Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বিবি রাসেল: একজন ফ্যাশন ফেরিওয়ালা এবং শিল্পদূত

বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের একটি উন্নয়নশীল দেশে যেখানে নারী অধিকার এখনও সঠিকভাবে সকলের কাছে পৌঁছায়নি, সেখানে পুরুষদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নিজেকে বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করা এক বিশাল ব্যাপার। এদেশের সবক্ষেত্রে নারীরা সমান অবদান রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করলেও অনেকক্ষেত্রেই তা নানা বাধা-বিপত্তির কারণে সম্ভবপর হয় না। ৯০ এর দশকে হাতেগোনা কয়েকজনের কঠোর পরিশ্রমের ফলস্বরূপ আমাদের এই ছোট মাতৃভূমির নাম বিশ্বদরবারে হয়ে উঠে জাজ্বল্যমান। দেশে-বিদেশে সমানভাবে নিজেদের কৃতিত্ব প্রমাণের খাতায় অগ্রজ হিসেবেই নাম লেখান আমাদের সবার পরিচিত বিবি রাসেল। তিনি বিশ্বব্যাপী নিজেকে যেমন নিয়ে গিয়েছেন খ্যাতির শিখরে, তেমনি বাংলাদেশকেও বসিয়েছেন সম্মানের আসনে।

বিবি রাসেল; Image Source: Mysuru Today

বাংলাদেশ পোশাকশিল্পে উন্নতি করে চলেছে সেই দু’হাজারের পর থেকেই। ২০০২ সাল থেকে দেশের অর্থনীতি ব্যাপকভাবে এই পোশাকশিল্পের উপর নির্ভরশীল। কেবলমাত্র পোশাক তৈরি নয়, ডিজাইনের ক্ষেত্রেও এই অগ্রযাত্রা সমানভাবে প্রযোজ্য। আর এই ডিজাইনের ক্ষেত্রে এক অনন্য উচ্চতায় আসীন বিবি রাসেল।

বিবি রাসেল ১৯৫০ সালে চট্টগ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। মো: মোখলেসুর রহমান এবং শামসুন নাহারের পাঁচ সন্তান-সন্ততির মধ্যে তিনি তৃতীয়। ছোটবেলায় কামরুন্নেসা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। এরপর ঢাকার আজিমপুরে গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজে অধ্যয়ন করেন এবং সবশেষে লন্ডনের কলেজ অভ ফ্যাশন অ্যান্ড ডিজাইন থেকে পড়াশোনা শেষ করেন। পরবর্তী পাঁচ বছর তিনি বিভিন্ন নামকরা ম্যাগাজিনের টপ মডেল ছিলেন, যার মধ্যে ভোগ, কসমোপলিটন উল্লেখ্য।

১৯৯৪ সাল পর্যন্ত তিনি নামকরা বিদেশি ডিজাইনার, যেমন- আরমানি, সেইন্ট লরেন্ট, কোকো শ্যানেল, কেঞ্জো- এদের সাথে ফ্যাশন শোতে কাজ করেন এবং সেই বছরই দেশে এসে তিনি ‘বিবি প্রোডাকশন’ নামে নিজস্ব ব্র্যান্ড চালু করেন। তার এই ফ্যাশন হাউজের মূল লক্ষ্য ছিল দেশের একদম নিজস্ব সংস্কৃতিকে পৃথিবীর বুকে তুলে ধরা। ২০০৪ সালের মধ্যে তিনি প্রায় ৩৫,০০০ গ্রামীণ পোশাকশিল্পীকে নিজের সাথে যুক্ত করতে সক্ষম হন।

গামছাশিল্প নিয়ে কথা বলা এক সাক্ষাৎকারে বিবি রাসেল; Image source: Prothomalo.com

বিবি রাসেল ছোটবেলা থেকেই নিজের স্বপ্নপূরণের জন্য বাবা-মায়ের সাহায্য পেয়েছেন। মা তার জন্য যে কাপড় সেলাই করতেন, তা তার ঠিক পছন্দ ছিল না। ১০ বছর বয়সে বাবা তার জন্য একটি সেলাই মেশিন কিনে আনেন, যেটিতে তিনি নিজের পছন্দমতো কাপড় সেলাই করতেন, কখনো বা রান্নাঘরের হলুদ কাজে লাগিয়ে কাপড়ে রঙ ফুটিয়ে তুলতেন। ১৬ বছর বয়সে একদিন তার বাবা ইন্টারন্যাশনাল ডিজাইনার কোকো শ্যানেলের করা একটি ম্যাগাজিন নিয়ে আসেন, যেটা দেখে তার ফ্যাশন ডিজাইনার হওয়ার ইচ্ছা তিনি তার বাবাকে জানান।

বিবি রাসেল ১৯৭২ সালে লন্ডন কলেজ অভ ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে যোগ দিতে যান। ক্লাস শুরুর ছ’মাস আগেই তিনি চলে যান, কিন্তু ইংরেজি পাঠ্যক্রমের কোনো সার্টিফিকেট না থাকায় তিনি ভর্তির জন্য অনুপযুক্ত ছিলেন। প্রতিদিন তিনি অফিসে ফোন দিতে থাকলেন এবং একসময় তিনিসহ আরো কয়েকজন প্রার্থীকে সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকা হয়। তিনি সেদিন বাংলাদেশের পোশাক, ডিজাইন, ফ্যাশন নিয়ে করা মৌলিক কিছু প্রশ্নের উত্তর দেন; যদিও প্রাতিষ্ঠানিক ধারণা না থাকায় কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে ব্যর্থ হন। এসময় তাকে অতিরিক্ত ক্লাসগুলোতে অংশ নেয়ার শর্তে ভর্তি হবার সুযোগ দেয়া হয়।

