প্রাচীনকালের উপকথা, লোককথা, কিংবা পৌরাণিক কাহিনি- সবগুলোই গড়ে উঠেছে শুভ এবং অশুভর মিশেলে। সত্যের বিপক্ষে মিথ্যা, ভালোর বিরুদ্ধে মন্দ, দিনের বিপরীতে রাত; এভাবেই বৈপরীত্যের অনুপম মিশ্রণে সাজানো রয়েছে গল্পগুলো। সেদিক থেকে দেবতা এবং অপদেবতাদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব চিরস্থায়ী। প্রাচীন মেসোপটেমীয় সভ্যতায় বসবাসকারী লোকদের ছিল নিজস্ব ধর্ম এবং লোককথা। এসবে বার বার উঠে এসেছে পিশাচ বা অপদেবতাদের কুকীর্তি এবং দেবতাদের সাহসী কর্মকাণ্ড। পিশাচ, প্রেতাত্মা, রাক্ষস, দেও-দানব- এসবের প্রাচুর্য রয়েছে মেসোপটেমীয় উপকথায়। তাই মেসোপটেমিয়ার সুপরিচিত কয়েকজন পিশাচ, অপদেবতা, দৈত্য-দানব নিয়েই নিয়েই আজকের এই আয়োজন।
পাজুজু
ব্যাবিলনীয় এবং অ্যাসিরীয় সভ্যতায় পিশাচ পাজুজুর বর্ণনা উঠে এসেছে বহুবার। মানুষের মতো দেহ হলেও, পাখির মতো মাথা, ডানা, এবং লম্বা নখযুক্ত আঙুল তাকে যথেষ্ট ভয়ানকভাবে লোককথায় উপস্থাপন করেছিল। তার পুরো শরীর ছিল পশমে আবৃত। তাকে প্রায়শই এক হাতে একটি সাপ এবং অন্য হাতে একটি অস্ত্র ধরে থাকতে দেখা যেত। মেসোপটেমীয়দের বিশ্বাস ছিল, পাজুজু মানবজাতির জন্য দুর্ভিক্ষ এবং খরা নিয়ে আসত। দক্ষিণ-পশ্চিমের বায়ুও তার নির্দেশে প্রবাহিত হতো বলে তাদের ধারণা ছিল। কারণ, মেসোপটেমিয়ায় দক্ষিণ-পশ্চিমের বায়ু সবসময় অতিরিক্ত গরম এবং শুষ্কতা নিয়ে আসত বলে বায়ু পরিবর্তনের কারণে তখনকার লোকেরা অসুস্থ হয়ে পড়ত।
পাজুজু খতরনাক এক পিশাচ হিসেবে প্রাচীন বিশ্বে কুখ্যাতি লাভ করলেও, তাকে সবসময় অপদেবতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়নি। রোগ-শোক এবং দুর্ভিক্ষ থেকে বাঁচতে অনেকসময় মেসোপটেমীয়রা তার পূজা-অর্চনাও সম্পন্ন করেছে। সে হিসেবে লোককাহিনির কোনো কোনো সংস্করণে আবির্ভূত হয়েছে একজন ত্রাণকর্তা হিসেবে। বহু পণ্ডিতের মতে, পাজুজু নিরাময় এবং চিকিৎসাব্যবস্থার সাথেও যুক্ত থাকতে পারেন।
লামাশতু
লোককাহিনীর কুখ্যাত চরিত্রদের নিয়ে তালিকা সাজালে, এর মধ্যে ডাকিনী লামাশতুর নাম একদম উঁচুতে ঠাঁই নেবে অবধারিতভাবে। লামাশতুকে বর্ণনা করা হয়েছে নবজাতক এবং অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের হন্তারক হিসেবে। যেসকল দেবতা পৃথিবীতে দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে আসত বলে মেসোপটেমীয়দের বিশ্বাস, তাদের মধ্যে লামাশতু ছিল অন্যতম। হয়তো লামাশতুর ভয় দেখিয়েই তখন বাচ্চাদের ঘুমপাড়ানো হতো।
