বডিলাইনের ব্যবচ্ছেদ: ষষ্ঠ পর্ব

অধিনায়ক জার্ডিন আর ম্যানেজার ওয়ার্নারের সঙ্গে এমসিসির বার্তা আদান-প্রদান হচ্ছিল নিয়মিতই। স্ত্রীকে জার্ডিনের ব্যাপারে যতই গালমন্দ করুন, এমসিসিতে বডিলাইন নিয়ে কিছুই বলেননি প্লাম। ইংল্যান্ডে অস্ট্রেলিয়ার বার্তা নিয়ে গজিয়ে ওঠা আক্রোশ চোখে পড়েছিল লর্ডসের কাঁচঘেরা কক্ষ থেকেও, এমসিসি তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বেশ কড়া করেই এসিবিকে জবাব পাঠানোর।

এমসিসি সচিব বিল ফিন্ডলের করা প্রথম খসড়া যে এসিবির তারের জবাব হিসেবে পাঠানো হয়নি, তার পেছনেও কাজ করেছিল এই সমুচিত জবাব দেয়া মনোভাব। প্রথম খসড়া বাদ দিয়ে দীর্ঘ পাঁচদিনের আলাপচারিতা-বৈঠক-কমিটি পেরিয়ে যে তারবার্তা পাঠানো হয়েছিল, তা কেবলমাত্র জবাবে আটকে না থেকে প্রশ্ন তুলেছিল অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটারদের সামর্থ্য নিয়ে। লারউডের বোলিংকে অস্ট্রেলিয়ানদের জন্যে একটু বেশিই দ্রুতগতির বলেও ইঙ্গিত ছিল সে বার্তায়।

এসিবি ক্রিকেটের বিদ্যমান আইনে কোনো সংশোধন আনতে চাইলে তা নিয়ে আলোচনা করতে এমসিসি তৈরি বলেও লেখা ছিল সেখানে। নিজেদের অধিনায়ক এবং ম্যানেজারের ওপর এমসিসির সর্বোচ্চ সমর্থন আছে জানিয়ে টেলিগ্রামের ইতি টানা হয়েছিল সিরিজ বাতিলের প্রচ্ছন্ন এক হুমকিতে।

উইলিয়াম বিল ফিন্ডলে, এমসিসির তৎকালীন সচিব; Image source: Bodyline Autopsy

ওদিকে ‘Unsportsmanlike’ শব্দ তুলে নেয়া ব্যতীত এমসিসির ক্রিকেটাররা ব্রিসবেনে মাঠে নামবেন না, এমন ঘোষণাও ততদিনে জানিয়ে দিয়েছেন জার্ডিন। এমসিসি থেকেও তার অস্ট্রেলিয়ায় পৌঁছেছিল জানুয়ারির ২৩ তারিখে। ব্যাপারটি যে আর টেলিফোন কলে সমাধানযোগ্য নয়, তা বুঝতে পেরে এসিবির সদস্যরা জরুরি সভায় বসেছিলেন এর সাতদিন পর। সাতদিন বিরতির কারণ যে তখন অস্ট্রেলিয়ার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যেতে পাঁচদিন পর্যন্তও লাগতো, তা তো উল্লেখ করা হয়েছে আগেই। এমসিসির সিরিজ বাতিলের হুমকিতে অস্ট্রেলিয়া তখন রীতিমতো কোণঠাসা। আর সিরিজ বাতিল মানেই রাজস্ব হারানো, অস্ট্রেলিয়ার তৎকালীন অবস্থায় রাজ্যগুলোর জন্যে যা হতো বিশাল ধাক্কা।

দীর্ঘ বৈঠকের পরেও ফল আসেনি এসিবির ৩০ তারিখের সভায়, বদলে জ্যাক হাচসনকে প্রধান করে গঠিত হয়েছিল উপকমিটি। এমসিসিকে প্রত্যুত্তর দেবার কাজটি করেছিল সেই উপকমিটিই, যদিও তাতে ভুল রয়ে গিয়েছিল একটি। ক্রিকেটারদের আচরণকে ‘অখেলোয়াড়োচিত’ বলা নিয়ে যে আপত্তি ছিল এমসিসির, তা বহাল ছিল এই তারবার্তাতেও। এমসিসির পরবর্তী টেলিগ্রামে তাই মূল প্রশ্ন ছিল,

‘May we accept this as a clear indication that the good sportsmanship of our team is not in question?’

