করোনাভাইরাস মহামারি নিয়ন্ত্রণে এসেছে অনেকটাই। লকডাউন তুলে দিয়ে অনেক দেশই চেষ্টা করছে মহামারি-পূর্ব অবস্থায় ধীরে ধীরে ফিরে যেতে। এর পেছনে সম্মিলিত প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে কোভিড ভ্যাক্সিন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। আজকের পৃথিবীতে অন্তত ২২টি অনুমোদিত ভ্যাক্সিন বিভিন্ন দেশে ব্যবহৃত হচ্ছে। ৬ বিলিয়নেরও বেশি টিকার প্রয়োগ হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
প্রচলিত ভ্যাক্সিনগুলোর মধ্যে ফাইজার-বায়োএনটেক, মডার্না আর অ্যাস্ট্রা-জেনেকার টিকাগুলোই সবচেয়ে বেশি দেয়া হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ অন্যান্য উন্নত দেশ এই তিনটি ভ্যাক্সিন অনুমোদন করে তাদের নাগরিকদের মাঝে প্রয়োগ করছে। যদিও কোনো ভ্যাক্সিনই সংক্রমণ বন্ধ করতে পারে না, তবে তারা সক্ষম রোগের তীব্রতা কমিয়ে দিতে। দেখা গেছে, পরীক্ষাগারের বাইরে প্রয়োগে হাসপাতালে কোভিড রোগীর ভর্তির হার কমাতে ফাইজার-বায়োএনটেক ভ্যাক্সিন ৭১-৯৭ শতাংশ, মডার্না ৯৫-৯৭ শতাংশ এবং অ্যাস্ট্রা-জেনেকা ৮০ শতাংশের মতো কার্যকর।
কিন্তু ভ্যাক্সিনের কার্যক্ষমতা ছাপিয়ে অন্য যে ইস্যু বড় হয়ে উঠেছে তা হলো- কতদিন পর্যন্ত ভ্যাক্সিন আমাদের রক্ষা করতে পারবে? স্বাভাবিকভাবেই ভ্যাক্সিন দেয়ার পর করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, তা একটা সময় পর ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে যেতে পারে। ফলে তখন কি আমাদের নতুন করে আবার টিকা নিতে হবে? এরকম কিছু প্রশ্ন যুক্তিসঙ্গতভাবেই উঠেছে। যেহেতু ফাইজার-বায়োএনটেক, মডার্না আর অ্যাস্ট্রা-জেনেকার ভ্যাক্সিন বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত সবচেয়ে বেশি পাওয়া গিয়েছে, সুতরাং এই তিনটির ব্যাপারে গবেষকেরা একটি মোটামুটি চিত্র দাঁড় করাতে পেরেছেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অরেগন বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্লোবাল হেলথের প্রধান চুনহিউ চি’র ভাষায়, যেহেতু প্রত্যেক মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সমান নয়, কোভিড ভ্যাক্সিনের কার্যক্ষমতাও তাই ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হবে। যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি, তাদের ক্ষেত্রে যেকোনো ভ্যাক্সিন বেশি দিন সুরক্ষা দেয়ার কথা, দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই সেই সময় হবে কম। এর পাশাপাশি ভাইরাসের মিউটেশনও গুরুত্বপূর্ণ। ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ মেডিসিনের বিশেষজ্ঞ লানা বেইবোর মতে, মিউটেশনের ফলে এমন ধরনের করোনাভাইরাস তৈরি হতে পারে যা হয়তো ভ্যাক্সিনকে ফাঁকি দিতে সক্ষম। এরকম হলে যতদিন আমরা সুরক্ষা আশা করছি তা না-ও পেতে পারি।
