বিগত বছরের একেবারে শেষ দিকে এসে করোনাভাইরাস মহামারি শুরু হয়। ইতোমধ্যে কেটে গেছে চলতি বছরের ছয়টি মাস। কী এক তাণ্ডবলীলা চালিয়ে গেল এই করোনাভাইরাস! চোখে দেখা যায় না অথচ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব মানুষকে এক অর্থে চূড়ান্ত পর্যায়ের পর্যুদস্ত করে দিল ভাইরাসটি। পৃথিবীর বাঘা বাঘা সব চিকিৎসক, নার্স, হাসপাতাল সবকিছুকে নাস্তানাবুদ বানিয়ে এটি এখনও বেশুমার মৃত্যু উপহার দিয়ে যাচ্ছে। মহামারিতে মৃত্যু বা লাশ আক্ষরিক অর্থেই যেন শুধু সংখ্যা। চোখের সামনে একের পর এক মৃত্যু দেখতে দেখতে যারা বেঁচে আছেন, তারা শোকস্তব্ধ হয়ে যেন এক একটি প্রাণহীন জড়বস্তু।
শুরুর দিকের তুমুল প্রকোপ শেষে বিশ্বের নানা প্রান্তেই এখন মহামারি কিছুটা স্তিমিত পর্যায়ে। আবার বিশেষজ্ঞদের মতে, মহামারির দ্বিতীয় পর্যায় আসারও সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে, যা কি না হতে পারে প্রথমটির চেয়ে আরও ভয়ংকর। তবুও রাষ্ট্রযন্ত্র নেতিবাচক দিকে মনোনিবেশ না করে অর্থনীতির চাকা সচল করার উদ্দেশ্যে সমাজব্যবস্থাকে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক করে তুলতে চাইছে। দোকানপাট, রেস্তোরাঁ, পার্ক, প্রেক্ষাগৃহ, সেলুন ইত্যাদি নানা কিছুই খুলে দেওয়া হচ্ছে। কোথাও পুরোপুরি, আবার কোথাও সীমিত পরিসরে।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ হ্রাসের লক্ষ্যে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে উৎসাহিত করেছে নাগরিকদের। কম-বেশি সব দেশেই জারি হয়েছে লকডাউন। একদিকে ভাইরাসের দরুন বাইরে বের হওয়া যাবে না, অন্যদিকে ঘরে বসে থাকতে থাকতে সবাই হয়ে যাচ্ছে মানসিকভাবে ক্লান্ত আর পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে গৃহ নির্যাতন। এ যেন জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ!
যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্যে এখন সামাজিক ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গৃহীত হয়েছে। বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের সংশ্লিষ্ট সরকার নিজেদের শাসন ব্যবস্থা ও মহামারির তীব্রতানুযায়ী সিদ্ধান্ত নিয়ে লকডাউনের উপর থেকে আংশিক বা পুরোপুরিভাবে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। আধুনিক বিশ্বের অন্যতম পরাক্রমশালী দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র করোনা মহামারি পুরো সময়টা জুড়ে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রযন্ত্রের ভূমিকা সুনিপুণভাবে (!) পালন করে গেছে।
বর্তমানে টেক্সাস সরকার ১০০ জনের অধিক যেকোনো গণজমায়েত নিষিদ্ধ করেছে। অন্যদিকে টেক্সাসের রাজধানী শহর অস্টিনেই ১০ জনের বেশি মানুষের একত্র হওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ (ব্যতিক্রম হিসেবে থাকছে শুধু একই ঘরে বসবাসকারীরা)। রাজ্য সরকার বলছে এক কথা, আর রাজধানীর প্রশাসন বলছে ভিন্ন কথা। আবার দক্ষিণ ক্যারোলিনা ও ক্যালিফোর্নিয়ার অবস্থা আরও এককাঠি সরেস। যেকোনো ডাইন ইন ব্যবস্থায় সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার ব্যপারটি তাদের প্রশাসন কর্তৃক ‘প্রস্তাবিত’, তবে কোনোভাবেই ‘বাধ্যতামূলক’ নয়। টেনিসী ও উইসকনসিন রাজ্য দুটিতে সকল ধরনের প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তিদেরকে মাস্ক পরতে কর্তৃপক্ষ ‘উৎসাহিত’ করেছে কিন্তু ‘প্রয়োজনীয়’ বলে ঘোষণা দেয়নি। করোনা মহামারি নিয়ে স্বাস্থ্যসেবা খাতের সবচেয়ে তুখোড় ব্যক্তিরাই যেখানে কোনো ধরনের বলিষ্ঠ মন্তব্য করতে পারছেন না, তখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন চূড়ান্ত অযোগ্যতার প্রমাণ রেখে যাচ্ছে।
