
ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি, “একবার না পারিলে দেখ শতবার”। মাঝে মাঝে কালীপ্রসন্ন ঘোষের উপর খুব রাগ হয়। উনি লিখে গেছেন বলেই না বাবা-মা’র কাছে সব সময় শুনে আসতে হয়েছে এই উপদেশবাণী। আবার মাঝে মাঝে মনে হয়, কোনো কাজ একশবার করার মতো ধৈর্য ও চেষ্টা যদি কারও থেকে থাকে, সফলতা যে তার পরিণাম, তা অবশ্যম্ভাবী। ছেলেবেলা থেকেই কবিতাটি পড়ে এসেছি কেবল, কখনো এর বাস্তবতার নিরিখে দেখা হয় নি। কিন্তু আজও যখন কিছু মানুষের সফল হওয়ার গল্প শুনি, তখনই মনে হয় ভুল তো নয়! চাইলেই তো সব পাওয়া যায়। শুধুমাত্র চাওয়ার পিছে একাগ্রতা আর সত্যি করে পাবার আকাঙ্ক্ষা চাই। আর তেমনি একজনের গল্প বলতে যাচ্ছি আজ, যা আমাদের জীবন সম্পর্কে ধারণাটাই হয়তো বদলে দিবে।

সফলতার সিঁড়ি; Image Source: www.theimpactnews.com
গুলশান শুটিং কমপ্লেক্স হয়ে গুলশান-১ যাওয়ার পথে অথবা ধানমন্ডির সাত মসজিদ রোড ধরে যে লাল রঙের বিল্ডিং সকলের নজর কাড়ে তা যে কে.এফ.সি সেটা তো সবার জানা। শুধু এর ফ্রাইড চিকেনের জন্যই নয়, পাশে লোগো আকারে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটিও আমাদের সকলের কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দু সবসময়। সেই হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে তার মহান কীর্তি, ফ্রাইড চিকেন রেসিপি।

KFC Image Source: www.bakerconstruct.com
বুড়ো বয়সে ভিমরতি বলে একটা কথা প্রচলিত রয়েছে আমাদের সমাজে। চাকরি শেষ, অবসর সময় মানে চুপচাপ ঘরে বসে থাকা আর মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া কিছু যেন চাওয়া পাওয়া নেই। অধিকাংশ লোকেরই এমন ভাবনা অবাক করা নয়। কিন্তু তার মধ্যে ব্যতিক্রম যে কেউ নেই তা কিন্তু নয়। তেমনি এক সংগ্রামী, উদ্যমী এবং সফল উদ্যোক্তা হারল্যান্ড স্যান্ডারস। ৬৫ বছর বয়সে তার জীবনের মোড় পাল্টে যায় এক অদ্ভুত নাটকীয় ঘটনায়।

কর্নেল সেন্ডারস। Image Source: www.theverge.com
১৮৯০ সালে জন্ম আমেরিকার ‘ইন্ডিয়ানা’ স্টেটে। আর বাড়িটা ছিল ইন্ডিয়ানার হেনরিভ্যালি থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে। মাত্র ছয় বছর বয়সে পিতাকে হারানোর পর যেন সংসারের সকল চাপ নিজের কাঁধের উপর উঠে আসে। যখন তার মা বাইরে কাজ করতে যেতেন, স্যান্ডারসকে তার ছোট ভাই ও বোনটিকে দেখে শুনে রাখতে হত। মাত্র সাত বছর বয়সেই বেশ ভাল রান্না শিখে গিয়েছিলেন তিনি। কারণ ছোট ভাই-বোনের খাওয়ার দায়িত্ব তো ছিল তার কাঁধেই।

কিশোর বয়সে স্যান্ডারস Image Source: www.pinterest.com
১২ বছর বয়সে তার মা নতুন বিয়ে করলে সৎ বাবার আশ্রয়ে খুব বেশিদিন কাটাতে পারেননি তিনি। পরবর্তীতে একটা ফার্ম হাউজে কাজ নিয়ে চলে আসেন অনেকটা দূরে। পড়াশোনাও খুব বেশিদিন চালিয়ে যেতে পারলেন না। এর পর থেকে শুরু হয় তার প্রতিকূল পথচলা। অনেক চড়াই উৎরায় পাড় করে চলে তার জীবন।

