রাইনের দিকে তাকানো যাক।
ভিয়েনা কনভেনশনের পরে পরাজিত ফ্রান্সকে ঠেলে দেয়া হয়েছিল ফরাসী বিপ্লবপূর্ব সীমান্তের দিকে। রাইনল্যান্ড আর ওয়েস্টফ্যালেয়াতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্রুশিয়ান নিয়ন্ত্রন। ফলে রাইনের দুই তীর আর মোজেল নদীর অববাহিকা অঞ্চলও ছিল প্রুশিয়ার সীমানাভুক্ত। মোজেলের অঞ্চল জার্মানির সাথে উত্তরপূর্ব ফ্রান্স এবং লুক্সেমবার্গকে সংযুক্ত করেছিল। ফলে ফ্রান্সে আগ্রাসনের জন্য এই পথ খুব সুবিধাজনক।
তৃতীয় নেপোলিয়ন তার পূর্বসুরির মতো সেনানায়ক নন। কিন্তু তার এবং ফরাসি জনগণের বড় অংশের ইচ্ছা অন্তত রাইনের দক্ষিণ তীর ফরাসি অধিকারে আসুক। তাদের যুক্তি ফ্রান্স এবং জার্মানির পারস্পরিক সুরক্ষার জন্যই রাইনের দুই তীর দুই পরাশক্তির মাঝে ভাগ হওয়া দরকার, যদিও ভিয়েনা কনভেনশন চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হিসেবেই অনুমোদিত ছিল। সুতরাং নেপোলিয়ন জানতেন সোজা আঙ্গুলে ঘি উঠবে না। তাই বিভিন্ন সময় তিনি প্রুশিয়া আর অস্ট্রিয়ার থেকে নানাভাবে জার্মানিতে ফরাসি সমর্থনের বিপরীতে ছাড় আদায়ের চেষ্টা করতেন।
এদিকে অস্ট্রিয়ার সাথে লড়াইয়ের পর জার্মান একত্রীকরণ মনে হচ্ছিল সুদুরপরাহত। মেইন নদী বরাবর জার্মানি উত্তর ও দক্ষিণ দুই খণ্ডে ভাগ হয়ে গিয়েছে। উত্তর জার্মান কনফডারেশনে প্রুশিয়াই সর্বেসর্বা। কিন্তু দক্ষিণ জার্মান রাষ্ট্রগুলোতে ফ্রান্স ও অস্ট্রিয়ার প্রভাব অস্বীকার করা যাচ্ছিল না। দক্ষিণ জার্মানির অধিকাংশ মানুষ, বিশেষ করে বাভারিয়ানরা অস্ট্রিয়াকে সঙ্গী রেখেই গসডয়েচ বা গ্রেটার জার্মানির পক্ষে ছিল। প্রুশিয়ার থেকে অস্ট্রিয়ার সাথে তাদের সাংস্কৃতিক দিক থেকে মিল ছিল বেশি।
১৮৬৭ সালের মার্চে প্রুশিয়ার সাথে দক্ষিণ জার্মানির রাজ্যগুলোর গোপন সামরিক চুক্তি প্রকাশ হয়ে পড়লে সেখানকার সাধারণ মানুষ নিজেদের শাসকদের উপর অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। একই সময় ইংল্যান্ড এবং রাশিয়াও উত্তর জার্মান কনফেডারেশন কর্তৃক শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে জার্মান একত্রীকরণের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে। দক্ষিণ জার্মানির লিবারেল শক্তিগুলোও দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায়। জার্মান একত্রীকরণ তাদের উদ্দেশ্য, কিন্তু প্রুশিয়াকে অখণ্ড জার্মানির নেতা মানতে অনেকেই নারাজ। এমনকি ব্যাডেনের মতো প্রগতিশীল রাষ্ট্র, যারা দক্ষিণের দেশগুলোর মধ্যে অখণ্ড জার্মানির পক্ষে সবথেকে বেশি উচ্চকণ্ঠ, সেখানেও লিবারেলদের মধ্যে বিভাজন তৈরি হয়।
