আমাকে প্রায়ই জিজ্ঞেস করা হয়, কীভাবে আমি লেখালেখিতে এলাম? এই প্রশ্নের সবচেয়ে মোক্ষম জবাবটি হলো, আমার টাকার দরকার ছিল! বিভিন্ন পেশায় ব্যর্থ হয়ে যখন আমি লেখালেখি শুরু করি, তখন আমার বয়স ৩৫ বছর।
আমার জন্ম হয়েছিল শিকাগোতে। আমি যে দুটো স্কুলে পড়তাম সেগুলো মহামারীর কবলে পড়ে বন্ধ হয়ে যাওয়ায়, বাবা-মা আমাকে নিয়ে ইয়াডাহোর একটি র্যাঞ্চে চলে আসেন। সেখানে আমি আমার দুই বড় ভাইয়ের সাথে সময় কাটাতাম। ওরা তখন সদ্য কলেজ শেষ করে গরুর ব্যবসায় নেমেছিলেন। ব্যবসা করাটাই যেন ছিল তাদের ডিগ্রির যথাযথ ব্যবহার! তারপর আমি ভর্তি হলাম অ্যানডোভারের ফিলিপস একাডেমিতে। সেখানে গিয়েছিলাম আর্মিতে যোগ দেওয়ার জন্য, কিন্তু হার্ট দুর্বল হওয়ার কারণে আমাকে সেখান থেকে বের করে দেওয়া হয়। অতঃপর, আমার ভাই আমাকে পসাটিল্লোতে একটা স্টেশনারিতে বসিয়ে দিলেন। যদিও সেখানে বেশি দিন টিকতে পারিনি।
১৯০০ সালে যখন বিয়ে করলাম, তখন আমি বাবার ব্যাটারি স্টোরেজের ব্যবসায় কাজ করে সপ্তাহে মাত্র ১৫ ডলার করে উপার্জন করছি। ১৯০৩ সালে আমার বড় ভাই জর্জ আমাকে ইয়াডাহোর স্ট্যানলি বেসিন কান্ট্রিতে সোনা উত্তোলন প্রজেক্টে একটা চাকরি নিয়ে দিলেন। ওখান থেকে সরিয়ে স্নেক রিভারে একই কাজে লাগিয়ে দিলেন আমার আরেক ভাই হেনরি। আমরা যখন ওয়্যাগনে চড়ে সেখানে হাজির হলাম, তখন সাথে ছিল একটা কুকুর আর মাত্র ৪০ ডলার। নতুন এক জায়গায় গিয়ে থিতু হওয়ার জন্য ৪০ ডলার তো কিছুই নয়। তাই আমি পোকার খেলার কথা চিন্তা করি। প্রতি রাতে পোকার খেলে আমি কয়েক শ’ ডলার করে মূলধন যোগাচ্ছিলাম।
যা-ই হোক, সেই প্রজেক্ট বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত আমি সেখানে কাজ করেছি। তারপর আমার ভাই সল্ট লেক সিটিতে আমাকে রেইলরোডে পুলিশম্যানের চাকরি নিয়ে দিলেন। সে সময় দারিদ্র্যের করাল গ্রাসে নাকানি-চুবানি খাচ্ছিলাম আমরা। কিন্তু অহংকারের কারণে কারও কাছ থেকে সাহায্যও চাইতে পারছিলাম না। ঐ সময় আমার জুতোগুলো থেকে অর্ধেক জুতো বিক্রি করে দিয়েছিলাম আমি! পরবর্তীতে এই বিক্রির পরিমাণ আরও বেড়ে গেল। আমরা আমাদের যাবতীয় আসবাবপত্র নিলামে তুললাম। সফলতার সাথে নগদ অর্থে সেগুলো বিক্রি করে আমরা ফার্স্ট ক্লাসে (!) চড়ে ফিরে গেলাম শিকাগোতে।
তারপর কয়েক মাস ভয়ংকর রকমের সব কাজ করলাম। যেমন: অফিস, ঘরবাড়িতে গিয়ে গিয়ে ইলেকট্রিক বাল্ব বিক্রি করা, দোকানে গিয়ে চকলেট বিক্রি এবং দ্বারে দ্বারে গিয়ে হকারি করা ইত্যাদি। এরপর একদিন একটা চাকরির বিজ্ঞাপন দেখলাম, যেখানে ‘অভিজ্ঞ হিসাব রক্ষক’ চাওয়া হয়েছে। ব্যর্থতায় জর্জরিত জীবন আমার। তাই সফল হওয়ার তাগিদে আমি হিসাব-নিকাশের উপর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকার পরও আবেদন করলাম এবং চাকরিটা পেয়েও গেলাম!
