Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মাধুরী গুপ্ত: যে ভারতীয় কূটনীতিক পাকিস্তানে তথ্য পাচার করেছিলেন

ঘটনাটি এতটাই চমকপ্রদ যে, এটি নিয়ে অনায়াসে কোনো ব্লকবাস্টার মুভি তৈরি করা যাবে। দুটি দেশ, জন্মলগ্ন একে অপরের চির প্রতিদ্বন্দ্বী। দুটি দেশের মধ্যে বিচ্ছিন্ন যুদ্ধও হয়েছে বেশ কয়েকবার। দুই দেশেরই তরুণ প্রজন্মকে ছোট থেকে শেখানো হয় তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশটি ভালো নয়, তাদেরকে সবসময় ঘৃণা করতে হবে। দুটি দেশের এই চিরবৈরিতার উত্তাপ রাজনীতির ময়দান ছাড়িয়ে চলে আসে ক্রিকেটের মতো খেলায়, কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কাদা ছোড়াছুড়িতে রূপ নেয় প্রায় সময়ই। এই দুটি দেশের মধ্যে একটি দেশের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা একজন ব্যক্তি যখন তার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আরেকটি দেশের গোয়েন্দাদের কাছে স্পর্শকাতর ও গোপন তথ্য পাচার করে, তখন ঘটনা চমকপ্রদ হতে বাধ্য বটে! সাবেক ভারতীয় কূটনীতিক মাধুরী শর্মার ঘটনাও অনেকটা এরকমই। যে পাকিস্তান তার দেশ ভারতের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী, সেই পাকিস্তানের ‘ফাঁদে পড়ে’ তিনি ভারতের অসংখ্য তথ্য তাদের গোয়েন্দা সংস্থার কাছে হস্তান্তর করেছিলেন।

মাধুরী গুপ্তর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে জানা যাক। তিনি ছিলেন একজন উচ্চশিক্ষিত মহিলা। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা হিসেবে প্রায় সাতাশ বছর চাকরি করেছেন। পেশাগত দায়িত্ব পালনে তাকে ক্রোয়েশিয়া, লাইবেরিয়া, কিংবা ইরাকে যেতে হয়েছে। তবে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার কাছে ধরা পড়ার আগে তার শেষ কর্মসংস্থল ছিল পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে অবস্থিত ভারতীয় দূতাবাসে। ২০০৯ সালের দিকে ইসলামাবাদে অবস্থিত ভারতীয় দূতাবাসের ‘সেকেন্ড সেক্রেটারি’ পদের জন্য ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এমন একজন কূটনীতিক খুঁজছিল, যার উর্দু ভাষার উপর ভালো দখল রয়েছে। তখন দেখা গিয়েছিল, এই পদের জন্য যোগ্য ব্যক্তি হিসেবে মাধুরী গুপ্ত ছাড়া আর কেউ নেই। তিনি উর্দু ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারতেন, এছাড়া সুফিবাদের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ায় উর্দু ভাষার অসংখ্য বই পাঠ করেছিলেন তিনি। ইরানি কবি জালালুদ্দিন রুমির উপর পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনও শুরু করেছিলেন, কিন্তু পেশাগত দায়িত্বের চাপে আর সেটা শেষ করতে পারেননি। শেষমেশ তাকেই পদায়ন করে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

হডওতকতজ
ভারত ও পাকিস্তানের বৈরিতার শুরু রাষ্ট্র দুটির জন্মলগ্ন থেকেই; image source: business-standard.com

