গত বিশ বছর ধরে চলা আফগান-আমেরিকান যুদ্ধ আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয় ২০২১ সালের ৩০ আগস্ট। এদিন সর্বশেষ মার্কিন সেনা বহনকারী সামরিক বিমান কাবুল ত্যাগ করে। ২০১১ সালে যুদ্ধ যখন তুঙ্গে, তখন দেশটিতে এক লাখের বেশি মার্কিন সেনা মোতায়েন ছিল। কিন্তু প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, প্রয়োজন হলে দেশটিতে আবারও বিমান হামলা চালানো হবে। এজন্য ব্যবহার করা হবে আশেপাশের মার্কিন সামরিক ঘাঁটি। এখন পাঠক মাত্রই জানতে চাইবেন, আফগানিস্তানের নিকটবর্তী কোথায় মার্কিন যুদ্ধবিমান রয়েছে?
অবাক করা বিষয় হচ্ছে- শুধু আফগানিস্তান নয়, পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশেরই আশেপাশে কোনো না কোনো মার্কিন সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। বর্তমানে পুরো বিশ্বে নিজ দেশের বাইরে মাত্র ১২টি পরাশক্তির বিদেশে সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। এসব ঘাঁটির ৯০ ভাগই আমেরিকান! বাকি ১০ ভাগে আছে রাশিয়া, চীন, ব্রিটেন, ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি, তুরস্ক, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া ও নেদারল্যান্ড। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে বিদেশে এত সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করল? সেসব দেশ কেন মার্কিন সেনাদের জায়গা দিল? এসব ঘাঁটিগুলোর প্রয়োজনীয়তা কী? এই লেখায় আপনাদের জানানো হবে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর কথা, যাদের বিদেশী মিলিটারি বেজগুলোর সঠিক সংখ্যা দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ও জানে না!
বিদেশে সেনাঘাঁটি নির্মাণের শুরু যেভাবে
বিদেশে মার্কিন ঘাঁটি নির্মাণের শুরু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। সেসময় ইতালি-জার্মানির হামলায় ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত ব্রিটিশ নৌবাহিনী তাদের মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সাহায্য হিসেবে যুদ্ধজাহাজ ধার চেয়ে বসে। মার্কিনীরা তখনও যুদ্ধে যোগ না দিলেও মিত্র দেশগুলোকে ব্যাপক সামরিক-বেসামরিক সহায়তা দিচ্ছিল। আর্থিক হিসাবে অঙ্কটি ৫০.১ বিলিয়ন (আজকের ৬৯০ বিলিয়ন) ডলারের সমতুল্য। এর আওতায় ১৯৪০ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্যবহৃত পুরনো ৫০টি ডেস্ট্রয়ার শ্রেণীর যুদ্ধজাহাজ ব্রিটেনকে একেবারে দিয়ে দেয় যুক্তরাষ্ট্র। বিনিময়ে তারা ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে থাকা বেশ ৮টি ব্রিটিশ নৌ-ঘাঁটি নিজেদের ব্যবহারের জন্য ৯৯ বছরের জন্য লিজ নিয়ে নেয়। এরপরই মূলত বিদেশে সামরিক ঘাঁটি বানানোর কাজ জোরেশোরে শুরু করে মার্কিন সামরিক বাহিনী। পরবর্তীতে পার্ল হারবার আক্রমণের মধ্য দিয়ে জাপানের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে যায় দেশটি। এরপর তারা প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ব্যাপক হারে সামরিক ঘাঁটি বানানো শুরু করে। অচিরেই পুরো পৃথিবী জুড়ে ছড়াতে থাকতে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি। নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত মাসে গড়ে ১১২টি করে বিদেশী মিলিটারি বেজ বানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র! এভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে শেষ নাগাদ দেখা যায় সারা বিশ্বে জালের মতো ছড়িয়ে পড়েছে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি। ভয়াবহ এই মহাযুদ্ধে অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তি যেখানে নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল, সেখান থেকে মাথা তুলে দাঁড়ায় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষের কয়েক বছরের মাথায় কোরিয়া ও ভিয়েতনাম যুদ্ধে জড়িয়ে যায় দেশটি। প্রথমে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে টক্কর দেয়ার স্নায়ুযুদ্ধ, পরবর্তীতে চীন, ইরান, উত্তর কোরিয়ার মতো মার্কিন বিরোধী রাষ্ট্রগুলো উত্তর আমেরিকার দেশটিকে সারা বিশ্বে এত বিপুল সংখ্যক সামরিক ঘাঁটি রাখতে অঘোষিত বৈধতা দিয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের যখন পতন হয়, তখন ৪০টি দেশে প্রায় ১,৬০০ ঘাঁটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের!
