(পর্ব ১ এর পর থেকে)
বর্তমান সংকটে রাশিয়ার প্রতি যুক্তরাষ্ট্র যে মনোভাব দেখাচ্ছে, এতে আরো বড় ধরনের যুদ্ধের সম্ভাবনা বাড়ছে না কমছে? আপনার কী মনে হয়?
চমস্কি: আমি জানি না, আপনি দেখেছেন কিনা। যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান কূটনীতিকদের মধ্যে সবচেয়ে বিচক্ষণ ও সম্মানিত ব্যক্তিদের একজন চ্যাস ফ্রিম্যান, কিছুদিন আগে এক সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা সাক্ষাৎকার। সেখানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের “শেষ ইউক্রেনীয় জীবিত থাকা পর্যন্ত রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা” নীতির সমালোচনা করেছেন। ফ্রিম্যান বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের নীতির কারণে ইউক্রেন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, এবং পরিস্থিতি একটা অন্তিম যুদ্ধের দিকে যাচ্ছে।
ইউক্রেন সংকট সমাধানে এখন দুটি পথ খোলা আছে। প্রথমটি হচ্ছে, কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টির নিষ্পত্তি করা, যা পুতিনকে পার পেয়ে যেতে সাহায্য করবে। আমাদের কি সেটা করার উপায় আছে? আমরা জানি না; আমরা কেবল চেষ্টা করে দেখতে পারি, কিন্তু আমরা চেষ্টা করতে রাজি না। আরেকটি উপায় হচ্ছে, পুতিন ও তার ঘনিষ্ঠ সহচরদের স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেওয়া যে, তারা যা-ই করুক না কেন, তাদেরকে যুদ্ধাপরাধের জন্য বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। বরিস জনসন অনেকটা এমন সুরেই বলেছেন, “আপনারা যা-ই করুন না কেন, অবরোধ (স্যাঙ্কশন) চলতেই থাকবে।” এটা কী নির্দেশ করে? এটা বোঝায়- যাও, ইউক্রেন ধ্বংস করে দাও, যা অন্তিম যুদ্ধের শুরু করবে।
দুটি পথের মধ্যে আমরা দ্বিতীয়টি বেছে নিয়েছি। আমরা আমাদের বীরত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ডের প্রশংসা করে যাচ্ছি। আমার কাছে মনে হয়, পুরো বিশ্বই হাস্যকর আর অদ্ভুত রূপ ধারণ করেছে। কিছুদিন আগে হিলারি ক্লিনটন পরামর্শ দিলেন, আমরা ব্রেজেজিনস্কির কৌশল অবলম্বন করতে পারি। ব্রেজেজিনস্কি ছিলেন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা। তিনি ১৯৯৮ সালে ফ্রান্সে এক সাক্ষাৎকারে জানান, রাশিয়াকে কীভাবে তারা আফগানিস্তানে যুদ্ধে টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন, যা ১৯৭৯-৮৯ এর সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধের সূচনা করে। ঘটনাটা আদৌ সত্য ছিল, নাকি তিনি কৃতিত্ব নেওয়ার জন্য এমন বলছিলেন, তা খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। তিনি বলেছিলেন, কার্টারের নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে তিনি প্রেসিডেন্টকে প্রলুব্ধ করেন, আফগানিস্তানের রুশপন্থি সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা গোষ্ঠীদের অস্ত্র সরবরাহ করার জন্য। তিনি যুক্তি দেখান, এতে রুশরা সেখানে সরাসরি যুক্ত হয়ে যাবে।
রুশ আর্কাইভের নথিগুলো ফাঁস হওয়ায় আমরা এখন জানি, রাশিয়া খুব দ্রুতই তাদের ভুল বুঝতে পেরেছিল, এবং আফগানিস্তান থেকে বের হয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু ব্রেজেজিনস্কি যেটা শুরু করেছিলেন, পরবর্তীতে রিগ্যানের প্রশাসনের সময়েও যুক্তরাষ্ট্র সেটা ধরে রাখে। যুক্তরাষ্ট্র তখন ওসামা বিন লাদেনের মতো ব্যক্তিদের সংগঠিত করতে থাকে, যেন রাশিয়া যুদ্ধ থেকে বের হয়ে আসতে না পারে। এর ফলে প্রায় দশ লক্ষ আফগান নাগরিকের মৃত্যু হয়, এবং দেশটি ধ্বংস হয়ে যায়।
ব্রেজেজিনস্কিকে ওই সাক্ষাৎকারে প্রশ্ন করা হয়, এতে কি আদৌ কোনো উপকার হয়েছে কিনা। তিনি উত্তর দেন, আমাদের শত্রুকে দুর্বল করে দেওয়ার সাথে আফগানদের পরিণতির কোনো তুলনা হয় নাকি!
