X এর বয়স তেইশ, ঢাকারই একটি স্বনামধন্য সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। থাকে বিশ্ববিদ্যালয়েরই একটি অাবাসিক হলে। বেশ মিষ্টি স্বভাবের মেয়ে হলেও X কে নিয়ে তার রুমমেটদের দুশ্চিন্তার কোনো অন্ত নেই। কারণটাও বেশ অদ্ভুত। ভয়ানকও বটে। ভার্সিটি পড়ুয়া মেয়ে, এখনো ঘুমের ঘোরে রুমের বাইরে চলে যায়, নিজের মনে কথা বলে, কাঁদে, আবার ঘুমিয়ে পড়ে আপনাতেই। সকাল বেলা আবার ঘুম থেকে উঠে রাতের কীর্তিকলাপের কিছুই মনে থাকে না তার। রাতে কী করেছে বা কোথায় ছিলো জিজ্ঞেস করলে কোনো সদুত্তর দিতে পারে না, ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে শুধু।
প্রথমে প্রথমে খুব একটা অামলে না নিলেও X এর এই অাজব সমস্যায় ধীরে ধীরে সবাই তাকে ভয় পেতে শুরু করলো। সহপাঠী থেকে শুরু করে রুমমেটরা পর্যন্ত X কে এড়িয়ে চলতে শুরু করলো। সবাই বলাবলি শুরু করলো, “ওর ওপর জীনের অাছর করেছে…”, “ওর সঙ্গে কিছু একটা বাস করে…”, “ও স্বাভাবিক কোনো মেয়ে নয়…”, “ওর মধ্যে দোষ অাছে…” ইত্যাদি।
ধীরে ধীরে X একা হয়ে পড়তে শুরু করলো। এখন অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে যে কেউ তার পাশে বসতেও অাগ্রহ দেখায় না। মোটামুটি একঘরে হয়ে পড়েছে সে। এর মাঝেই ঘটলো এক দুর্ঘটনা।
এক মাঝরাতে X এর এক রুমমেট ঘুম থেকে উঠে দেখলো, সে তার খাটে নেই। ব্যাস, অার যায় কোথায়! শুরু হয়ে গেল চারিদিকে খোঁজাখুজি। এককথায় যাকে বলে চিরুনী অভিযান। শেষমেষ X এর সন্ধান যখন পাওয়া গেল তখন সে হলের পুকুরপাড়ে অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে অাছে।
অভিভাবকদের খবর দেয়া হলো। তাদেরকে ঘটনা অবহিত করলে তারা মেয়েকে বাড়িতে নিয়ে এলেন। শরণাপন্ন হলেন চিকিৎসকের। নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে জানা গেল X অাসলে এক বিচিত্র সমস্যায় ভুগছে, যার নাম সমনামবুলিজম বা স্লিপ ওয়াকিং।
সমনামবুলিজম কী?
ঘুমের ঘোরে হাঁটাচলা করাকে সমনামবুলিজম বা স্লিপ ওয়াকিং বলে। এর অারেক নাম ‘নকচামবুলিজম’। এটি ৩০ সেকেন্ড থেকে খুব বেশি হলে ২ মিনিট স্থায়ী হয়। স্লিপ ওয়াকাররা স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরার পর ঘুমের মধ্যে কী ঘটেছিল কিছুই মনে করতে পারে না। সাধারণত ছোটদের মাঝে দেখা গেলেও বড়রাও আক্রান্ত হয় এর দ্বারা।
ইতিহাস
সমনামবুলিজম এর ইতিহাসটা খুব পুরনো না হলেও বেশ রহস্যাবৃত। যুগে যুগে এটি মনোবিদ এবং দার্শনিকদের অাগ্রহের কেন্দ্রস্থল হয়ে ছিলো। সমনামবুলিজম সম্মন্ধে সর্বপ্রথম অালোকপাত করেন জার্মান প্যারাসাইকোলজিস্ট ব্যারন কার্ল লুডভিগ রাইখেনবাখ (১৭৮৮-১৮৬৯)। তিনি স্লিপ ওয়াকারদের দীর্ঘদিন পর্যবেক্ষণ করে তার বিখ্যাত Odic Force তত্ত্ব প্রদান করেন। তবে শব্দটি প্রথম ব্যবহৃত হয় ১৭৯৭ সালে।
