শ্বেতশুভ্র বরফ-মোড়া তিব্বত পর্বত, যেখানে শ্বাস-প্রশ্বাস চালিয়ে যাওয়াই দুষ্কর, সেখানে সময়রেখার সাথে পাল্লা দিয়ে সহস্রাধিক বছর ধরে দিব্যি টিকে আছে এক পারমার্থিক ঐতিহ্য। তিব্বতের এই রহস্যপূর্ণ ধর্ম ‘বন’ নামে পরিচিত। তিব্বতে বৌদ্ধধর্মের ছোঁয়া লাগার আগ থেকে স্রোতস্বিনী নদীর মতো বয়ে চলে এই ধর্ম শুধু তিব্বতই নয়, পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন এক ধর্ম হিসেবে ঠাঁই নিয়েছে ইতিহাসের পাতায়। মানবমনের সরলতা ও পবিত্রতার সাথে একাত্মতা পোষণ করা এই ধর্মের জানা-অজানা ও রহস্যময় দিক নিয়েই আজকের এই আয়োজন।
এই ধর্ম বৌদ্ধধর্মের চেয়েও প্রাচীন
বর্তমানে তিব্বতের অধিকাংশ অঞ্চল জুড়েই ছেয়ে আছে বৌদ্ধধর্মের ছায়া। তবে মজার ব্যাপার হলো, তিব্বতে বৌদ্ধধর্ম প্রবেশের পূর্বেই এই বন ধর্মের রীতিনীতি চালু ছিল। তিব্বতের বন ধর্ম ঠিক কতটুকু প্রাচীন, সে ব্যাপারে পরিষ্কার কোনো ধারণা না পাওয়া গেলেও বলা হয় এই ধর্ম প্রায় ৩০০০-৪০০০ বছর পুরনো। আবার কোনো কোনো উৎস অনুসারে, খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০ অব্দেও বন ধর্মের অস্তিত্ব ছিল। ‘বন’ শব্দটি নেওয়া হয়েছে বনপো ভাষা থেকে, যার বাংলা অর্থ হচ্ছে ‘দেবতাদের আহ্বান করা’। ধর্মটি অতি প্রাচীন হলেও, এত বছর ধরে বহমান থাকায় ধর্মীয় রীতিনীতিতে অনেক পরিবর্তন এসেছে। প্রাচীনকালে পালনকৃত রেওয়াজের সাথে বর্তমানের প্রভূত ফারাক লক্ষ্য করা যায়। তিব্বতে বৌদ্ধধর্ম প্রবেশের পর দুই ধর্ম একে অপরের সাথে মিশে গিয়েছে। বৌদ্ধধর্মের প্রভাবে বন ধর্মের দুটি শাখা, যথাক্রমে প্রাচীন বন এবং নয়া বন সৃষ্টি হয়েছে।
সর্বপ্রাণবাদে বিশ্বাস
বর্তমানে পৃথিবীতে প্রচলিত ধর্মসমূহের সাথে বন ধর্মের একটা বৈসাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। সেটি হলো সর্বপ্রাণবাদে বিশ্বাস। এই মতবাদ অনুযায়ী, এই মহাবিশ্বের সকল বস্তু, পাথর থেকে গাছ, জীবজন্তু থেকে মানুষ- সকলেই পারমার্থিক বা আধ্যাত্মিক শক্তি ধারণ করে। বন ধর্মের অনুসারীদের মতে, এই ক্ষমতাই জীবনীশক্তি ও প্রাণধারণের মূল ভিত্তি। মহাজগতের প্রতিটি জিনিসই একে অপরের সাথে জটিল অন্তর্জালে এক পারলৌকিক বলের সাহায্যে আবদ্ধ।
এছাড়াও তারা বিশ্বাস করে, পারমার্থিক শক্তির পাশাপাশি প্রত্যেক জিনিসের আলাদা আলাদা আত্মা বা সত্তা বিদ্যমান। তাদের রয়েছে যোগাযোগ করার ক্ষমতা। এসকল আত্মার সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে মহাবিশ্বে ভারসাম্য ও ঐকতান ফিরিয়ে সৃষ্টি করা সম্ভব বলে বন ধর্মের অনুসারীদের বিশ্বাস। এর থেকে বোঝা যায়, প্রকৃতির সাথে বন ধর্মের আধ্যাত্মিক সম্পর্ক খুবই প্রগাঢ়।
বহুদেববাদী বিশ্বাস
