
একজন নারী গর্ভবতী হয়েছেন কিনা তা আজকাল ঘরে বসেই পরীক্ষা করে নেয়া যায়। প্রেগন্যান্সি পরীক্ষার সময়টাতে কেউ হয়তো আশা করছে ফলাফল পজিটিভ আসুক, আবার কেউবা হয়তো মনে মনে বলছে, পজিটিভ যেন না আসে। মূত্রের নমুনা স্ট্রিপে রেখে আপনি যখন অপেক্ষা করছেন তখন স্ট্রিপে যে কত কিছু হয়ে যাচ্ছে…। এই কতকিছুর বিস্তারিত বর্ণনার আগে মানবদেহের কিছু জৈবিক কার্যক্রম সম্পর্কে বলে নেয়া দরকার।
নারীদেহের ডিম্বাণু পরিপক্ব হয়ে জরায়ুর ফেলোপিয়ান নালীতে শুক্রাণুর সাথে মিলিত হয়ে নিষেক সম্পন্ন করে। শুক্রাণু এবং ডিম্বাণু মিলে গঠন করে জাইগোট। জাইগোট উৎপন্ন হলে তা ফেলোপিয়ান নালী ত্যাগ করে জরায়ুতে এসে অবস্থান নেয়। নালী ত্যাগ করে জরায়ুতে আসার পথেই ক্রমে ক্রমে বিভাজিত হয়ে ভ্রূণ তৈরি করে জাইগোটটি। মায়ের কাছ থেকে পুষ্টি পেয়ে ভ্রূণ তখন ধীরে ধীরে বেড়ে উঠে। মায়ের পুষ্টি জরায়ুতে প্রবেশ করে অমরা বা প্লাসেন্টার মাধ্যমে। অমরা থেকে আম্বিলিক্যাল কর্ড নামক নালীতে করে জরায়ুতে বাড়ন্ত শিশুকে পুষ্টি প্রদান করেন মা।

প্লাসেন্টা তথা অমরার সাথে সংযুক্ত আম্বিলিক্যাল কর্ড; Source: sciencemag.org

অমরায় আম্বিলিক্যাল কর্ডের সাথে যুক্ত সন্তান। আম্বিলিক্যাল কর্ডই মায়ের সাথে সন্তানের সংযোগ স্থাপন করে; Source: wikipedia.org

সঙ্গমের পরপরই জরায়ুর ফেলোপিয়ান নালীর অ্যাম্পুলা অংশে ডিম্বাণু নিষিক্ত হয়ে জাইগোট তৈরি করে। জাইগোটটি ফেলোপিয়ান নালীতে ভ্রমণ করে জরায়ু তে প্রবেশ করতে সময় নেয় ৮ দিনের মতো। জরায়ুতে আসতে আসতে মাইটোসিস বিভাজন বিভাজিত হয়ে তৈরি করে ভ্রূণ। ৯ম দিনে ভ্রূণটি গিয়ে অবস্থান নেয় জরায়ুতে। এখানেই ধীরে ধীরে বেড়ে উঠতে থাকে শিশু; Source: impacthubmedia.com
ভ্রূণ যখন জরায়ুতে যুক্ত হয়, তখন মায়ের রক্তে প্রচুর পরিমাণে হিউম্যান করিওনিক গোনাডোট্রপিন (এইচসিজি) নামক হরমোনের উপস্থিতি পাওয়া যায়। রক্তে এইচসিজি হরমোনটি দুই ধরনের কাজ সম্পাদন করতে শুরু করে। প্রথমত, এর উপস্থিতিতে মায়ের রক্তে আরো একটি হরমোনের উপস্থিতি বৃদ্ধি পায়। সেটি হলো প্রোজেস্টেরন। দেহে প্রোজেস্টেরনের কাজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি জরায়ুর সবচেয়ে ভেতরের স্তর এন্ডোমেট্রিয়ামকে সুস্থির করে রাখে যেন ভেঙে না পড়ে। এ স্তরটিই সুরক্ষিত রাখে গর্ভের সন্তানকে।
এ হরমোন সন্তানকে রক্ষা করবার কাজও করে থাকে। সন্তানের শরীরের ৫০ শতাংশই আসে পিতার শরীর থেকে। পিতার শরীরের কোনোকিছু আবার মায়ের শরীরের ক্ষেত্রে বহিরাগত। আর বহিরাগত জিনিসকে দেহের প্রতিরোধ ব্যবস্থা আক্রমণ করে। এমতাবস্থায় সন্তাহকে মায়ের দেহের প্রতিরোধ ব্যবস্থা আক্রমণ করলে সন্তানের প্রভূত ক্ষতি সাধিত হবে। মায়ের শরীরের এই প্রতিরক্ষা বাহিনী যেন সন্তানের দেহের বহিরাগত অর্ধেককে যেন শত্রু ভাবতে না পারে সেজন্য সুরক্ষা দেয় এইচসিজি।
এই এইচসিজি হরমোনটি গর্ভাবস্থার গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক। এর উপস্থিতির পরিমাণ দেখে বলে দেয়া যাবে পেটে সন্তান আছে কিনা। এটি সামান্য পরিমাণে মূত্রনালীতেও প্রবেশ করে। সেখান থেকে মূত্রের সাথে বেরিয়েও আসে সামান্য পরিমাণ। তাই প্রেগন্যান্সি স্ট্রিপে নমুনা হিসেবে মূত্র দেয়া হলে স্ট্রিপটি তখন এইচসিজি-র উপস্থিতি পরীক্ষা করে দেখে। উপস্থিতি অনুপস্থিতি দেখে বলা যায় একজন মহিলা গর্ভবতী কিনা।
প্রেগন্যান্সি পরীক্ষা করতে যে স্ট্রিপগুলো ব্যবহৃত হয় সেগুলো কাজ করে মূলত ক্রোমাটোগ্রাফির উপর ভিত্তি করে। স্ট্রিপের নির্দিষ্ট একটি অংশে মূত্রের নমুনা রাখা হয়, কিংবা স্ট্রিপের কোনো অংশকে মূত্রের নমুনায় ডুবিয়ে দেয়া হয়। এরপর বাকি কাজ স্ট্রিপ নিজেই করে নেয়।

