জিরিয়াব তার গান লেখার, সুর করার এবং বাদ্যযন্ত্র তৈরির প্রতিভার কথা তার কাছ থেকে গোপন করে রেখেছিলেন। এছাড়াও খলিফার প্রতিক্রিয়া থেকে ইসহাক বুঝতে পেরেছিলেন, খলিফা হয়তো অবিলম্বেই তাকে সরিয়ে জিরিয়াবকেই রাজদরবারের প্রধান সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে নিযুক্ত করবেন। ইর্ষা এবং ক্রোধের বশবর্তী হয়ে গুরু তার শিষ্যকে বাগদাদ ছাড়তে বাধ্য করেন।
বাগদাদ ছেড়ে আনুমানিক ৮১৩ সালে জিরিয়াব মাগরেব তথা পশ্চিমের দিকে যাত্রা করেন। মিসর এবং লিবিয়া পাড়ি দিয়ে তিনি বর্তমান তিউনিসিয়ায় উপস্থিত হন। সেখানকার আগলাবিদ সাম্রাজ্যের আমির, প্রথম জিয়াদাতুল্লাহ্ তাকে কারিওয়ানে তার রাজদরবারে আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু জিরিয়াবের কারিওয়ানে থাকার কোনো ইচ্ছে ছিল না। তার দৃষ্টি ছিল বাগদাদকে টেক্কা দিয়ে ইসলামী শিল্প-সাহিত্য এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের নতুন প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠতে থাকা স্পেনের আন্দালুসের দিকে।
জিরিয়াব আন্দালুসের আমির, উইমাইয়া শাসক আল-হাকামের কাছে নিজের যোগ্যতার কথা জানিয়ে পত্র লেখেন। হাকাম খুশিমনে তাকে আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু দীর্ঘযাত্রা শেষে ৮২২ খ্রিস্টাব্দে জিরিয়াব যখন কর্দোভাতে পৌঁছেন, তখন তিনি জানতে পারেন আল-হাকাম আরও আগেই মৃত্যুবরণ করেছেন। হতাশ হয়ে তিনি যখন তিউনিসিয়াতে ফিরে যাওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছিলেন, তখন আবু নাসের আল-মানসুর নামে কর্দোভার রয়্যাল কোর্টের এক ইহুদী সুরকারের পরামর্শে আল-হাকামের পুত্র ও উত্তরসূরী, কর্দোভার আমির, দ্বিতীয় আব্দুর রহমান তাকে রাজদরবারে স্থান দেন।
কর্দোভার রাজদরবারে জিরিয়াব তার যোগ্য স্থান খুঁজে পান। মাসিক ২০০ স্বর্ণমুদ্রা এবং অন্যান্য বাৎসরিক সুযোগ-সুবিধার বিনিময়ে আমির আব্দুর রহমান তাকে রাজদরবারের প্রধান সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে নিয়োগ করেন। তবে বাস্তবে জিরিয়াবের কর্যপরিধি ছিল আরও ব্যাপক। আমিরের পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি অনেকটা আন্দালুসের সংস্কৃতিমন্ত্রীর মতোই দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। তিনি কর্দোভাতে একটি গানের স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন, যেটিকে বিশ্বের প্রথম সাধারণ জনগণের জন্য উন্মুক্ত গানের স্কুল হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
সুমধুর কণ্ঠস্বর ছাড়াও জিরিয়াবের ছিল অসাধারণ স্মরণশক্তি। ইতিহাসবিদ ইবনে হাইয়ানের মতে, জিরিয়াবের প্রায় হাজের দশেক গান মুখস্ত ছিল। তিনি ‘নুবা’ নামক আন্দালুসীয় সঙ্গীতের সুরের জন্য প্রতাষ্ঠানিক নিয়ম-কানুন প্রণয়ন করেন, যেগুলো আজও অনুসরণ করা হয়। ভারতীয় ক্লাসিক্যাল রাগ সঙ্গীতের মতো তিনি দিনের ২৪ ঘন্টার উপযোগী ২৪টি ‘নুবা’ সৃষ্টি করেন। এই ২৪টি ‘নুবা’ পরবর্তীতে খ্রিস্টানদের চার্চের মিউজিককে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে, বর্তমানে যা ওয়েস্টার্ন ক্লাসিক্যাল মিউজিক নামে পরিচিত। তার তৈরি করা বাদ্যযন্ত্র ‘উদ’ পরবর্তীতে স্প্যানিশ গিটারে বিবর্তিত হয়। তাকে ইসলামিক স্পেনের সঙ্গীতের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