বন ধর্মের মাঝে বহু দেব-দেবী বিদ্যমান। একেক দেব-দেবী প্রকৃতির একেক দিককে নির্দেশ করে থাকে। অনুসারীদের বিশ্বাস, দেব-দেবীরা এই বিশ্ব পরিচালনায় সদা-সর্বদা গুরুদায়িত্ব পালন করছেন। মহাবিশ্বকে রক্ষা ও পৃথিবীতে সঠিক পথপ্রদর্শনের জন্য দেবতাদের সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ধর্মীয় ও শাস্ত্রীয় রীতিনীতি রয়েছে। বন দেবতাদের নানাপ্রকার দলের সাথে বিভিন্ন উপদলও বিদ্যমান। প্রধান দুই দলের একদল শান্তিপ্রিয়, অপরদল ক্রোধপূর্ণ।
বন ধর্মের প্রধান দেব-দেবীর আসনে আসীন আছেন চারজন।
- এই ধর্মের প্রধান দেবমাতা হলেন সাতরিগ এরসাং, যার নামের অর্থ হলো ‘প্রজ্ঞা’। তাকে প্রায়শই জ্ঞানের দেবী ‘শেরাব ছাম্মা’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়। একেক রঙের সাথে একেক বন দেব-দেবী সম্পৃক্ত। সেই হিসেবে, দেবমাতার রঙ হলো সাদা।
- শেনলাহ ওকার ‘শুভ্র জ্যোতির জ্ঞান দেবতা’ হিসেবে পরিচিত। তিনি জ্ঞান ও আলোর দেবতা। এর পাশাপাশি তিনি আকাশ এবং আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। তাই, বন ধর্মের উপাসকরা যুতসই আবহাওয়ার জন্য শেনলাহ ওকারের কাছেই প্রার্থনা করে থাকেন।
- তৃতীয়জন হলেন ‘সাংপো বুমত্রি’। এই দেবতার মাধ্যমেই সৃষ্টি হয়েছিল বন ধর্মের। তিনি সৃষ্টিতত্ত্বের সাথে জড়িত।
- পথপ্রদর্শক হিসেবে বন ধর্মের অনুসারীরা পূজা করে থাকেন দেবতা তনপা শেনরাব মিউছিকে। সাংপো বুমত্রি বন ধর্মের সৃষ্টির জন্য দায়ী থাকলেও এর আচার অনুষ্ঠানের রীতিনীতি তৈরি করেছিলেন তনপা শেনরাব। প্রাচীন তিব্বতে তাকে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে মানা হতো, যিনি সর্বত্র শান্তি ও প্রগতির শিক্ষা দিয়ে বেড়াতেন।
অশরীরী ও প্রেতাত্মায় বিশ্বাস
অসংখ্য দেবদেবীর পাশাপাশি বন ধর্ম বহু অপদেবতা, পিশাচ ও আত্মায় বিশ্বাস রাখে। এদের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত আত্মা হলো ‘ল্হা’। হিতৈষী এই আত্মা বাস করে পর্বত, নদী, এবং হ্রদে। তাদের কবজায় থাকা জায়গাতে কোনো মানুষ ঢুকে পড়লে তারা ওই মানুষকে যেকোনো অলৌকিক ভেল্কি দেখাতে পারে। বন ধর্মের অনুসারীরা প্রায়শই এই আত্মাকে পূজা দিয়ে থাকে খুশি করার উদ্দেশ্যে, যাতে সে তাদেরকে বিভিন্ন বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করে। ল্হার পাশাপাশি আরেক জনপ্রিয় আত্মা হলো সেন। ল্হার মতো এই আত্মাও তিব্বত ও এর আশেপাশের স্থানে বাস করে। ভূমির রক্ষাকর্তা হিসেবে এই আত্মাকে পূজা করা হয়।
বহু পিশাচ ও প্রেতাত্মার উপস্থিতিও রয়েছে বন ধর্মের উপাখ্যানে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কুখ্যাতি অর্জন করেছে ‘আগইয়ে’ নামে এক প্রেতাত্মা, যে রোগ ও অসুস্থতা ছড়ানোর জন্য দায়ী। তাকে প্রায়শই বর্ণনা করা হয় হিংস্র- পৈশাচিক সত্তা হিসেবে, যার মাথায় শোভা পায় খুলির মুকুট আর গায়ে জড়ানো থাকে বিশাল এক সাপ। আগইয়ের কুদৃষ্টি থেকে সমাজকে রক্ষা করার জন্য বন ধর্মের তান্ত্রিকেরা ঝাড়-ফুঁক ও পবিত্র মন্ত্রের সাহায্য নিয়ে থাকেন।