তৎকালীন এসিবির সদস্যরা; Image source: Bodyline Autopsy

এসিবি তখন উভয়-সংকটে। টেস্ট শুরুর দশদিন আগেও অনিশ্চিয়তায় আচ্ছন্ন ব্রিসবেন টেস্টের ভবিষ্যৎ, মাথার ওপরে রাজস্ব পড়ে যাওয়ার শঙ্কা। আবার অন্যদিকে টেস্ট মাঠে গড়ালে ক্রিকেটারদের ফেলে দিতে হচ্ছে হুমকির মুখে। হেলমেটবিহীন ক্রিকেটের যুগে যদি ভয়াবহ কোনো বিপদ ঘটেই যায় অমন বডিলাইন বোলিংয়ে, তখন কী হবে? উপায়ান্তর না দেখে এসিবি যোগাযোগ করেছিল ওয়ার্নারের সঙ্গে। পুরো সিরিজে ওয়ার্নারের কর্তব্যজ্ঞান প্রশ্নবিদ্ধ হলেও এই শঙ্কার সময়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপটি নিয়েছিলেন তিনিই।

অস্ট্রেলিয়াতেও ফেব্রুয়ারির এক তারিখেই ঘটেছিল আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ক্যানবেরায় নিযুক্ত ব্রিটেনের হেড অব দ্য মিশন আর্নেস্ট চার্চলিকে টেলিগ্রাম করেছিলেন ওয়ার্নার। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সামনে নিজে যাবার সাহস ছিল না; তাই চার্চলির কাছে আবদার করেছিলেন, তিনি গিয়ে যেন প্রধানমন্ত্রীকে রাজি করান, এসিবির তারবার্তা থেকে ‘আনস্পোর্টসম্যানলাইক’ শব্দটি প্রত্যাহার করার চাপ দিতে।

জোসেফ লায়ন্স; Image source: Getty Images 

সামান্য গোল অবশ্য সেই টেলিগ্রামেও বেঁধেছিল। টেলিগ্রাম অফিসের এক কেরানি ফাঁস করে দিয়েছিলেন ওয়ার্নারের পাঠানো টেলিগ্রাম। পত্রপত্রিকায় জানাজানি হলেও তা নিয়ে অবশ্য ক্ষতিবৃদ্ধি কিছু হয়নি। বরং ক্রিকেটমোদী অস্ট্রেলিয়ান প্রধানমন্ত্রী টেলিগ্রাম পেয়ে তৎক্ষণাৎ যোগাযোগ করেছিলেন এসিবি প্রধান রবার্টসনের সঙ্গে। অস্ট্রেলিয়ার ক্ষয়িষ্ণু অর্থনৈতিক অবস্থা, সাথে ব্রিটেনের উচ্চ সুদে দেয়া ঋণের উল্লেখ করে তিনি এসিবিকে নির্দেশ করেছিলেন ওই শব্দটি প্রত্যাহারে। এসিবি মেনে নিয়েছিল তা; তবে সাথে সাথে আরজি ছিল, সিরিজের বাকি দুই টেস্টে বডিলাইন বোলিং করা হবে না, এই প্রতিশ্রুতিও যেন আসে এমসিসির তরফ থেকে। কিন্তু এমসিসি ছিল অনমনীয়। ফলতঃ কোনোরূপ প্রতিশ্রুতি আদায় ছাড়াই এসিবি বাধ্য হয়েছিল জানাতে,

‘এমসিসির ক্রিকেটারদের খেলোয়াড়চিত মানসিকতা নিয়ে আমাদের কোনো প্রশ্ন নেই।’     

ততদিনে এমসিসি দল প্রদর্শনী ম্যাচ খেলে কুইন্সল্যান্ডে চলে এসেছে চতুর্থ টেস্ট খেলতে। হোর‍্যাসের লেখা লাইন তুলে দিলে এসিবির তখনকার অনুভূতি প্রকাশে তা-ই যথেষ্ট,

“Lighten grief with hopes of a better tomorrow.”