শুধু সঙ্গীত নয়, জিরিয়াব তার প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছিলেন সে সময়ের ফ্যাশন, হেয়ারস্টাইল, লাইফস্টাইলসহ জীবন যাপনের প্রায় সকল ক্ষেত্রে। এছাড়াও ভূগোল, জ্যোতির্বিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যাসহ, চিকিৎসাবিদ্যাসহ বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায়ও তার ছিল দক্ষ পদচারণা। দাবা শেখার জন্য তিনি ভারত থেকে দাবাড়ুদেরকে কর্দোভাতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তার হাত ধরেই দাবা ইউরোপে প্রবেশ করে। তিনি ছিলেন তার সময়ের তুলনায় কয়েক শতাব্দী এগিয়ে থাকা একজন সত্যিকার জিনিয়াস।
তিনি সুস্বাদু খাবার খেতে পছন্দ করতেন। তার সময়ের আগে স্পেনে খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে কোনো নিয়ম অনুসরণ করা হতো না। ভ্যান্ডালদের কাছ থেকে পাওয়া ঐতিহ্য অনুসারে নগ্ন কাঠের টেবিলে সব ধরনের খাবার একত্রে পরিবেশন করা হতো। টেবিল ম্যানার নামে কোনো জিনিসের অস্তিত্ব তখন ছিল না।
জিরিয়াব এই অভ্যাস পাল্টে দেন। ফরাসিদের মধ্যে যে থ্রি-কোর্স মিল তথা তিন ধাপের খাবার প্রচলিত, সেটি জিরিয়াবেরই কীর্তি। তিনিই প্রথম কর্দোভার রাজদরবারে প্রথমে স্যুপ, এরপর মেইন ডিশ এবং সবশেষে মিষ্টান্ন বা ফলমূল পরিবেশনের পরামর্শ দেন, যা পরবর্তীতে ফ্রান্সসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ডাইনিং টেবিলের সাথে চামড়ায় মোড়ানো চেয়ার, টেবিল ক্লথ এবং ধাতব গ্লাসের পরিবর্তে স্ফটিকের গ্লাস ব্যবহারেরও প্রচলক তিনি।
বাগদাদের বিভিন্ন রেসিপির উপর ভিত্তি করে এবং সেগুলোকে পরিবর্তন করে কর্দোভাতে তিনি নতুন নতুন খাবারেরও প্রচল করেন। তার উদ্ভাবিত খাবারের মধ্যে আখরোট এবং মধুর সমন্বয়ে তৈরি মিষ্টান্ন এবং অ্যাসপার্যাগাস তথা শতমূলী আজও জনপ্রিয়। কর্দোভাতে আজও ভাজি করা একধরনের শিম তার নাম অনুসারে জিরিয়াবি নামে পরিচিত। এছাড়াও জিলাপীও তার আবিষ্কার বলে ধারণা করা হয়। জিলাপির আরবি ‘জাল্লাবিয়া’ শব্দটিও জিরিয়াব নাম থেকে এসেছে বলে অনেকে দাবি করেন।
জিরিয়াব ছিলেন ফ্যাশনের সুলতান। তার আগে বছরে শুধু দুই ধরনের পোশাকের প্রচলন ছিল- গরমকালের এবং শীতকালের। জিরিয়াবই প্রথম ভিন্ন ভিন্ন ঋতুর জন্য ভিন্ন ভিন্ন পোশাক চালু করেন, যা পরবর্তীতে ইউরোপীয় ফ্যাশনের অনুপ্রেরণা হয়ে দাঁড়ায়। শুধুমাত্র বেশি বা কম কাপড়ের পরিবর্তে তিনি বিভিন্ন স্টাইলের এবং রংয়ের কাপড় পরার উপর গুরুত্ব দেন। গরমকালের জন্য তিনি ধবধবে সাদা মসৃণ কাপড়, বসন্তকালের জন্য উজ্জ্বল বর্ণের সিল্কের কাপড় এবং শীতকালের জন্য গাঢ় বর্ণের উলের কাপড়ের প্রচলন করেন।