‘ভালো’ আর ‘খারাপ’ নির্ধারিত হয় কীভাবে? সেটা নির্ধারিত হয় ‘সফলতা’ ও ‘ব্যর্থতা’র উপর। সৌভাগ্যবশতঃ আমি যেখানে চাকরি পেয়েছিলাম সেখানকার মালিক হিসাব সম্পর্কে আমার চেয়েও কম জানতেন! অর্থাৎ আমি সফল! সেখানে কর্মরত অবস্থায় আমি আবিস্কার করলাম, মেইল-অর্ডার ব্যবসায় বেশ ভালো ভবিষ্যৎ আছে। এই সময়, আমার মেয়ে জোয়ান জন্ম নিল। ভালো চাকরি করার সুবাদে আমার মাথায় এলো, নিজেই একটা ব্যবসা করা যাক! ব্যবসাটা শুরু করার সময় আমার হাতে তেমন কোনো মূলধন ছিল না। ওদিকে মেইল-অর্ডার কোম্পানিতে আমাকে একটি চমৎকার পদ দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হলো। যদি আমি সেটি গ্রহণ করে নিতাম, তাহলে হয়তো ভালো বেতন পেয়ে নিরাপদে হেসে-খেলে পার করে দিতে পারতাম জীবনটা। বলে রাখা ভালো, তখনও পর্যন্ত আমি কিন্তু গ্রহণযোগ্য কিংবা অখাদ্য কোনো ধরনের গল্পই লেখার সুযোগ পাইনি।
যখন আমার সাধের ব্যবসা কোনো চিহ্ন না রেখেই রসাতলে গেল, তখন আমার অর্থনৈতিক অবস্থার আবার সেই করুণ দশা ফিরে এল। উপরন্তু জন্ম নিল আমার ছেলে হালবার্ট। আমার না আছে চাকরি, না আছে টাকা। মিসেস বারোজের গহনা আর আমার ঘড়ি বিক্রি করে খাবার কিনলাম। দারিদ্র্যে তখন আমি একদম নিমজ্জিত। সবকিছু শেষ হওয়ার ইঙ্গিত ছিল যেন। মান-সম্মান সব শেষ। এমনিতেই দরিদ্রতা খারাপ জিনিস, তার উপর আশাবিহীন দরিদ্রতা তো আরও জঘন্য।
যা-ই হোক, অতঃপর আমি আবার আরেকটি চাকরির বিজ্ঞাপনে সাড়া দিলাম। সেখানে আমি হলাম একজন এজেন্ট, কাজ পেন্সিল-শার্পনার বিক্রি করা! একটা অফিস ভাড়া নিয়ে সেখান থেকে শার্পনার বিক্রি করার ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলাম। আর তখনই আমি আমার প্রথম গল্পটি লিখি। লেখা শেষ করে সেটি বিক্রি করার চিন্তাটা মাথায় আসার যথেষ্ট কারণ ছিল। আমি কিছু ফিকশন ম্যাগাজিন পড়তাম। ভাবলাম, পাঠকরা যদি এসব ছাঁইপাশ মার্কা লেখা টাকা দিয়ে কিনে পড়ে, তাহলে আমি কিছু লিখলে সেটা নিশ্চয়ই ফেলনা হবে না! যদিও আমি কখনো গল্প লিখিনি, কিন্তু আমি জানতাম কীভাবে শুধু আনন্দ দেওয়ার জন্য লিখতে হয়, অন্ততপক্ষে ম্যাগাজিনে যেসব লেখা পড়েছি সেগুলোর চেয়ে ভাল গল্প কীভাবে লেখা যায়, সেটা বোধহয় জানতাম। তবে আমি কিন্তু গল্প লেখার তাত্ত্বিক কৌশল সম্পর্কে কিছুই জানতাম না, এমনকি লেখালেখির প্রায় ১৮ বছর পার করে এসে এখনও জানি না ! আমার সর্বশেষ উপন্যাস ‘টারজান দ্য লস্ট অ্যাম্পায়ার’ সহ মোট ৩১টি বই আমি এরকম না জেনেই লিখেছি!