১৯০৭ সালে মনোবিদ সিগমুন্ড ফ্রয়েড ভিয়েনা সাইকো অ্যানালিটিক সোসাইটির সম্মেলনে স্লিপ ওয়াকিং নিয়ে তার তত্ত্ব তুলে ধরেন। তিনি মনে করতেন, মানুষের অবচেতন মনে অবদমিত যৌন অাকাঙ্খার বহিঃপ্রকাশ ঘটে সমনামবুলিজমের মাধ্যমে।
ক্রিয়াকৌশল
আমাদের ঘুমের প্রধান দুটি ধাপ রয়েছে। এগুলো হলো র্যাপিড আই মুভমেন্ট (REM) এবং নন র্যাপিড আই মুভমেন্ট (Non REM)।
ঘুমের প্রথমে আসে Non REM ধাপ। এটা ৪টি উপ-পর্যায়ে বিভক্ত। এর পরে অাসে REM ধাপ যার দুটি উপ-পর্যায় রয়েছে।
REM ধাপে চোখের পেশীর সংকোচন বাড়ে, চোখ নাড়াচাড়া করতে থাকে, অন্যদিকে Non REM ধাপে চোখের পেশীর নাড়াচাড়া কমে আসে। মানুষ স্বপ্ন দেখে REM ধাপে, অার সমনামবুলিজম ঘটে ঘুমের Non REM ধাপের ৩য় ও ৪র্থ উপ-পর্যায়ে।
যাদের সমনামবুলিজমের সমস্যা অাছে তারা আর সকলের মতোই ঘুমাতে যায় বিছানায়, ঘুমিয়ে পড়ে ঠিকমতোই। কয়েক ঘন্টার মাঝেই তারা কথা বলা শুরু করে আপন মনে, হয়তো কাঁদে বা চিৎকার করে, উঠে পড়ে ঘুম থেকে। চোখ খুলে তাকায়, কিন্তু চেহারা থাকে ভাবলেশহীন, অভিব্যক্তিহীন। কারণ তারা তো আসলে জেগে নেই, চোখ খোলা ঠিকই কিন্তু তার মস্তিস্ক রয়ে গেছে ঘুমের রাজ্যে। হয়তো ঘরের মাঝে হাঁটছে সে, দরজা খুলে যাইরে চলে যাচ্ছে, যেখানে সেখানে ঘুমিয়ে পড়ছে নিজের অগোচরে, পোশাক পরছে বা খুলছে, প্রাত্যহিক অন্যান্য কাজও করছে; সবই সেই ঘুমের মাঝেই।
এমন সময় তাদেরকে সজাগ করতে গেলে হয়তো অনেকে প্রচণ্ড বিক্ষিপ্ত আচরণ করে, চিৎকার করে, ধাতস্থ হতে সময় লাগে তাদের। তবে সকলের মাঝে একটা বিষয়ে মিল থাকে যে, তারা ঘুম ভেঙ্গে আর মনে করতে পারে না ঘুমের মাঝে কী কী করেছে বা বলেছে।
কারণ
বিজ্ঞানীরা এখনো এটি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবগত নন যে ঠিক কোন কারণে মানুষ মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে আপনমনে হাঁটা শুরু করে। তবে তাদের ধারণা সারাদিনের ক্লান্তি এবং ভেঙ্গে যাওয়া ঘুম স্লিপ ওয়াকিং বা ঘুমের মধ্যে হাঁটা রোগের প্রধান কারণ। মূলত নিচের কারণগুলো সমনামবুলিজমের এর সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়।
• খুব ক্লান্ত দেহে বিছানায় গেলে।
• সারাদিন অতিরিক্ত পরিশ্রম করলে।
• অনিয়মিত ও অপর্যাপ্ত ঘুম হলে।
• কোনো কিছু নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তিত থাকলে।
• উত্তেজনা, ভয়, মানসিক অস্থিরতা থাকলে।
• স্লিপ অ্যাপানিয়া বা ঘুমের সময়ে শ্বাস-প্রশ্বাস জনিত কোনো জটিলতা থাকলে।
• ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে।
• পরিবারে কারো থেকে অাগে থেকেই ঘুমের ঘোরে হাঁটার অভ্যাস থেকে থাকলে।
