প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার আক্কাদীয় সাম্রাজ্যের প্রাজ্ঞ, প্রভাবশালী ও গুণীজনদের তালিকা করলে এনহেদুয়ানার নাম উঠে আসবে অবধারিতভাবেই। বলা হয়ে থাকে, তিনি আক্কাদীয় সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা মহামতি সার্গন দ্য গ্রেটের কন্যা। প্রত্নতাত্ত্বিক নথি থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, এনহেদুয়ানা একইসাথে ছিলেন প্রাচীন সুমেরীয় মন্দিরের একজন মহাযাজিকা এবং বিশ্বের প্রথম পরিচিত লেখিকা। মৌলিক সাহিত্য রচনার জন্য সর্বাধিক খ্যাতি কুড়িয়েছেন। এসবে তিনি শুধু মেসোপটেমীয় দেবতাদের প্রশংসাই করেননি, বরং তাদের মানবিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন দিকগুলোর দিকেও আলোকপাত করেছেন। সার্গনের হাতে নবনির্মিত আক্কাদীয় সাম্রাজ্যকে একতাবদ্ধকরণ, এবং সমৃদ্ধিসাধনে তার ভূমিকা অনস্বীকার্য।
নামের অর্থ
কিউনিফর্ম লিপি এনহেদুয়ানার নাম লিখা হয় এভাবে ‘𒂗𒃶𒁺𒀭𒈾’। এখানে সুমেরীয় শব্দ ‘এন’ মানে হলো মহাযাজক বা যাজিকা, ‘হেদু’ শব্দের অর্থ হলো অলংকার, আর আনা দিয়ে বোঝায় স্বর্গলোককে। অর্থাৎ তার নামের অর্থ দাঁড়ায় ‘অলংকার পরিহিতা স্বর্গের রমণী’।
সার্গনকন্যা এনহেদুয়ানা
খ্রি.পূ. ২২৮৬ অব্দের দিকে প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার উর্বর ভূমিতে এনহেদুয়ানার জন্ম। তার বাল্যকাল সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না। শুধু বলা হয়ে থাকে, তিনি সম্রাট সার্গন দ্য গ্রেটের সন্তান। তবে, তাতেও আপত্তি জানিয়েছেন অনেক ইতিহাসবিদ। তাদের ভাষায়, সার্গন এনহেদুয়ানার জন্মদাতা পিতা নন। সাম্রাজ্য পরিচালনায় সম্রাট এনহেদুয়ানাকে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ পদ বসিয়েছিলেন বলে তাকে সার্গনকন্যা হিসেবে অভিহিত করা হয়।
কিউনিফর্মে উৎকীর্ণ সাহিত্যকর্ম
যশ-প্রতিপত্তি কিংবা প্রজ্ঞার বিচারে, এনহেদুয়ানা ছিলেন মেসোপটেমিয়ার অন্য দশজন মহিলা থেকে ব্যতিক্রম। পরাক্রমশালী শাসকের সন্তান হওয়ায়, শিক্ষা কার্যক্রমের সম্পূর্ণটাই গ্রহণের সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। তিনি সুমেরীয় এবং আক্কাদীয় উভয় ভাষা-ই পড়তে ও লিখতে জানতেন। জটিল গাণিতিক হিসেবেও সমান পারদর্শী ছিলেন তিনি।