***

টেস্ট মাঠে গড়ানো নিয়ে শঙ্কা না হয় কেটেছিল, কিন্তু মাঠে গড়ানোর পর পুরোনো বিতর্ক নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার আশঙ্কাও তো ছিল। বডিলাইন বোলিং করা হবে না, এমন কোনো মুচলেকা এসিবি আদায় করতে পারেনি এমসিসি থেকে। সিরিজের চতুর্থ টেস্ট বসতে যাচ্ছিল যে গ্যাবাতে, রক্তগঙ্গায় ভেসে যাবার স্বাদ সে ভেন্যু আগেই পেয়েছিল। ১৯৩২-এর জুনে গ্রেট ব্রিটেন আর অস্ট্রেলিয়ার রাগবি টেস্ট রূপ নিয়েছিল যুদ্ধের। অভিঘাতের শিকার হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার বেশ কয়েকজন খেলোয়াড়, ড্যান ডেম্পসি ভেঙে ফেলেছিলেন হাতের নিম্নভাগ, ঠোঁট কেটেছিলেন হেক জি। মাসআটেক পর সেই গ্যাবাতেই আবার রক্ত ঝরবে, এবার ক্রিকেটের বলি হয়ে; এমন মানসিক প্রস্তুতি বোধহয় নিয়েই রেখেছিলেন অস্ট্রেলীয়রা।

নাহ, ব্রিসবেনে বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি, ঘটেনি সিডনিতে সিরিজের শেষ টেস্টেও। চারিদিকের হাজারো গুঞ্জনে আর অস্ট্রেলীয়দের একের পর এক গঞ্জনা সয়ে ভেতরে ভেতরে নিশ্চয়ই ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলেন জার্ডিনও। অ্যাডিলেডের তৃতীয় টেস্টের পর নাকি গাবি অ্যালেন দেখা পেয়েছিলেন অন্য এক জার্ডিনের। এই জার্ডিন আগের মতো বডিলাইনের কথা ভাবেন না।

তবুও বল গায়ে লেগেছিল ঠিকই, ম্যাককেবের হাতের ওপরের অংশে বল লেগে খেলা বন্ধও ছিল বেশ খানিকক্ষণ। তবে সিরিজ জয় নিশ্চিত করার জন্য যেহেতু সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে আরও একটি, ব্রিসবেনে গা-সইসই বোলিংয়ের গাড়ি ধীরে চালাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন জার্ডিন। ব্রিসবেনে ক্রিজে নতুন ব্যাটসম্যান এলে শুরুর দু-এক ওভার কোনো শর্ট বল করেননি লারউড। আর ব্রিসবেনে জয় পাবার পর তো সিডনিতে আর বডিলাইনের প্রয়োজনই ছিল না।

ম্যাককেবের (ডানে) হাত লেগেছে বল, দেখতে এগিয়ে আসছেন ব্র‍্যাডম্যান; Image source: Bodyline Autopsy

বডিলাইনের সিরিজে বডিলাইন বোলিংই যখন নেই, তখন ম্যাচ নিয়ে আলোচনার কী-ই বা থাকে! কিন্তু বডিলাইন ছাড়াও তো তখন ক্রিকেট হতো, মাঠে ব্যাটে-বলের সাম্যের লড়াই তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করতেই মাঠে উপবিষ্ট হতেন দর্শকেরা। ব্রিসবেনের তীব্র গরমে চিংড়িপোড়া হয়ে দর্শকেরা সেই পুরোনো বিনোদনের আঁচই পেয়েছিলেন।  

তিন বদলের অস্ট্রেলিয়া একাদশে বিশেষজ্ঞ বোলার ছিলেন মোটে তিনজন। টেস্টের আগের শুক্রবারেই শেফিল্ড শিল্ডের প্রথম বোলার হিসেবে ইনিংসে দশ উইকেট তুলে নিয়েছিলেন টিম ওয়াল। কে জানে, অস্ট্রেলিয়ার নির্বাচকেরা এমসিসির বিপক্ষেও তার কাছ থেকে তেমন কিছুই আশা করেছিলেন কি না! সেই আশার গুড়ে অবশ্য বালি ঢেলে দিয়েছিলেন ইংরেজ ব্যাটসম্যানরা, ব্রিসবেনে চল্লিশ ওভার বল করে ওয়াল সর্বসাকুল্যে পেয়েছিলেন দুই উইকেট।