কাপড় পরিষ্কার করার জন্য তিনি প্রথম লবণ এবং পারঅক্সাইডের দ্রবণের ব্যবহার জনপ্রিয় করেন। তাকে প্রথম টুথপেস্টের প্রচলনকারী হিসেবেও ধরা হয়, যদিও তার টুথপেস্টে কী ধরনের উপাদান ব্যবহৃত হয়েছিল, তা জানা যায় না। শরীরের দুর্ঘন্ধ দূর করার জন্য বাহুর নিচে ডিওডোরেন্ট স্প্রে ব্যবহারেরও প্রচলক চিনি। পুরুষদের জন্য তিনি কান, গলা এবং কপাল উন্মুক্ত রেখে ছোটো করে চুল ছাঁটার এবং শেভ করার স্টাইল চালু করেছিলেন। আর নারীদের জন্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বিউটি পার্লার এবং কসমেটোলজি স্কুল।
সে সময়ের নারীরা প্রধানত চুলের মাঝ বরাবর সিঁথি করত। তাদের চুল থাকত পেছনের দিকে কোমর পর্যন্ত লম্বা। জিরিয়াব নারীদের চুল ছোট করে কেটে, কান অনাবৃত রেখে, কপালের উপর দিয়ে ভ্রু পর্যন্ত ঝালর দেওয়ার ফ্যাশন চালু করেন। তিনি বিভিন্ন ধরনের পারফিউম ব্যবহারে এবং ভ্রু পরিচ্ছন্ন করার ব্যাপারেও নারীদেরকে উৎসাহিত করেন। ইতিহাসবিদ জন গিলের মতে, তিনি নারীদের কাছে স্বচ্ছ পোশাক জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন, যা ছিল সময়ের তুলনায় অনেক সাহসী।
স্বাভাবিকভাবেই জিরিয়াবের বিভিন্ন পদক্ষেপের প্রবল সমালোচনাও ছিল। কিন্তু কর্দোভার আমির দ্বিতীয় আব্দুর রহমানের পৃষ্ঠপোষকতায় থাকার কারণে কোনো সমালোচনা এবং বিরোধিতা শেষপর্যন্ত পাত্তা পায়নি। ৮৫২ সালে আমিরের মৃত্যুর পাঁচ বছর পর, ৬৮ বছর বয়সে জিরিয়াব পরলোকগমন করেন। কিন্তু পেছনে রেখে যান তার অমর সব কীর্তি।
জিরিয়াবের মতো বহুমুখী প্রতিভা এবং পান্ডিত্যের অধিকারী এবং সমাজকে ও মানুষের জীবনধারাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করা মানুষের সংখ্যা ইতিহাসে কম। এমন নয় যে, জিরিয়াবের সবকিছুই তার একেবারেই নিজস্ব আবিষ্কার। অনেক কিছুরই তিনি প্রচলন করেছিলেন বাগদাদের এবং স্থানীয় আন্দালুসের সংস্কৃতির সমন্বয় করে এবং সেগুলোর উন্নয়ন ঘটিয়ে। কিন্তু তিনি যে সফলভাগে সেগুলো প্রয়োগ করতে সক্ষম হয়েছিলেন, তার অন্যতম প্রধান কারণ সে সময়ের উদার আন্দালুসীয় সভ্যতা, যে সভ্যতা জ্ঞানীদের প্রকৃত মর্যাদা দিতে জানত, তাদেরকে উৎসাহিত করত।
জিরিয়াবের মৃত্যুর পরবর্তী সময়ে আন্দালুস ধীরে ধীরে হয়ে উঠে ইউরোপের জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রাণকেন্দ্র। সমগ্র ইউরোপ থেকে মানুষ জ্ঞান চর্চার জন্য ছুটে আসতে থাকে আন্দালুসে। আর ফিরে যাওয়ার সময় সাথে করে নিয়ে যেতে থাকে জিরিয়াবের চালু করে যাওয়া ফ্যাশন এবং স্টাইলগুলো।
বর্তমানের ইউরোপীয়রা অনেকে জানেই না, যে জীবনধারাকে তারা ইউরোপীয় জীবনধারা মনে করছে, তার প্রচলন আসলে ঘটেছে মধ্যযুগের এক আরবীয়ের হাতে। কিন্তু তারা না জানলেও ইতিহাসের পাতায় ঠিকই জিরিয়াবের নাম রয়ে গেছে। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে জিরিয়াবের নাম বেশ গর্বের সাথেই স্মরণ করা হয়। জিরিয়াব টিকে আছেন ইতিহাসের পাতায়, বিশ্বের অসংখ্য রাস্তাঘাট, রেস্তোঁরা ও প্রতিষ্ঠানের নামের মধ্যে এবং কোটি কোটি মানুষের জীবনধারার মধ্য দিয়ে।
বি: দ্র: স্পেনে মুসলমানদের বিস্তারিত ইতিহাস সম্পর্কে জানতে চাইলে দেখুন মাহবুবুর রহমানের ‘স্পেনে মুসলমানদের ইতিহাস (৭১০-১৮৯২ খ্রিঃ)‘ বইটি।