উর শহরের একজন মহাযাজিকা হিসেবে, কিউনিফর্ম লিপির ব্যবহার সর্বক্ষেত্রে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। বণিকদের মাঝে যোগাযোগ ও বাণিজ্যিক বিবরণী সংরক্ষণে এর বহুল ব্যবহার শুরু হয় তখন। কিউনিফর্ম লিপিতে প্রচুর সাহিত্যকর্ম ও স্তুতি রচিত হয়েছে তার হাত ধরে। মেসোপটেমীয় দেবী ইনানার শ্রদ্ধার্ঘে তিনি চমৎকার তিনটি মহাকাব্য লিখেছিলেন।
এনহেদুয়ানাই দ্ব্যর্থ কণ্ঠে মানুষকে জানিয়েছিলেন, দেবতারা শক্তিমান ও পরাক্রমশালী হলেও, মানুষের মতো তাদেরও আবেগ-অনুভূতি বিদ্যমান। অন্য ভাষায় বললে, তারা প্রণয়ে মোহিত হন, রাগ ও ক্ষোভ তাদের কাবু করে, নিজেদের মধ্যে কলহ জড়ান তারা, তাদের প্রতিহিংসাপরায়ণ স্বভাবও বিদ্যমান।
চন্দ্রদেব নান্নার ধর্মযাজিকা
এনহেদুয়ানা ছিলেন চন্দ্রদেবতা নান্নার সর্বপ্রধান ধর্মযাজিকা। নান্নার আরাধনার প্রমাণ সর্বপ্রথম পাওয়া যায় খ্রি.পূ. চতুর্থ সহস্রাব্দের দিকে। সেসময় তার ধর্মমন্দিরের অবস্থান ছিল দক্ষিণ মেসোপটেমিয়ার উর শহরে। নান্না ছিলেন উর শহরের পৃষ্ঠপোষক দেবতা। নিজ রাজত্বকালে সম্রাট সার্গন এনহেদুয়ানাকে গুরুত্বপূর্ণ একজন উপদেষ্টা হিসেবে দাবার ঘুটির মতো ব্যবহার করেছেন। সার্গন জানতেন, পুরো সুমেরে নিজের কর্তৃত্ব বিস্তার করতে হলে তাকে অত্যন্ত সাহসী পদক্ষেপ নিতে হবে। হতে হবে সামরিক জ্ঞানে ঝানু, থাকতে হবে সূক্ষ্মতর কূটনৈতিক জ্ঞান। সকল প্রজাকে এক ছাদের নিয়ে নিয়ে আসতে তিনি কাজে লাগালেন ধর্মীয় অনুভূতিকে। এখানেই সফলতার সাথে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন এনহেদুয়ানা।
সুমেরীয় ধর্মমন্দিরে এনহেদুয়ানাকে প্রধান পুরোহিতের আসনে বসানো হয়েছিল। সম্রাট জানতেন, মেসোপটেমিয়ার বিভিন্ন দেবতাকে এক প্যান্থিয়নের অধীনে একীভূত করতে পারবে এই এনহেদুয়ানা। চমক হিসেবে এনহেদুয়ানা দেব-দেবীদের উদ্দেশ্যে স্তোত্র এবং কবিতা রচনা করেছেন বলে জানা যায়। উদাহরণস্বরূপ, সুমেরীয় দেবী ইনানাকে আক্কাদীয় দেবী ইশতারের অনুরূপ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন তিনি। এভাবে উর্বরতা ও ভালোবাসার দেবী ইনানা রূপ নিয়েছিলেন যুদ্ধের দেবী ইশতারে। এভাবে সুমেরীয় দেবকুলে আক্কাদীয় দেবতাদের অন্তর্ভুক্তি ঘটিয়েছিলেন এনহেদুয়ানা। দেব-দেবীর সংখ্যার বৃদ্ধি পাওয়ায় দেবকুল হয়ে ওঠে বৃহৎ। ফলে, রাজ্য শাসনে আরও সুবিধা হয় সার্গনের।
দেবতা নান্নার সহধর্মিণী
সমগ্র মেসোপটেমিয়া জুড়ে দেবতা নান্নার পূজা করা হতো বিধায় তিনি মেসোপটেমীয় দেবকুলে এক গুরুত্বপূর্ণ দেবতা হিসেবে স্থান পেয়েছেন। নান্নার মন্দিরের মহাযাজিকা হিসেবে দায়িত্ব পালন করায় এনহেদুয়ানাকে মাঝেমধ্যে ‘নান্নার স্ত্রী’ বলে অভিহিত করা হয়। প্রাচীন মেসোপটেমীয়বাসীর বিশ্বাস ছিল, দেবতারা এনহেদুয়ানাকে প্রাণভরে আশীর্বাদ করেছিলেন বলে সে সুফল পেয়েছিলেন সার্গন দ্য গ্রেট। পূর্ণ শক্তি-সমরে তিনি রাজ্যসমূহ নিজের করায়ত্তে আনার পর তার দৌহিত্র নারাম-সিন পর্যন্ত জয়ের এই সমুজ্জ্বল ধারা অব্যাহত ছিল।