ইংল্যান্ডও বোলিংয়ে নেমেছিল এক পরিবর্তন নিয়ে, তা অবশ্য ভোস ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হওয়াতে বাধ্য হয়ে। ইংল্যান্ডের অবশ্য ক্ষতিবৃদ্ধি তেমন হয়নি তাতে। একে তো ধীরগতির উইকেটে বডিলাইনের প্রয়োগ কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন জার্ডিন, বাড়তি পাওনা ছিল বিকল্প হয়ে আসা টমি মিচেলের দারুণ বোলিং। দুই ইনিংসেই অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়কের উইকেট বাগিয়েছিলেন মিচেল।

***

ম্যাচভাগ্য পক্ষে না এলেও টসভাগ্য তো উডফুলেরই ছিল। সুযোগ পেয়ে ইনিংস গড়ার প্রথম মওকাটা উডফুলই নিয়েছিলেন। সিরিজ বাঁচানোর সংকল্পে ইনিংস উদ্বোধনে নামার আগে সঙ্গী রিচার্ডসনকে বলেছিলেন,

‘যেকোনো মূল্যে লারউডকে উইকেট নেয়া থেকে আটকাতে হবে।’

তা তারা আটকেছিলেনও। ভোস না থাকায় একপ্রান্তে নন-বডিলাইন বোলিংয়ের নিশ্চয়তা ছিলই। লারউডের বোলিংয়ে কিছু সময়ে লেগ-কর্ডনে ছয়জন ফিল্ডার থাকলেও বডিলাইন বলের সংখ্যা গিয়েছিল পড়ে, তীব্র গরমে নেমে এসেছিল কার্যকারিতাও। সেই ফাঁকে উদ্বোধনী জুটিতে অস্ট্রেলিয়া সিরিজে পেয়েছিল একমাত্র শতরানের দেখা।

ভিক রিচার্ডসন পুল খেললেন লেগ-ট্র‍্যাপ এড়িয়ে; Image source: Bodyline Autopsy

হতাশায় লারউড বাউন্সারের পরিমাণ দিয়েছিলেন বাড়িয়ে, কিন্তু গ্যাবার নিচু বাউন্স আর কিছুটা ধীরগতির উইকেটে কাজে আসেনি তা। সিরিজে প্রথমবারের মতো রান পেয়ে রিচার্ডসনকে যেন পেয়ে বসেছিল আত্মাশ্লাঘায়, রান করবার ফাঁকতাল খুঁজছিলেন সব বলেই। শেষতক কাল হয়েছিল সেটাই, হ্যামন্ডকে ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে এসে মারতে গিয়ে হয়েছিলেন স্ট্যাম্পিংয়ের শিকার, আরও এক অস্ট্রেলিয়ান কাঁটা পড়েছিলেন আশির ঘরে।

অস্ট্রেলিয়া অবশ্য ২০০ পার হয়েছিল কেবল রিচার্ডসনকে খুইয়েই। শুরুর জড়ভাব কাটিয়ে নিউ সাউথ ওয়েলসের ফর্ম ফেরত পেয়েছিলেন ব্র‍্যাডম্যানও, মৌসুমে ১০০০ রানের মাইলফলক ছুঁয়েছিলেন ব্যক্তিগত ৪৮ রানে। উডফুল সাজঘরে ফিরেছিলেন ৬৭ করে। লারউডের বল হাতে লাগবার পর ম্যাককেবও টেকেননি বেশিক্ষণ। তবে প্রথম দিন অস্ট্রেলিয়াই শেষ করেছিল এগিয়ে থেকে।

গোটা দিনে খোয়া গিয়েছিল মাত্র তিন উইকেট, ব্র‍্যাডম্যান ক্রিজে ছিলেন ৭১ রানে। নিজের পুরোটা ঢেলে দিয়েও লারউড ছিলেন উইকেটশূন্য। সিডনি মর্নিং হেরাল্ড এই চিত্র দেখেই ঘোষণার সুরে বলেছিল,

‘বডিলাইন বশ মেনেছে।’

দ্বিতীয় দিনেই অবশ্য বশ্যতার সংজ্ঞা গিয়েছিল বদলে, ঠোঁটে বিয়ারের ছোঁয়া পেয়ে লারউড ফেরত পেয়েছিলেন নিজেকে। এমসিসির সহ-অধিনায়ক ওয়াইটের চোখে ফাস্ট বোলিংয়ের সুন্দরতম প্রদর্শনী দেখিয়ে অস্ট্রেলিয়ার শেষ সাত উইকেট তুলে নিয়েছিলেন লারউড আর অ্যালেন, মাঝে রান এসেছিল মাত্র ৭৬। অত লম্বা ব্যাটিং লাইনআপ নিয়েও, অমন একটা শুরুর পরও ৩৪০ রানে গুটিয়ে যাওয়াটা হতাশাজনকই।