কিছু কিছু স্ট্রিপ মূত্রের নমুনায় প্রথম দাগের নিচে পর্যন্ত ডুবিয়ে রেখে পরীক্ষা করতে হয়; Source: youtube.com
যে অংশটি মূত্রের সংস্পর্শে থাকবে সেটি তৈরি করা হয় শোষক পদার্থ দিয়ে। টিস্যু পেপারকে পানির সংস্পর্শে রাখলে পেপারটি যেমন পানি শোষণ করে নেয়, তেমনই হয় স্ট্রিপও শোষণ করে নেয় মূত্র। একটি টিস্যু পেপারের সামান্য অংশ পানিতে ফেলে রাখলে দেখা যাবে পেপারটিকে বেয়ে পানি নিজে থেকেই শুষ্ক অংশে প্রবেশ করছে। প্রেগন্যান্সি স্ট্রিপকে যখন মূত্রের সংস্পর্শে নেয়া হয় তখন মূত্র আপনা-আপনিই বেয়ে ভেতরের দিকে যেতে শুরু করে।
স্ট্রিপের ভেতরের এই শোষক অংশটিতে তিন ধরনের দাগাঙ্কিত স্থান থাকে। প্রথম যে দাগটি থাকে সেটিকে বলা হয় বিক্রিয়ার স্থান। এখানে বিক্রিয়া হয়। দাগের অংশটুকুতে নির্দিষ্ট কিছু অ্যান্টিবডি থাকে। এসব অ্যান্টিবডির কাজ হলো হিউম্যান করিওনিক গোনাডোট্রপিন অর্থাৎ এইচসিজি হরমোনকে খুঁজে বের করা এবং পাকড়াও করা। এই অ্যান্টিবডিগুলো কেবলমাত্র এইচসিজিকেই পাকড়াও করতে পারে, অন্য কোনোকিছুকে শনাক্ত করে আক্রমণ করতে পারে না।

একটি গর্ভধারণ পরীক্ষণ স্ট্রিপের বিভিন্ন অংশ; Source: earlybirdswift.co.uk
মূত্রের নমুনা বিক্রিয়ার দাগ পেরিয়ে ভেতরের দিকে প্রবেশ করার সাথে সাথে বিক্রিয়ার স্থানে তৈরি হওয়া নতুন এইচসিজি-অ্যান্টিবডি যৌগটিকেও টেনে নিয়ে যায়। নমুনাটি গিয়ে পৌঁছায় দ্বিতীয় দাগ ‘পরীক্ষণ স্থান’-এ। পরীক্ষণ স্থানে একপ্রকার রাসায়নিক পদার্থ থাকে, যেটি শুধুমাত্র এইচসিজির সাথে যুক্ত অ্যান্টিবডিগুলোর সাথে বিক্রিয়া করে। মূত্রের নমুনায় যদি এইচসিজি উপস্থিত না থাকে তাহলে দ্বিতীয় দাগে কোনো ধরনের বিক্রিয়া সম্পন্ন হয় না।
কিন্তু নমুনাতে যদি এইচসিজি উপস্থিত থাকে, এবং অ্যান্টিবডির সঙ্গে যুক্ত অবস্থায় দ্বিতীয় দাগে পৌঁছায় তাহলে এটি অ্যান্টিবডির সাথে বিক্রিয়া করে একধরণের রঙের নিঃসরণ করে। এই রঙটিই আমরা দেখতে পাই খালি চোখে। মূত্রের নমুনা যার থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে তিনি যদি গর্ভবতী না হয়ে থাকেন, তাহলে নমুনাতে এইচসিজি হরমোনটি অনুপস্থিত থাকবে, ফলে স্ট্রিপে যখন নমুনা দেয়া হবে, অ্যান্টিবডিগুলো এইচসিজি ছাড়াই দ্বিতীয় দাগ অতিক্রম করবে। দ্বিতীয় দাগে তখন এইচসিজি না থাকায় কোনো বিক্রিয়াও সম্পন্ন হবে না, রঙের নিঃসরণও আমরা দেখতে পাবো না।
দ্বিতীয় দাগে পরীক্ষা শেষ করে নমুনাটি শোষক পদার্থকে বেয়ে আরো ভেতরে প্রবেশ করে তৃতীয় এবং সর্বশেষ দাগে পৌঁছায়। তৃতীয় দাগটিকে বলা হয় ‘নিয়ন্ত্রক স্থান’। এখানেও এমন একধরনের বিক্রিয়ক পদার্থ রাখা হয়েছে যেটি এইচসিজিকে খুঁজে বেড়ায় না। তবে প্রথম দাগ থেকে আসা অ্যান্টিবডির দেখা পেলেই হলো, বিক্রিয়া করে বসে সেই অ্যান্টিবডির সাথে। এইচসিজি যুক্ত থাকুক কিংবা না থাকুক, অ্যান্টিবডির উপস্থিতি থাকা মাত্রই তৃতীয় দাগের স্থানে বিক্রিয়া সংঘটিত হবে এবং আরো একবার রঙের নিঃসরণ ঘটাবে বিক্রিয়াটি। এই রঙকেও খালি চোখে বাইরে থেকে আমরা দেখতে পাবো।