কেন এত সেনা ঘাঁটির প্রয়োজন?
বর্তমানে ৮০টি দেশে আনুমানিক প্রায় ৭৫০টি সামরিক ঘাঁটি রয়েছে দেশটির। অর্থাৎ বিশ্বের প্রতি দশটি দেশের চারটির মধ্যেই মার্কিন মিলিটারি বেজ রয়েছে! এসব ঘাঁটির জন্য ৮ লাখ ৪৫ হাজারের বেশি ভবন ও বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করতে হয়েছে। জমি অধিগ্রহণ করতে হয়েছে প্রায় তিন কোটি একর। সেই হিসেবে মার্কিন প্রতিরক্ষা সদর দফতর পেন্টাগন বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ভূমি-মালিক। এসকল জমির সবই যে বৈধভাবে ক্রয়/লিজ নিয়ে হয়েছে তা কিন্তু নয়। বেশ কিছু কৌশলগত স্থানে সামরিক ঘাঁটি বানানোর জন্য জোর খাটিয়েছে দেশটি। এসব দখলের ফলে বাস্তুহারা হয়েছে বহু মানুষ। উদাহরণ হিসেবে কক্সবাজার উপকূল থেকে ৩,৮৪৩ কি.মি. দক্ষিণ-পশ্চিমে ভারত মহাসাগরে অবস্থিত ‘ডিয়েগো গার্সিয়া’ দ্বীপের কথা বলা যায়। জায়গাটি মার্কিনীদের কাছে সামরিক ঘাঁটি বানানোর জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে সেখানকার সকল আদিবাসীকে উচ্ছেদ করা হয়। আফগানিস্তানে লংরেঞ্জ বোমারু বিমান থেকে হামলা করতে মধ্যপ্রাচ্যের ঘাঁটিগুলোর পাশাপাশি এই ঘাঁটিটি ব্যবহৃত হতো। এসব কারণে বিভিন্ন দেশে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি রাখার বিরুদ্ধে আন্দোলন হচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আয়ারল্যান্ডের শ্যানন বিমানবন্দর নিজেদের সামরিক কাজে লাগানোর জন্য উন্নত করছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে দেশটির শান্তিপ্রিয় মানুষেরা। ২০০৮ সালে ইকুয়েডরের প্রেসিডেন্ট রাফায়েল কোরেয়া সবচেয়ে সাহসী এবং মজার কাজ করে বসেন। তিনি দেশে থাকা মার্কিন ঘাঁটির লাইসেন্স নবায়ন না করে তাদের বের হয়ে যেতে নির্দেশ দেন। একইসঙ্গে নতুন লাইসেন্স পেতে হলে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে ইকুয়েডর আর্মির ঘাঁটি করার আবদার করে বসেন।
এসব সামরিক ঘাঁটি মার্কিন সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবহার করছে। সে অনুযায়ী বিমান উড্ডয়ন-অবতরণের উপযোগী রানওয়ে, বিভিন্ন আকারের যুদ্ধজাহাজ নোঙ্গরের উপযোগী ডক এসব ঘাঁটির জন্য নির্মাণ করা হয়। এছাড়া সামরিক সরঞ্জাম মেরামত সুবিধা, খাদ্য-জ্বালানীসহ অন্যান্য সামরিক রসদ মজুদ ও সরবরাহ এসব ঘাঁটিতে থাকে। ছোট-বড় আকারের সেনা ঘাঁটি/ ক্যাম্পগুলোতে ট্যাংক-কামান থেকে শুরু করে রাইফেল-গোলাবারুদসহ বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র মজুদ ও মোতায়েনের কাজে এসব সেনা ঘাঁটি ব্যবহার করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিতে সন্ত্রাসবাদ দমন, মানবাধিকার রক্ষা কিংবা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা- এসব কাজে সামরিক ও কূটনৈতিক চাপের জন্য এসব ঘাঁটি মোক্ষম অস্ত্র।