পন্সফোর্ড যেন অস্ট্রেলিয়া দলের প্রতীক; Image source: Bodyline Autopsy

এই রানই অবশ্য যথেষ্ট প্রমাণিত হচ্ছিল এমসিসির ইনিংসের এক পর্যায়ে। যদিও উদ্বোধনী জোটে শতরান পার করেছিল ইংল্যান্ডও, হাঁসফাঁস করা গরমের ভেতরে আরও একবার দর্শকদের বিরক্তি বাড়িয়ে সাড়ে তিন ঘণ্টায় আর ১৯১ বলে জার্ডিন করেছিলেন ৪৬, দুই অঙ্কের দেখা পেয়েছিলেন শেষ ব্যাটসম্যান টমি মিচেল ছাড়া সবাই৷ কিন্তু অর্ধশতকের দেখা পেয়েছিলেন কেবল দুইজন। জার্ডিনের উদ্বোধনী সঙ্গী সাটক্লিফ এবং পেইন্টার।

এবং পেইন্টার ইনিংসটি খেলেছিলেন হাসপাতালের বিছানা ঘুরে এসে।

***

পেইন্টার অস্বস্তিবোধ করছিলেন ম্যাচের প্রথম দিন থেকেই। একে তো জার্ডিনের মিলিটারি মেজাজ, তার ওপরে ‘ব্রিসবেনের তীব্র গরমেই খারাপ লাগছে’ ধারণা করে পাত্তা দেননি পেইন্টারও। দ্বিতীয় দিন অবশ্য পাত্তা না দিয়ে পারেননি, গলাব্যথার সঙ্গে শরীরের তাপমাত্রাও উঠে গিয়েছিল ১০২-তে। ব্রিসবেন জেনারেল হাসপাতালে নেবার পর জানা গিয়েছিল, পেইন্টার টনসিলাইটিসে আক্রান্ত। এ ম্যাচ তো বটেই, বাকি সিরিজেই আর মাঠে নামতে পারবেন কি না, তখন সংশয় এ নিয়েই।

তীব্র গরমে দর্শকদের লাইন লেগেছিল কলের সামনে; Image source: Bodyline Autopsy

এরপর পেইন্টার যে গল্প লিখেছিলেন, তা কল্পকথাতেই ভালো মানানসই হতো। এমসিসি বহরের আরেক অসুস্থ রোগী বিল ভোস এসেছিলেন হাসপাতালে, দুজনে মিলে রেডিওতে শুনলেন, এমসিসির টপাটপ উইকেট পড়ছে। ততক্ষণে পেইন্টারের স্বদেশপ্রেম জেগে উঠেছে। উঠে বেরিয়ে গেলেন কামরা থেকে। নার্স জানালেন, ‘শরীর যদি আরও খারাপ হয়, এর দায়ভার আমি কিংবা ডাক্তার নেবো না।’ পেইন্টার উত্তর করলেন, ঝুঁকিটা তিনিই নিচ্ছেন। তার দেশকে উদ্ধার করতে হবে। ভোসকে দিয়ে ট্যাক্সি ডাকিয়ে হাসপাতালের গাউনেই পেইন্টার চলে গিয়েছিলেন মাঠে। সেদিন শেষ বিকেলে ৭৫ মিনিট সেঁটে ছিলেন ওই কাঠফাটা রোদ্দুরে। ২৪ রানে অপরাজিত থেকে আবার তার ঠাঁই মিলেছিল হাসপাতালে। পেইন্টারের ভাষ্যে, ওইটুকু ঘামানো নাকি তাকে উপকার করেছিল ভীষণ।

