আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে পণ্য পরিবহনে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয় সমুদ্রপথ। বিশ্বের প্রায় ৮০% বাণিজ্য সমুদ্রপথেই হয়ে থাকে। বহু আগে থেকেই মানুষ সমুদ্র পাড়ি দিয়ে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাতায়াত করছে। এক দেশ থেকে অন্য দেশে পণ্য আনা-নেওয়া বা বাণিজ্য করা ও সাম্রাজ্য বিস্তারের উদ্দেশে মানুষ সমুদ্রপথ ব্যবহার করত। এছাড়া, বর্তমান বিশ্বে বিভিন্ন দেশের মাঝে বাণিজ্যের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই যোগাযোগের জন্য সমুদ্রপথের গুরুত্ব আগের চেয়ে অনেক বেশি।
এশিয়া এবং ইউরোপ মহাদেশের মধ্যে বাণিজ্য ব্যবস্থার জন্য সুপরিচিত পথ ছিল উত্তমাশা অন্তরীপ পথ বা কেপ অব গুড হোপ। বহুকাল আগে থেকেই বিভিন্ন নাবিক ও অভিযাত্রী এই সমুদ্রপথটি ব্যবহার করে ইউরোপ থেকে এশিয়ায় এসেছেন। তবে এই পথ দিয়ে যাত্রা যেমন ছিল সময়সাপেক্ষ, তেমনই বিপজ্জনক। কারণ, এই পথ দিয়ে আসতে হলে জাহাজগুলোকে সমগ্র আফ্রিকার উপকূল ঘুরে আসতে হতো। আফ্রিকার একেবারে দক্ষিণে, অর্থাৎ বর্তমান দক্ষিণ আফ্রিকা দিয়ে আসতে হতো বলে এই পথের জাহাজগুলোকে অনেক প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হতে হতো।
এই সমস্যার সমাধান হিসেবে এশিয়া ও আফ্রিকার সংকীর্ণ সংযোগস্থলে একটি খাল খনন করা হয়, যার অবস্থান বর্তমান মিশরে। ১৮৬৯ সালে চালু হওয়া এই খালের নাম সুয়েজ খাল। এটি ভূমধ্যসাগরকে লোহিত সাগরের সাথে সংযুক্ত করে। ফলে যাত্রার সময় যেমন কমে এসেছে, তেমনি বাণিজ্যের প্রসারও হয়েছে উল্লেখযোগ্য হারে।
এশিয়া থেকে ইউরোপে বাণিজ্য যাত্রার আরো একটি পথ রয়েছে। তবে বছরের বেশিরভাগ সময় বরফাবৃত থাকার কারণে এই পথে জাহাজ চলাচল অনুকূল নয়। বলছি আর্কটিক বা উত্তর মহাসাগরের কথা। কিন্তু বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উত্তর মেরুর বরফ খুব দ্রুত গলছে, যার কারণে এই পথটি আগের মতো অধিক সময় বরফাবৃত থাকছে না। ফলে এই পথে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য প্রসারের সুযোগ উঁকি দিচ্ছে।
সমগ্র রাশিয়ার সীমান্ত জুড়ে অবস্থিত এই সমুদ্রপথের নাম উত্তর সাগর সমুদ্রপথ বা নর্দান সি রুট (Northern Sea Route)। রাশিয়া ও আলাস্কার মাঝে অবস্থিত পথ যা বেরিং প্রণালী নামে পরিচিত, সেটি এই সমুদ্রপথে প্রবেশ করার অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জাহাজ চলাচলের জন্য এটি সুয়েজ খালের বিকল্প হয়ে উঠছে। বেরিং প্রণালী হয়ে উত্তর সাগর সমুদ্রপথের বাণিজ্য সম্পর্কে আজকের এই লেখাটি জলবায়ু পরিবর্তনে বিশ্ব বাণিজ্যের গতিশীলতা ও পরিবর্তন, আর্কটিক অঞ্চলে রাশিয়ার প্রাকৃতিক সম্পদের বিকাশ ও জ্বালানী সাশ্রয়, এবং চীন, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের বাণিজ্যের উত্থান সম্পর্কে আলোকপাত করবে।
এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে যাতায়াতের জন্য ১৯৩ কিলোমিটার দীর্ঘ সুয়েজ খাল একটি অপরিহার্য বাণিজ্যপথ হিসেবে বিবেচিত। খালটি হাইড্রোকার্বন, বিশেষ করে খনিজ তেল ও গ্যাস পরিবহনের জন্য প্রধান বাণিজ্যপথ হিসেবে কাজ করে, যা মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়। ব্রিটিশ শিপিং ডেইলি ‘লয়েডস লিস্ট’ এর হিসেব অনুযায়ী, প্রতিদিন প্রায় ৮ বিলিয়ন ইউরোর বেশি পণ্য সুয়েজ খাল দিয়ে যায়, আর টোল হিসেবে ১৩ মিলিয়ন ইউরো পরিশোধ করে। এই হিসেবে বার্ষিক টোলের পরিমাণ প্রায় ৪.৮ বিলিয়ন ইউরো।
তবে, সম্প্রতি ৪০০ মিটার লম্বা ‘এভার গিভেন’ জাহাজ সুয়েজ খালে আটকা পড়ার ফলে এই পথে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বেশ কিছুটা ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এই ঘটনা সুয়েজ খালের দুর্বলতা প্রকাশ করেছে, ফলে বিকল্প বাণিজ্যিক সমুদ্রপথগুলোর আলোচনা আবারও আলোচনায় উঠে আসে।
জাহাজের জ্বালানি ও অন্যান্য খরচ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা বিকল্প অথচ স্বল্প দূরত্বের সমুদ্রপথে যাত্রার জন্য সুযোগ সৃষ্টি করে। সুয়েজ খালের সীমাবদ্ধতার কারণে বেরিং প্রণালী হয়ে নর্দান সি রুটটি তাই অন্যতম বিকল্প হিসেবে দেখা হচ্ছে। এছাড়া, পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উত্তর মেরুর বরফ হ্রাস পাচ্ছে, যা আর্কটিক অঞ্চলের এই বাণিজ্যিক সমুদ্রপথটি পণ্য পরিবহনের জন্য একটি নতুন কৌশলগত সুযোগ হিসেবে ধরা দিয়েছে।
এশিয়া এবং ইউরোপের মধ্যে শর্টকাট পথ হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিত উত্তর সাগরের বাণিজ্য পথটি সুয়েজ খালের একটি অন্যতম বিকল্প হিসেবে কাজ করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিশ্বের ব্যস্ততম বাণিজ্যপথ সুয়েজ খাল দূর প্রাচ্যের দেশ ও অঞ্চলে পণ্য পরিবহনের জন্য ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এর বিকল্প বেরিং প্রণালী প্রশান্ত মহাসাগরকে উত্তর মহাসাগরের সাথে যুক্ত করেছে। উত্তর সাগর সমুদ্রপথটি ব্যবহার করতে হলে বেরিং হয়ে আর্কটিকে জাহাজগুলোকে চলাচল করতে হবে, যার ফলে এটি রাশিয়ার জন্য একচেটিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চল হয়ে উঠবে। যদিও এই বাণিজ্যপথটি বছরে মাত্র দুই মাসের জন্য বরফমুক্ত থাকে, তথাপি এটি রাশিয়ার তেল ও গ্যাস শিল্পকে একটি বড় সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে পারে।
অনুমান করা হয় যে, বেরিং প্রণালী হয়ে উত্তর সাগর বাণিজ্যপথটি ব্যবহার করলে উত্তর ইউরোপ থেকে চীনের দূরত্ব সুয়েজ খালের তুলনায় ৪০% কম হয়। এই পথ ব্যবহার করে একটি জাহাজ যদি ইউরোপ থেকে দক্ষিণ কোরিয়ার একটি বন্দরে যায়, সেটির যাত্রা সুয়েজ খালের তুলনায় ৩৮ দিন থেকে কমে মাত্র ১৯ দিনে নেমে আসতে পারে। দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ইংল্যান্ডে যাওয়ার ক্ষেত্রে সুয়েজ খালের তুলনায় এই পথে প্রায় ৪,০০০ নটিক্যাল মাইল কম দূরত্ব অতিক্রম করতে হয়। যেখানে জাপান থেকে ইউরোপে একটি সমুদ্রযাত্রার জন্য উত্তমাশা অন্তরীপের মাধ্যমে প্রায় ২৯ দিন এবং সুয়েজ খাল হয়ে ২২ দিন সময় লাগে, আর্কটিক মহাসাগরের মাধ্যমে এটি মাত্র ১০ দিন লাগবে। সুয়েজ খালের মধ্য দিয়ে গেলে প্রায় ২০,০০০ কিলোমিটার যেতে হয়, কিন্তু বেরিং প্রণালী হয়ে গেলে তা ৯,০০০ কিলোমিটারেরও কম দূরত্ব হয়।
