বিশ্বে আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্তের সংখ্যা। ডায়াবেটিসের একটি রূপ টাইপ-২ ডায়াবেটিস। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৪৫ সালের মধ্যে পৃথিবীতে প্রায় ৭০ কোটি মানুষ টাইপ-২ ডায়াবেটিসের শিকার হবে। আর তাই তো ডায়াবেটিসকে বৈশ্বিক মহামারি বলতে একটুও দ্বিধাবোধ করছেন না বিশেষজ্ঞরা।
ডায়াবেটিস ও এর কারণ নিয়ে গবেষণা নতুন কোনো বিষয় নয়। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর মূত্র মিষ্টি স্বাদ যুক্ত হওয়ায় তা সহজেই পিঁপড়াকে আকর্ষণ করে। তাই প্রাচীন ভারতীয় চিকিৎসকেরা এই ডায়াবেটিসকে ‘মধুমেহ’ রোগ বলে আখ্যা দেন। পরবর্তীতে কালের বিবর্তনে ডায়াবেটিস সম্পর্কে মানুষের ধারণার ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। ডায়াবেটিসের জন্য দায়ী কারণ হিসেবে উঠে এসেছে— জিনগত কারণ, খাদ্যাভ্যাস, অতিরিক্ত স্থূলতা, মেটাবলিক সিন্ড্রোম, ডিসবায়োসিস, অটোইমিউনিটি, বিভিন্ন ড্রাগ, গর্ভাবস্থাসহ নানা বিষয়।
তবে এবার মধুমেহ রোগের সম্পূর্ণ নতুন এক কারণ আবিষ্কারে ভূমিকা রেখেছেন বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ড. মধু এস মালো ও তার দল। তাদের গবেষণা বলছে— ইন্টেস্টিনাল অ্যালকালাইন ফসফেটেজ (আইএপি) নামক একধরনের আন্ত্রিক এনজাইমের অভাবে ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়।
ডায়াবেটিসের প্রকারভেদ
আমরা দৈনন্দিন যেসব শর্করা জাতীয় খাদ্য খাই, তা দেহে পরিপাক হয়ে গ্লুকোজে পরিণত হয়। এ গ্লুকোজ আমাদের দেহের শক্তির প্রধান উৎস। পরিপাকের মাধ্যমে প্রাপ্ত এ গ্লুকোজ দেহের কোষগুলো গ্রহণ করে শক্তি উৎপন্ন করে। ইনসুলিন নামক একধরনের হরমোন দেহের কোষগুলোকে গ্লুকোজ গ্রহণে সহায়তা করে। আমাদের দেহের প্যানক্রিয়াস বা অগ্ন্যাশয়ের আইলেটস অব ল্যাঙ্গারহ্যান্স থেকে তৈরি হয় এ ইনসুলিন। কোনো কারণে দেহে ইনসুলিনের পরিমাণ কমে গেলে, কিংবা দেহের কোষগুলো ইনসুলিনের প্রতি পর্যাপ্ত সাড়া না দেওয়ার কারণে কোষগুলো আর প্রয়োজনীয় গ্লুকোজ গ্রহণ করতে পারে না। ফলে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ অত্যধিক বেড়ে যায়। দেহে দেখা দেয় নানা জটিলতা। রক্তে গ্লুকোজের অস্বাভাবিক এ বৃদ্ধিকেই বলা হয় ডায়াবেটিস। অগ্ন্যাশয়ে পর্যাপ্ত ইনসুলিন উৎপন্ন না হওয়ার কারণে যে ডায়াবেটিস হয়, তা মূলত টাইপ-১ ডায়াবেটিস। আর দেহে পর্যাপ্ত ইনসুলিন থাকা সত্ত্বেও দেহের কোষগুলো ইনসুলিনের প্রতি কোনো সাড়া না দেওয়া বা ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্সের জন্য যে ডায়াবেটিস হয় তা হলো টাইপ-২ ডায়াবেটিস। আমাদের দেশের বিজ্ঞানীরা মূলত এ টাইপ-২ ডায়াবেটিসের একটি নতুন কারণ উদ্ভাবনে সক্ষম হয়েছেন।
এলপিএস ও টাইপ-২ ডায়াবেটিস
আমাদের অন্ত্রে ১০০ ট্রিলিয়ন পরিমাণ ব্যাকটেরিয়া রয়েছে। ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বেড়ে বা কমে গেলে শরীরের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া তা নিয়ন্ত্রণ করে। ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বেড়ে গেলে অতিরিক্ত ব্যাকটেরিয়াকে শরীর মেরে ফেলে। গ্রাম নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়ার মৃত্যুর ফলে এর কোষপ্রাচীর বিদীর্ণ হয়ে লিপোপলিস্যাকারাইড (এলপিএস) তৈরি করে।
এই এলপিএস মূলত একধরনের এন্ডোটক্সিন যা অন্ত্রে প্রদাহের সৃষ্টি করে। সাধারণত মানুষের মলের সাথে এই এলপিএস অপসারিত হলেও কিছু বিশেষ অবস্থায় এরা রক্তে প্রবেশ করতে পারে।
