অনুবাদকের নোট: ইউভাল নোয়াহ হারারি একজন ঐতিহাসিক, যিনি তাঁর ‘স্যাপিয়েন্স আ ব্রিফ হিস্ট্রি অফ হিউম্যানকাইন্ড’ গ্রন্থটির জন্য বিশ্বজুড়ে পরিচিত। ইউক্রেনে সাম্প্রতিক রুশ আগ্রাসন নিয়ে তাঁর একটি লেখা গত ২৮ ফেব্রুয়ারি বিলাতের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এটি বাংলাভাষী পাঠকদের জন্য সেই লেখার অনুবাদ।
যুদ্ধটার এক সপ্তাহও হয়নি। এর মধ্যেই ক্রমেই এটা মনে হচ্ছে যে, ভ্লাদিমির পুতিন একটা ঐতিহাসিক পরাজয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। তিনি হয়তো সবগুলো সমরেই জিতবেন, কিন্তু যুদ্ধে হেরে যাবেন। রুশ সাম্রাজ্যকে পুনর্গঠিত করার যে স্বপ্ন পুতিন দেখেন, তা সবসময়ই একটা মিথ্যার ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে ছিল। সেই মিথ্যাটা হচ্ছে- ইউক্রেন একটা প্রকৃত রাষ্ট্র নয়, ইউক্রেনীয়রা একটা প্রকৃত জাতি নন, আর কিয়িভ, খারকিভ, ও ভিভের জনগণ মস্কোর শাসনের জন্য তড়পাচ্ছে। এটা সম্পূর্ণরূপে একটা মিথ্যা কথা। ইউক্রেনীয়রা এমন একটি জাতি যার রয়েছে হাজার বছরের ইতিহাস। মস্কো যখন একটা গ্রামও ছিল না, তখনই কিয়িভ ছিল একটা গুরুত্বপূর্ণ মহানগর। কিন্তু রুশ স্বৈরতন্ত্রীটি তার মিথ্যা কথাটা এতবার বলেছেন যে, মালুম হয় তিনি নিজেই এটা বিশ্বাস করেন।
ইউক্রেন আক্রমণের মতলব আঁটার সময়, অনেকগুলো জানা তথ্যের ওপর ভরসা রাখতে পেরেছেন পুতিন। তিনি জানতেন, সামরিক শক্তিতে রাশিয়ার তুলনায় ইউক্রেন কিছুই নয়। তিনি জানতেন, ন্যাটো ইউক্রেনকে সহায়তা করতে সেনা পাঠাবে না। তিনি জানতেন, রুশ তেল-গ্যাসের ওপর ইউরোপের নির্ভরশীলতার কারণে জার্মানির মতো দেশগুলো রাশিয়ার ওপর কঠোর অবরোধ আরোপে ইতস্তত বোধ করবে। এই সব জানা তথ্যের ভিত্তিতে পুতিনের মতলবটা ছিল, ইউক্রেনকে দ্রুত ও তীব্রভাবে আঘাত করা। ইউক্রেন সরকারের পতন ঘটিয়ে কিয়িভে পুতুল সরকার বসানো। এবং পশ্চিমা অবরোধ সামলানো।
কিন্তু এই পরিকল্পনায় একটা খাদ রয়ে গেছিল। মার্কিনীরা ইরাকে আর সোভিয়েতরা আফগানিস্তানে যেমনটা শিখেছে, একটা দেশ দখল করা যত সহজ, সেই দখল জারি রাখা তত সহজ না। পুতিন জানতেন ইউক্রেন দখলের ক্ষমতা তার আছে। কিন্তু ইউক্রেনীয় জনগণ কি মস্কোর পুতুল সরকারকে বরণ করে নেবে? পুতিন বাজি ধরলেন, যে, নেবে। আখেরে, ইচ্ছুক যেকোনো শ্রোতাকে তিনি বারবার যেই ব্যাখ্যাটা দিয়েছেন তা হলো, ইউক্রেন একটা প্রকৃত রাষ্ট্র নয় এবং ইউক্রেনীয়রাও প্রকৃত জাতি নয়। ২০১৪ সালে রুশ হানাদারদের বিরুদ্ধে ক্রিমিয়ার জনগণ কোনো প্রতিরোধ গড়ে তোলেনি বললেই চলে। ২০২২ সালে কেন ভিন্ন কিছু ঘটবে?