আমরা (আমেরিকানরা) এমনই। হিলারি ক্লিনটন এমন ঘটনারই পুনরাবৃত্তি করতে চাচ্ছেন। রুশদের ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যতটা সম্ভব দীর্ঘ সময় ধরে যুদ্ধরত অবস্থায় রাখা। এতে রাশিয়া ক্লান্ত হয়ে যাবে, দুর্বল হয়ে যাবে, ধ্বংস হয়ে যাবে; আমরা তাদের পরাজিত করতে পারব। অন্যদিকে অবশ্যই ইউক্রেন দেশটি মুছে যাবে। এটাই আমাদের উদারনৈতিক মনোভাব।
যখন কেউ বলে, রাশিয়া ইউক্রেনে আগ্রাসনমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে, তখন আপনি এটাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করেন? এটা যুদ্ধাপরাধ। হ্যাঁ, যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিচারিতা থাকতে পারে; কিন্তু রাশিয়ার যুদ্ধাপরাধকেও তো উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি হাত জোর করে নো-ফ্লাই জোন ঘোষণা করার কথা বলছেন; সেটা সম্ভব না হলে বেশি বেশি অস্ত্রের সরবরাহ দেওয়ার কথা বলছেন। এটা ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব রক্ষার যুদ্ধ। আর এই সংকটের সমাধানে যদি পুতিনকে পার পেয়ে যেতে দেওয়া হয়, তাহলে তা ভবিষ্যতে আরো আক্রমণাত্মক যুদ্ধ শুরুর সম্মতি হিসেবে কাজ করতে পারে। এরকম প্রশ্ন উঠলে কীভাবে এর ব্যাখ্যা দেওয়া উচিত?
চমস্কি: দেখুন, আমি জেলেনস্কির সমালোচনা করতে চাই না। তিনি খুবই সাহসিকতার সাথে লড়ে যাচ্ছেন। তিনি যে অবস্থানে আছেন, তার প্রতি সহানুভূতি কাজ করে। কিন্তু পেন্টাগন এখানে তার চেয়ে বাস্তবসম্মত পন্থা অবলম্বন করেছে। হ্যাঁ, আমরা যুদ্ধে জড়িয়ে যেতে পারি। আমরা জেলেনস্কিকে জেট প্লেন আর অত্যাধুনিক অস্ত্রের যোগান দিতে পারি। কিন্তু পুতিনও একইসাথে ইউক্রেনে আক্রমণের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে দেশটাকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দেবেন, যার সামর্থ্য তার আছে। তিনি অত্যাধুনিক অস্ত্রের সাপ্লাই চেইনগুলোতে আক্রমণ করবেন। এতে আমরাও যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ব, যা হবে পারমাণবিক যুদ্ধ এবং তা আমাদের সকলকেই ধ্বংস করে দেবে।
তাই আমি জেলেনস্কিকে দোষ দিচ্ছি না; তিনি একজন সম্মানিত ব্যক্তি, তিনি খুব সাহসিকতা দেখাচ্ছেন। আপনি তার অবস্থান বিবেচনা করে সহানুভূতি দেখাতে পারেন। কিন্তু একইসাথে আপনাকে বাস্তবতাও অনুধাবন করতে হবে। আমি আবারও বলছি, আমাদের দুটি রাস্তা খোলা আছে। একটা হচ্ছে, আমরা এখন যেটা করছি- শেষ ইউক্রেনীয় জীবিত থাকা পর্যন্ত রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়া। একইসাথে অবশ্যই আমরা পারমাণবিক যুদ্ধের সম্ভাবনার কথাও বিবেচনায় রাখতে পারি। অথবা, এর বিকল্প কেবল কূটনৈতিক মধ্যস্থতায় সমাধান করতে পারি। কিন্তু এটা পুতিন আর তার সহচরদের পার পেয়ে যেতে সাহায্য করবে।