তবে এমসিসি তৃতীয় দিন শেষেও পিছিয়ে ছিল ৬৯ রানে, হাতে ছিল কেবল দুই উইকেট। তবে মাঝে যেহেতু পেয়েছিলেন রবিবার, সেদিন বিশ্রাম নেবার পর পেইন্টার তরতাজা বোধ করছিলেন আরও। হাসপাতাল থেকে চতুর্থ দিন মাঠে গিয়েছিলেন আবারও। ভেরিটির সঙ্গে দশম উইকেটে গড়েছিলেন ৯০ রানের জোট, প্রথম ইনিংসে পিছিয়ে পড়ার শঙ্কা কাটিয়ে দলকে এনে দিয়েছিলেন প্যালাডিয়ামতুল্য ১৬ রানের লিড। খুব সম্ভবত এমসিসি ম্যাচটা জিতে গিয়েছিল ওখানেই, আর চারদিন আগের অখ্যাত এক ক্রিকেটার ঢুকে গিয়েছিলেন অমরত্বে।

হাসপাতালের বিছানা ছেড়ে এসে; Image source: Bodyline Autopsy

বডিলাইন বোলিং আর তীব্র অস্ট্রেলিয়া-বিদ্বেষে আড়ালে পড়ে গিয়েছিল, নইলে জার্ডিন দুর্দান্ত অধিনায়কত্ব করেছিলেন পুরো সিরিজজুড়েই। ব্রিসবেন টেস্ট শেষে ক্লড করবেট তাকে ‘জাত নেতা’ বলেও আখ্যা দিয়েছিলেন নিজের লেখাতে। প্রয়োজনমতো ব্যাটিংক্রম অদল-বদল করেছিলেন প্রতি ম্যাচেই, ব্রিসবেনে ওষ্ঠাগতপ্রাণ গরমে বদল করেছিলেন বোলারদেরও। অস্ট্রেলিয়ার ওপর চাপটা যেন বজায় থাকে সবসময়ই, তাই ব্রিসবেনে দলের মূল দুই পেসার লারউড আর অ্যালেনকে বল করিয়েছিলেন আলাদা আলাদা স্পেলে।

নির্দেশনা দিচ্ছেন জার্ডিন; Image source: Bodyline Autopsy

তীব্র গরমে দশ ঘণ্টা মাঠে থাকবার পরে ব্যাটে নেমে তালগোল পাকিয়ে ফেলেছিলেন অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যানেরা। নতুন বলটা কাটিয়ে দিলেও ওপেনাররা রান তুলে তুলেছিলেন মাত্র ৪৬। ১০ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে পন্সফোর্ড ডাকের লজ্জা পেয়েছিলেন প্রথম ও শেষবারের মতো। লক্ষ জনতাকে হতাশায় ফেলে ব্র‍্যাডম্যান আউট হয়েছিলেন মাত্র ২৪ রানে।

ব্র‍্যাডম্যানের ব্যাটিং প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিল আবারও। এমনকি ব্র‍্যাডম্যানের বন্ধুবর হিসেবে পরিচিত গাবি অ্যালেন ওই সিরিজে ব্র‍্যাডম্যানের ব্যাটিং দেখে বলেছিলেন,

‘Terrible little coward of fast-bowling.’  

ব্রিসবেনে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটে নামবার আগে স্কোরার ফার্গুসনের কাছে নাকি ব্র‍্যাডম্যান বলে গিয়েছিলেন,

‘ক্রিকেট খেলতে গিয়ে আহত হবার ইচ্ছে আমার নেই। এতে ক্রিকেট যদি ছেড়েও দিতে হয়, তবে তাই দেবো।’

অভিষিক্ত লেন ডার্লিং করেছিলেন ইনিংস সর্বোচ্চ ৩৯, যার শেষটা হয়েছিল আরেক নবকুঁড়ি হ্যামি লাভের সঙ্গে বিশ্রীভাবে গোল বাঁধিয়ে। তা রান-আউটগুলো তো এমন বিশৃঙ্খলেই ঘটে। সিরিজে অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটিংয়ে ধ্বস নামাটা ছিল রোজকার ঘটনা, এবার শেষ ৬ উইকেট পড়েছিল ৬৭ রানে। ভেতরের সমস্ত জীবনীশক্তি শুষে নেয়া গরমেও লারউড বল করেছিলেন সর্বস্ব দিয়ে, প্রথম ইনিংসে চারের পরে দ্বিতীয় ইনিংসে উইকেট নিয়েছিলেন তিনটি। শেষ ব্যাটসম্যান ও’রাইলির স্ট্যাম্প যখন উপড়ে ফেলেছিলেন লারউড, সে সময় অস্ট্রেলিয়ার রান ১৭৫। তবে ইংল্যান্ড তাকে পড়ছিল ১৬০; প্রথম ইনিংসে এগিয়ে থাকবার সুবাদে অ্যাশেজ পুনরুদ্ধারের জন্যে তাই ছিল লক্ষ্য।