মাধুরী গুপ্তকে কীভাবে পাকিস্তানি গোয়েন্দা তাদের ফাঁদে ফেলেছিল, সেটি বুঝতে হলে ‘হানি ট্র্যাপ’ (Honey Trap) সম্পর্কে মৌলিক ধারণা থাকতে হবে। সাধারণত প্রশিক্ষিত গোয়েন্দারা তাদের পরিচয় লুকিয়ে রেখে ছদ্মবেশ ধারণ করে কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা ব্যক্তির সাথে ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি করে। এই সম্পর্ক তৈরি করার ক্ষেত্রে মূল উদ্দেশ্য থাকে সেই গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা ব্যক্তির কাছ থেকে যাতে গোপন ও স্পর্শকাতর তথ্য হাতিয়ে নেয়া যায়। মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা এই যে, সে তার ভালোবাসার মানুষের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে, তার ভালোবাসার মানুষ যা চায়, সেগুলো দেওয়ার চেষ্টা করে। ব্যক্তিগত সম্পর্কের কাছে প্রায় সময়ই জাতীয় স্বার্থ ফিকে হয়ে যায়। ছদ্মবেশী গোয়েন্দারা যার সাথে ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি করেন, পরবর্তীতে সুযোগ বুঝে তার কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। এই বিষয়টিই আসলে ‘হানি ট্র্যাপ’। মাধুরী গুপ্ত আসলে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার পাতানো হানি ট্র্যাপেই পা দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন ষাট বছর বয়সী একজন নারী, তার সাথে ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল ত্রিশ বছর বয়সী এক ছদ্মবেশী পাকিস্তানি গোয়েন্দার, যার নাম জামশেদ। মাধুরী গুপ্তের কাছে তিনি ‘জিম’ নামে পরিচিত ছিলেন।

আগেই বলা হয়েছে, যোগ্যতার ভিত্তিতে ইসলামাবাদের ভারতীয় দূতাবাসে ‘সেকেন্ড সেক্রেটারি’ পদে মাধুরী গুপ্তকে পদায়ন করা হয়েছিল। সেকেন্ড সেক্রেটারি পদের মূল দায়িত্ব ছিল নিয়মিত পাকিস্তানি গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে নয়া দিল্লিতে প্রেরণ করা। সেই হিসেবে মাধুরী গুপ্ত প্রতিদিন দুবার পাকিস্তানি গণমাধ্যমে উর্দু ভাষায় প্রকাশিত বিভিন্ন খবর বিশ্লেষণ করে তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে প্রেরণ করতেন। যেহেতু তিনি উর্দু ভাষায় বেশ দক্ষ ছিলেন, তাই তার কাছে এই কাজ খুব কঠিন ছিল না। কূটনীতিক হিসেবে সাতাশ বছরের পেশাগত জীবন অতিবাহিত করায় তিনি ভারতের অনেক স্পর্শকাতর তথ্য আগে থেকেই জানতেন, তাই পাকিস্তানি গোয়েন্দারা তাকেই লক্ষ্য করে হানি ট্র্যাপ পেতেছিল। তবে এটা বোধহয় তাদের ধারণাতেও ছিল না যে মাধুরী গুপ্ত এত সহজে তাদের ফাঁদে পা দেবেন!

হশহচজচজআ
মাধুরী গুপ্ত একজন কূটনীতিক, যিনি সাতাশ বছর ধরে বিভিন্ন ভারতীয় দূতাবাসে কাজ করেছেন; image source: indiatoday.in

মাধুরী গুপ্তের ইসলামাবাদে সেকেন্ড সেক্রেটারির দায়িত্ব পাওয়ার মাত্র ছয় মাস পর নয়া দিল্লিতে খবর পৌঁছায়- একজন কূটনীতিক পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার কাছে তথ্য পাচার করছেন। এই খবরের ভিত্তিতে ইসলামাবাদের ভারতীয় দূতাবাসের সমস্ত কূটনীতিককে কঠোর নজরদারির আওতায় নিয়ে আসা হয়, মাধুরী গুপ্তের বিরুদ্ধে সন্দেহ ঘনীভূত হওয়ায় তার বিরুদ্ধে প্রাথমিক তদন্ত শুরু হয়। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো’র (আইবি) প্রাথমিক তদন্তের পর রিপোর্ট পাঠানো হয় আইবির প্রধান রাজীব মথুরের কাছে। প্রাথমিক তদন্তের রিপোর্টে বলা হয়েছিল, মাধুরী গুপ্ত সত্যিই গুপ্তচরবৃত্তিতে জড়িত, তার বিরুদ্ধে যা সন্দেহ করা হয়েছিল, সেটি সত্য। রাজীব মথুর এবার সেই রিপোর্ট ভারতের আরেক গোয়েন্দা সংস্থা ‘রিসার্চ এন্ড এনালাইসিস উইং (র’) এর প্রধান কে. সি. ভার্মা ও স্বরাষ্ট্র সচিব জি. কে. পিল্লাইয়ের কাছে প্রেরণ করেন। প্রাথমিক রিপোর্টে কিছুটা অস্পষ্টতা থাকায় তিনজনই তৎক্ষণাৎ গ্রেফতার না করে আরও কিছুদিন মাধুরী গুপ্তকে নজরদারির মধ্যে রাখার সিদ্ধান্ত নেন। আরও দুই-তিন সপ্তাহ নজরদারি চালানো পর যখন পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য পাঠানোর শক্ত প্রমাণ হাতে আসে, তখন মাধুরী গুপ্তকে গ্রেফতারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।