বিদ্যমান তথ্য বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞদের সিংহভাগ ধারণা প্রকাশ করেছেন, কোভিড ভ্যাক্সিনের সুরক্ষা ৬-৮ মাস পর্যন্ত থাকতে পারে। সর্বোচ্চ হয়তো ১-১.৫ বছর এই সুরক্ষা কিছুটা বজায় থাকবে, তবে তারপর অতিরিক্ত একটি ডোজ দেয়ার প্রয়োজন হবে। ফ্লু ভ্যাক্সিন যেমন বছর বছর দিতে হয়ে, কোভিডের ক্ষেত্রেও সেরকম কিছু দরকার হতে পারে।
যুক্তরাজ্যের জনস্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান বিভাগের সহকারী পরিচালক অধ্যাপক নিক অ্যান্ড্রুজের নেতৃত্বে গবেষকেরা ফাইজার, অ্যাস্ট্রা-জেনেকা আর মডার্নার ভ্যাক্সিনের একটি তুলনামূলক গবেষণা চালিয়েছেন। তাদের ফলাফলে দেখা গেছে, ফাইজার আর মডার্নার ভ্যাক্সিন দ্বিতীয় ডোজের পর করোনা সংক্রমণের লক্ষণ ঠেকাতে প্রায় আড়াই মাসের মতো সর্বোচ্চ কার্যকারিতা দেখায়। আর হাসপাতালে ভর্তি এবং মৃত্যুহার কমাতে এই দুটি টিকা পাঁচ মাস সর্বোচ্চ কর্মক্ষম থাকে।এর পর আস্তে আস্তে এই ক্ষমতা কমে যায়। অ্যাস্ট্রা-জেনেকা আবার অন্য দুটি ভ্যাক্সিনের থেকে সবদিক থেকেই পিছিয়ে।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে অতিরিক্ত ডোজ বা বুস্টারের কথা জোরেশোরে উঠে এসেছে। ইসরায়েল বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে বুস্টার চালু করেছে। ২০২১ সালের জুলাই থেকে অন্তত পাঁচ মাস আগে ফাইজারের ভ্যাক্সিন পাওয়া লোকদের ইসরায়েল বুস্টার ডোজ দিচ্ছে। প্রাথমিক ফলাফলে দেখা গিয়েছে, বুস্টারের প্রথম দুই সপ্তাহের মধ্যে করোনা প্রতিরোধী অ্যান্টিবডির পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়, তবে কতদিন পর্যন্ত তা রক্তে থাকে তা নিয়ে সুস্পষ্ট উত্তর এখনও মেলেনি।
দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার গবেষণা এবং বিশ্লেষণ বিভাগের প্রধান সারা টারটফ ফাইজার-বায়োএনটেকের ভ্যাক্সিনের কার্যকারিতার সময় নিয়ে গবেষণা করেছেন। তার দল দেখিয়েছে, ফাইজারের টিকার দুই ডোজ নেবার পর অন্তত ৬ মাস হাসপাতালে ভর্তির হার কমিয়ে রাখতে পারে। এমনকি ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ার পরও এই কার্যক্ষমতার খুব বেশি হেরফের হয় না। সংক্রমণের লক্ষণ ঠেকাতে অবশ্য ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বিপক্ষে কার্যকারিতা চার মাসের মধ্যে শতকরা ৫৩ ভাগে নেমে আসে। তবে করোনাভাইরাসের অন্যান্য ভ্যারিয়েন্টের ক্ষেত্রে প্রথম মাসে এই কার্যকারিতা ৯৭ শতাংশ থেকে ৪-৫ মাস পর প্রায় ৬৭ শতাংশে নেমে আসে।