লন্ডনে পড়া অবস্থায় তাকে প্রতিদিন ভোর চারটার দিকে উঠে প্রস্তুতি নিতে হতো সারাদিনের, অতিরিক্ত ক্লাস করে রাতে ফিরতেন। তাকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য চিঠি বিলির কাজও করতে হয়, এসব তিনি দেশে তার বাবা-মাকে কখনোই জানাননি।

ফ্যাশন শো নির্দেশনায় বিবি; Image source: Hifipublic.com

১৯৭৫ সালে গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পর বিবিকে তার প্রফেসর, বিখ্যাত মডেল এজেন্ট ল্যারেইন এশটনের সাথে মডেলিংয়ে কাজ করার পরামর্শ দেন। মডেলিংয়ের কোনো ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও ফ্যাশনজগত সম্পর্কে ভালোভাবে জানার জন্য তিনি কাজ করতে আগ্রহী হন। প্রথম মডেলিং ছিল ইতালীয় ডিজাইনার ভ্যালেন্তিনোর সাথে এবং তিনি সর্বপ্রথম হার্পার্স বাজারের জন্য মডেলিং করেন। একই সময়ে তিনি অন্যান্য নামিদামি মডেলের সাথে র‍্যাম্পে অংশ নিতে থাকেন।

৫ ফুট ১০ ইঞ্চি উচ্চতার এই মডেল অল্প ক’দিনের মধ্যেই তার কাজের প্রতি আগ্রহ এবং বুদ্ধিদীপ্ততার জন্য পরিচিত হয়ে যান। তামাটে রঙ, লম্বা চুল, আর প্রাচ্যের সংস্কৃতির মিশ্রণে তিনি সেসময়ে বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কাজ করেন। এর মধ্যে টয়োটা, জাগুয়ারের জন্য করা মডেলিং ছিল অন্যতম। সবকিছুর পরেও যেকোনো নতুন কাজের জন্য তার আগ্রহ ছিল অপরিসীম এবং নিত্যনতুনভাবে নিজেকে আবিষ্কারের নেশা ছিল তার। একবার একটি শ্যাম্পুর মডেলিংয়ের জন্য সুইমিংপুলে উঁচু জাম্পবোর্ড থেকে লাফ দিতে হয়। এরকম কাজ আগে না হওয়ায় তাকে টানা ১০ দিন অনুশীলনের মধ্য দিয়েও যেতে হয়।

লন্ডনে বাংলাদেশী ফ্যাশন উইক; Image source: East London News

ক্যারিয়ারে প্রথম থেকেই বিবির ইচ্ছা ছিল, বাংলাদেশের পোশাক শিল্প এবং ফ্যাশন নিয়ে কাজ করবেন। এ ব্যাপারে সহকর্মীদের জানালে তারা ব্যাপারটাকে একরকম উড়িয়ে দেন এবং তাকে সেখানেই মডেলিং আর অভিনয়ে মন দিতে বলেন। কিন্তু বিবি তার ইচ্ছায় অটল ছিলেন। ১৯৯৪ সালে তিনি দেশে আসেন। দেশে ফিরে তিনি তার বাবা-মাকে তার ইচ্ছার কথা জানান এবং লোকজনের নানা কটূক্তিসত্ত্বেও তারা বিবিকে সাহায্য করেন। প্রায় দেড় বছর তিনি দেশের প্রতিটি আনাচে-কানাচে ঘোরেন এবং হস্তশিল্পীদের সাথে কথাবার্তা বলেন। তখনও তারা কেউই বিশ্বাস করতে চাননি; কেননা তাদের ধারণা ছিল, বিবিও হয়তো কিছু সংবাদকর্মীর মতোই নেহাত বুলি খরচ করে চলেছেন।

কিন্তু প্রায় দেড় বছর দেশের আনাচে-কানাচে সব পোশাক-শিল্পীর সাথে কথা বলে তিনি তাদের বিশ্বাস অর্জন করেন এবং নিজের কাজ শুরু করেন। সেই শুরুর পর থেকে কখনও পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। প্রায় একা হাতেই সামলে যাচ্ছেন নিজের বিবি প্রোডাকশন। অর্জন করেছেন দেশ-বিদেশের অসংখ্য সম্মাননা এবং স্বীকৃতি। কখনো বাংলা একাডেমির ‘সম্মানিত ফেলো’, কখনো হয়তো এল ম্যাগাজিনের ‘বর্ষসেরা নারী’। ২০১০ সালের সেরা চলচ্চিত্র ‘মনের মানুষ’-এর পোশাক পরিকল্পনাকারী হিসেবে জাতীয় পুরস্কারও জিতে নেন তিনি। ২০১৫ সালে নারী জাগরণ, আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার বিবি রাসেলকে বেগম রোকেয়া পদকে ভূষিত করেন।

কলকাতার এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার নিচ্ছেন বিবি রাসেল; Image source: Telegraph India

“আমি মনে করি ফ্যাশন কোনো শ্রেণীর জন্য নয়, বরং ফ্যাশন সবার জন্য”

এমনই বলিষ্ঠ উত্তর দিয়ে গেছেন বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে বিবি রাসেল। তাঁতিদের বাঁচানোর জন্য, তাদের পরিবারকে বাঁচানোর জন্য বিদেশে উজ্জ্বল ক্যারিয়ার ছেড়ে চলে আসেন তিনি। কেবলমাত্র পুরস্কার দিয়ে অর্জন মাপেন না তিনি, বরং দেশীয় সংস্কৃতিকে সাথে নিয়ে দেশের মানুষের জন্য এগিয়ে যেতে চান এই শিল্পী।

Related Articles