যতই দিন পেরোচ্ছে, এটা পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে যে, পুতিন তার বাজিতে হেরে যাচ্ছেন। ইউক্রেনীয় জনগণ জানবাজি রেখে প্রতিরোধ গড়ে তুলছেন। তারা সারা দুনিয়ার মানুষের প্রশংসা কুড়াচ্ছেন। এবং যুদ্ধটাও জিতছেন। সামনে অনেক অন্ধকার দিন আসতে যাচ্ছে। রুশরা হয়তো ইউক্রেনের পুরোটাই দখল করে নেবে। কিন্তু যুদ্ধে জিততে হলে, রাশিয়াকে ইউক্রেনের ওপর দখলদারিত্ব বজায় রাখতে হবে। আর তারা সেটা শুধু তখনই করতে পারবে, ইউক্রেনীয়রা যখন হাল ছেড়ে দেবেন। ক্রমেই মনে হচ্ছে ইউক্রেনীয়রা হাল ছাড়বেন না।
প্রতিটা ধ্বংসকৃত রুশ ট্যাংক ইউক্রেনীয়দের মনোবল বাড়ায়। প্রতিজন খুন হওয়া রুশ সৈন্য ইউক্রেনীয়দের প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সাহস যোগায়। আর খুন হওয়া প্রতিজন ইউক্রেনীয় রুশ দখলদারদের ব্যাপারে ইউক্রেনীয়দের ঘৃণা বৃদ্ধি করে। ঘৃণা মানুষের সবচেয়ে কুৎসিত আবেগগুলোর একটি। কিন্তু মজলুম জাতিগুলোর জন্য ঘৃণা এক গুপ্তধন। হৃদয়ের গভীরে প্রোথিত থেকে, এটা প্রজন্মের পর প্রজন্মকে প্রতিরোধের প্রেরণা যোগায়। রুশ সাম্রাজ্য ফিরিয়ে আনতে হলে, পুতিনের একটা অপেক্ষাকৃত রক্তপাতহীন বিজয়ের প্রয়োজন হবে, যা একটা অপেক্ষাকৃত ঘৃণামুক্ত দখলদারিত্বের দিকে ধাবিত করবে। যতই ইউক্রেনীয়দের খুন ঝরাচ্ছেন পুতিন, ততই তিনি এটা নিশ্চিত করে চলেছেন যে, তার স্বপ্ন পূরণ হবে না। রুশ সাম্রাজ্যের মৃত্যু সনদে মিখাইল গর্বাচেভের নাম লেখা থাকবে না: লেখা থাকবে পুতিনের নাম। গর্বাচেভ যখন ক্ষমতা ছেড়ে যান, তখন তিনি রুশী আর ইউক্রেনীয়দেরকে এমন দশায় রেখে গেছিলেন, যেন তারা একে অপরের ভাই। পুতিন রুশী আর ইউক্রেনীয়দেরকে পরস্পরের শত্রুতে রূপান্তরিত করেছেন। এর মধ্য দিয়েই তিনি এটা নিশ্চিত করেছেন যে, এখন থেকে, ইউক্রেনীয় জাতি নিজেদেরকে রুশদের বিরোধিতার মধ্য দিয়ে সংজ্ঞায়িত করবে।
জাতিগুলো শেষ বিচারে গল্পের মাধ্যমে তৈরি হয়। যতই দিন গড়াচ্ছে, ততই ইউক্রেনীয়দের ভাঁড়ারে নতুন নতুন গল্প যুক্ত হচ্ছে। এই গল্পগুলো তারা যে শুধু আসন্ন অন্ধকার দিনগুলোতেই বলবেন তা নয়, আসন্ন দশকগুলোতে বলবেন, বলবেন প্রজন্মান্তরে। সেই প্রেসিডেন্টের গল্প, যিনি রাজধানী ছেড়ে পালিয়ে যেতে রাজি হননি, মার্কিনীদেরকে বলেছেন, তার অস্ত্র দরকার ভ্রমণ নয়। স্নেক আইল্যান্ডের সেই সৈনিকদের গল্প যারা একটা রুশ যুদ্ধজাহাজকে বলেছেন, “মারা খাও”। সেই নাগরিকদের গল্প যারা রুশ ট্যাংকের গতিরোধ করতে রাস্তায় শুয়ে পড়েছেন। জাতিগুলো এসব উপাদান দিয়েই গঠিত হয়। দীর্ঘমেয়াদে, ট্যাংকের চেয়ে এসব গল্পের শক্তি বেশি।