তিনটি মূল ভ্যাক্সিনের বাইরে জনসন অ্যান্ড জনসনের ভ্যাক্সিন নিয়েও প্রাথমিকভাবে বেশ উচ্ছ্বাস পরিলক্ষিত হয়েছিল। এর মূল কারণ অন্যান্য টিকা যেখানে দুই ডোজ দিতে হয়, জনসনের টিকার একটি ডোজ দিলেই চলে বলে দাবি করা হয়েছিল। তবে নানা কারণে এই উচ্ছ্বাসে ভাটা পড়েছে। বর্তমানে তারা দুই ডোজের কার্যকারিতা নিয়ে গবেষণা করছে। প্রাথমিক ফলাফলে দুই ডোজ এক ডোজের থেকে বেশি কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। এতে করোনা প্রতিরোধী অ্যান্টিবডির উৎপাদন চার থেকে ছয় গুন বাড়ে। এর সাথে ছয় মাসের বুস্টার ডোজ যোগ করলে অ্যান্টিবডির পরিমাণ প্রায় নয়-বার গুন বেশি হয়। এই উপাত্ত ইতোমধ্যে এফডিএ-র কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। জনসনের থেকে তাদের টিকাপ্রাপ্তদের দ্বিতীয় ডোজ একটি বুস্টার হিসেবে দেয়ার কথাও বলা হচ্ছে।
স্বল্পোন্নত দেশগুলো টিকার ব্যাপারে চীনের উপর অনেকটা নির্ভরশীল। সেক্ষেত্রে সিনোভ্যাক বা সিনোফার্মের ভ্যাক্সিন নিয়ে ব্যাপক আকারে গবেষণা চালানো দরকার হলেও তথ্যের সীমাবদ্ধতা এখানে বাধা হিসেবে কাজ করছে। তারপরও সিনোভ্যাকের উপর চালানো গবেষণায় দেখা গিয়েছে, দ্বিতীয় ডোজের ৬ মাস পর করোনা প্রতিরোধী অ্যান্টিবডির মাত্রা প্রয়োজনের থেকে কমে যায়। তবে বুস্টার ডোজ প্রয়োগের মাধ্যমে একে আবার বাড়ানো সম্ভব।
প্রচলিত কয়েকটি ভ্যাক্সিনের মধ্যে চালানো তুলনামূলক গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফল দেখাচ্ছে- ফাইজার আর মডার্নার টিকার প্রাথমিকভাবে প্রায় ৯৫ শতাংশ কার্যকারিতা থাকে, যা আট মাস পর কমে গেলেও ৫০ শতাংশের নিচে নামেনি। তবে জনসনের টিকার ক্ষেত্রে দুই মাসের কম সময়ে সুরক্ষার ক্ষমতা কমে আসে ৫০ শতাংশে। রাশিয়ার স্পুটনিক আবার সেদিক থেকে ভাল ফল দেখিয়েছে। এর ক্ষেত্রে প্রতিরোধ ক্ষমতা ৫০ শতাংশে নেমে আসতে সময় নেয় প্রায় সাত মাস। ভারত বায়োটেকের ভ্যাক্সিনে ৫০ শতাংশ ধরে রাখে প্রায় পাঁচ মাস। সিনোফার্মের ক্ষেত্রে প্রাথমিক কার্যকারিতাই ৫০ শতাংশের মতো থাকে।
কোভিড ভ্যাক্সিন নিয়ে গবেষণা এখনও চলছে। আরো দীর্ঘদিন তা চলবে, এবং তারপরই কোনো ভ্যাক্সিন কতদিন সুরক্ষা দিতে পারে সেই বিষয়ে সুস্পষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছান যাবে। তবে মনে রাখতে হবে- স্বাভাবিক নিয়মেই করোনা প্রতিরোধী অ্যান্টিবডির পরিমাণ সময়ের সাথে সাথে কমতে থাকবে। একপর্যায়ে ভাইরাস ঠেকানোর মতো পর্যাপ্ত অ্যান্টিবডি শরীরে হয়তো আর থাকবে না। তবে ততদিনে মানবদেহ করোনাভাইরাসকে চিনে ফেলার দরুন আক্রান্ত হলেও দ্রুত নতুন অ্যান্টিবডি তৈরি করা যাবে যাতে সংক্রমণের তীব্রতা থাকবে কম। রচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডেভিড টফামের মতে, যারা টিকাপ্রাপ্ত তাদের ক্ষেত্রে করোনা সংক্রমণ সাধারণ সর্দিকাশির মতো কিছুতে পরিণত হবে।