১৬৯৭ সালের কথা। বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসের রাজকীয় প্রাসাদ ভ্রমণ করতে এসেছেন সুইজারল্যান্ডের রাজধানী জুরিখের মেয়র তথা প্রধান প্রশাসনিক ব্যক্তি হেনরি এসচার। তিনি ঘুরে দেখলেন পুরো প্রাসাদ। তাকে সঙ্গ দিল বেলজিয়ান রাজপরিবারের সদস্যরা। এরপর শুরু হলো ভোজনপর্ব। বিভিন্ন পদের খাবারের পর একটি পেয়ালায় দেয়া হলো গরম চকলেট, যা ছিল তৎকালীন বেলজিয়ামের সবচেয়ে দামী খাবারগুলোর একটি। পেয়ালায় চুমুক দেয়ার পর বেলজিয়ান চকলেটের স্বাদে অভিভূত হয়ে গেলেন মেয়র। রাজপরিবারের কাছে অনুরোধ করলেন, তাকে যেন কোকোয়া গাছের বীজ দেয়া হয়। বেলজিয়ান রাজপরিবার তাদের অতিথির অনুরোধ রক্ষা করল, পর্যাপ্ত পরিমাণ কোকোয়া বীজ দেয়া হলো তাকে। তিনি দেশে গিয়ে কোকোয়া ফল চাষের কথা জানালেন, এটা থেকে উৎপাদিত চকলেটের যে বিশাল চাহিদা তৈরি হতে পারে সেই সম্ভাবনার কথা জানালেন।
সুইস চাষীরা মেয়র এসচারের কথা গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করল। প্রথমে পরীক্ষামূলকভাবে চাষ করা হলো অল্প কিছু জায়গায়। সফলতা পাওয়া গিয়েছিল, সুইজারল্যান্ডের মাটিতে বেশ ভালোভাবে কোকোয়া গাছ জন্মেছিল। উৎপাদিত চকলেটের চড়া মূল্য ও চাহিদা থাকায় সুইস চাষীরা আগ্রহী হয়ে ওঠে। বেলজিয়ামের মতো সেদেশেও মূলত চকলেট হয়ে ওঠে সমাজের অভিজাত শ্রেণীর মানুষের খাবার। কোকোয়া গাছ ও এ থেকে উৎপাদিত চকলেটের গুণগান ছড়িয়ে পড়ে পুরো সুইজারল্যান্ডে। আরও বড় পরিসরে চাষাবাদ শুরু হয়। সেই যে বেলজিয়াম থেকে নিয়ে আসা কিছু কোকোয়া বীজের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে চাষাবাদ শুরু হয়েছিল, আজও দেশটিতে কোকোয়া গাছ থেকে চকলেটের উৎপাদন চলছেই। বর্তমানে বিশ্ববাজারে চকলেট উৎপাদনে বেলজিয়ামের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী সুইজারল্যান্ড। প্রতিবছর বেলজিয়ামে উৎপাদিত হয় প্রায় দুই লাখ সত্তর হাজার টন চকলেট। দেশটির নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী সুইজারল্যান্ডের ক্ষেত্রে সংখ্যাটি এক লাখ আশি হাজার টন। বিশ্বে দুটি দেশেরই খুব ভালোমানের চকলেট উৎপাদনের সুনাম রয়েছে।
আজকের দিনে যে কেউ চকলেট কিনতে পারে, সমাজের সব শ্রেণীর মানুষের জন্য এটি সহজলভ্য হয়ে গিয়েছে। কিন্তু শুরুর দিনগুলোতে চিত্র ছিল পুরোপুরি ভিন্ন। সতের শতকের দিকে বেলজিয়াম যখন স্প্যানিশদের অধীনে একটি উপনিবেশ হিসেবে ছিল, তখন দক্ষিণ আমেরিকা থেকে স্পেনিশরা দেশটিতে কোকোয়া বীজ নিয়ে আসে। মূলত সেটাই ছিল ইউরোপে প্রথমবারের মতো কোকোয়া বীজ আনার ঘটনা। ঠিক যেভাবে পুরো সুইজারল্যান্ডে কোকোয়া গাছের চাষাবাদ ছড়িয়ে পড়েছিল, বেলজিয়ামেও ঠিক একইভাবে সারাদেশে কোকোয়া ফলের চাষাবাদ ছড়িয়ে পড়ে। এর মূল কারণ ছিল গতানুগতিক ফসল চাষ করে বেলজিয়ান চাষীরা যে অর্থ আয় করছিলেন, তার তুলনায় কোকোয়া ফলের চাষ থেকে প্রাপ্ত আয়ের পরিমাণ ছিল অনেক বেশি। তখনকার সময়ে এজন্যই চকলেটের স্বাদ গ্রহণের ক্ষেত্রে সমাজের নিচু শ্রেণির মানুষদের ‘সাধ থাকলেও সাধ্য ছিল না’। তাদের ভূমিকা শুধু কোকোয়া বীজ চাষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।