উত্তর সাগর বাণিজ্যপথ ব্যবহার করার মাধ্যমে সুয়েজ খালের তুলনায় ৩০-৪০% কম জ্বালানি এবং সময় সাশ্রয় হয়। তাছাড়া এখানে জলদস্যুরও ঝুঁকি নেই। আরেকটি সুবিধা হলো- এই পথ দিয়ে যাওয়া জাহাজগুলো সুয়েজ খাল হয়ে যাওয়ার চেয়ে সংক্ষিপ্ত পথ অতিক্রম করে, ফলে অনেক কম দূষণ নির্গত হয়। এই কারণে ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন ডাইঅক্সাইড নির্গমন বছরে ১.২ মিলিয়ন টন হ্রাস করা যেতে পারে। এই পরিপ্রেক্ষিতে যখন আর্কটিক গ্রীষ্মকালে প্রায় বরফমুক্ত থাকে, তখন উত্তর সাগর বাণিজ্যপথ, এবং বছরের বাকি সময়ে সুয়েজ খাল ব্যবহার করার সুপারিশ করা হয়েছে। তবে পরিবেশগত ঝুঁকি এবং অধিক ব্যয় এই পথের বাণিজ্য নিয়ে উদ্বেগের একটি প্রধান কারণ।
নরওয়েভিত্তিক প্রতিষ্ঠান Det Norske Veritas (DNV) সম্প্রতি উত্তর সাগর বাণিজ্যপথের সম্ভাবনা নিয়ে একটি সমীক্ষা পরিচালনা করেছে। তারা দেখিয়েছে যে- চাহিদা বৃদ্ধির ফলে এই পথে ২০৩০ সাল নাগাদ ৫০০ এবং ২০৫০ সালের মধ্যে ৯০০ জাহাজের চলাচল বৃদ্ধি পাবে। কানাডিয়ান এবং আমেরিকান সামুদ্রিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০৩০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক শিপিংয়ের ২ শতাংশ আর্কটিকের মাধ্যমে হতে পারে, এবং তা ২০৫০ সালের মধ্যে ৫ শতাংশে পৌঁছে যাবে।
রাশিয়ান পারমাণবিক সংস্থা রোসাটম সুয়েজ খালের বর্তমান পরিস্থিতির আলোকে এই পথের বিকল্প হিসেবে বেরিং প্রণালী হয়ে উত্তর সাগর বাণিজ্যপথ ব্যবহারের প্রস্তাব করেছে। এই পথ ব্যবহার করলে রাশিয়া আর্কটিক অঞ্চলের তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের অধিকতর উন্নয়ন ঘটাতে পারবে। এছাড়া, রাশিয়ার তুন্দ্রা অঞ্চলের বরফ গলতে শুরু করলে সেসব জায়গায় পাইপলাইন ও রেলপথ নির্মাণ আরও বেশি গতিশীল হবে, এবং এসব প্রাকৃতিক সম্পদ উত্তর সাগর রুটের মাধ্যমে রপ্তানি হবে।
যেহেতু এই পুরো বাণিজ্যপথটি রাশিয়ার একচেটিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চলের (EEZ) মধ্যে অবস্থিত, তাই পথটিতে জাহাজ চলাচল হলে পরিবহন খরচ উল্লেখযোগ্য হারে কমতে পারে। রাশিয়ার জন্য এই সমুদ্রপথটি হলো সাইবেরিয়া অঞ্চলের শিল্প বিকাশের চাবিকাঠি। এছাড়া, আর্কটিক অঞ্চলের দেশগুলো এ অঞ্চলে অবকাঠামো উন্নয়ন, যেমন- বন্দর ও জাহাজ নির্মাণ গবেষণায় তাদের বিনিয়োগ বৃদ্ধি করবে। ফলে এই অঞ্চলে এসব দেশের উন্নয়ন ভৌগোলিক এবং অর্থনৈতিকভাবে ত্বরান্বিত হবে। কিন্তু এ দেশগুলোই একমাত্র বিনিয়োগকারী নয়, কারণ চীনও উত্তর সাগর বাণিজ্যপথের ভূ-কৌশলগত সম্ভাবনা নিয়ে উৎসাহী। তাই আর্কটিকের বরফ যতই গলছে, সেই সাথে এ অঞ্চলের বাণিজ্যের সুযোগ নতুন দ্বার উন্মোচন হচ্ছে।