প্রুশিয়ার বিপক্ষে এক হলো অস্ট্রিয়াপন্থি জার্মান ক্যাথলিক, প্রজাতন্ত্রী এবং লিবারেলদের একাংশ। এরা অস্ট্রিয়াকে বাদ দিয়ে ক্লাইনডয়েচ মডেলে জার্মান একত্রীকরণের বিরুদ্ধে ছিল। ১৮৬৯ সালে বাভারিয়া এবং ভুর্তেমবার্গের নির্বাচনে এই দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। বিসমার্ক ভেবেছিলেন দক্ষিণ জার্মান রাষ্ট্রগুলোকে দিয়ে একটি কনফেডারেশন গঠন করা যায় কিনা, যারা উত্তর জার্মান কনফেডারেশনের সাথে ধীরে ধীরে একীভূত হবে। কিন্তু উত্তর কনফেডারেশনের সাথে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার ব্যাপারে দক্ষিণের জনতা প্রচন্ড বিরোধিতা করে। বাভারিয়াতে ক্যাথলিক ধর্মযাজকেরা উত্তর জার্মান কনফেডারেশনের সাথে সহায়তার বিপক্ষে প্রচুর স্বাক্ষর জোগাড় করে দরখাস্ত জমা দেন। এছাড়া রাজ্যগুলোর নিজেদের মধ্যে অনাস্থা আর অবিশ্বাসের জন্যেও বিসমার্কের এই ভাবনা সফল হলো না। তিনি এরপর চিন্তা করলেন কাস্টমস ইউনিয়নে দক্ষিণের রাজ্যগুলো আছে, তো সেখান দিয়ে তাদের আস্তে আস্তে উত্তরের সাথে একত্রিত করা যায় কিনা। কিন্তু ১৮৬৮ সালের কাস্টমস ইউনিয়নের সংসদ নির্বাচনে দেখা গেল বাভারিয়া আর ভুর্তেমবার্গে প্রুশিয়া বিরোধীরা বিশাল সাফল্য লাভ করেছে। ব্যাডেনেও তারা জিততে জিততে হেরে যায়। ফলে এই পরিকল্পনাও বানচাল হয়ে গেল।
বিসমার্ক শান্তিপূর্ণ উপায়ে অখণ্ড জার্মানির সম্ভাবনা দেখতে না পেয়ে ফিরে গেলেন তার পুরনো পরিকল্পনাতে, ফ্রান্স জুজুর ভয় দেখিয়ে দক্ষিণ জার্মানিকে দলে টানা। ১৮৬৬ সালের গ্রীষ্মে তিনি ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন যে যদি ফ্রান্সের সাথে যুদ্ধ লাগে, তাহলে মেইন নদীর বিভাজন কোন কাজে আসবে না। পুরো জার্মানিই সংঘাতে জড়িয়ে পড়বে। বিসমার্ক জানতেন যুদ্ধ এমনভাবে লাগাতে হবে যাতে দেশে বিদেশে ফ্রান্সই আগ্রাসী বলে প্রতীয়মান হয়। তাহলেই পুরো জার্মানি প্রুশিয়ার পেছনে একাট্টা হবে।
বিসমার্কের সমর্থকেরা এতটা আশাবাদী ছিল না। তাই ১৮৭০ সালের শুরুতে তারা প্রস্তাব করল ব্যাডেনকে উত্তর জার্মান কনফেডারেশনে নিয়ে আসা হোক। দক্ষিণের রাষ্ট্রগুলোর ভেতর কেবল তারাই উত্তর কনফেডারেশনের সাথে অন্তর্ভুক্তির পক্ষে ছিল। কিন্তু এতে করে ব্যাডেন প্রতিবেশীদের তোপের মুখে পড়বে, বাভারিয়া আর ভুর্তেমবার্গের উপরেও নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হতে পারে। তাছাড়া দক্ষিণ জার্মানিতে প্রুশিয়ার একজন মিত্র প্রয়োজন ছিল, ব্যাডেন সেই স্থান পূরণ করছে। হঠাৎ করে সে প্রুশিয়ার সাথে গাঁটছড়া বাঁধলে তার প্রতিবেশীরা যে একে তাদের অঞ্চলে প্রুশিয়ান আগ্রাসন বিবেচনা করে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে সামরিক চুক্তি থেকে সরে যাবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়। তাছাড়া এই বিবাদে ফ্রান্স জড়িয়ে পড়ে জল ঘোলা করার চেষ্টাও করতে পারে। সবদিক ভেবে বিসমার্ক এই প্ল্যান অনুমোদন করলেন না।