এছাড়া যেকোনো অজুহাতে যেকোনো দেশে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মার্কিন হস্তক্ষেপের পেছনে এসব ঘাঁটিগুলোর ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। বিদ্রোহ বা অভ্যুথানের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে অনুগত শাসক শ্রেণী তৈরি অথবা কোনো দেশকে সর্বদা কূটনৈতিক চাপে রাখার ক্ষেত্রেও এসব সামরিক ঘাঁটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান অস্ত্র। ছোট্ট একটি উদাহরণ দেয়া যাক। উত্তর কোরিয়ার হুমকি মোকাবেলায় জাপান-দক্ষিণ কোরিয়ায় বড় আকারের ৩৮টি ঘাঁটি রয়েছে। শুধুমাত্র ইরানের আশেপাশের দেশগুলোতেই ৫০টি মার্কিন ঘাঁটি রয়েছে! মধ্যপ্রাচ্যের সস্তা জ্বালানী তেলের অবাধ সরবরাহ ছাড়াও ইসরায়েলের নিরাপত্তায় এত ঘাঁটি বানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
তবে সংখ্যার দিক সবচেয়ে বেশি ঘাঁটি রয়েছে ইউরোপ ও উত্তর-পূর্ব এশিয়ায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই কয়েকটি পরাজিত দেশে আজীবনের জন্য স্থায়ীভাবে মার্কিন সেনারা রয়ে গেছে! বর্তমানে বিদেশে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মার্কিন ঘাঁটি রয়েছে জাপানে। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব ডিফেন্সের দেয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী- দেশটির ছোট-বড় ১২০টি ঘাঁটিতে ৫৬,০১০ জন মার্কিন সৈনিক কর্মরত। পাশের দেশ দক্ষিণ কোরিয়ার ছোট-বড় ৭৩টি ঘাঁটিতে রয়েছে ২৫,৫৯৩ জন মার্কিন সেনা। চীন-উত্তর কোরিয়ার হুমকি মোকাবেলায় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাসহ এত বিপুল সংখ্যক সৈন্য এশিয়ার দেশ দুটিতে অবস্থান করছে। তবে ১১৯টি মার্কিন ঘাঁটি নিয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অবস্থানে আছে জার্মানি। দেশটিতে প্রায় ৩৫,৪৬৮ জন সেনাসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ৬০ হাজারের বেশি মার্কিন সেনা রয়েছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র ব্রিটেনে রয়েছে ২৫টি মিলিটারি বেজ। এসব ঘাঁটি মূলত ন্যাটো সামরিক জোটের কাজে ব্যবহৃত হয় যা রাশিয়ার হুমকি মোকাবেলায় বানানো হয়েছে। এছাড়া বিশাল আকারের মার্কিন এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারগুলো যেন এক একটি ভাসমান বিমানঘাঁটি। এর সঙ্গী অন্যান্য জাহাজ মিলিয়ে ১০ হাজারের বেশি মার্কিন সামরিক সদস্য প্রায় সময় ইরান, চীন, উত্তর কোরিয়ার মতো দেশগুলোর জলসীমার ঠিক বাইরে শক্তি প্রদর্শন করতে যায়।
বিদেশে ঘাঁটির সঠিক সংখ্যা কত?
ব্যাপক গোপনীয়তার কারণে বিশ্বজুড়ে মার্কিন ঘাঁটির সংখ্যা আসলে মোট কতটি তা সম্পর্কে সম্পূর্ণ সঠিক তথ্য কোথাও নেই। মার্কিন নৃবিজ্ঞানী ও রাজনৈতিক নৃবিজ্ঞানের শিক্ষক প্রফেসর ডেভিড ভাইন তার ‘Base Nation’ নামের একটি গবেষণাধর্মী বই লিখেছেন। সেখানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের কতগুলো বিদেশী সামরিক ঘাঁটি রয়েছে, ঘাঁটিগুলো কীভাবে পরিচালিত হয়, এগুলো কী পরিমাণ অর্থনৈতিক, পরিবেশগত এবং মানুষের জীবনহানির কারণ হচ্ছে সেই সম্পর্কে একটি প্রাথমিক ধারণা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন, নিজ দেশের বাইরে পৃথিবীর অন্তত ৮০টি দেশ বা ভূখণ্ডে সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ৭৫০টির বেশি সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি হবে বলেই ধারণা করেন তিনি ও অন্যান্য বিশ্লেষকগণ। কারণ মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগ পেন্টাগনের সঠিক তথ্য-উপাত্ত কখনোই প্রকাশ করে না। আবার কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তা ব্যতীত এসব ঘাঁটির খবর কেউ জানে না। ফলে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক বাজেটের অর্থ কোথায় যাচ্ছে সেই সম্পর্কে জানার উপায় নেই।
