![](https://assets.roar.media/assets/xQZg6dPFPJiXndPE_2b8cc29dde9e4a1899762d91866dd113_18.jpg?w=1200)
হীবার কাহিনী
২০১৮ সালের ২৩ নভেম্বর। সেদিনটাও ছিল অন্য আর সব দিনের মতোই। ১৮ মাস বয়সী হীবা মনের আনন্দে খেলা করছিল তার বড় ভাইয়ের সাথে। খেলতে খেলতে খিলখিলিয়ে হেসে উঠছিল সে। জগতের সকল সুখ যেন এসে ভর করেছিল তার চোখে-মুখে। ক্ষণিক বাদেই যে সেই চোখে অন্ধকার নেমে আসবে, সেই মুখের হাসি বিলীন হয়ে যাবে, তা কি কেউ ভাবতে পেরেছিল! কিন্তু বিধাতার কী নির্মম পরিহাস, বাস্তবে হলো ঠিক এমনটাই।
হীবাদের বাড়ির অদূরেই ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে লড়াই করছিল তাদের গ্রামের মানুষজন। নিরাপত্তা বাহিনী যখন ছয় বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসীকে ধরতে অভিযান চালায়, তখন গ্রামের কিছু মানুষ ভারতবিরোধী স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে। মুহূর্তের মধ্যেই গোটা এলাকায় তুমুল উত্তেজনা বিরাজ করতে শুরু করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে টিয়ার গ্যাস ছোঁড়ে নিরাপত্তা বাহিনী।
একপর্যায়ে নিরাপত্তা বাহিনী আর বিক্ষুব্ধ জনতা হীবাদের বাড়ির কয়েকশো মিটারের মধ্যে চলে আসে। এবং হীবাদের বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করে ভয়ংকর টিয়ার গ্যাস। বাড়িময় ছড়িয়ে পড়ে বিষাক্ত ধোঁয়া। প্রতি সেকেন্ডেই যেন বাতাস আগের চেয়েও ভারি হয়ে উঠতে থাকে। শ্বাস নেওয়াটাই হয়ে পড়ে দুরূহ ব্যাপার। হীবার পাঁচ বছর বয়সী বড় ভাই শাহাদাতের দম বন্ধ হয়ে আসে। আর হীবা তো বমিই করতে শুরু করে।
![](https://assets.roar.media/assets/peM18uKka0Q7Uw6f_hiba-jan.jpg)
হীবাদের বাড়িতে তখন সে আর তার বড় ভাই ছাড়া ছিল কেবল তাদের মা মুরসালা জান। রান্নাঘরে কাজ করছিলেন তিনি। ঘরের মধ্যে ধোঁয়া ঢুকে পড়ায় হাতের কাজ ফেলে সন্তানদের কাছে ছুটে আসলেন তিনি। ঘরের মধ্যে শ্বাস নেওয়া অসম্ভব ছিল বলে সন্তানদের হাত ধরে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে পড়লেন তিনি। আর সেটিই ছিল তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। বাইরে বেরিয়েই তিনি বুঝতে পারলেন, ফাঁদে আটকা পড়ে গেছেন। ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুনে পতিত হওয়ার মতো সরাসরি যুদ্ধের ময়দানে হাজির হয়ে গেছেন।
মুরসালা জান দেখতে পেলেন, নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা তাদের দিকেই এগিয়ে আসছে। তাই এক হাত দিয়ে ছেলে শাহাদাতকে টেনে নিজের পেছনে নিয়ে আসলেন তিনি। আর অন্য হাত দিয়ে চেপে ধরলেন মেয়ে হীবার মুখ। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হলো না। এক সৈন্য তিনটি পেলেট ছুঁড়ল তার হাত লক্ষ্য করে। সেই তিনটি পেলেটের দুটি তার হাতে বিদ্ধ হলেও, বাকি একটি তার হাত ফাঁকি দিয়ে লাগলো সরাসরি হীবার ডান চোখে।
ব্যথায় গগণবিদারী চিৎকার করে উঠলো হীবা। গলগল করে রক্ত বের হতে থাকল তার চোখ দিয়ে। ১৮ মাস বয়সী হীবা সেই নারকীয় যন্ত্রণা সইবে কী করে! অসহনীয় ব্যথায় মূর্ছা গেল সে। যখন তার জ্ঞান ফিরলো, তখন তাকে অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে রাজধানী শ্রীনগরের হাসপাতালে। চারপাশে পরিচিত মুখদের দেখতে পেল সে। সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত মায়ের মুখটিও ছিল সেখানে- উদ্বিগ্ন, উৎকণ্ঠিত, সন্তানের কষ্টে দিশেহারা এক মায়ের মুখ। মেয়ের দিকে একটি ক্যান্ডি এগিয়ে দিলেন তিনি। কিন্তু যে মেয়ে ক্যান্ডি বলতে পাগল, এবার সে তার সেই প্রিয় ক্যান্ডি পেয়েও খুশি হলো না। ককিয়ে ককিয়ে কেবল বলতে থাকল, “মা, ব্যথা, ব্যথা!”