রাশিয়া
১৮৬৬ সালের গ্রীষ্মকাল। ক্রিট দ্বীপে অটোমান শাসনের বিরুদ্ধে বাসিন্দারা বিদ্রোহ করে। ফলে অটোমান শাসিত এলাকায় খ্রিষ্টান সংখ্যালঘুদের ব্যাপারে রাশিয়া উদ্বেগ প্রকাশ করল। তারা ইংল্যান্ড আর ফ্রান্সের কাছে অটোমানদের উপর চাপ প্রয়োগের অনুরোধ জানায়। কিন্তু সেই সময় দানা বেঁধে ওঠা লুক্সেমবার্গ ক্রাইসিসের কারণে ব্যস্ত দুই পক্ষই রাশিয়াকে ফিরিয়ে দেয়। ক্রাইসিস কেটে গেলে জার অ্যালেক্সান্ডার আর তার মন্ত্রী গর্চাকভ প্যারিসে এসেছিলেন।উদ্দেশ্য ফ্রান্সের সাথে রেষারেষি কাটিয়ে মিত্রতা করা, সেজন্য রাইন নিয়ে নেপোলিয়নকে সমর্থন দিতে তারা প্রস্তুত। কিন্তু নেপোলিয়নের ভাবভঙ্গিতে তারা ক্ষুব্ধ হন। এখানে থাকাকালে জারকে হত্যাচেষ্টাও চালানো হয়।
রাশিয়া ফ্রান্সের ব্যাপারে মনোভাব পরিবর্তন করল। ইংল্যান্ড তাদের সাথে জোটে ইচ্ছুক নয়, অস্ট্রিয়া তো বল্কানে তাদের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী। ফলে বাকি ছিল প্রুশিয়া। ১৮৬৮ সালের মার্চে জার অ্যালেক্সান্ডার উত্তর জার্মানির রাষ্ট্রদূতের সাথে আলাপচারিতায় যুদ্ধের সময় পারস্পরিক সহযোগিতার উপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি প্রস্তাব দেন ফ্রান্সের সাথে প্রুশিয়ার লড়াই লেগে গেলে তিনি অস্ট্রিয়ার পূর্ব সীমান্তে এক লাখ সেনা মোতায়েন করবেন যাতে তারা নেপোলিয়নের সাথে যোগ দেবার কথা ভুলেও না ভাবে। যদি বল্কানে অস্ট্রিয়ার সাথে রাশিয়ার সংঘাত হয় সেক্ষেত্রে তিনি প্রুশিয়ার থেকে একই অঙ্গীকার আশা করেন। বিসমার্ক মৌখিকভাবে রাশিয়ার সাথে এই মিত্রতার ব্যাপারে সম্মতি দিলেন, তবে কোন লিখিত চুক্তি করতে রাজি হলেন না।
লুক্সেমবার্গ ক্রাইসিস
রাশিয়ান জার গর্চাকভ প্যারিস সফরের পূর্বে লুক্সেমবার্গ নিয়ে ইউরোপে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল। এই ঘটনাই লুক্সেমবার্গ ক্রাইসিস নামে পরিচিত।
লুক্সেমবার্গ ডাচি ছিল নেদারল্যান্ডসের রাজার অধীন, তবে সেখানে প্রুশিয়ান সেনাঘাঁটিও ছিল। তারা জার্মান কাস্টমস ইউনিয়নেরও সদস্য। অভ্যন্তরীণ সমস্যায় জর্জরিত তৃতীয় নেপোলিয়ন চিন্তা করলেন জনগণের নজর অন্যদিকে সরাবার জন্য কিছু করা দরকার। রাজ্যবিস্তার সবসময়েই জনতাকে উৎফুল্ল করে। সুতরাং তিনি লুক্সেমবার্গ কেনার ফয়সালা করলেন। নেদারল্যান্ডের রাজা এবং বিসমার্কের সাথে নেপোলিয়ন যোগাযোগ করেন। বিসমার্ক জানালেন তার আপত্তি নেই। তবে একাজ করতে হবে গোপনে যত দ্রুত সম্ভব এবং তাকে আনুষ্ঠানিক আলোচনার বাইরে রেখে।