শাসিকা এনহেদুয়ানা
সার্গনের সরকারব্যবস্থার একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে এনহেদুয়ানা মেসোপটেমিয়ার ব্যস্ততম ও গুরুত্বপূর্ণ শহর ‘উর’ এর মন্দিরের সভাপতি হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। তৎকালে শহরটির জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৩৪ হাজারের কাছাকাছি। তবে শহরের মহাযাজিকা হিসেবে, এনহেদুয়ানার ভূমিকা শুধু ধর্মীয় ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ ছিল না। শহরকে শান্তিপূর্ণ এবং স্থিতিশীল রাখার জন্যও তিনি সদা সচেষ্ট ছিলেন। তাকে সেচ এবং শস্যভাণ্ডারসহ শহরের অবকাঠামোগত ব্যবস্থায় অংশ নিতে হয়েছিল। তিনি শহরের বাজার, মন্দির এবং স্মৃতিস্তম্ভসহ বহু প্রকল্পের নির্মাণ নিজে হাতে তদারকি করতেন। স্বপ্নের ব্যাখ্যাও পাওয়া যেত তার কাছে। তার প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল নব্য আক্কাদীয় সভ্যতার সাথে প্রাচীন সুমেরীয় সংস্কৃতির সংমিশ্রণকে সহজতর করা।
ইনানার প্রতি সম্মানপ্রদর্শন
এনহেদুয়ানা রচিত প্রধান তিনটি বন্দনাকাব্য নিনমেসারা (ইনানার মহিমাকীর্তন), ইন্নিনমেহুসা (প্রবল ক্ষমতাশালী দেবী), ইন্নিন্সাগুরা (মহান হৃদয়ের অধিকারী সম্রাজ্ঞী) সর্বাধিক গুরুত্ব পেয়েছে। এই স্তবগানগুলোতে ভক্তিসহকারে ভালোবাসা, সৌন্দর্য, উর্বরতার দেবী ইনানার গুণকীর্তন গাওয়া হয়েছে। উপকথার এই উপাখ্যানে ইনানা ছিলেন নান্নার কন্যা এনহেদুয়ানা এই সুমেরীয় দেবীকে ইশতার বলে উল্লেখ করেছেন। ইশতারকে উৎসর্গীকৃত এনহেদুয়ানার লেখা কবিতাসমূহ ছিল যৌনতায় পরিপূর্ণ। তাই, ইশতার যৌনতার দেবী হিসেবেও বিবেচিত। এই প্রধান তিনটি স্তোত্রের পাশাপাশি, এনহেদুয়ানার দ্বারা আরও অনেক রচনা লিখা হয়েছিল, যার বেশিরভাগই ছোট ছোট। এগুলো ছিল ছোট আকারের কবিতা যা প্রেম, যুদ্ধ, উর্বরতা এবং অন্যান্য বিষয় সংশ্লিষ্ট।