ব্যবসায়িক মিটিং-এ স্যান্ডারস. Image Source: www.thenewindian.in
কখনো ক্ষেতমজুর, ট্রেনের ফায়ারম্যান, কখনোবা বিমা কোম্পানির সেলসম্যান, গাড়ির টায়ার বিক্রেতা, ফিলিং স্টেশনের কর্মচারী এবং সর্বশেষ একজন রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ী। ১৯৩০ সালের দিকে স্যান্ডারস কেন্টাকিতে একটি পেট্রোল স্টেশনের পাশে বিভিন্ন ধরনের খাদ্য বিক্রয় করতে লাগলেন। নিজেই রান্না করে বিভিন্ন সাউথ আমেরিকান খাওয়ার পরিবেশন করতেন। ধীরে ধীরে খাবারের খ্যাতি আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ে।
ধীরে ধীরে জায়গাটিকে পুরো রেস্টুরেন্টে রূপ দেন। তার প্রথম সফলতা আসে যখন ১৯৩৯ সালের দিকে তার সিগনেচার রান্না নতুনভাবে সকলের সামনে উপস্থাপন করেন। তিনি নিজেই একটি এমন প্রেসার কুকার তৈরি করে নেন যা ছিল প্রচলিতগুলোর চেয়ে আলাদা। কিন্তু এই প্রেসার কুকারে ফ্রাইড চিকেনের টেক্সচার বা মচমচে ভাবটা খুব ভালভাবেই আসে।

নতুন প্রেসার কুকারে রান্না শিখাচ্ছেন স্যান্ডারস; Image Source: www.entrepreneur.com
এর পরের দশ বছর বেশ ভালভাবেই কাটে স্যান্ডারসের। ১৯৫০ সালে কেন্টাকির গভর্ণর তাকে ‘কর্নেল’ উপাধি দেন যা একটি স্টেটের পক্ষে ছিল সর্বোচ্চ সম্মান। এরপর সেন্ডারস নিজের আইকনিক লুকের জন্য সাদা স্যুট এবং কেন্টাকি কর্নেল টাই পরিহিত হয়ে সবার সামনে ধরা দেন। আর এই পোশাকই তাকে আধুনিক যুব সমাজে অন্যতম আইকন হিসেবে জাহির করে।

চুক্তিবদ্ধ অবস্থায় স্যান্ডারস; Image Source: www.123rf.com
১৯৫২ সালের দিকে তার এই ব্যবসা নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করেন স্যান্ডারস। তার এক ব্যবসায়িক বন্ধু পিট হারমেনের সাথে চুক্তি করেন যে তার তৈরি “Kentucky Fried Chicken” এর প্রতিটি মূল্যের সাথে রয়্যালটি হিসেবে চার সেন্ট করে পাবেন। এই চুক্তির ব্যাপক সাফল্যের পর সেন্ডারস আরও কিছু রেস্টুরেন্টের সাথে অনুরূপ চুক্তি করেন। সবকিছু বেশ ভালভাবেই চলছিল। কিন্তু হঠাৎ সরকারি জায়গা অধিগ্রহণের বেড়াজালে পড়ে বিশাল ক্ষতিতে বিক্রয় করতে বাধ্য হন তার রেস্টুরেন্ট। হাতে পড়ে থাকে শুধুমাত্র ১০৫ ডলারের সিকিউরিটি চেকের অর্থ।