এরই মধ্যে ‘স্ক্র্যাম্বল ফর আফ্রিকা’ শুরু হয়। শক্তিশালী ইউরোপীয় দেশগুলো আলোচনার টেবিলে বসে আফ্রিকা মহাদেশের প্রায় সব অঞ্চল নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়। বেলজিয়ামও এই আলোচনার টেবিলে নিজেদের প্রতিনিধি প্রেরণ করেছিল। দীর্ঘ আলোচনার পর সমঝোতা চুক্তি অনুযায়ী, আফ্রিকার কঙ্গোর উপর ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য বেলজিয়ামকে অনুমোদন দেয়া হয়। অন্যান্য ইউরোপীয় পরাশক্তিগুলোর কাছ থেকে অনুমোদন লাভের পর বেলজিয়ামের তৎকালীন রাজতন্ত্রের কর্তাব্যক্তিরা খুব বেশি দেরি করেননি। তারা দ্রুত সৈন্যসামন্ত নিয়ে কঙ্গোতে গিয়ে ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। কঙ্গোতে পা রাখার পর তারা দেখতে পান, দেশটির জঙ্গলাবৃত অঞ্চলে ব্যাপক আকারে কোকোয়া ফলের চাষ হচ্ছে না। সাধারণত ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো নামমাত্র বিনিময় মূল্য প্রদানের মাধ্যমে উপনিবেশের স্থানীয় অধিবাসীদের সাথে বাণিজ্য করত। তৎকালীন বেলজিয়ান শাসকেরা নামমাত্র মূল্যে কঙ্গো থেকে মালবাহী জাহাজে করে বিপুল পরিমাণ কোকোয়া ফলের বীজ বেলজিয়ামে নিয়ে আসতে শুরু করেন। ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে বেলজিয়ামে চকলেটের উৎপাদন ফুলে-ফেঁপে উঠতে শুরু করে।
বলা হয়ে থাকে, ইউরোপকে চকলেট খেতে শিখিয়েছে বেলজিয়ানরা। কঙ্গো থেকে যখন জাহাজে করে বিশাল পরিমাণ কোকোয়া বীজ আনা হচ্ছিল বেলজিয়ামে, তখনও সুইজারল্যান্ড ছাড়া ইউরোপের অন্য পরাশক্তিগুলোর চকলেট সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না। এদিকে বেলজিয়ামে কোকোয়া বীজ থেকে সুস্বাদু চকলেট তৈরির জন্য অসংখ্য ছোটখাট প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে, যেগুলো বেশিরভাগই ব্যক্তিগত মালিকানায় পরিচালিত হতো। পশ্চিম ইউরোপে যাওয়ার সময় প্রায় সব মানুষকে বেলজিয়ামের ভেতর দিয়ে গমন করতে হতো। বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় রাস্তার পাশের দোকানে বাহারি রং, গন্ধ ও স্বাদের চকলেট দেখে ভ্রমণকারীরা তাদের প্রিয়জনদের জন্য চকলেট কিনে নিয়ে যেতেন। এভাবে পুরো ধীরে ধীরে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় যে, বেলজিয়ামে দুর্দান্ত চকলেট পাওয়া যায়। সুনামের কারণে দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও বেলজিয়ামের চকলেটের বাড়তি চাহিদা তৈরি হয়েছিল।