ইনানার অপরিমেয় শক্তি নিয়ে গ্রথিত কবিতাদ্বয় নিনমেসারা এবং ইন্নিনমেহুসার মাধ্যমে এনহেদুয়ানা শ্রোতাদের ইনানার অফুরন্ত শক্তিমত্তা সম্পর্কে ধারণা দেওয়া চেষ্টা করেন। দেবীর আদেশ অমান্য করলে তার পরিণাম কত নিষ্ঠুর ও ভয়াবহ হতে, সে সম্পর্কে তিনি মানুষকে সতর্ক করেছিলেন। ঐসময় পুরোহিত ও সম্রাটের আদেশ দেবতাদের উচ্চারিত বাণী হিসেবে প্রচারিত হতো। তাই ইশতারের শাস্তির ভয়ে প্রজারা এনহেদুয়ানা এবং সার্গনের আদেশ-নিষেধ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতেন। এই কলাকৌশলে সার্গন রাজ্যের বাসিন্দাদের তার শাসনের প্রতি অনুগত ও অবিচল রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন।
অস্থায়ী নির্বাসন
সার্গনের মৃত্যুর পর, এক বিদ্রোহী নেতা (সম্ভবত লুগাল-আনে) দ্বারা দখল হয়ে যায় আক্কাদীয় সাম্রাজ্যের সিংহাসন। ফলশ্রুতিতে, এনহেদুয়ানাসহ অনেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নির্বাসনে যেতে বাধ্য হন। পরবর্তীতে তার ভাগ্নে নারেম-সিন সফলভাবে সে বিদ্রোহ দমন করলে তিনি ফিরে আসেন তার চিরপরিচিত উর শহরে। তাকে তার উচ্চাবস্থান পুনরায় ফিরিয়ে দেওয়া হয়। একটি লিপিকর্ম থেকে দেখা যায়, নিজের অবস্থান ফিরে পেয়ে তিনি দেবতাদের, বিশেষ করে ইনানার সমীপে পরিপূর্ণ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেছিলেন।
ক্ষয়িষ্ণু স্মৃতির পুনরুদ্ধার
ব্যাবিলনীয় সভ্যতার পতনের পর হাজার বছর ধরে ধ্বংসস্তূপের আড়ালে চাপা পড়েছিল এনহেদুয়ানার কীর্তিকথা ও গৌরব। তার ক্ষয়িষ্ণু স্মৃতি পুনরুজ্জীবিত হয় ১৯২৭ সালে, প্রত্নতত্ত্ববিৎ স্যার লিওনার্ড ওলির হাত ধরে। প্রাচীন উর শহরের ধ্বংসাবশেষ থেকে তিনি চাকতি আকৃতির এক মৃত্তিকা ফলক থেকে এনহেদুয়ানার নাম উদ্ধার করেন।
উপসংহার
বিশ্বের প্রথম লেখিকা, মহিলা কবি এবং দেবী ইনানার মহাযাজিকা হিসেবে ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে খোদাই করা আছে সার্গনকন্যা এনহেদুয়ানার নাম। তার ৪২টি সাহিত্যকর্ম কাব্যগ্রন্থসমূহ যশস্বী গ্রিক কবি সাফোর (খ্রি.পূ. ৬৩৪ অব্দ – খ্রি.পূ. ৫৭০ অব্দ) প্রায় ১৬০০ বছর পূর্বে রচিত হয়েছিল। মেসোপটেমীয় রাজকন্যাদের ধর্মমন্দিরের মহাযাজিকা পদের সাথে যুক্ত হবার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল এনহেদুয়ানারা মাধ্যমে। পরবর্তীতে দীর্ঘকাল যাবত মেসোপটেমিয়ায় এই ঐতিহ্যধারা বহাল ছিল। কমপক্ষে পাঁচ শতাব্দী ধরে অন্যান্য লেখকেরা তার স্তোত্রগুলো প্রতিলিপি করে এসেছে। এনহেদুয়ানাকে পরিপূর্ণ সম্মান জানাতে, প্রাচীন বেনামী এক সুরকার তাঁর উদ্দেশ্যে একটি স্তোত্র উৎসর্গ করেছিলেন। মেসোপটেমিয়ার ধূসর ভূমিতে এনহেদুয়ানা রচিত সাহিত্যকর্মগুলো বিরাট প্রভাবের ছাপ রেখে যায়, যার জ্বলন্ত সাক্ষী হয়ে আছে হিব্রু ওল্ড টেস্টামেন্ট এবং মহাকবি হোমারের মহাকাব্যসমূহ।