শ্রি নামে এক পিশাচিনীকেও দারুণ ভয় পায় বন ধর্মের লোকেরা। বিশ্বাস অনুযায়ী, শ্রি অন্তঃসত্ত্বা মহিলা ও বাচ্চাদের মেরে ফেলে। ধারালো দাঁত, হিংস্র অভিব্যক্তিসমেত শ্রি ভয়ংকর দেহ ওই এলাকার লোকেদের মাঝে এক ত্রাসের সঞ্চার করে রাখে।
মৃত্যু নিয়ে জটিলতা
বন ধর্মে জীবন-মৃত্যুর বোঝাপড়াটা বেশ চমৎকার। মৃত্যুকে এই ধর্মে জীবনের সমাপ্তি হিসেবে না দেখে একে জন্ম, মৃত্যু এবং পুনর্জন্মের এক প্রাকৃতিক চক্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
এই ধর্মমতে, যখন একজন মানুষ মারা যায় তখন তার আত্মা এক ঊর্ধ্ব জগতে আরোহণ করে, যা বার্ডো নামে পরিচিত। যতদিন পর্যন্ত আত্মা পরিশোধিত না হয়ে পুনর্জন্মের প্রক্রিয়া চালু না হচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত এই বার্ডোতে আত্মাকে অবস্থান করতে হয়। এর সময়সীমা হচ্ছে ৪৯ দিন। ৪৯ দিনের এই সময়কালে আত্মা বহু শান্তিপূর্ণ ও ক্রোধপূর্ণ অবস্থা অবলোকন করে, এবং বহু দেবতা ও অপদেবতার সাক্ষাৎ পায়। পৃথিবীতে এই আত্মাকে পাঠানো এবং পরবর্তী জীবনের অংশ হিসেবেই এই প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়।
বন ধর্মে নরক বলে কোনোকিছুর অস্তিত্ব নেই। এই জন্মের কৃতকর্মের উপর ভিত্তি করেই তার পরবর্তী জীবন নির্ধারিত হবে। যেহেতু বন ধর্ম সর্বপ্রাণবাদে বিশ্বাসী, তাই মানুষ পুনর্জন্মে যেকোনো কিছু হয়ে পৃথিবীতে আসতে পারবে। যদি দুনিয়ায় ভালো কাজ করে তাহলে মানুষ, প্রাণী, কিংবা গাছ হয়ে পুনরায় জন্ম নিতে পারবে পৃথিবীতে। আর খারাপ কাজের সাথে যুক্ত থাকলে কীটপতঙ্গ কিংবা পাথর।
জাদুবিদ্যা ও মন্ত্র
বন ধর্মে প্রকৃতি, মহাবিশ্ব, দেব-দেবী, আত্মা, কিংবা পিশাচদের সাথে যোগাযোগ প্রক্রিয়াকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে দেখা হয়।
তাদেরকে বিভিন্ন জিনিসের মাধ্যমে সন্তুষ্ট করতে হয়। বন ধর্মের অনুসারীদের বিশ্বাস, জাদুবিদ্যা এবং মন্ত্রের মাধ্যমে অন্য জগতের সত্তাদের প্রভাবিত করা যায়। বন ম্যাজিককে সাধারণত ‘ফোয়া’ বলে অভিহিত করা হয়। এতে থাকে পবিত্র মন্ত্র ও শব্দের সন্নিবেশ। বিশ্বাস করা হয়, বন ধর্মের নিরাময়কারীরা শক্তিশালী মন্ত্র দ্বারা শারীরিক ও মানসিক রোগ সারাতে পারেন। প্রতিরক্ষার জন্যও মন্ত্র ব্যবহার করা হয়। তান্ত্রিকেরা নিজেদের ও তাদের ভালোবাসার জিনিসকে দুষ্ট আত্মা ও পিশাচের হাত থেকে রক্ষার জন্য বিভিন্ন মন্ত্র ব্যবহার করে থাকেন। এছাড়াও সঠিক অনুমান এবং সম্ভাব্য ঝামেলা এড়ানোর জন্য জাদুবিদ্যার মাধ্যমেই ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়।
তিব্বতের বন ধর্ম রহস্য ও গোপনীয়তায় পরিপূর্ণ। ভ্রমণকারীরা তিব্বত ভ্রমণে গেলে এই ধর্ম সম্পর্কে জানতে পারলে যারপরনাই অবাক হন।