রাশিয়া সুয়েজ খালের পরিবর্তে এই পথটি সুপারিশ করলেও এখানে কিছু সমস্যা আছে। প্রথম সমস্যা হলো আর্কটিক মহাসাগরের বরফ। দ্বিতীয়ত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বেরিং প্রণালীতে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। আবার, রাশিয়ার এই উদ্যোগে আন্তর্জাতিকভাবে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া আসতে পারে। এছাড়া নিরাপত্তা ঝুঁকি, খরচ, উন্নত জাহাজ, বীমা খরচ এবং আইসব্রেকারের (যাতে জাহাজগুলো বরফ ভেঙে যেতে পারে) খরচের কারণে আর্কটিক শিপিং কোম্পানিগুলোর জন্য এখনও এটি একটি ঝুঁকিপূর্ণ এবং ব্যয়বহুল উদ্যোগ।
ইউএস কংগ্রেসনাল রিসার্চ সার্ভিসের (CRS) প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এ অঞ্চলের বাণিজ্য সম্ভাবনা ও সমস্যা সত্ত্বেও আর্কটিককে ঘিরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং রাশিয়ার মধ্যে ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে।
আর্কটিককে ঘিরে ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্য একটি নতুন নীতি প্রবর্তিত হলে তা এ অঞ্চলের পরাশক্তি দেশগুলোর মধ্যে ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতার ভারসাম্য রক্ষা করবে বলে ধারণা করা হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের শেষ আর্কটিক নীতি প্রকাশিত হয় ২০১৬ সালের এপ্রিলে। যদিও এখন উত্তর সাগর বাণিজ্যপথটি ব্যবহার করা কঠিন, তবে এটি কয়েক দশকের মধ্যে পরিবর্তন হতে পারে। ভূ-রাজনৈতিকভাবে এর বিশাল প্রভাব রয়েছে, কারণ এটি চীন এবং রাশিয়াকে মিত্র হিসেবে আরও কাছাকাছি নিয়ে আসতে পারে, এবং শক্তিশালি আইসব্রেকার তৈরি করতে সাহায্য করতে পারে, যা এই অঞ্চলের বাণিজ্যিক প্রসারের একটি প্রয়োজনীয় হাতিয়ার। যেহেতু ইইউ সদস্য রাষ্ট্রগুলোতে আর্কটিক অঞ্চলের গ্যাস, তেল এবং মাছের বিশাল গ্রাহক রয়েছে, তাই ইউরোপীয় ইউনিয়নকে অবশ্যই একইসাথে বাস্তবমুখী ও কার্যকরী পন্থা অবলম্বন করতে হবে, যেমন- জলবায়ু পরিবর্তনের উপর ইউরোপীয় গ্রীন ডিল নীতি, যা এই সমস্যার শুধুমাত্র একটি অংশের সমাধানের পরামর্শ দেয়। এছাড়া ইইউ-এর আর্কটিকের অন্যান্য বিষয়ের উপরও নজর দেয়া উচিত, যেমন- টেকসই খাদ্য ব্যবস্থা, পরিবেশবান্ধব শিল্পখাত, নতুন বাণিজ্যপথের অনুসন্ধান, এবং অন্যান্য দেশের সাথে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক।
বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব আর্কটিক অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি পড়ছে, যেখানে বার্ষিক গড় তাপমাত্রা গত ১০০ বছরের স্বাভাবিক হারের তুলনায় দ্বিগুণ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে গত ২,০০০ বছরের যেকোনো সময়ের চেয়ে আর্কটিক এখন বেশি উষ্ণ।
বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে এই অঞ্চলের বরফ গলে যাচ্ছে, আর তাই এই পথে জাহাজ চলাচলের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। আমেরিকার NOAA (National Oceanic and Atmospheric Administration) এর তথ্যানুসারে, অতিমাত্রায় গ্রীনহাউস গ্যাস নির্গমনের কারণে ২০২১ সাল ছিল আর্কটিকের জন্য ৭ম উষ্ণতম বছরের রেকর্ড, যেখানে গত ১৫ বছরে সর্বনিম্ন ১৫টি রেকর্ড ছিল। গত দশক থেকে আর্কটিকে জাহাজ চলাচল এবং অন্যান্য বাণিজ্যিক সমুদ্রযাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১০ সালে যেখানে ৪টি জাহাজ চলেছিল, ২০১১ সালে সেটি বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৪১টিতে, ২০১২ সালে ৪৬টিতে, এবং ২০১৩ সালে ৭১টি জাহাজ এই পথে যাত্রা করেছিল।
পুরো বিষয়টি পরখ করলে চারটি প্রধান কারণ সামনে আসবে।
প্রথমত, সুয়েজ খালের তুলনায় উত্তর সাগর বাণিজ্যপথের বেশ কিছু সুবিধা রয়েছে, এবং বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন ধীরে ধীরে এর প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি করে দিচ্ছে। ফেডারেল সার্ভিস ফর হাইড্রোমেটিওরোলজি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল মনিটরিং অব রাশিয়া রিপোর্ট করেছে যে- ২০২০ সাল ছিল পৃথিবীর সর্বোচ্চ রেকর্ড তাপমাত্রার বছর, যার ফলে আর্কটিকের বরফ ১৯৮০ সালের তুলনায় ৫-৭ গুণ কমেছে। সেই বছর আর্কটিক মহাসাগরে বরফ ২৬,০০০ বর্গ কিলোমিটার পর্যন্ত গলে যায়, যা ছিল একটি রেকর্ড। রাশিয়া তাই এই মুহুর্তে বিশ্বের একমাত্র দেশ হিসেবে অবশ্যই এই জলবায়ুগত প্রবণতাকে পুঁজি করার চেষ্টা করতে পারে।
দ্বিতীয়ত, অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, উত্তর সাগর বাণিজ্যপথের যদি অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়, তবে অর্থনৈতিকভাবে এটি আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে। এক্ষেত্রে শুধুমাত্র চীনই রাশিয়ার পাশে থাকা ও সাহায্য করতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যদিও চীন এ পথে প্রয়োজনীয় অর্থায়ন করবে কিনা তা সময়ই বলে দেবে।
তৃতীয়ত, উত্তর মেরুর হিমবাহ গলে যাওয়ার ফলে পরিবেশগত বিপর্যয় ঘটতে পারে, যা রাশিয়ার জন্য অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সুনামগত প্রভাব ফেলতে পারে।
অবশেষে, যদি ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং আমেরিকা রাশিয়ার বিরুদ্ধে তাদের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রসারিত করে, এবং বেরিং প্রণালী ব্যবহার করা একটি বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে উত্তর সাগর বাণিজ্যপথের সম্ভাবনা কমে আসবে।
পরিশেষে বলা যায়- রাশিয়া সুয়েজ খালের সমস্যাকে পুঁজি করে বেরিং প্রণালীকে ব্যবহারের সুবিধা অর্জনের চেষ্টা করবে। তাই বেরিং প্রণালী হয়ে উত্তর সাগর পথটি সহজতর করা মস্কোর রাজনৈতিক লক্ষ্যগুলোর মধ্যে একটি হয়ে উঠেছে।