এরপর কীভাবে কী হলো তা ধোঁয়াশাপূর্ণ। তবে অনেক ঐতিহাসিকই মনে করেন ফ্রান্সকে খেপিয়ে তুলতে বিসমার্ক নিজেই সংবাদপত্রের কাছে এই খবর পাচার করে দেন। চারিদিকে হুলস্থূল পড়ে গেল। এমনিতেই ইউরোপিয়ান পরাশক্তিগুলো, বিশেষ করে রাশিয়া আর ইংল্যান্ড, তৃতীয় নেপোলিয়নের ব্যাপারে প্রচণ্ডভাবে সন্দেহপ্রবণ ছিল। সবাই হা রে রে করে উঠল। দক্ষিণ জার্মান জাতীয়তাবাদীরা ভ্রাতৃপ্রতিম লুক্সেমবার্গের জন্য ফ্রান্সের বিপক্ষে লড়াইয়ের কথা বলে গলা ফাটাতে লাগল। রাইখস্ট্যাগের সভায় বেনিংসন বিসমার্ককে প্রশ্নবানে জর্জরিত করেন, অনেকে বলেন বিসমার্কই তাকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন এ-কাজ করতে।
প্রকাশ্যে বিসমার্ক নিজেকে লুক্সেমবার্গের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের কান্ডারি হিসেবে তুলে ধরেন।গণ্ডগোল দেখে নেদারল্যান্ডসের রাজাও শেষ মুহূর্তে পিছিয়ে যান। ১৮৬৭ সালে পরাশক্তিগুলোর লন্ডন সম্মেলনে ঘোষণা করা হলো লুক্সেমবার্গ চিরকাল স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ রাজ্য হিসেবে থাকবে। একই বছর মেক্সিকোতে ফ্রান্সের রাজ্য বিস্তারের চেষ্টা শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হলে নেপোলিয়ন রাজনৈতিক অঙ্গনে কোণঠাসা হয়ে পড়েন। তার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে ওঠে। এই ঘটনা ফ্রান্সকে প্রুশিয়ার প্রতি আরো রাগিয়ে দেয়। বিসমার্ক জানতেন ফরাসিরা তেতে আছে, শুধু একটা ছুতো তাদের দিতে হবে।
ফ্রান্সের মিত্র সন্ধান
প্রুশিয়ার কাছে পরাজিত হবার পর অস্ট্রিয়া আর ফ্রান্স কাছাকাছি চলে এসেছিল। দুই পক্ষই প্রুশিয়ার ক্রমবর্ধমান শক্তিতে উদ্বিগ্ন। ১৮৬৭ সালে নেপোলিয়ন অস্ট্রিয়াতে রাষ্ট্রীয় সফরেও যান। এরপর তাদের মন্ত্রীরা অস্ট্রো-ফ্রেঞ্চ একটি জোটের ব্যাপারে কথাবার্তা বলতে থাকেন। নেপোলিয়নের চাওয়া ছিল দক্ষিণ জার্মানিকে উত্তর থেকে বিচ্ছিন্ন রাখা এবং প্রুশিয়ার সাথে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে অস্ট্রিয়ার সহায়তা। কিন্তু অস্ট্রিয়াতে তখনো বড় সংখ্যক জার্মান লোক বসবাস করত, ফলে এরকম কোন অঙ্গিকার করলে তাদের দিক থেকে বিরোধিতার আশঙ্কা ছিল।তাছাড়া অস্ট্রিয়ার ক্ষমতার ধরণ পরিবর্তন হয়ে এখন হাঙ্গেরিয়ানরা প্রচুর রাজনৈতিক ক্ষমতার মালিক হয়েছে। তারাও ফ্রান্সের সাথে এরকম শর্তে চুক্তিতে নারাজ।
এই পরিস্থিতিতে ইতালিয়ানরা নাক গলাল। অস্ট্রিয়ার থেকে ভেনেশিয়া পাবার পর তাদের নজর রোম নগরের দিকে। সেখানে ফরাসি ক্যাথলিকদের চাপে নেপোলিয়ন একদল সেনা মোতায়েন রাখতে বাধ্য হয়েছেন, যারা পোপকে সুরক্ষা দিচ্ছে। ফলে তখন পর্যন্ত ইতালিয়ানরা রোমে ঢুকতে পারেনি। তারা ফ্রান্স ও অস্ট্রিয়ার সাথে চুক্তির বিনিময়ে রোমসহ আরো কিছু এলাকা দাবি করে।