বেলজিয়ানদের চকলেট প্রস্তুতের বিশেষ পদ্ধতি তাদেরকে অন্যদের চেয়ে স্বাতন্ত্র্য এনে দিয়েছে। বেলজিয়ানরা সেই ঔপনিবেশিক সময় থেকে তাদের উৎপাদিত চকলেটের গুণগত মান নিয়ন্ত্রণের জন্য সচেষ্ট ছিল। ১৮৯৪ সালে বেলজিয়ান রাজপরিবার একটি আইন প্রণয়ন করে, যে আইনে বলা হয়েছিল- কোনো চকলেট প্রস্তুতকারক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যদি চকলেটে ৩৫% এর কম কোকোয়া পাউডার ব্যবহার করে, তাহলে তাকে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা হবে। এছাড়া এই আইনের মাধ্যমে চকলেটে অপ্রয়োজনীয় ও অস্বাস্থ্যকর চর্বিজাতীয় উপাদান মেশানো নিষিদ্ধ করা হয়। অবাক করার মতো ব্যাপার হলো, প্রায় একশো বছর আগে চকলেটের যে স্বাদ ছিল, এখনও বেলজিয়ান চকলেটের সেই স্বাদই রয়েছে। অসংখ্য বেলজিয়ান পরিবারের নিজস্ব চকলেট প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যে প্রতিষ্ঠানের চকলেট প্রস্তুতকারকেরা তাদের গোপন কৌশলগুলো প্রজন্মের থেকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে দিয়েছেন। ইউরোপের চকলেট উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে বেলজিয়াম সর্বপ্রথম এমন যন্ত্র উদ্ভাবন করেছিল, যার মাধ্যমে কোকোয়া বীজ গুঁড়া করার সময় খুব মিহি করা যায়। এতে প্রস্তুতকৃত চকলেট খাওয়ার সময় খুবই মোলায়েম অনুভূতি পাওয়া যেত। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বেলজিয়ান চকলেটের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হওয়ার পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে এই ‘মান নিয়ন্ত্রণ’।
প্রস্তুতকৃত চকলেটে নতুনত্ব আনার জন্য বেলজিয়ান চকলেট প্রস্তুতকারকেরা নিয়মিত বিভিন্ন পরীক্ষা চালাতে শুরু করেন। ১৯১২ সালে বেলজিয়াম চকলেট প্রস্তুতকরণের ইতিহাসে ঘটে যায় এক অভাবনীয় ঘটনা। রাজধানী ব্রাসেলসে জিন নিউহাউস নামের একজন চকলেট ব্যবসায়ী এমন এক কৌশল আবিষ্কার করেন, যার মাধ্যমে একটি চকলেটের ভেতরে ফাঁকা জায়গা রেখে সেই জায়গায় বিভিন্ন উপাদান যুক্ত করা যেত। এ ধরনের চকলেটকে বলা হতো ‘প্র্যালাইন্স’। এই কৌশলের মাধ্যমে একটি চকলেটের অভ্যন্তরে বিভিন্ন ফ্লেভার যুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। সাধারণত, পূর্বে যেখানে গতানুগতিক কৌশল প্রয়োগ করে প্রস্তুতকৃত চকলেটের ভেতরে আলাদা কোনো উপাদান যুক্ত করার জায়গা থাকতো না, সেখানে এই কৌশল ব্যবহার করে চকলেটের ভেতরে বাদামের লেই কিংবা বিভিন্ন ফলের নির্যাস দিয়ে বিভিন্ন স্বাদ, বর্ণ কিংবা গন্ধের চকলেট প্রস্তুত করা সম্ভব হতো। আজ থেকে একশো বারো বছর আগে চকলেট ব্যবসায়ী জিন নিউহাউসের দ্বারা আবিষ্কৃত সেই কৌশল ব্যবহার করা হয় আজও।