এসব বিদেশী ঘাঁটির মধ্যে ৩৮টি দেশে খুব বড় আকারে (১ হাজার+) সশস্ত্র মার্কিন সেনা ও যুদ্ধাস্ত্র মজুদ আছে। বাকি দেশগুলোর সামরিক ঘাঁটিগুলো বিভিন্ন ধরনের সামরিক কৌশলগত কাজে ব্যবহৃত হয় যা উপরে উল্লেখ করা হয়েছে। এর উল্লেখযোগ্য অংশ মার্কিন বাহিনীর রসদ মজুদ ও সাপ্লাইয়ের কাজে লাগে। অর্থাৎ এসব ঘাঁটিতে তেমন বেশি সেনা নেই, তবে রসদের অভাব নেই। ম্যাপ দেখলে দেখা যায়, বিরানভূমিতে রানওয়েসমৃদ্ধ বেশ কিছু ঘাঁটি আছে, যেগুলো আসলে ব্যবহার করাই হয় না। এগুলো আসলে ভবিষ্যতের যুদ্ধে কাজে লাগবে ভেবে বানানো! এ কারণে নতুন কোনো যুদ্ধে জড়াতে হলে ইউএস মিলিটারিকে লজিস্টিক সাপোর্ট নিয়ে তেমন কোনো বেগ পেতে হয় না। কিছু কিছু ছোট সামরিক ঘাঁটি আছে শুধুমাত্র রাডার নজরদারি, আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বা ড্রোন অপারেশন চালানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। আবার মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ পরিচালিত এমন কিছু ব্ল্যাক সাইট রয়েছে যেগুলোর কথা পেন্টাগন তো দূরের কথা, মার্কিন প্রশাসনের শীর্ষস্থানীয় গুটিকয়েক ব্যাক্তি ব্যতীত আর কেউই জানে না। দরকার না হলে মার্কিন প্রেসিডেন্টকেও এসব তথ্য জানানো হয় না!
যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ব্যয় কেন সবার চেয়ে বেশি?
২০২১ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী সামরিক খাতে যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক খরচ ৮০১ বিলিয়ন ডলার (২৯৩ বিলিয়ন খরচ করে দ্বিতীয় স্থানে চীন) যা সারা বিশ্বের মোট সামরিক ব্যায়ের ৩৮%। এর উল্লেখযোগ্য অংশ বিদেশী সামরিক ঘাঁটির পেছনে ব্যয় হয়। তবে সংখ্যাটি কত সেই সম্পর্কে পরিষ্কার তথ্য কোথাও নেই। ২০১৮ সালে ১,২০০ সেচ্ছাসেবী হিসাবরক্ষক মিলে মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে বিদেশী সামরিক ঘাঁটিগুলোর পেছনে মোট ব্যয়ের পূর্ণাঙ্গ অডিট করে দেয়ার আবেদন করলে তারা প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট সরবরাহ করতে পারেনি। বিষয়টিকে প্রফেসর ভাইন বলেছেন, পেন্টাগন নিজেই জানে না তাদের বাহিনী আসলে কত বড়। কয়েক বছর আগে ‘র্যান্ড কর্প’ নামের একটি হিসাবরক্ষণ ফার্ম মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক অডিটের সময় প্রফেসর ভাইনের বইয়ে দেয়া বিদেশী ঘাঁটিগুলোর লিস্ট ব্যবহার করেছিল। এই ব্যাপারটিতে উক্ত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক খুশি হওয়ার বদলে ‘স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব’ বলে মন্তব্য করেন। অর্থাৎ বেশ কিছু সামরিক ঘাঁটির কাজ এত গোপনীয় যে এদের বার্ষিক বাজেটের কোনো জনসম্মুখে ডকুমেন্ট প্রকাশ করা হয় না। ফলে গণতান্ত্রিক দেশ হয়েও মার্কিন নাগরিকদের জানার উপায় নেই যে তাদের ট্যাক্সের অর্থ কোথায়, কীভাবে ব্যয় হচ্ছে। অবাক করা তথ্য হচ্ছে- ২০১১ সাল থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি বিস্তারের কাজ নাটকীয়ভাবে বেড়েছে। এসব সামরিক ঘাঁটি ও হাজার হাজার সেনার পেছনে অঢেল অর্থও ব্যয় করে যুক্তরাষ্ট্র যা বিশ্বের শীর্ষ ১০ দেশের মোট ব্যয়ের চেয়েও বেশি।