গর্ভধারণ পরীক্ষার বিভিন্ন ফল। মাঝের ডিসপ্লেতে কেবলমাত্র দ্বিতীয় (বাম) এবং তৃতীয় (ডান) দাগ দু’টো দেখা যাচ্ছে। কিছু ফল ইনভ্যালিড অর্থাৎ অকার্যকর দেখা যাচ্ছে। এমনটি হবার কারণ হলো দ্বিতীয় দাগ যেহেতু দৃশ্যমান হয়েছে, সেহেতু তৃতীয় দাগটিও অবশ্যই দৃশ্যমান হবে। আর কোনো দাগ দৃশ্যমান না হবারও সুযোগ নেই, ফলফল নেগেটিভ হলেও অন্তত তৃতীয় দাগটি দৃশ্যমান হবেই; Source: amazon.co.uk
যদি বাইরে থেকে খালি চোখে কেবলমাত্র নিয়ন্ত্রক দাগটি দেখতে পাই আমরা, তাহলে ধারণা করে নেয়া হয় নমুনা যার থেকে নেয়া হয়েছে তিনি গর্ভবতী নন। আর যদি নিয়ন্ত্রক দাগের পাশাপাশি পরীক্ষণ দাগেও রঙের উপস্থিতি পাওয়া যায়, তবে ধারণা করা হয় তিনি গর্ভবতী।

গর্ভধারণ করা সত্ত্বেও স্ট্রিপের নমুনা ত্রুটিপূর্ণভাবে নেগেটিভ ফল দেখাতে পারে। যদি ত্রুটিপূর্ণ হয়ে থাকে তাহলে বুঝতে হবে যে, এইচসিজি হরমোন উৎপন্ন হবার পূর্বেই স্ট্রিপে পরীক্ষা করতে দেয়া হয়েছে। নতুবা মানসিক চাপের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় রজঃস্রাব অনিয়মিত হয়ে পড়তে পারে। আর এমনটি হলে সাধারণত কখনোই কেউ ধরে নেবে না যে গর্ভধারণ করেছে; Source: verywell.com
অনিরাপদ সঙ্গমের পরপরই কিন্তু রক্তে বা মূত্রে এইচসিজি চলে আসে না। কেউ যদি চায় যে গর্ভধারণ করবে, তাহলে সহবাসের পর অপেক্ষা করুন সেই সকালটির জন্য যেদিন মাসিক হবার প্রথম দিন, কিন্তু মাসিক হয়নি।
যদি আরো নির্ভরযোগ্য ফলাফল চান, তাহলে রক্ত পরীক্ষা তো আছেই। রক্তে যেমন প্রায় সকল রোগের লক্ষণ লুকিয়ে থাকে, তেমনই একজন গর্ভবতী মায়ের শরীরে যে এইচসিজি হরমোন তৈরি হয় তা রক্তেও পাওয়া যাবে। রক্তপরীক্ষার মাঝে আর সন্দেহের কিছু নেই, রক্তে এইচসিজি উপস্থিত হলে রক্তের নমুনাতে পাওয়া যাবেই। রক্তপরীক্ষার ফল সঙ্গে সঙ্গে পাওয়া যাবে না, ডিম্বাণু নিষিক্ত হওয়া অর্থাৎ সহবাসের পর ৬-৮ দিনের মতো অপেক্ষা করতে হয় রক্তের নমুনা পরীক্ষা করে দেখবার জন্য। রক্ত পরীক্ষাতেও কিছুদিন সময় লাগেই। তবে রক্ত পরীক্ষায় যে ফল আসবে তার আর কোনো ভুল নেই।
ফিচার ইমেজ: romper.com