বেলজিয়ামের চকলেট প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান আছে প্রায় দুই হাজারের মতো। এর মধ্যে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের আয়তন খুব ক্ষুদ্র। পরিবারভিত্তিক ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানগুলো এখনও গতানুগতিক পদ্ধতিতে সাধারণ সরঞ্জাম ব্যবহার করে চকলেট প্রস্তুত করে থাকে। বলা হয়, চকলেট প্রস্তুতকারীদের মধ্যে কিছু অলিখিত চুক্তি রয়েছে, যেগুলো তারা কখনোই ভঙ্গ করে না। চকলেট প্রস্তুতের কৌশল যেন কালের বিবর্তনে হারিয়ে না যায়, এজন্য পরিবারের একজন চকলেট প্রস্তুতকারক বৃদ্ধ হয়ে গেলে তিনি পরবর্তী প্রজন্মের কোনো ব্যক্তিকে তার কৌশলগুলো শিখিয়ে দিয়ে যান। বেলজিয়ামে কোকোয়া পাউডার থেকে চকলেট প্রস্তুতের জন্য বড় প্রতিষ্ঠানও রয়েছে বেশ কিছু। এমনই একটি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ‘ক্যোত দ্যুঁও’। বেলজিয়ামের সব নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দোকানে এই প্রতিষ্ঠানটির দ্বারা প্রস্তুতকৃত চকলেট পাওয়া যায়। এটা ছাড়া নিউহাউস, বেলভাস, গোদিভা কিংবা লিওনিদাসের মতো কিছু প্রতিষ্ঠান আছে, যারা অত্যন্ত উচ্চমানের ও উচ্চমূল্যের চকলেট সরবরাহ করে থাকে সারা বিশ্বে।
বেলজিয়ামে সাধারণত যারা বেড়াতে যান, তাদের অন্যতম উদ্দেশ্য থাকে বিভিন্ন ধরনের চকলেটের স্বাদ নেয়া। রাজধানী ব্রাসেলের বিভিন্ন দোকানে গিয়ে নানা স্বাদের চকলেট সংগ্রহ করতে দেখা যায় পর্যটকদের। আপনি যদি কখনও বেলজিয়ামে যান, তবে চকলেট প্রস্তুতকরণের পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে হলে আপনাকে যেতে হবে ‘দ্য মিউজিয়াম অব কোকোয়া এন্ড চকলেটস’ নামের জাদুঘরে, যেটি রাজধানী ব্রাসেলসের রাজকীয় প্রাসাদের কাছেই অবস্থিত। বেড়াতে আসা পর্যটক কিংবা ভ্রমণকারীদের মধ্যে বেলজিয়ান চকলেট নিয়ে আরও বেশি জনসচেতনতা তৈরির জন্য সম্প্রতি জাদুঘর কর্তৃপক্ষ একটি নতুন গেমের ধারণা নিয়ে এসেছে, যে গেমে একজন ট্রাক ড্রাইভারের চরিত্র ব্রাসেলসের বিভিন্ন রাস্তায় ঘুরে পর্যায়ক্রমে চকলেটের বিশাল সম্ভার আবিষ্কার করে।
যুগ যুগ ধরে কোকোয়া ফল চাষাবাদ কিংবা ফলের বীজ থেকে চকলেট উৎপাদন করতে করতে এসব বেলজিয়ান সংস্কৃতির অংশ হয়ে গিয়েছে। ফ্রান্সের গ্রামগুলোতে যেমন প্রায় প্রতিটি পরিবার আঙুরের চাষ করে, ইতালিতে যেমন অসংখ্য পরিবার যেমন জলপাইয়ের তেল উৎপাদন করে, তেমনই বেলজিয়ামের ক্ষেত্রে প্রায় সব পরিবার কোকোয়া ফলের চাষাবাদ কিংবা বীজ থেকে চকলেট প্রস্তুতকরণের সাথে জড়িত থাকে। দেশটির অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি বিশ্ববাজারে চকলেট রপ্তানি করা। ইদানীং বিশ্ববাজারে পৃথিবীর অনেক দেশের চকলেট প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে বেলজিয়ামের প্রতিষ্ঠানগুলো তীব্র প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হলেও ইতিহাস-ঐতিহ্য কিংবা গুণগত মান বজায় রাখার সুনাম থাকায় বেলজিয়ামের চকলেট প্রস্তুতকারীর প্রতিষ্ঠানগুলোর দ্বারা প্রস্তুতকৃত চকলেটের বাড়তি চাহিদা রয়েছে। চকলেট হয়ে উঠেছে বেলজিয়ামের ‘ট্রেডমার্ক’।