বিশটি গ্র্যান্ড স্ল্যাম, ২৪টি বছর প্রতিযোগিতামূলক টেনিসের চূঁড়ায় থাকা, হাজারও রেকর্ডের অধিকারী, দুর্দান্ত ব্যক্তিত্ব, টেনিস কোর্টে অনবদ্য কিছু গল্প, অসামান্য সব স্মৃতি, শক্তিশালী ব্যাকহ্যান্ড, কিংবা একাধিপত্যের রাজত্ব… এসব ছাড়িয়ে রজার ফেদেরার কবে যেন হয়ে উঠেছেন টেনিস নামের এক খেলার প্রতিশব্দ। অনেকদিন ধরেই শরীরটা আর সায় দিচ্ছিল না তেমন; ঘোষণাটা যেকোনো মুহূর্তে চলে আসতে পারে, সেটাও বোঝা যাচ্ছিল। অবশেষে সেই ঘোষণা চলেই এলো। এক চিঠির মাধ্যমে ঘোষণা করলেন, আগামী সপ্তাহে লন্ডনে অনুষ্ঠিতব্য লেভার কাপই হবে তার শেষ এটিপি ইভেন্ট। চলুন দেখে নেওয়া যাক তার চিঠিটার ভাষান্তর।
সুইজারল্যান্ড, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২।
আমার টেনিস পরিবার এবং অন্যান্য সকলে,
এত বছর টেনিস খেলার পরে, টেনিসের কাছ থেকে আমি যে সেরা উপহারটা পেয়েছি, সেটা হলো আমার চারপাশের মানুষজন। আমার বন্ধু, প্রতিদ্বন্দ্বী, এবং যারা খেলাটার আসল প্রাণ, সেই সমর্থকেরা, আজ আমি আপনাদের উদ্দেশ্যে কিছু কথা বলতে চাই।
আপনারা অনেকেই জানেন, বিগত তিন বছরে আমাকে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছে। একটার পর একটা চোটে পড়েছি, বারবার অস্ত্রোপচারের টেবিলে যেতে হয়েছে আমাকে। নিজের সেরা অবস্থায় ফেরার জন্য আমি কঠোর পরিশ্রমও করেছি। কিন্তু আমি আমার শরীরের সীমাবদ্ধতাটা জানি। আমি জানি, আমার শরীর কোন সীমারেখা পর্যন্ত ধকল সইতে পারবে। এখন আমার বয়স একচল্লিশ; আমি গত চব্বিশ বছরে ১,৫০০-র বেশি ম্যাচ খেলেছি। টেনিস থেকে আমি যা পেয়েছি, তা আমি কখনো কল্পনাও করতে পারতাম না। আর প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক টেনিসকে বিদায় বলার সঠিক মুহূর্তটাও আমাকেই বেছে নিতে হবে।
আগামী সপ্তাহে লন্ডনে অনুষ্ঠিতব্য লেভার কাপই হবে আমার শেষ এটিপি ইভেন্ট। আমি ভবিষ্যতেও অবশ্যই টেনিস খেলব, কিন্তু গ্র্যান্ড স্ল্যাম বা ট্যুরে খেলার ইতি এখানেই।
এই সিদ্ধান্তটা আমার জন্য অম্লমধুর। আমি অবশ্যই প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক টেনিসকে মিস করব, কিন্তু পাশাপাশি আমি এই সিদ্ধান্তটাকে উদযাপনও করব। আমি নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবানদের একজন বলে মনে করি, কেননা টেনিস খেলার জন্য বিশেষ প্রতিভা ছিল আমার। আমি সেই প্রতিভাটাকে যেভাবে এবং যত সময় ধরে কাজে লাগাতে পেরেছি, সেটা আমার জন্য ছিল অকল্পনীয়।
আমি বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানাতে চাই আমার স্ত্রী মির্কাকে, যে প্রতিটা মুহূর্তে আমার পাশে ছিল। প্রতিটা ফাইনালের আগে সে আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছে, আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায়ও সে অগণিত ম্যাচ দেখেছে, আর বিশ বছর ধরে আমার রসিকতাগুলো সহ্য করেছে।
পাশাপাশি আমি ধন্যবাদ জানতে চাই আমার চারজন সন্তানকে, যারা সবসময় আমাকে সমর্থন জুগিয়েছে, নতুন নতুন জায়গায় বেড়ানোর আগ্রহ পোষণ করেছে, এবং অসাধারণ সব স্মৃতি তৈরি করেছে। আর দর্শকসারিতে আমার পরিবারকে উল্লাস করতে দেখার অনুভূতিটা সবসময়েই থাকবে আমার হৃদয়ের মণিকোঠায়।