এরপর দুবার অস্ত্রোপচার করা হয়েছে হীবার চোখে। কিন্তু চিকিৎসকরা কোনো আশার আলো দেখাতে পারেননি। তাদের আশঙ্কা, ক্রমশই চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যেতে পারে হীবার। এবং একসময়ে পুরোপুরি অন্ধ হয়ে যাওয়াও বিচিত্র কিছু নয়।
![](https://assets.roar.media/assets/q3VmKZLDi4a8PqGd__104520399_hibajanpelletvictim1.jpg)
এবং এভাবেই হীবা পরিণত হয়েছে পেলেট গানে আক্রান্ত বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ ব্যক্তিতে। নিঃসন্দেহে কোনো বাবা-মা তার সন্তানের এমন অর্জনের আকাঙ্ক্ষা করবেন না।
“একটি বাচ্চার মায়ের জন্য এর চেয়ে কষ্টকর আর কিছু কি হতে পারে? আমি বুঝতে পারছি সে কী অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করছে। কিন্তু মুখ ফুটে সেটা প্রকাশও করতে পারছে না!” এভাবেই মেয়ের অবর্ণণীয় কষ্টের বিবরণ দেন মা মুরসালা জান।
“আমি জানি না ভবিষ্যতে তার জন্য কী অপেক্ষা করছে। জগতের এত অন্ধকার নিয়ে সে কী করবে? সে এতই ছোট যে কোথায় কষ্ট হচ্ছে তা আমাকে বলতেও পারছে না। কেবল হাত দিয়ে নিজের চোখ দেখাচ্ছে আমাকে। কিন্তু সে চোখ বন্ধ করতেও চাইছে না। হয়তো চোখ বন্ধ করলে তার ব্যথা আরও বেড়ে যায়।“
মুরসালা জানের যে বাক্যটি সবচেয়ে বেশি নাড়া দেয়, তা হলো, “ওর বদলে পেলেটগুলো যদি আমাকে আঘাত করতো!“
পেলেট গান বিভীষিকা
জম্মু-কাশ্মীরের মানুষের কাছে এই পেলেট গান এক বিভীষিকার নাম। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের পরিসংখ্যান মতে, ২০১০ সালের পর থেকে এই পেলেট গান কেড়ে নিয়েছে কাশ্মীরের ১৪ জন মানুষের প্রাণ। এছাড়াও ২০১৬ সালে ভারতীয় আর্মির হাতে বিদ্রোহী নেতা বুরহান ওয়ানির মৃত্যুর পর থেকে কাশ্মীর জুড়ে যে সহিংসতা শুরু হয়েছে, তার সূত্র ধরে পেলেট গানের আঘাতে আহত হয়েছে ছয় হাজারেরও বেশি মানুষ। তাদের মধ্যে ৭৮২ জন দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছে কিংবা হারানোর পথে। অপরদিকে রাজ্যের মানবাধিকার কমিশন বলছে, ২০১৬ সালের পর থেকে ৩,৮০০ জন ব্যক্তির পেলেট গান দ্বারা আক্রান্ত হওয়া ও অন্ধত্ব বরণের তথ্য তাদের হাতে রয়েছে। তবে এটিও ঠিক যে এমন অনেকেই আছে যারা ভবিষ্যতে আরও খারাপ পরিণতির ভয়ে মানবাধিকার কমিশনের কাছে নিজেদের আক্রান্ত হওয়ার ব্যাপারে আনুষ্ঠানিকভাবে নিবন্ধন করছে না।
কী এই পেলেট গান?