ইউক্রেনকে নিরপেক্ষ অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার উপায় হলো, দনবাস অঞ্চলকে স্বায়ত্ত্বশাসনের সুযোগ দেওয়া, যেটা ইউক্রেনের ফেডারেল ব্যবস্থার মধ্যে হতে পারে; এবং অবশ্যই ক্রাইমিয়াকে আলোচনার বাইরে রাখা, আপনি সেটা পছন্দ করুন বা না করুন তাতে কিছু যায় আসে না। ধরুন, আগামীকাল সুনামি আসছে। কিন্তু আপনি চিৎকার করে বললেন, “আমি সুনামি পছন্দ করি না”, বা “আমি সুনামির অস্তিত্ব স্বীকার করি না”। আপনার এ ধরনের বক্তব্য কোনো কাজে আসবে না। বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন বিশ্লেষকরা বুঝেন, ক্রাইমিয়া নিয়ে এখন আলোচনার সময় নয়। ইউক্রেন ধ্বংস হওয়া আর পারমাণবিক যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার বিকল্প খুঁজে পাওয়া যেতে পারে কূটনৈতিক মধ্যস্থতা দিয়েই। আপনি চাইলে বীরদর্পে বিবৃতি দিতে পারেন, বলতে পারেন সুনামি আপনার ভালো লাগে না, কিংবা সমাধানটা পছন্দ করছেন না। কিন্তু এতে কারোরই কোনো লাভ হবে না।
রাশিয়ার আক্রমণের আগে থেকেই কূটনৈতিক মধ্যস্থতার ক্ষেত্রে, বাইডেন প্রশাসনকে অনিচ্ছুক মনে হয়েছে। আমেরিকান মিডিয়াতে দেখানো হচ্ছে, পুতিন তার সাইকোপ্যাথি থেকে ইউক্রেনে আক্রমণ করেছেন, এবং আমাদের কাজ হচ্ছে ইউক্রেনীয়দের অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করা। এখানে একমাত্র বিতর্ক হচ্ছে, তাদেরকে আমাদের ঠিক কী পরিমাণ অস্ত্র দেওয়া উচিত? আমরা কি শুধু অস্ত্র দিয়েই বসে থাকব, নাকি সামরিক দিক দিয়েও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করব? কিন্তু আপনি যেটা বলেন, এখানে যুক্তিসঙ্গত কাজ হবে ইউক্রেনীয়দের এই ভয়াবহ যুদ্ধে প্রাণ হারানো থেকে মুক্ত করা।
চমস্কি: আমি একমত, শুধু মাত্র “যুক্তিসঙ্গত” শব্দটা ছাড়া। এটা তুলনামূলক মানবিক পন্থা। হিটলারও পুরোপুরি যুক্তিসঙ্গত কাজ করতেন। এটা যৌক্তিকতার কোনো ব্যাপার নয়। একটা জাতিকে গণহত্যা করে নির্মূল করে ফেলেও আপনি যৌক্তিক কাজ করতে পারেন। হেনরি কিসিঞ্জার যুক্তরাষ্ট্রে অনেক প্রশংসিত একজন ব্যক্তি। আমি নিশ্চিত, তিনি যখন তার আধা-মাতাল নেতা রিচার্ড নিক্সনের কাছ থেকে নির্দেশ পাওয়ার পর, যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনীর কাছে প্রেরণ করেন, তিনিও তখন যৌক্তিক কাজই করেছিলেন। নির্দেশনাটি ছিল, কম্বোডিয়াতে “যেকোনো কিছু উড়তে দেখলে বা নড়াচড়া করতে দেখলেই বোমা