আর্চি জ্যাকসন, পৃথিবী ছেড়েছিলেন ব্রিসবেন টেস্ট চলাকালীনই; Image source: Bodyline Autopsy

রান খুব বড় না হলেও একটা ভয় অবশ্য ছিল। ব্রিসবেনের নরম হয়ে যাওয়া পিচে চতুর্থ ইনিংসে ও’রাইলি-আয়রনমঙ্গারের প্রলয়নাচন তোলার কথা তো ছিলই। শুরুতেই সাটক্লিফ সাজঘরে ফেরত যাওয়াতে শঙ্কার মেঘও দেখা গিয়েছিল ইংল্যান্ডের সাজঘরে। কিন্তু, ওই পর্যন্তই। ‘দের আয়ে, দুরস্ত আয়ে’ নীতি মেনে পঞ্চম দিন শেষ সেশনে এমসিসি রান তুলেছিল মাত্র ৬২। ব্রিসবেনের গরমের মতো জার্ডিনের ধীরগতির ব্যাটিং বারেবারেই ঘুরেফিরে এসেছে লেখায়, তবে এদিন তিনি ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন আগের সব কীর্তিকলাপ। জার্ডিন নিজেই তো তার ব্যাটিংকে বলেছিলেন ‘বাড়ির বুড়ি পরিচারিকার সতীত্ব রক্ষা করবার চেষ্টার’ মতো। মাঠে উপস্থিত দর্শকদের বহু গল্প শোনা গিয়েছে তার সেদিনের ইনিংস নিয়ে, কেউ কেউ নাকি মাইল দেড়েক দূরের বারে গিয়ে বিয়ার গিলে ফেরত এসে দেখেছিলেন, জার্ডিন আটকে রয়েছেন একই রানে। ইনিংসের এক পর্যায়ে ৮২ বল আর ৬৩ মিনিট কোনো রান নেননি জার্ডিন, এতটুকু শোনার পরে এই লেখক যাকে আষাঢ়ে গল্প বলতে পারেননি কোনোক্রমেই।

টাইমলেস টেস্টের দিনগুলোতে ওই ব্যাটিং অবশ্য দর্শকদের বিতৃষ্ণা ছাড়া কোনো লোকসানই করেনি। টেস্টের ষষ্ঠীর দিন শুরু হয়েছিল বৃষ্টিতে, মাঝে বৃষ্টি বিরতি দিয়েছিল ক্ষণকালের জন্যে। স্টিকি উইকেটের ভয় কাটিয়ে ম্যাচজয়ের আনুষ্ঠানিকতা সারা হয়েছিল ওই দেড় ঘণ্টাতেই। সমাপন যার ব্যাটে সবচেয়ে ভালো মানাতো, সেই পেইন্টারই ম্যাচের ইতি টেনেছিলেন ছয়ের মারে, ইংল্যান্ডের হাতে তখনো সাত উইকেট।

সিরিজের নিষ্পত্তি এই শটে; Image source: Bodyline Autopsy

ম্যাচ শেষ হতে না হতেই নেমেছিল ঝুম বৃষ্টি, চলেছিল পরের বারো ঘণ্টা ধরে। সেদিন সকালেই বড্ড অকালে আর্চি জ্যাকসনের পরপারে চলে যাওয়াটা খুব সম্ভবত মেনে নিতে পারেনি প্রকৃতিও।

This article is in Bangla language. This article is on the cricket's most sensational test series, 1932-33 ashes. Necessary images are attached inside.

Featured image © Getty Images

Background Image ©  Getty Images

Reference:

  1. David Frith; (2002); Bodyline autopsy: The full story of the most sensational test cricket series Australia vs England 1932-33 (1st ed.); Aurum Press Ltd, 74-77 White Lion Street, London N1 9PF; ABC Books for the Australian Broadcasting Corporation.
  1. Harold Larwood (Duncan Hamilton).Duncan Hamilton; (2009); Harold Larwood (Paperback ed.); 21 Bloomsbury Square, London WC1A 2NS; Quercus.

Related Articles

Exit mobile version