যুক্তরাজ্যভিত্তিক দাতব্য সংস্থা ওমেগা রিসার্চ ফাউন্ডেশনের মতে, “ভারতীয় বাহিনী একে পেলেট গান বলে চালাচ্ছে। কিন্তু এটি আসলে একটি পাম্প অ্যাকশন শটগান। পার্থক্য কেবল অ্যামুনিশনের ধরনে- একটি কার্টিজে পাঁচশোর মতো ছোট লেড পেলেট থাকে, ফায়ার করার পর যা চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। সাধারণত শিকারীরা বন্যপ্রাণী শিকার করতে এগুলো ব্যবহার করে থাকে। এই অ্যামুনিশন জননিয়ন্ত্রণের জন্য প্রস্তুত হয়নি।“
![](https://assets.roar.media/assets/IB3QTXFz4lVACxCW_552900-guns-thinkstock-030217.jpg)
ফায়ার করার পর লেড পেলেটগুলো যখন বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে পড়ে, তখন তারা নির্দিষ্ট কোনো প্যাটার্ন অনুসরণ করে না। পেলেটগুলো ত্বকের পাতলা টিস্যু ভেদ করে ভেতরে ঢুকে যায়, এবং যেহেতু চোখ শরীর কাঠামোর সবচেয়ে স্পর্শকাতর ও নমনীয় অংশ, তাই পেলেটের আক্রমণে চোখের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে সর্বোচ্চ। পেলেট একবার চোখের ভেতরে প্রবেশের পর চোখের সব টিস্যু ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয়। ফলে চোখের ক্ষতি হওয়া একপ্রকার নিশ্চিত। বেশি রক্তক্ষরণে কেবল অন্ধত্বই নয়, আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যুও অস্বাভাবিক কিছু নয়।
প্রথমদিকে কেবল গোলাকার পেলেটের দেখা মিললেও, আজকাল চিকিৎসকরা আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে বিভিন্ন আকৃতির, এবং আগের চেয়েও অনেক বেশি তীক্ষ্ণ ও চোখা পেলেট আবিষ্কার করছেন, যা আক্রান্ত ব্যক্তির সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনাকে প্রায় ধূলিসাৎ করে দিচ্ছে।
ভারতে পেলেট গানের ব্যবহার
২০১০ সালে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্য পুলিশ প্রথম পেলেট গান ব্যবহার করে। সেবার যখন প্রস্তরনিক্ষেপ আন্দোলনে শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছিল, তখনই পেলেট গান প্রয়োগের প্রথম অভিযোগ পাওয়া যায়। ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী একে ‘প্রাণঘাতী নয়’ বলে দাবি করলেও, ২০১৬ সালে এর বিরুদ্ধে জনসাধারণের তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়, এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এই পেলেট গান ব্যবহারের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আশ্বাস দেয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত পেলেট গান ব্যবহার অব্যহত রয়েছে। ক্রমাগত এটি আগের চেয়েও বেশি বিধ্বংসী হয়ে উঠছে।
![](https://assets.roar.media/assets/RWKJBRmtH0uHwqpg_pakistan-militant-759.jpg)
পেলেট গানের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া
সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে পেলেট গান ব্যবহারের বিরুদ্ধে জনমত গঠনের প্রচেষ্টা চলছে। একদিকে ভারতের মূলধারার গণমাধ্যম যেমন পেলেট গান নিয়ে খবরের শিরোনাম করছে, তেমনই পাকিস্তানে পেলেট গানের ব্যবহার চিত্রিত হচ্ছে ভারতীয় নির্মমতার আরও একটি নিদর্শন হিসেবে। আর কাশ্মীরের মানুষের মাঝে নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে ক্ষোভ অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে চরম আকার ধারণ করেছে।
২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জম্মু ও কাশ্মীরের পিপল’স ডেমোক্রেটিক পার্টি (পিডিপি) ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে পেলেট গানের ব্যবহারের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল। তৎকালীন পিডিপি প্রেসিডেন্ট মেহবুবা মুফতি মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহর বিরুদ্ধে ‘পেলেট গান ব্যবহারের মাধ্যমে কাশ্মিরী তরুণ সমাজকে অন্ধ করে দেয়ার’ অভিযোগ এনেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে তার দল ক্ষমতায় আসার পরও পেলেট গানের ব্যবহার বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়েছে। এ ব্যাপারে জম্মু ও কাশ্মীর সরকারের মুখপাত্র ও শিক্ষামন্ত্রী নাঈম আখতার বলেন, “আমরা পেলেট গানের ব্যবহারের বিরোধী। কিন্তু যতদিন পর্যন্ত আমরা এর বিকল্প কোনো অপ্রাণঘাতী অস্ত্রের সন্ধান না পাই, ততদিন পর্যন্ত একে আমাদের মেনে নিতেই হবে।” তিনি পেলেট গানকে ‘Necessary evil’ বলেও অভিহিত করেন।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ভারতীয় সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছে পেলেট গানের ব্যবহার নিষিদ্ধ করার জন্য। ভারতের আইনজীবী ও অন্যান্য মানবাধিকার সংগঠনগুলোও এ ব্যাপারে সোচ্চার হয়েছে।
![](https://assets.roar.media/assets/BT140qphWua5u68w_8.jpeg)
বিশ্বের অন্যান্য দেশে পেলেট গানের ব্যবহার
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতে, ইতিপূর্বে ইসরায়েল, মিশর ও ভেনেজুয়েলার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও পাম্প অ্যাকশন গান ব্যবহার করেছে। কিন্তু নিরস্ত্র সাধারণ জনগণের উপর এই মারণাস্ত্রের এমন প্রয়োগ বিরল ঘটনাই বটে।
২০১৫ সালে মিশরে শাইমা আল সাব্বাগ নামে এক প্রতিবাদী তাহরির স্কোয়াডে আন্দোলনরত অবস্থায় পেলেট গান দ্বারা আক্রান্ত হয় ও পরে মারা যায়। এর ফলস্বরূপ এক পুলিশ অফিসারকে ১৫ বছরের কারাদন্ড প্রদান করা হয়েছে।
কিন্তু এখন পর্যন্ত এতগুলো মানুষের প্রাণ গেলেও, এবং হাজার হাজার মানুষ অন্ধত্ব বরণ করলেও কোনো ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী কর্মীরই ন্যূনতম শাস্তিটুকু হয়নি।
চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/