নিক্ষেপ করা”। এটা ছিল ব্যাপক আকারে গণহত্যার নির্দেশ। আমার মনে হয় না, আর্কাইভ ঘেটে দেখলে আপনি এর চেয়ে যৌক্তিক কোনো পন্থা খুঁজে পাবেন; আপনি চেষ্টা করে দেখতে পারেন। ওয়াশিংটন একে অনুমোদন দিয়েছিল। আসলে সেটা কাজেও দিয়েছিল। তিনি এখন আমেরিকার সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তিদের একজন। আমরা যদি একটু সাহস নিয়ে আমেরিকান ইতিহাসের দিকে তাকাই, সেখান থেকে অনেক কিছু শিখতে পারি।
তাহলে যুক্তরাষ্ট্র এখানে অযৌক্তিক কিছু করছে না। যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণীর ইতিহাসের দিকে তাকালে আপনি দেখতে পান, আমরা যা করেছি তা পুরোপুরি যৌক্তিক ছিল; কিন্তু তা হয়ে যায় সোশিওপ্যাথিক কার্যক্রম। বিভিন্ন ঘটনা বিচার করে দেখলে এটাই সত্য মনে হয়।
চমস্কি: কিসিঞ্জারের আরেকটি অর্জনের দিকে তাকান। তিনি চিলির সংসদীয় সরকারকে উৎখাত করে সেখানে খুনী পিনোচেত স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করেন। ঠিক এই মুহূর্তে, চিলিবাসীরা সেই ঘটনার পরিণতি দূর করতে চাচ্ছে। কিসিঞ্জার খুবই যুক্তিসঙ্গত অবস্থান নিয়েছিলেন। তার পদক্ষেপের পেছনে যথেষ্ট কারণ ছিল। আর এই কারণগুলোও যৌক্তিক ছিল। তিনি বলেছিলেন,
চিলিতে যদি সংস্কারপন্থী সংসদীয় গণতন্ত্র সফল হয়, তাহলে এর প্রভাব হবে ক্ষতিকর। এটা দক্ষিণ ইউরোপে পর্যন্ত ছড়িয়ে যেতে পারে, যেখানে ইতালি আর স্পেন সংসদীয় বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ে অস্বস্তিতে আছে। এটা হচ্ছে ইউরো-কমিউনিজম বা সামাজিক গণতন্ত্র। আমরা চাই না এই ভাইরাস পুরো ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ুক। তাই চিলির সরকার উৎখাত করে দেওয়াটাই ভালো হবে।
এটা কি যৌক্তিক? এটাই রাজনীতি। আমরা এ কারণেই পঞ্চাশের দশকের শুরুতে ভিয়েতনামে যুদ্ধ করতে গিয়েছিলাম। আপনি অভ্যন্তরীণ রেকর্ডগুলো দেখলে আপনার কাছে যুদ্ধে যাওয়াটা যৌক্তিকই মনে হবে।
এগুলো আমাদের স্কুলে শেখানো হয় না, কিন্তু বাস্তবে প্রতিটি ঘটনার ক্ষেত্রেই এসব হয়। বিখ্যাত ইউরোপীয় নেতা মেটারনিখ, কিসিঞ্জারের মতোই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন আমেরিকান বিপ্লব নিয়ে। তিনি চিন্তা করছিলেন, সংসদীয় গণতন্ত্র পুরো বিশ্বেই ছড়িয়ে পড়তে পারে, যা বিশ্বে ইউরোপীয়দের আধিপত্য খর্ব করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রই এরকম চিন্তা প্রথম করেনি। আমরা যদি একটা মুক্ত দেশে বাস করতাম, তাহলে আমার এগুলো বলার প্রয়োজন পড়ত না। তখন সবাই মাধ্যমিক স্কুলেই এসব বাস্তবতা সম্পর্কে জানতে পারত।
(পরবর্তী অংশ শেষ পর্বে)