বর্তমানে ৮০টি দেশের বিদেশী সেনাঘাঁটি, বিভিন্ন দেশে প্রশিক্ষণ গ্রহণ ও প্রদান, নিজেদের দূতাবাসের নিরাপত্তা ইত্যাদি কাজসহ সব মিলিয়ে ১ লাখ ৭৩ হাজার সৈনিক মোতায়েন রয়েছে। বিশ্বব্যাপী আমেরিকার এসব ঘাঁটি পরিচালনার জন্য প্রতি বছর গড়ে প্রায় ১৫৬ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়। রাশিয়ার বার্তা সংস্থা স্পুৎনিকের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, বিদেশে মোতায়েন একজন সেনার জন্য মার্কিন করদাতাদের বছরে ১০ হাজার থেকে ৪০ হাজার ডলার ট্যাক্স দিতে হয়। পরোক্ষভাবে বিশ্বের বহু দেশের জনগণকেও বহন করতে হয় সে অর্থ। কারণ বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফ-এর মাধ্যমে আমেরিকা নানা কায়দায় বিভিন্ন দেশের কাঁধে সুদের বিনিময়ে ঋণের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে থাকে। ২০০১ সাল থেকে আজ অবধি সামরিক ক্ষেত্রে ৬ ট্রিলিয়ন ডলার সামরিক খাতে ব্যয় করেছে যুক্তরাষ্ট্র। অর্থের অঙ্ক কত বড় তা বোঝাতে একটি উদাহরণ দিচ্ছি। এই অর্থে যুক্তরাষ্ট্রের বিপুল সংখ্যক গৃহহীন মানুষের নিরাপদ আবাসের ব্যবস্থা করা যেত। এছাড়া পুরো বিশ্বের খাদ্য সমস্যার সমাধান করে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা শূন্যে নামিয়ে আনা যেত। প্রফেসর ভাইন তার বইয়ে মার্কিন সরকারের বিপুল অর্থের অযাচিত ব্যয় ছাড়াও প্রাণহানীর একটি পরিসংখ্যান দিয়েছেন। ৯/১১ এর টুইন টাওয়ার পরবর্তী সন্ত্রাসবাদ বিরোধী যুদ্ধে এখন পর্যন্ত ৮ লাখের বেশি মানুষ মারা গেছে। বিদেশে এসব সেনাঘাঁটি থাকার একমাত্র দৃশ্যমান ইতিবাচক প্রভাব হচ্ছে- এসব ঘাঁটির কারণে পর্যন্ত ৮০ হাজার স্থানীয় জনগণের কর্মসংস্থান হয়েছে। তবে মার্কিনীদের জীবনে এটি নেতিবাচক হয়ে দেখা দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের অন্যায় যুদ্ধগুলোতে হাজার হাজার নিহত হওয়া ছাড়াও পঙ্গু হয়েছে বহু সংখ্যক সেনা। এছাড়া দীর্ঘসময় বিদেশে মোতায়েন থাকায় সেনা পরিবারগুলোতে দাম্পত্য কলহ, বিবাহবিচ্ছেদ ছাড়াও বাবা-মায়ের দীর্ঘ অনুপস্থিতিতে শিশুদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্থ হচ্ছে বলে এক গবেষণায় দেখা গেছে।
বিদেশী সামরিক ঘাঁটিগুলোর পেছনে বিপুল অর্থ ব্যয়ের অর্থনৈতিক চাপ থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন দেশে সামরিক উপস্থিতির সংখ্যা বাড়িয়েই চলছে দেশটি। সম্প্রতি আফ্রিকায় আল-কায়েদা, আল-শাবাবের বিরুদ্ধে লড়াই করতে একাধিক নতুন ড্রোন ও বিমান ঘাঁটি বানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ইরাক, আফগানিস্তান থেকে গুটিয়ে নিলেও মার্কিন সামরিক সাম্রাজ্যবাদের জালের বিস্তার সহজে থামবে না। গত কয়েক বছরে মালদ্বীপ-শ্রীলঙ্কায় চীনের সামরিক আনাগোনা বেড়ে গেছে। তাদের টেক্কা দিতে কূটনৈতিক চেষ্টার অংশ হিসেবে বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক জোরদার করছে দেশটি। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে নতুন মার্কিন সামরিক ঘাঁটি বানানো হবে কিনা তা সময়ই বলে দেবে।