আমি জীবনে কখনো কোনো সম্পাদকের সাথে দেখা করিনি বা কোনো প্রকাশকের সাথেও দেখা করিনি, চিনিও না কাউকে। একটা গল্প কীভাবে জমা দিতে হয়, পারিশ্রমিক কীভাবে নিতে হয়, এসব ব্যাপারে আমার কোনো ধারণা ছিল না। আমার গল্পটার প্রথম অর্ধেক পাঠানোর আগে এসবের কিছুই জানতাম না আমি। টমাস নিউওয়েল মিটকাফ, তিনি হলেন ‘অল স্টোরি’ ম্যাগাজিনের সম্পাদক। উনি আমাকে লিখলেন, গল্পের প্রথম অর্ধেক উনার পছন্দ হয়েছে, শেষ অর্ধেকও যদি এরকম হয় তাহলে ছাপানো যায় কিনা ভেবে দেখবেন। যদি তিনি সেদিন ঐটুকু উৎসাহ না দিতেন, তাহলে আমি হয়তো কোনোদিন গল্পটা শেষই করতে পারতাম না।
শুরুতে আমি কিন্তু ভালোবাসা থেকে লেখালেখি করিনি। আমি লেখালেখি করেছি আমার স্ত্রী এবং দুটো সন্তানের কথা ভেবে। অর্থ ছাড়া তাদের ভরণ-পোষণ করা কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। তো গল্পের বাকি অংশ লিখে শেষ করলাম। গল্পটির স্বত্ত্ব বিক্রির বিনিময়ে আমি পেলাম ৪০০ ডলার। সেই চেকটা ছিল আমার জীবনের এক অন্যতম বড় অর্জন! এখন তো অনেক বড় বড় চেক হাতে আসে, কিন্তু সেই ৪০০ ডলারের চেকটা আমাকে যে রোমাঞ্চর অনুভূতি দিয়েছিল, তা আর হয় না।
আমার প্রথম গল্পটির নাম ছিল ‘ডেজাহ থোরিস, প্রিন্স অব মার্স’, কিন্তু সম্পাদক সাহেব সেটাকে বদলে ‘আন্ডার দ্য মুনস অব মার্স’ নামে ছাপালেন। পরবর্তীতে এটি ‘প্রিন্সেস অব মার্স’ নামে বই হিসেবে বের হয়েছিল।
প্রথম গল্পের সফলতার পর আমি লেখালেখিকে ক্যারিয়ার হিসেবে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। এদিকে চাকরিটা ছেড়ে দেওয়ার মতো এখনও যথেষ্ট অর্থিক সচ্ছলতা অর্জন করতে পারিনি। কিন্তু চাকরির টাকা দিয়ে আমার দরিদ্রতাও দূর হচ্ছে না। শেষমেশ আশায় বুক বেঁধে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম, ফিকশন লিখে জীবিকা নির্বাহ করবো। তাই আপাতত একটা বিজনেস ম্যাগাজিনের ডিপার্টমেন্ট ম্যানেজারের চাকরি জুটিয়ে, সন্ধ্যায় আর ছুটির দিনগুলোতে লিখে ফেললাম ‘টারজান অব দি এইপস’। পুরো লেখাটা লিখেছিলাম পুরোনো বিদঘুটে কাগজে। আমার কাছে এটাকে খুব মানসম্মত গল্প বলে মনে হচ্ছিল না। এমনকি লেখাটি বিক্রি হবে কি হবে না, এই ব্যাপারেও সন্দিহান ছিলাম। কিন্তু বব ডেভিস এটিকে ম্যাগাজিনে ছাপানোর সম্ভাবনা দেখতে পেলেন। আমিও আরেকটা চেক পেয়ে গেলাম। এবারের চেকটা ৭০০ ডলারের!