রেস্টুরেন্টে নিজের বানানো রেসিপির চিকেন ফ্রাই দেখাচ্ছেন স্যান্ডারস. Image Source: www.tsadakay.com
কিন্তু স্যান্ডারস হার মেনে নেয়ার পাত্র নন। তার চার বছর আগে ফেলে আসা ব্যবসায়িক চিন্তাকে নতুন করে গড়ে তোলার জন্য বদ্ধ পরিকর হলেন। তার গাড়ি ভর্তি করে নিলেন প্রেসার কুকার, ময়দা, মুরগি, তার নিজের তৈরি রেসিপির অন্যান্য উপকরণ আর ঘুরতে লাগলেন রেস্টুরেন্ট থেকে রেস্টুরেন্ট। উদ্দেশ্য একটাই, যদি ভাল লেগে যায় তার রেসিপি, তাহলেই চুক্তিবদ্ধ হবেন।
কাজটা শুনতে যতটাই সহজ মনে হোক না কেন, বস্তুত ছিল অনেক কষ্টসাধ্য। অনেক রেস্টুরেন্টের দ্বারে দ্বারে যেতে হয়েছিল তার। কেউ শুনেই হাসি দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিল, কেউ বলেছিল পাগল, আবার কেউ রেসিপি পছন্দ করেও কোনো প্রকার চুক্তি করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। কিন্তু থেমে থাকেননি বদ্ধ পরিকর। চেষ্টা এক সময় সফলতায় রূপ নিল।

হাজার চেষ্টার পর আসে সফলতা; Image Source: www.awesomejelly.com
১৯৬৩ সাল পর্যন্ত তার চেষ্টায় প্রায় ৬০০টি রেস্টুরেন্টের সাথে চুক্তিবদ্ধ হতে পেরেছিলেন। সেই বছরই অক্টোবর মাসের দিকে ‘জেক সি মেসি’ নামে একজন ধনাঢ্য ব্যক্তির কাছ থেকে তার রেসিপির রয়্যালিটির অধিকার কিনে নেয়ার আবেদন পান।
শুরুর দিকে কোনো আগ্রহই দেখাননি বদ্ধ পরিকর। কিন্তু পরবর্তীতে চিন্তা করে দেখলেন, তার এই রেসিপি শুধুমাত্র পারিবারিক উত্তরাধিকার হিসেবে না রেখে পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে দিলে তার যশ আর খ্যাতি হয়ে থাকবে চিরন্তন। ১৯৬৫ সালের জানুয়ারি মাসে তার জগত ভোলানো রেসিপির অধিকারস্বত্ব দুই মিলিয়ন ডলারে বিক্রয় করেন তিনি।

KFC; Image Source: www.bakerconstruct.com
চুক্তিপত্র অনুযায়ী Kentucky Fried Chicken কোম্পানি হিসেবে পুরো বিশ্বে নিজস্ব রেস্টুরেন্ট খুলবে এবং রেসিপির ব্যাপারে কোনো প্রকার ছাড় দেয়া হবে না। স্যান্ডারস সারা জীবনের বেতন হিসেবে ৪০,০০০ ডলার পাবেন, অধিকাংশ শেয়ারের মালিক হবেন এবং কোম্পানির ব্র্যান্ড এম্বেসেডর হয়ে কোম্পানির প্রচারে অংশগ্রহণ করবেন।

হারলেন্ড স্যান্ডারসের জীবনদর্শন; Image Source: Goalhabits.com
১৯৮০ সালের তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত স্যান্ডারস ছুটে বেড়িয়েছে মাইলের পর মাইল তার হাতে গড়া রেসিপির কদর আর মান দেখার জন্য। কখনো গুণাগুণের ব্যাপারে সমঝোতা করেন নি। সব সময় চেয়েছেন নিজের তৈরি রেসিপি নিয়ে মানুষের মনে বেঁচে থাকতে। তার চাওয়া যে সফলভাবে পাওয়াতে পরিণত হয়েছে তা তো সময়ই প্রমাণ। তাই মন থেকে কিছু চেয়ে সঠিকভাবে লেগে থাকলে সফলতা আসবেই। নয়তো যে বয়সে সব হারানোর ব্যথায় নিজেকে লুকিয়ে রাখার কথা, সেই বয়সে নতুন উদ্দীপনায় নতুন কৌশলে নিজেকে জাহির করলেন অন্য এক মাত্রায় এই পৃথিবীর বুকে। তাই জীবনে কিছু করে দেখানোর জন্য বয়সকে আমলে না নিয়ে কি করে যেতে চাই সেটাতে জোর দেয়া উচিৎ, যা ছিল স্যান্ডারসের আদর্শ।