সহজেই অন্ত্রের প্রাচীর ভেদ করতে পারা কিংবা অতিরিক্ত উচ্চ ফ্যাটসমৃদ্ধ খাবার, অ্যালকোহল, কোমল পানীয় গ্রহণে এই এলপিএস সহজেই অন্ত্র থেকে রক্তে প্রবেশ করে বিষক্রিয়া ঘটাতে পারে। রক্তে প্রবেশের পর দেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সাথে এই টক্সিনের যুদ্ধ হয়। আর এ যুদ্ধে যোদ্ধারা ছাড়াও আশেপাশের কোষও ক্ষতিগ্রস্থ হয়। রক্তে অতিরিক্ত এই টক্সিনের উপস্থিতি লো গ্রেড সিস্টেমিক প্রদাহের সৃষ্টি করে। ফলে একসময় ইনসুলিন যেসকল কোষের উপর কাজ করে গ্লুকোজের কোষে প্রবেশে সহায়তা করে ঐসব কোষও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে দেখা দেয় ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স। অর্থাৎ, দেহে পর্যাপ্ত ইনসুলিন থাকলেও কোষ কোনো সাড়া না দেওয়ায় রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যায়। আর গ্লুকোজের এরূপ অস্বাভাবিক বৃদ্ধিই তো টাইপ-২ ডায়াবেটিস।
একজন মধু এস মালো এবং আইএপি এনজাইম বিষয়ক গবেষণা
ছোটবেলা থেকেই বইয়ের পোকা ছিলেন মধু এস মালো। এই বই পড়া থেকেই নতুন কিছু উদ্ভাবনের এক অদম্য ইচ্ছা অনুভব করেন তিনি। উদ্ভাবনী মানসিকতার বাস্তবায়নে জ্ঞানার্জনের নেশায় দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন। একসময় শুরু করেন গবেষণা। আইএপি নিয়ে বিশ্লেষণ শুরু করেন ড. মধু এস মালো।
অন্ত্রে উৎপন্ন এলপিএস টক্সিনকে নিষ্ক্রিয় করতে পারে এমন উপাদানের মধ্যে অন্যতম হলো ইন্টেস্টিনাল অ্যালকালাইন ফসফেটেজ (Intestinal Alkaline Phosphatase) বা আইএপি। আইএপি হলো মানুষের অন্ত্রে তৈরি একধরনের এনজাইম যা আংশিকভাবে মলের সাথে নির্গত হয়। ব্যাকটেরিয়াল টক্সিনের সাথে আবদ্ধ হয়ে এই আইএপি টক্সিনকে নষ্ট বা অকার্যকর করে ফেলে। ফলে দীর্ঘমেয়াদী কোনো প্রদাহের সৃষ্টি হয় না।
২০১৩ সাল। আইএপি নিয়ে নিজের তত্ত্ব দাঁড় করাতে পরীক্ষাগারে জন্মানো ইঁদুর নিয়ে গবেষণা শুরু করেন ড. মধু এস মালো। গবেষণার বিষয়ে তিনি কানাকারাজু কালিয়ানান নামে একজন পোস্ট-ডক্টরাল প্রার্থীর শরণাপন্ন হন। আইএপি জিন নেই এমন ইঁদুর নিয়ে শুরু হয় গবেষণা। তত্ত্ব অনুসারে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার কথা ইঁদুরগুলোর। কারণ টক্সিন এলপিএসকে ধ্বংসের জন্য কোনো আইএপিই তো নেই ইঁদুরগুলোর। তত্ত্বকে সঠিক প্রমাণ করে তাদের গবেষণা বলছে, ইঁদুরগুলো শুধু ডায়াবেটিসেই আক্রান্ত হয়নি, সাথে ডিসলিপিডেমিয়া, ফ্যাটি লিভারেও আক্রান্ত হয়েছে। বিজ্ঞানীরা এ অবস্থাকে বলেন মেটাবলিক সিন্ড্রোম। শুধু তা-ই না; তারা দেখান যে, ইঁদুরগুলোকে পর্যাপ্ত আইএপি এনজাইম সরবরাহ করা হলে তা মেটাবলিক সিন্ড্রোমকে প্রতিরোধ করতে সক্ষম।
এ গবেষণায় আশানুরূপ সাফল্যে ড. মধু এস মালো আরও বিস্তরভাবে আইএপি বিষয়ক গবেষণা করার কথা ভাবেন। ডায়াবেটিস বিষয়ক গবেষণা হওয়ায় তিনি নিজ দেশের ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশনের সাথে কাজ করার কথা ভাবেন। দেশে ফিরে নতুন উদ্যমে গবেষণার কাজ শুরু করেন ড. মধু। উচ্চমাত্রার আইএপি যদি ইঁদুরে ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করতে পারে, তাহলে উচ্চ আইএপি সম্ভবত মানুষেও ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করতে পারবে— এমন ধারণা থেকে শুরু হয় হিউম্যান ট্রায়াল। ২০২ জন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগী এবং ৪৪৫ জন সুস্থ ও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত নয় এমন মানুষের মলে আইএপি এনজাইমের মাত্রা নির্ণয় করেন গবেষকরা। গবেষকদের ধারণাকে সত্য প্রমাণ করে ২০১৫ সালে প্রকাশিত এ গবেষণার ফলাফল বলছে— উচ্চ মাত্রার আইএপি মানুষেও টাইপ-২ ডায়াবেটিস প্রতিরোধে সক্ষম। এমনকি, ব্যক্তি যদি অতি মাত্রায় মোটাও হন, কিন্তু তার উচ্চ মাত্রার আইএপি এনজাইম থাকে, তবু তার ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