এমোরি ইউনিভার্সিটি ইন আটলান্টার রোলিন্স স্কুল অভ পাবলিক হেলথের অধ্যাপক বব বেডনার্কজিক, জর্জিয়া প্রসঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য পেশ করেন। জর্জিয়া রাজ্যের জনস্বাস্থ্য বিভাগের কাছে থাকা তথ্য বিশ্লেষণ করে তিনি বলেন,
আমরা একটি বিষয়ে সফল মানতেই হবে; আর সেটি হলো করোনাভাইরাস সংক্রমণের সূচকীয় হার হ্রাসের বিষয়টি। এ বিষয়টি আমরা সাফল্যের সাথে সম্পাদন করতে পারলেও লকডাউন তুলে নেওয়ার মতো পরিস্থিতি আসেনি। সংক্রমণের লেখচিত্রানুযায়ী আক্রান্তের সংখ্যা কমার যে ধারাবাহিকতা, সেটি এখনও পর্যাপ্ত সুস্থিতিশীল হয়নি। অর্থাৎ, এ মুহূর্তেই সব ব্যবসা-বাণিজ্য চালু করে দেওয়া হলে সংক্রমণের লেখচিত্রটিকে ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার পথ করে দেওয়া হবে।
মহামারির শুরু থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থা কখনও ছিল সম্পূর্ণ নীরব, উদাসীন আবার কখনও ছিল অহেতুক, বানোয়াট সিদ্ধান্ত উৎপাদন করার কাজে নিয়োজিত। এখন পর্যন্ত প্রশাসনের কোনো সিদ্ধান্তই জনস্বাস্থ্য বিভাগের বিশেষজ্ঞদলের কাছে সন্তোষজনক বলে মনে হয়নি। স্বাস্থ্যসেবা খাতে যেসব অভিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ নিয়োজিত আছেন, তাদের কথা আমলে না নিয়েই প্রশাসন নিজের স্থূলবুদ্ধির উপর নির্ভর করে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে এসেছে, যাতে করে প্রতিবারই হিতে বিপরীত হয়েছে। হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলে কর্মরত ঐতিহাসিক ন্যান্সি কোয়েন অধ্যাপনা করছেন দুর্যোগকালীন নেতৃত্ব বিষয়ে। মহামারি নিয়ন্ত্রণে তার দেশের রাজনৈতিক ব্যর্থতার প্রতি উদ্দেশ করে তিনি বলেন,
যুক্তরাষ্ট্রের সংকটকালে নেতৃত্বের এ এক শোচনীয় ব্যর্থতা। মহামারি নিয়ন্ত্রণে একজন সচেতন নাগরিকের দায়িত্ব, করণীয়, জীবন যাত্রার ধরন সম্পর্কে রাষ্ট্রযন্ত্রের বাস্তবসম্মত ও সময়োচিত দিক নির্দেশনা না দিতে পারা মূলত জাতীয় পর্যায়ে এক বিরাট ব্যর্থতা।
মহামারির মাঝে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের এই আস্থাহীনতার নিদর্শন মূলত সুস্থ থাকার দায় জনগণের ওপরেই বর্তায়। অর্থাৎ বিচক্ষণতার সাথে, পরিকল্পনামাফিক যে সমস্যাটির সমাধান করা যেত, শাসন ব্যবস্থার কেন্দ্র থেকে সেই একই পদক্ষেপগুলো প্রত্যেককে গ্রহণ করতে হবে ব্যক্তিগত জায়গা থেকে। অ্যান্থনি ফাউচি এ বিপর্যয় কাটিয়ে উঠবার জন্য প্রত্যেক নাগরিককে স্বীয় অবস্থান থেকে সর্বোচ্চ সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
দিনের পর দিন ঘরে বসে থাকতে থাকতে সকলের মাঝেই ক্লান্তি চলে আসাটা খুবই স্বাভাবিক। বাইরের পরিবেশের মাঝে বের হয়ে নিজেকে মেলে দেওয়ার ইচ্ছাটা তাই প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছে। করোনাভাইরাস সংক্রমণের পথও এটিই। করোনা ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হওয়ার সম্পূর্ণ দায় আপনার একার নয়; আপনার চারপাশের মানুষের আচরণের উপরও নির্ভর করছে আপনার সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা। শঙ্কার বিষয় হচ্ছে, দিন দিন লক্ষণবিহীন সংক্রমণের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। যদি একজন ব্যক্তি করোনাভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাব্য লক্ষণসমূহ প্রদর্শন করেন, তাহলে তিনি এবং তার চারপাশের মানুষ সতর্কতা অবলম্বনের সুযোগ পাচ্ছেন। কিন্তু, ন্যূনতম কোনো লক্ষণ ছাড়াই যারা নিজেদের দেহে ভাইরাসটিকে বহন করে চলেছেন, তাদের ক্ষেত্রে ব্যপারটি ভিন্ন।
অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত কোনো দেশেই লকডাউন চালু রাখা সম্ভব না। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনযাপনে সকলকেই ফিরতে হবে। বাচ্চারা বাইরে বের হতে চাইবে, ব্যবসা চালু হবে, বিনোদন কেন্দ্রগুলো সচল হবে, সবাই কর্মক্ষেত্রে ফিরবে- পুরো আর্থসামাজিক ব্যবস্থার চাকা খুব অল্প করে হলেও ঘুরতে শুরু করবে। এমতাবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব হবে না। তখন মাস্ক এবং গ্লাভস পরিধান হবে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বনের একমাত্র পন্থা।
মাস্ক পরে রাস্তা দিয়ে যখন আপনি কাউকে অতিক্রম করছেন, বাস কিংবা ট্রেনে সহযাত্রীর সাথে একই গন্তব্যে ভ্রমণ করছেন, কর্মস্থলে সহকর্মীকে সাহায্য করছেন, তখন আপনার এই আচরণটি মহামারির সময়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বার্তা বহন করে- আপনি আপনার চারপাশের মানুষগুলোর প্রতি মানবিকতা, সহমর্মিতা প্রদর্শন করছেন। আপনি একজন ব্যক্তি মাস্ক পরিধানের মাধ্যমে অন্যদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করছেন। এভাবে করে প্রত্যেকের একই ব্যবহার সকলের জন্য একটি সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা গড়ে তোলে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মার্ক মলিন্সকি এ বিষয়ে বলেন,
ভাইরাসের বিস্তার রোধে প্রত্যেকের মাস্ক পরিধান করা উচিত। মাস্ক পরিধানকে নিজের ব্যক্তিস্বাধীনতার সাথে সাংঘর্ষিক পদক্ষেপ কিংবা নিজস্ব পছন্দ হিসেবে বিবেচনা না করে বরং সমাজের অন্য সকলের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের মাধ্যম হিসেবে দেখা যেতে পারে।
এখানে বিশেষভাবে মনে রাখা দরকার, লকডাউন উঠে যাওয়ার অর্থ এই না যে, করোনাভাইরাস মানুষের নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। জীবনযাত্রার স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে যেতে হবে বলে লকডাউন ধীরে ধীরে উঠিয়ে নেওয়া হচ্ছে সারা বিশ্ব জুড়ে। কেননা, মানুষ এখন ঘর থেকে বের হতে অনেকটাই বাধ্য। তাই সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা (যতটা সম্ভব), নিয়মিত হাত ধোয়া এবং মাস্ক ব্যবহারের চর্চা করতেই হবে সকলকে। প্রতিরক্ষামূলক এসব আচরণের মাধ্যমে মানুষ হয়তো এমন একটি জীবন বাঁচাবে, যা তার নিজের নয়। স্বাভাবিক জীবনে ফেরার যাত্রায় শামিল হতে হলে সতর্কতা শুধু নিজের জন্যই নয়, বরং অন্য সকলের জন্যও।
লকডাউনের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা সরে যাওয়ার অর্থ, আইনত একজন মানুষ ঘরের মাঝে থাকতে বাধ্য নন। স্বাভাবিক মেলামেশায় কেউ যদি অংশগ্রহণ করেন, তবে সেটিকে অপরাধ বলে গণ্য করা যাবে না। তবে সুরক্ষার জন্য চাইলেই নিজের আচরণের রাশ টেনে ধরা যায়। মহামারির এই সময়টাতে ‘নিতান্ত প্রয়োজনীয়’ আর ‘ঐচ্ছিক’ এই দুটি বিষয়ের পার্থক্য বুঝতে হবে। যে কাজটি না করলেই নয়, শুধু সেটিকেই প্রাধান্য দেওয়া উচিত। আড্ডা, রেস্তোরাঁয় খাওয়া, পার্কে ঘুরতে যাওয়া, আনন্দ-উৎসব করা; এ ধরনের যেসব কাজ না করলেও জীবন চলছে, সেগুলো পরিহার করাই শ্রেয়।
শুধু প্রশাসনের সিদ্ধান্ত বা ঘোষণার দিকে না তাকিয়ে থেকে নিজের জায়গা থেকে সচেতন থাকাটাই হবে এখন সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ। নিজে বাঁচুন, অন্যকেও বাঁচার পথে সাহায্য করুন; সর্বোপরি, যথাসম্ভব নিরাপদে থাকুন।