আমি আমার পিতামাতাকে ধন্যবাদ জানাতে চাই, ধন্যবাদ জানাতে চাই আমার বোনকেও, যাদের ছাড়া আসলে কোনো কিছুই সম্ভব হতো না। যারা আমাকে সবসময় সঠিক পথের সন্ধান পেতে সাহায্য করেছেন, আমার পূর্বের সেই সকল কোচকে ধন্যবাদ জানাই। সুইস টেনিস, যারা তরুণ ফেদেরারের ওপর ভরসা রেখেছিলেন, তাদেরও ধন্যবাদ জানাতে চাই আমাকে একটা সুন্দর শুরু পেতে সাহায্য করার জন্য।
আমি আমার টিমকেও ধন্যবাদ জানাতে চাই। ইভান, ড্যানি, রোল্যান্ড, এবং বিশেষ করে স্যাভে এবং পিয়ের, যারা সবসময় সঠিক পরামর্শ দিয়ে আমার পাশে থেকেছে। আমার সকল ব্যবসায়িক কাজগুলো সতেরো বছর ধরে দেখাশোনা করার জন্য টনিকে ধন্যবাদ। তোমাদের প্রত্যেকের সাথে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত আমি ভীষণভাবে উপভোগ করেছি।
আমি আমার পৃষ্ঠপোষকদের ধন্যবাদ জানাতে চাই। আমি আরো ধন্যবাদ জানাতে চাই এটিপি ট্যুরের সকল টুর্নামেন্ট ও দলকে, যারা আমাদের সকলকে আন্তরিকভাবে স্বাগত জানিয়েছিলেন।
কোর্টের সকল প্রতিদ্বন্দ্বীর প্রতিও আমার কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই। কোর্টে অনেকগুলো মহাকাব্যিক ম্যাচের সাক্ষী হতে পেরে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছি। আমরা প্রত্যেকবারই তীব্র আবেগ নিয়ে কঠিনভাবে কোর্টে লড়েছি, এবং আমি সবসময়েই খেলাটার ইতিহাসের প্রতি যথাযথ সম্মান বজায়ে রাখার চেষ্টা করেছি। আমরা একে অপরকে উদ্বুদ্ধ করেছি, এবং আমরা একসাথে টেনিসকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছি। এজন্য আমি সবার প্রতি খুবই কৃতজ্ঞ।
আর সর্বোপরি, আমি বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানাতে চাই আপনাদের, আমার অবিশ্বাস্য সমর্থকদের। আমি হয়তো কখনোই ঠিক বুঝাতে পারব না, আপনারা আমাকে প্রতিনিয়ত কতখানি শক্তি আর বিশ্বাস জুগিয়ে গেছেন। প্রত্যেকবার ভরা স্টেডিয়ামে হেঁটে যাওয়ার যে অনুভূতি, সেটার তুলনায় রোমাঞ্চকর অনুভূতি আমার জীবনে খুব কমই এসেছে। আপনাদের উপস্থিতি না থাকলে সাফল্যপ্রাপ্তির মুহূর্তে নিজেকে আনন্দিত আর উজ্জীবিত মনে হওয়ার বদলে ভুগতাম একাকীত্বে।
গত চব্বিশটা বছর আমার জন্য ছিল একটা অবিশ্বাস্য অভিযানের মতো। কখনো মনে হয় মাত্র চব্বিশ ঘণ্টা সময় পেরিয়েছে হয়তো, আবার কখনো মনে হয় একটা পুরো জীবনই কি কেটে গেল? আমার সৌভাগ্য যে আমি চল্লিশটার বেশি দেশে আপনাদের সামনে খেলতে পেরেছি। কখনো আনন্দে হেসেছি, কখনো বেদনায় কেঁদেছি, কিন্তু পুরো সময়টাই আমি দারুণভাবে উপভোগ করেছি। আমার দীর্ঘ ভ্রমণে আমি অনেক অসাধারণ মানুষের সাক্ষাৎ পেয়েছি, যাদের অনেকেই এখন আমার প্রিয় বন্ধু। অনেকেই তাদের ব্যস্ত জীবন থেকে কিছু সময় বের করে আমার খেলা দেখতে এসেছিলেন। আপনাদের প্রত্যেককে ধন্যবাদ।
টেনিসের প্রতি আমার ভালোবাসা যখন শুরু হয়, আমি তখন আমার শহর বাসেলের একজন বলবয়। আমি মুগ্ধ হয়ে খেলোয়াড়দের দেখতাম, আমার টেনিসস্বপ্নে তারাই ছিলেন নায়ক। আমার স্বপ্নই আমাকে টেনে নিয়ে গেছে কঠোর পরিশ্রমে, আমার মধ্যে জন্ম দিয়েছে আত্মবিশ্বাসের। এরপর কিছু সাফল্যে সেই আত্মবিশ্বাস বেড়েছে বহুগুণে, আর আমিও পা বাড়িয়েছি আমার জীবনের সম্ভাব্য সবচেয়ে আকর্ষণীয় ভ্রমণের পথে।
তো, সবাইকে আমি আমার হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। এই পৃথিবীর প্রত্যেককে, যারা সুইজারল্যান্ডের ছোট্ট বলবয় ফেদেরারের স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করতে সাহায্য করেছেন।
আর সবশেষে, প্রিয় টেনিস, আমি তোমাকে ভালোবাসি। আর আমি তোমাকে ছেড়ে যাচ্ছি না কখনোই।
রজার ফেদেরার।