আর সকলের মতো রুশ স্বৈরতন্ত্রীটিও এটা জানেন। সেই ছোটকাল থেকেই, লেনিনগ্রাদের অবরোধের সময় জার্মানদের চালানো হত্যাযজ্ঞ আর রুশদের গড়ে তোলা প্রতিরোধের গল্প শুনতে শুনতেই বেড়ে উঠেছেন পুতিন। তিনি বর্তমানে একই ধরনের গল্প তৈরি করছেন, তবে সেটা হিটলারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে।
ইউক্রেনীয়দের বীরত্বের গল্প শুধু ইউক্রেনীয়দেরকেই সাহস যোগাচ্ছে তাই নয়, এটা পুরো বিশ্ববাসীকে সাহস যোগাচ্ছে। এই গল্পগুলো ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর সরকারগুলোকে সাহস যোগাচ্ছে, মার্কিন প্রশাসনকে সাহস যোগাচ্ছে, আর এমনকি রাশিয়ার মজলুম নাগরিকদেরকেও সাহস যোগাচ্ছে। ইউক্রেনীয়দের যদি খালি হাতে একটা ট্যাংক রুখে দেয়ার সাহস থাকে, তাহলে জার্মান সরকারের ইউক্রেনীয়দেরকে কিছু ট্যাংকবিরোধী ক্ষেপনাস্ত্র সরবরাহ করার সাহস থাকতে পারে, মার্কিন সরকারের রাশিয়াকে সুইফট থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার সাহস থাকতে পারে, আর রুশ নাগরিকদের এই নিরর্থক যুদ্ধটার বিরুদ্ধে রাস্তায় নামার সাহস থাকতে পারে।
আমরা সকলেই কোনো না কোনো উপায়ে অবদান রাখার সাহস করে উঠতে পারি। সেটা হতে পারে দান করা, শরণার্থীদেরকে স্বাগত জানানো, বা অনলাইনে লড়াই চালানোয় সহায়তা করা। ইউক্রেন যুদ্ধ পুরো পৃথিবীর ভবিষ্যৎকে গড়ন দেবে। স্বৈরতন্ত্র আর আগ্রাসনকে যদি জিততে দেয়া হয়, এর পরিণামে আমাদের সকলকে ভুগতে হবে। স্রেফ সাক্ষী গোপাল হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। অবস্থান নেয়ার ও বিবেচিত হওয়ার সময় এসেছে।
দুর্ভাগ্যবশত, এই যুদ্ধটা দীর্ঘস্থায়ী হতে যাচ্ছে। বিভিন্ন রূপে এটা হয়তো বছরের পর বছর টিকে থাকবে। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুটা ইতোমধ্যেই নির্ধারিত হয়ে গেছে। গত অল্প কয়েকদিনেই সারা দুনিয়ার সামনে কিছু বিষয় পরিষ্কার হয়ে গেছে। আর তা হলো – ইউক্রেন একটা প্রকৃত রাষ্ট্র, ইউক্রেনীয়রা একটা প্রকৃত জাতি, আর তারা মোটেই একটা নয়া রুশ সাম্রাজ্যে বাস করতে চান না। দেখার বিষয় হলো, ক্রেমলিনের পুরু দেয়ালগুলো ভেদ করতে এই বার্তাটার কতদিন লাগে।
মূল লেখা: https://www.theguardian.com/commentisfree/2022/feb/28/vladimir-putin-war-russia-ukraine