সাফল্য এবং সম্ভাবনা যে গবেষণাকে ঘিরে
গবেষণায় একের পর এক সাফল্য বিজ্ঞানীদের আরও বৃহৎ পরিসরে দীর্ঘমেয়াদী গবেষণার দিকে ধাবিত করে। ২০১৫ সালে ৩০ থেকে ৬০ বছর বয়সী সম্পূর্ণ সুস্থ ও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত নয় এমন ৬৭১ জন ব্যক্তিকে নিয়ে শুরু হয় গবেষণা। মাইগ্রেশন, মৃত্যু কিংবা গর্ভাবস্থার মতো কারণে কিছু ব্যক্তি গবেষণার আওতার বাইরে চলে যান।
অবশেষে পাঁচ বছর পরে ৫৭৪ জন ব্যক্তির মলে আইএপি মাত্রা বিশ্লেষণ করে ফলাফল প্রকাশ করেন গবেষকরা। সুস্থ মানুষের প্রতি গ্রাম মলে গড় আইএপি মাত্রা সাধারণত ৬৫ ইউনিটের বেশি। এই এনজাইম যাদের ৬৫ ইউনিটের বেশি, তাদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে মাত্র ৩ শতাংশ মানুষের পরবর্তী সময়ে ডায়াবেটিস হয়েছে। আর যাদের ৬৫ ইউনিটের কম, তাদের মধ্যে ৪২ শতাংশ মানুষের ডায়াবেটিস হয়েছে।
আরেকভাবেও সহজে এ ফলাফলকে বিশ্লেষণ করা যায়। আইএপির মাত্রানুযায়ী মানুষকে ৫ ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন: ০-১৫ ইউনিট, ১৫-৩৩ ইউনিট, ৩৩-৫৫ ইউনিট, ৫৫-১১৫ ইউনিট এবং ১১৫ ইউনিটের বেশি। সবচেয়ে বেশি ইউনিট আইএপি এর তুলনায় সবচেয়ে কম ইউনিট আইএপির ক্ষেত্রে ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা প্রায় ১৪ গুণ। অর্থাৎ যেসব মানুষের আইএপি মাত্রা সবচেয়ে কম তাদের ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি প্রায় ১৪ গুণ বেশি।
মূলত এ গবেষণার মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা এ বার্তায় দিতে চাইলেন যে— দেহে আইএপি এনজাইমের অভাব ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। শুধু তা-ই না, ২০১৫ সালে গবেষণার শুরুতে যাদের দেহে আইএপি মাত্রা কম ছিল, কিন্তু কোনো কারণে পাঁচ বছর তা বেড়ে গিয়েছে, এমন মানুষ স্থূল হওয়ার পরেও তারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হননি। এ কারণেই বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন- স্থূলতার সাথে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ধারণাটি একটি ভ্রান্ত ধারণা মাত্র। যদি ব্যক্তির উচ্চ মাত্রার আইএপি থাকে, তাহলেই ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করা সম্ভব। তবে কীভাবে মানুষের দেহে আইএপি মাত্রা কমে যাচ্ছে কিংবা বেড়ে যাচ্ছে- এ বিষয়ে আরও বিস্তর গবেষণার প্রয়োজন বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা।
২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে ‘BMJ Open Diabetes Research & Care’ জার্নালে আলোড়ন সৃষ্টিকারী এ গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। ড. মধু এস মালোর নেতৃত্বে হওয়া এ গবেষণায় দেশি-বিদেশি খ্যাতনামা অনেক গবেষক অংশ নেন। ড. মধু এস মালো বর্তমানে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির উপদেষ্টা ও বারডেমের খণ্ডকালীন অধ্যাপক। যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের সাবেক সহকারী অধ্যাপক তিনি।
ডায়াবেটিস প্রতিরোধে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের এ গবেষণা। মানুষের মলে নিয়মিত আইএপির মাত্রা নির্ণয় করে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি সম্পর্কে আগাম ধারণা দেওয়া যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। এছাড়া দেহে আইএপি এনজাইম সরবরাহের ব্যবস্থা করলে তা ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করতে পারবে বলেও আশা করছেন বিজ্ঞানীরা।