এরপর লিখলাম ‘দ্য গডস অব মার্স’। সেটিও দ্রুত বিক্রি করে দিলাম ‘মুনসে কোম্পানি’র কাছে। ১৯১২-১৩ সালের ডিসেম্বর-জানুয়ারি মিলিয়ে লিখলাম ‘দ্য রিটার্ন অব টারজান’, সেটি পছন্দ না হওয়ায় মিটকাফ সাহেব বাতিল করে দিলেন। পরবর্তীতে ১৯১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ১,০০০ ডলারে ‘স্ট্রিট অ্যান্ড স্মিথ’ লেখাটি কিনে নেয়। যে মাসে লেখাটি প্রকাশিত হয়, সেই মাসেই আমাদের তৃতীয় সন্তান জন কোলম্যান জন্ম নেয়।
এবার আমি লেখালেখিতে উজাড় করে দিলাম নিজেকে। আমার উপার্জন নির্ভর করে ম্যাগাজিনের কাছে স্বত্ত্ব বিক্রির উপর। তখন আমি কোনো রয়্যালিটি পেতাম না। যদি এক মাস ম্যাগাজিন স্বত্ত্ব বিক্রি করতে ব্যর্থ হতাম, তাহলে আমি পরিবার নিয়ে হয়তো আবার জর্জরিত হয়ে যেতাম দারিদ্র্যে।
১৯১১ সাল থেকে ১৯১৩ সাল পর্যন্ত লেখালেখির জন্য আমি একটা গ্রাফ তৈরি করেছিলাম। লিখতে লিখতে দেখলাম বছর শেষে আমি ৪,১৩,০০০ শব্দ লিখে ফেলেছি! এরপর এমন একজন প্রকাশককে খুঁজতে শুরু করলাম, যিনি আমার লেখা কিছু বই আকারে বাজারে আনতে রাজি হবেন। কিন্তু আমি আশাহত হলাম। প্রতিষ্ঠিত সকল প্রকাশক (এ.সি. ম্যাক ক্লার্গ অ্যান্ড কো. সহ) আমার লেখা ‘টারজান অব দি এইপস’ ছাপার ব্যাপারে মুখ ফিরিয়ে নিল।
অবশেষে ‘দ্য নিউ ইয়র্ক ইভিনিং ওয়ার্ল্ড’ এর সম্পাদক জে.এইচ. ট্যানেন্ট তার পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে এটি ছাপাতে রাজি হলেন। এর ফলে বড় পরিসরে আমার লেখা প্রকাশিত হওয়ার সুযোগ পেল এবং একপর্যায়ে পাঠকদের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে দুই মলাটে বই আকারে সেটি প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেয় এ.সি. ম্যাক ক্লার্গ অ্যান্ড কোং! তারা আমার সাথে যোগাযোগ করে বইটি বের করার জন্য অনুমতি প্রার্থনা করে। অথচ এরাই কিনা একসময় আমার এই লেখাটিকে বাতিল বলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল!
এভাবেই ‘টারজান’-এর লেখক হিসেবে যাত্রা শুরু হয়েছিল আমার।