১৮৬৯ সালের মার্চে ফ্রান্স একটি খসড়া চুক্তি সব পক্ষের কাছে পাঠাল। এর একটি ধারা ছিল প্রুশিয়ার সাথে লড়াইয়ে অস্ট্রিয়া থাকবে নিরপেক্ষ। তবে রাশিয়া যদি প্রুশিয়ার স্বপক্ষে দাঁড়ায় তাহলে অস্ট্রিয়ানরা সামরিক সহায়তে দেবে ফরাসিদের। ওদিকে ইতালিয়ানরাও দুই লাখ সেনা ফ্রান্সের পক্ষে মোতায়েন করবে। একইভাবে ফ্রান্স রাশিয়ার যুদ্ধে অস্ট্রিয়া আর ইতালি সাহায্য করবে। কিন্তু অস্ট্রিয়া সামরিক সহায়তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। এদিকে যাজকেরা ক্ষেপে যাবে বলে নেপোলিয়ন রোম ছাড়তে রাজি না হওয়ায় ইতালিয়ানরাও তার আহ্বানে সাড়া দিল না। ফলে ফ্রান্স মিত্রশূন্য হয়ে পড়ল।
স্প্যানিশ সিংহাসন
সেপ্টেম্বর, ১৮৬৮ সাল।
বিপ্লবের মুখে স্পেনের শেষ বুর্বন বংশীয় রানী দ্বিতীয় ইসাবেলা পরিবার পরিজন নিয়ে প্যারিসে পালিয়ে এলেন। স্প্যানিশরা নিজেদের একটি সংবিধান প্রণয়ন করল। তারা সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের পথে হাঁটতে চায়। ফলে একজন উপযুক্ত লোকের খোঁজ পড়ল যার মাথায় স্পেনের মুকুট উঠবে।
দুই বছর পর জুনের ২৬ তারিখ ইসাবেলা আনুষ্ঠানিকভাবে স্প্যানিশ সিংহাসন ত্যাগ করেন তার বড় ছেলে আলফনসোর পক্ষে। তবে এটা নিশ্চিত ছিল আলফনসো তখনই স্পেনের রাজা হচ্ছেন না, কারণ স্প্যানিশরা আগে থেকেই তাদের জন্য রাজার সন্ধান করছিল। তাদের মনে ধরেছিল প্রুশিয়ার এক প্রিন্সিপ্যালিটির রাজপুত্র লিওপোল্ডকে। লিওপোল্ড প্রুশিয়ার প্রাক্তন মিনিস্টার-প্রেসিডেন্ট কার্ল অ্যান্টনের পুত্র, হনজোলার্নদের ক্যাথলিক ধারার সন্তান। তার স্ত্রী পর্তুগালের রাজকন্যা, এক ভাই রুমানিয়ার শাসক। সবদিক থেকেই রাজকীয় লিওপোল্ডের সিংহাসন গ্রহনে দরকার ছিল হনজোলার্নদের বড়কর্তা, প্রুশিয়ার রাজা উইলিয়ামের সম্মতি।
লিওপোল্ড খুব যে একটা আগ্রহী ছিলেন তা নয়। কিন্তু বিসমার্ক বুঝে গেলেন তাকে দিয়েই ফ্রান্সকে ক্ষেপানোর কাজ হাসিল হবে। তার প্ররোচনায় ১৮৭০ সালের মার্চে স্প্যানিশ রাষ্ট্রদূত স্যালাজারের প্রস্তাবে লিওপোল্ড রাজি হন, যদি উইলিয়াম অনুমতি দেন। উইলিয়াম জানতেন বুর্বনদের জায়গায় একজন হনজোলার্ন স্প্যানিশ সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হওয়া ফরাসিরা ভালভাবে নেবে না। কিন্তু বিসমার্ক বানোয়াট রিপোর্ট তৈরি করলেন যেখানে বলা ছিল মাদ্রিদের মানুষ লিওপোল্ডের আশু অভিষেকের সম্ভাবনায় আনন্দিত। ফলে জুনের ১৯ তারিখ উইলিয়াম সম্মতি দেন। এর এক সপ্তাহ পরেই ইসাবেলা আনুষ্ঠানিকভাবে স্প্যানিশ সিংহাসন ত্যাগ করেন।