লামাশতু ছিল আকাশদেবতা আনুর কন্যা। সে কারও আদেশ-নিষেধ মানত না। উল্টো নিজেই অন্যদের উপর ছড়ি ঘোরাতে পছন্দ করত। ব্যাবিলনীয় সভ্যতায় তাকে পূজা করা হতো শুধুমাত্র ভয় থেকে, যাতে সে ব্যাবিলনবাসীর কোনো ক্ষতি না করে। ধারণা করা হতো, সে সদ্য জন্ম নেওয়া নবজাতককে স্তন্যপান করা অবস্থায় মায়ের কোল থেকে ছিনিয়ে নিয়ে, তার ঘাড় মটকে রক্ত চুষে পান করত। তার শরীর বিভিন্ন প্রাণীর মিশ্রণে গড়া। তার মাথা ছিল সিংহীর, দাঁত আর কান ছিল গাধার, লম্বা নখযুক্ত পাখির পা এবং পুরো শরীর ছিল কালো চুলে ঢাকা। তাকে প্রায় সময় অন্তঃসত্ত্বা এবং হাতে ধরে রাখা সর্পসমেত দেখা গেছে। তার স্তন-যুগল ঢাকা থাকত মাথার খুলি দিয়ে। কিছু লেখা থেকে পাওয়া যায়, অন্যান্য অপদেবতা এবং দুষ্ট আত্মার হাত থেকে রেহাই পেতে তার পূজা করা হতো।
অ্যাসাগ
রোগ-বালাই এবং অসুস্থতার জন্য দায়ী করা হতো সুমেরীয় উপকথার অপদেবতা অ্যাসাগকে। তাকে সবসময় বিশাল এক সাপ অথবা ড্রাগনের রূপে দেখা গিয়েছে। তার থাবা ছিল পাখির মতো। তাকে প্রায়শই দেবতাদের শত্রু, বিশেষ করে ইনানার শত্রু হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। তার শ্বাস-প্রশ্বাস এতটাই বিষাক্ত ছিল যে, সে কোনো জায়গায় ঘন নিঃশ্বাস ত্যাগ করলে সেখানে সাথে সাথে জরাজীর্ণতা, অসুখ-বিসুখ এসে ভর করত। কিছু উপকথায় বলা আছে, অ্যাসাগ তার ক্ষমতাবলে অনেক দেবতাকে সিংহাসনচ্যুত করেছিল। আরেক লোককথা অনুযায়ী, অ্যাসাগ সংযুক্ত ছিল পাহাড়-পর্বত এবং পাথরের সাথে। পৃথিবীতে সৃষ্ট পাথুরে ভূখণ্ড, যেখানে সবুজের ছিঁটেফোঁটা নেই এবং উঁচু-নিচু বন্ধুর ভূমির জন্য দায়ী করা হতো তাকে।
হামবাবা
মেসোপটেমীয় উপকথায় সেডার বন অতি পবিত্র এক স্থান হিসেবে বিবেচিত। ওই বনের রক্ষক ছিল দৈত্য-সদৃশ পিশাচ হামবাবা। সিংহের থাবা, বুকে পশমের পরিবর্তে কাঁটাযুক্ত আঁশ, মাথায় ষাঁড়ের শিং, এবং লম্বা লেজযুক্ত এই দানবকে ব্যাবিলনীয় এবং অ্যাসিরীয় উপকথায় যথেষ্ট ভীতিপ্রদর্শক হিসেবে দেখানো হয়েছে। গিলগামেশ মহাকাব্যে বর্ণিত আছে, গিলগামেশ এবং তার বন্ধু এনকিদু সেডার বনে গিয়ে হামবাবাকে বধ করে মহামূল্যবান সেডার কাঠ নিয়ে আসে। তবে হামবাবার চরিত্র জটিলতায় পূর্ণ। কেউ কেউ তাকে রাক্ষস হিসেবে মানতে নারাজ। তারা ভাবেন, উপকথায় তাকে সবসময় ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
নামতার
প্রাচীন সুমেরীয় ভাষায় নামতার শব্দের অর্থ হলো, ‘দুর্ভাগ্য আনয়নকারী’। পাতালপুরীর এই বাসিন্দাকে মৃত্যুদেবতা বলা হতো। সে ছিল মানুষ প্রাণ ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য দায়ী। ব্যাবিলনীয় এবং অ্যাসিরীয়দের বিশ্বাস ছিল নামতার মানুষের মাঝে দুর্দশা এবং রোগ-বালাইয়ের মড়ক বিস্তার করে দিত। ছড়িয়ে মহামারি। মানুষের জীবন ও মৃত্যুর নিয়ন্ত্রণ ছিল তার হাতের মুঠোয়। পাতালপুরীর অধিকর্তা নেরগালের ভৃত্য ছিল সে। অতিমারি ও রোগ থেকে বাঁচতে অনেকে তার পূজা-উপাসনা করত। কখনো কখনো তাকে নখযুক্ত থাবাসমেত ডানাওয়ালা এক পিশাচ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।