মাধুরী গুপ্তকে গ্রেফতার করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল একেবারে গোপনে। তাকে সুকৌশলে সার্ক সম্মেলনে দায়িত্ব পালনের কথা বলে ভারতে নিয়ে আসা হয়। তিনি জানতেন না তাকে গ্রেফতার করা হবে, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ পালনের জন্য ২০১০ সালে ২১ এপ্রিল ভারতে নয়া দিল্লিতে পা রাখেন। এরই মধ্যে দিল্লি পুলিশের স্পেশাল সেলের কাছে গ্রেফতার আদেশ পাঠিয়ে দেয়া হয়। পরদিন, ২২ এপ্রিল পাকিস্তানি এজেন্টের কাছে স্পর্শকাতর তথ্য প্রেরণের অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করা হয়। দুই বছর পর, অর্থাৎ ২০১২ সালে, তার বিরুদ্ধে আদালতে বিচার শুরু হয়। তার কেসের তদন্তকারী ছিলেন পঙ্কজ সুদ নামের একজন কর্মকর্তা। তিনি বলেছিলেন, তদন্তের সময় মাধুরী গুপ্ত স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাকে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছিলেন। তিনি তার ব্যক্তিগত ই-মেইল অ্যাড্রেসের মাধ্যমে পাকিস্তানি এজেন্ট জিম তথা জামশেদকে যতগুলো মেইল প্রেরণ করেছিলেন, সবগুলো তদন্তকারী কর্মকর্তা পঙ্কজ সুদকে দেখিয়েছিলেন। তদন্তের পর চার্জশিটে বলা হয়েছিল, মাধুরী গুপ্তের সাথে সেই পাকিস্তানি এজেন্টের প্রায় ৭৩টি মেইল আদান-প্রদান হয়েছিল।

হডহডজজচজচ
‘হানি ট্র্যাপ’ এর ফাঁদে পা দিয়েছিলেন মাধুরী গুপ্ত; image source: thequint.in

দিল্লির উচ্চ আদালতে বিচারের সময় বিচারকেরা ‘অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট ১৯২৩’-এর দুটো ধারা ভঙ্গের দায়ে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে। তার এই অপরাধের খবর যখন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়, তখন তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি হয়। ভারতীয় নাগরিকেরা যখন গণমাধ্যমের দ্বারা জানতে পারেন- তাদেরই দেশের কূটনীতিক তাদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দেশের কাছে স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাচার করেছেন, তখন তারা একইসাথে বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ হন। ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জন্য এটি ছিল রীতিমতো কলঙ্কজনক একটি ঘটনা। মাধুরী গুপ্তের এই স্পর্শকাতর তথ্য পাচারের ঘটনা ভারতের বাইরে কর্মরত অসংখ্য কূটনীতিককে সন্দেহের কাতারে ফেলে দিয়েছিল। অনেকের বিরুদ্ধে নতুন করে নজরদারি শুরু হয়। ভালোবাসার কাছে যে অনেক সময় জাতীয় স্বার্থও বিলীন হয়ে যায়, মাধুরী গুপ্তের এই ঘটনা তার প্রকৃষ্ট উদাহরণগুলোর একটি।

Related Articles