ফ্রান্সের কানে খবর পৌঁছলে তারা অগ্নিশর্মা হয়ে গেল। স্পেনে হনজোলার্ন শাসন? কভি নেহি! স্পেন তাদের পুরনো বন্ধু, সেখানে লিওপোল্ড ক্ষমতা নেয়া মানে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে প্রুশিয়ার বিজয়। বিসমার্কের কাছে তারা ব্যাখ্যা দাবি করল। বিসমার্ক জানালেন এটা সম্পূর্ণই হনজোলার্নদের পারিবারিক ব্যাপার। তিনি যা জানেন তা সংবাদপত্র থেকেই। এদিকে নতুন ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী গ্রামন্টের ডিউক অ্যান্টোয়েন অ্যাগেনর সংসদে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলেন স্প্যানিশ মুকুট কখনোই কোনো হনজোলার্নের মাথায় উঠবে না।
এমস টেলিগ্রাম
গ্রামন্টের আদেশে ফরাসি রাষ্ট্রদূত বেনেডেট প্রুশিয়ার রাজার সাক্ষাৎপ্রার্থী হলেন। দুই দেশের কূটনৈতিক অঙ্গন তখন যুদ্ধের আশঙ্কায় তটস্থ। এই পরিস্থিতিতে জুলাইয়ের ৯ তারিখ প্যালাটাইনের ব্যাড এমস শহরে অবকাশ যাপনের সময় উইলিয়াম ফরাসি রাষ্ট্রদূতকে সময় দেন। বেনেডেট ফ্রান্সের অবস্থান তুলে ধরে রাজাকে অনুরোধ করেন যাতে তিনি লিওপোল্ডের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেন। উইলিয়াম শান্তভাবে বেনেডেটকে জানান সেই সিদ্ধান্ত লিওপোল্ড বা তার বাবাকেই নিতে হবে। তবে বেনেডেট চলে গেলে তিনি লিওপোল্ডের কাছে চিঠি পাঠিয়ে তাকে পরামর্শ দিলেন স্প্যানিশদের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিতে। ফলে ১২ তারিখ কার্ল অ্যান্টন ছেলের পক্ষ থেকে স্প্যানিশ সিংহাসনের উপর দাবি পরিত্যাগের ঘোষণা দিয়ে দেন।
ব্যাপার এখানেই শেষ হতে পারত। ফ্রান্সের দাবি পূরণের পর একে তারা জোরগলায় কূটনৈতিক সাফল্য হিসেবে তুলে ধরার সুযোগ ছিল। কিন্তু গ্রামন্ট কৌশলগত একটি ভুল করে বসেন। তিনি পরদিন আবার বেনেডেটকে পাঠান। বেনেডেট রাজাকে অনুরোধ করেন তিনি যাতে লিখিত আকারে আনুষ্ঠানিকভাবে একটি বিবৃতি দেন যেন স্প্যানিশ সিংহাসন আর কখনোই কোনো হনজোলার্ন দাবি না করে। রাজা তাকে স্মরণ করিয়ে দিলেন এটা সম্পূর্ণই তাদের পারিবারিক ব্যাপার। লিওপোল্ড তার দাবি উঠিয়ে নিয়েছে। ফরাসিরা যা চাইছিল তা পেয়েছে। সমস্যার নিষ্পত্তি হয়েছে এবং তিনি আর এ নিয়ে কথা বলতে আগ্রহী নন। সম্পূর্ণ কথাবার্তা কূটনৈতিক শিষ্টাচার মেনেই হয়েছিল। বেনেডেট এরপর ট্রেনে চেপে প্যারিসের দিকে যাত্রা করেন। তাকে বিদায় দিয়ে উইলিয়াম বেনেডেটের সাথে আলাপের সারাংশ বার্লিনে পাঠিয়ে দেন, যেখানে বিসমার্ক, মল্টকে আর রুন সভায় বসেছেন।