তিয়ামাত
তিয়ামাত হচ্ছেন মেসোপটেমীয় উপকথার একজন আদি দেবতা, যাকে ব্যাবিলনীয় লোককাহিনিতে বহু মাথাযুক্ত বিশাল এক সাপ কিংবা ড্রাগনের রূপে সবসময় উপস্থাপন করা হয়েছে। সৃষ্টির শুরুতে এই দেবী বিশৃঙ্খলা এবং ধ্বংসের সাথে যুক্ত ছিলেন। ব্যাবিলনীয় সৃষ্টিতত্ত্ব এনুমা এলিশে বর্ণিত আছে, আপসু এবং তিয়ামাতের গভীর প্রণয়ের ফলে অন্যান্য তরুণ দেবতা জন্ম নিয়েছিলেন। কিন্তু তারা একসময় আপসুকে হত্যার ষড়যন্ত্র করলে তাদের সবাইকে হত্যার হুমকি দেন তিয়ামাত।
ওই সময় তরুণ দেবতাদের কারোরই সাধ্য ছিল না শক্তিশালী তিয়ামাতের সামনে দাঁড়ানোর। সাহসী দেবতা মারদুক তাদের পক্ষ হয়ে তিয়ামাতের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছিলেন। মরণপণ ওই যুদ্ধে জয়ের মালা গলায় জড়াতে পেরেছিল দেবতা মারদুক। তিনি তিয়ামাতকে হত্যার পর তার দেহকে দ্বিখণ্ডিত করে একভাগ দিয়ে স্বর্গ, আরেকভাগ দিয়ে পৃথিবী সৃষ্টি করেছিলেন।
আনজু
সিংহের দেহ আর ইগলের বিশাল ডানা নিয়ে গঠিত পিশাচ আনজুর দেহ। তার কথা সুমেরীয় এবং আক্কাদীয় সভ্যতাতেই আলোচিত হয়েছে বেশি। আনজুর পাশাপাশি সে ইমদুগুদ নামেও পরিচিত ছিল। আনজু আকাশদেবতা এনলিলের থেকে ‘ট্যাবলেট অভ ডেসটিনি’ বা ‘ভাগ্যফলক’ চুরি করেছিল, যাতে লিখা ছিল মহাবিশ্বের সকল নিগুঢ় রহস্য। নিনুর্তা অথবা মারদুক যেকোনো একজন আনজুকে বধ করে সেই ভাগ্যফলক পুনরুদ্ধার করেছিল। উপকথার আরেক সংস্করণে বলা আছে, আনজু জ্ঞানের দেবতা এনকির হৃৎপিণ্ড চুরি করে নিয়েছিল। তখন দেবী নিন্মাহ অ্যাসাগ নামে এক দৈত্য সৃষ্টি করে, যে আনজুর কাছ থেকে এনকির হৃৎপিণ্ড পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়।
গাল্লু
গাল্লু স্বতন্ত্র কোনো চরিত্র নয়, বরং তারা ছিল এক পিশাচবাহিনী, যারা বিশৃঙ্খলা এবং শয়তানি সকল কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত ছিল। কুকুরের মাথা নিয়ে গঠিত গাল্লু সদস্যরা দেখতে ছিল ভয়ানক। এরা পাতালপুরীর সাথে সরাসরি যুক্ত ছিল।
তারা প্রচণ্ড গতি ও শক্তি নিয়ে খুব জোরে আঘাত করতে পারত। মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীকে অপহরণের ক্ষেত্রেও তাদের বিশেষ দুর্নাম রয়েছে। উপকথার কিছু সংস্করণ থেকে পাওয়া যায়, তারা নিজ ইচ্ছানুযায়ী মানুষ কিংবা যেকোনো প্রাণীর রূপ ধারণ করতে পারত।