• মাথায় কোনো আঘাত পেলে।
• চোখের রোগ থেকে থাকলে।
উপসর্গ
সমনামবুলিস্টরা এমনভাবে হাঁটাচলা করেন যেন তাদের সামনে কিছু নেই। সাধারণ মানুষের মতোই তারা চলাচল করেন। তবে কিছু কিছু উপসর্গ দেখে কেউ সমনামবুলিজমে অাক্রান্ত কি না তা নির্ণয় করা যায়।
• ঘুমের ঘোরেই হঠাৎ করে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়া।
• ঘুৃমের ঘোরে উঠে বসা।
• ঘুমের ঘোরেই হাঁটতে শুরু করা।
• ঘুমের ঘোরেই কথা বলতে শুরু করা (somniloquy)।
• ঘুমের ঘোরেই হাসাহাসি, কান্নাকাটি কিংবা চেঁচামেচি করা।
• সাময়িক কিংবা দীর্ঘমেয়াদী স্মৃতিভ্রম।
• শিশুদের মধ্যে মারামারি করবার প্রবণতা।
• অধিক গুরুতর ক্ষেত্রে ঘুমের মধ্যেই মলমূত্র ত্যাগ করে দেয়া।
রোগ নির্ণয়
একজন ব্যক্তি সমনামবুলিজমে অাক্রান্ত কি না তা বিভিন্নভাবে নির্ণয় করা যায়।
• শারীরিক পরীক্ষা: রোগীর দেহে বিভিন্ন ক্ষতচিহ্ন, অাঘাত (যা সে ঘুমের ঘোরে করেছে) দৈহিক ক্লান্তি, দেখে সে সমনামবুলিজমে অাক্রান্ত কি না তা নির্ণয় করা যায়।
• পলিসমনোগ্রাম।
• মাল্টিপল স্লিপ লেটেন্সি টেস্ট।
চিকিৎসা
১. সাইকোথেরাপি
বিভিন্ন সাইকোথেরাপি, যেমন- রিলাক্সেশন থেরাপি, মেন্টাল ইমেজিং এর মাধ্যমে সমনামবুলিজমের উপসর্গগুলো প্রশমন করা যায়। তবে সমনামবুলিজম নিরাময়ে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট থেরাপি হলো CPAP (Continuous Positive Airway Pressure) থেরাপি।
২. ওষুধ
বিভিন্ন ট্রাইসাইক্লিক অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট, যেমন- estazolam (ProSom), Trazodone (Desyrel) ওষুধ এক্ষেত্রে কাজে দেয়। এছাড়াও ঘুমাবার অাগে নিম্নডোজের Clonazepam (Klonopin) তিন থেকে ছয় সপ্তাহ ধরে গ্রহণ করলে উপকার পাওয়া যেতে পারে।
করণীয়
• রোগীকে কোনোভাবেই বিরক্ত করা যাবে না, সে যা করতে চায় তাকে তা করতে দিতে হবে।
• রোগীর আশেপাশে যেন কোনো ধারালো যন্ত্রপাতি না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
• রোগীকে বুঝিয়ে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে।
• রোগীকে একা ঘুমাতে দেয়া যাবে না, কারণ একা থাকলে সে নিজের অজান্তেই হাঁটতে হাঁটতে বাসা থেকে বের হয়ে যেতে পারে।
• রোগী যেন প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুমায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
• রোগীকে প্রতিদিন একই সময়ে বিছানায় যাবার অভ্যাস করাতে হবে।
• ঘুমের মাঝে যদি রোগী অদ্ভুত সব আচরণ করতে থাকে তবে তাকে সাবধানে জাগিয়ে দিতে হবে।
• ঘরের দরজায় এলার্ম লাগিয়ে দিতে হবে যেন রোগী দরজা দিয়ে বের হতে গেলে এলার্ম বেজে উঠে এবং অাশপাশের মানুষ সচেতন হতে পারে।