রাজার টেলিগ্রাম পেয়ে বিসমার্ক যেন হাতে চাঁদ পেলেন। টেলিগ্রামের ভাষা একটু অদলবদল করে উস্কানিমূলক এক রিপোর্ট বানালেন তিনি। সেখানে বলা ছিল বেনেডেট রাজার কাছে দাবি করেছেন, অনুরোধ নয়। ফলে রাজা তার সাথে পুনরায় দেখা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন এবং একজন অ্যাডজুটেন্টের মারফতে বেনেডেটকে সেই কথা জানিয়ে দেয়া হয়েছে। উল্লেখ্য যে অ্যাডজুটেন্ট ফরাসি বাহিনীতে নিচু পদ হলেও প্রুশিয়াতে তাদের অবস্থান ছিল ভিন্ন। বিসমার্কের এই কাণ্ডই এমস টেলিগ্রাম নামে পরিচিত।
১৩ তারিখ সন্ধ্যাতেই বার্লিনের সংবাদপত্রগুলি বিসমার্কের সরবরাহ করা রিপোর্ট নিয়ে খবর প্রকাশ করে। উত্তর দক্ষিণ সব জায়গায় জার্মানরা অগ্নিশর্মা হয়ে গেল। আমাদের রাজার পারিবারিক ব্যাপারে নাক গলাচ্ছে ফরাসীরা। আবার তার কাছে দাবি করার ধৃষ্টতাও দেখাচ্ছে। এই অপমান জার্মানির অপমান। বার্লিনে জনতার সমাবেশ থেকে অহঙ্কারি ফরাসিদের উপযুক্ত শিক্ষা দেবার দাবি উঠতে থাকে।
১৪ জুলাই, বাস্তিল দিবস।
প্যারিসে বসে নেপোলিয়ন আর তার মন্ত্রীরা ভাবছিলেন যা হয়েছে হয়েছে, এখন এই ব্যাপার আর বাড়তে না দিয়ে একে আমাদের সাফল্য বলে প্রচার করা যাক। কিন্তু সকালের সংবাদপত্র খুলে তাদের চক্ষু চড়কগাছ। ফ্রান্সসহ ইউরোপের সমস্ত পত্রিকার প্রথম পাতায় বিসমার্ক সম্পাদিত এমস টেলিগ্রামের খবর। ফরাসিরা তো ক্ষেপে আগুন। আমাদের রাষ্ট্রদূতের সাথে দেখা করতে পুঁচকে প্রুশিয়ার রাজা অস্বীকার করেছে। তা-ও সেখবর পাঠিয়েছে তুচ্ছ এক অফিসারের মাধ্যমে। এত্তবড় অপমান! প্যারিসের মানুষ রাস্তায় নেমে এল। বদমাশ জার্মানদের সাথে যুদ্ধ চেয়ে তারা আওয়াজ তুলল। মন্ত্রিদের মধ্যে বিভেদ থাকলেও গ্রামন্ট লড়াইয়ের পক্ষে অবস্থান নেন। ফরাসি সংসদে যুদ্ধের স্বপক্ষে তার আগ্রাসী বক্তব্য প্রুশিয়ার পক্ষেই কাজ করে। পুরো জার্মানি প্রুশিয়ার পক্ষে একাট্টা হয়। নেপোলিয়ন শেষ পর্যন্ত সেনা সমাবেশের আদেশ দিলেন। পরদিন সংসদে ২৪৫-১০ ভোটে যুদ্ধের জন্য অর্থ বরাদ্দের প্রস্তাব পাশ হয়ে যায়।
১৭ জুলাই প্রুশিয়ার বিরুদ্ধে ফ্রান্সের আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষণার কপি এসে পৌঁছে বার্লিনে। বিসমার্কের হাতে তা পড়ে ১৯ তারিখ। এক এমস টেলিগ্রাম দিয়ে তিনি জার্মানদের উইলিয়ামের পেছনে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হন।আগ বাড়িয়ে যুদ্ধ ঘোষণার জন্যে ইউরোপ ও জার্মান জনগণের চোখে ফ্রান্স আগ্রাসী শক্তি হিসেবে চিহ্নিত হয়। ফলে তার সাহায্যে এগিয়ে আসার কেউ ছিল না। অস্ট্রিয়া ব্যস্ত তার অভ্যন্তরীণ সমস্যা নিয়ে, ইতালি রোম থেকে ফরাসি সেনা না সরানো পর্যন্ত কোনো সমঝোতায় আগ্রহী নয়। ব্রিটিশরা প্রুশিয়ার নেতৃত্বে একীভূত জার্মানির বিরোধী ছিল না। অন্যদিকে রাশিয়াকে বিসমার্ক নিষ্ক্রিয় করে রাখেন এই বলে যে ক্রিমিয়ান চুক্তির শর্ত শিথিলে তিনি তাদের সাহায্য করবেন।