বিশ্ব ঐতিহ্যের নানা নিদর্শন ও স্থাপনা ছড়িয়ে রয়েছে সমগ্র মিশর জুড়ে। তেমনি এক নিদর্শন মিশরের দক্ষিণ প্রান্তে নীল নদের তীরে অবস্থিত পাথরের তৈরি পুরাতাত্ত্বিক স্থাপনা ‘আবু সিম্বেল’। এই অনন্য স্থাপনাটি জাতিসংঘ কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্যতম নিদর্শন হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এটি ‘নূবিয়ান মনুমেন্ট’ নামেও পরিচিত। এই মন্দিরের নির্মাণ কৌশল ও শিল্পবোধের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মিশরীয় সভ্যতার এক অজানা ইতিহাস।
আবু সিম্বেল মন্দিরের অবস্থান
মিশরের আসওয়ান শহরের দক্ষিণ-পশ্চিমে নাসের লেকের তীরে আবু সিম্বেল নামক এক গ্রামের অবস্থান। মিশরের আর পাঁচটা মরু গ্রামের মতোই প্রকৃতি এখানে রুক্ষ। সবুজের উপস্থিতি নেই বললেই চলে। চোখ শুধুই ধু ধু রুক্ষতার সাক্ষী। মনোরম সবুজের সামান্য আচঁও এখানে নেই, তা সত্ত্বেও প্রবল শক্তিমান কিছু ঘাস ইতিউতি মাথা তুলেছে। সূর্যস্নাত মিশর দেশের এই শুষ্ক-ধূসর প্রান্তরের গুরুত্ব কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে সমগ্র মানব সভ্যতার কাছে অমূল্য। কারণ এখানেই যে রয়েছে ভুবনবিদিত আবু সিম্বেল মন্দির। আসওয়ান হাই ড্যাম রিজারভয়ারের উপর দৈত্যাকার মন্দিরদু’টি অবস্থিত। পাথরের গায়ে খোদাই করে করে তৈরি করা হয়েছে বিশাল আকৃতির সব মূর্তি। ফারাও দ্বিতীয় রামসেসের সময়কালে এই অপূর্ব স্থাপত্যটি নির্মাণ করা হয় বলে ঐতিহাসিকদের অভিমত।
মন্দির আবিষ্কারের রহস্য
১৮১৩ সালের দিকের কথা। তখনও মিশরে মরুর বালির নীচে লুকিয়ে অজানা সব রহস্য। তিন ভাগের এক ভাগও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি মাটির নীচের রহস্যময় সব সম্পদের। বালি খুড়লেই যেন বেরিয়ে পড়বে স্তরে স্তরে সাজানো মূল্যবান পুরাতাত্ত্বিক ভগ্নাবশেষ।
এমনই এক ভগ্নাবশেষের একাংশ হঠাৎই চোখে পড়ে সুইস অনুসন্ধানী লুই বুরখার্ডটের। দক্ষিণ মিশরের নুরিয়া অঞ্চলে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন তিনি। হঠাৎ প্রচন্ড হাওয়ায় বালি উড়তে শুরু করলো। অনেকটা বালি উড়ে যাওয়ার পর লুই দেখলেন, বালির তলা থেকে কী একটা উঁকি মারছে। ফলে রহস্যের গন্ধ পেতে খুব একটা সময় নেননি অনুসন্ধানকারী লুই। সামনে গিয়ে বুঝলেন, ওটা একটা স্থাপত্যের ছাদ। কিন্তু বালি খুঁড়ে নীচে কী আছে দেখা হয়ে ওঠেনি। মিশর থেকে এই আবিষ্কারের কথা বলছিলেন তার এক বন্ধু জিওভানি বেলজোনিকে। এই ভদ্রলোক ছিলেন অনুসন্ধিৎসু এক মানুষ। তিনি কৌতুহল চাপতে না পেরে সোজা মিশরে রওনা দিলেন। প্রথমবার বালি খুঁড়ে নীচের রহস্যের সমাধান করতে পারলেন না বটে, কিন্তু হাল ছাড়লেন না।
১৮১৭ সালে ফিরে এলেন দলবল সহ। বালি খুঁড়ে একটি মন্দিরে ঢোকার প্রবেশদ্বার আবিষ্কার করলেন। অনুসন্ধানী হলেও, স্থাপত্যটির ঐতিহাসিক মূল্য নিয়ে তার বিশেষ মাথাব্যথা ছিল না। মন্দিরের ভিতরে ঢুকে যাবতীয় মূল্যবান জিনিস নিয়ে তিনি পালিয়ে যান। আর এভাবেই আবিষ্কৃত হয় প্রাচীন স্থাপত্যের এক অনন্য বিস্ময় ‘আবু সিম্বেল মন্দির’।
কীভাবে নামকরণ হলো এই স্থাপত্যের
ধারণা করা হয়, ‘আবু সিম্বেল’ নামটি এক বালকের, যে সেই সময় অভিযাত্রীদের বালিতে অর্ধেক চাপা পড়া এই মন্দির দেখাতো। সেই থেকেই এই ছেলেটির নামেই মন্দিরের নাম হয়ে যায় ‘আবু সিম্বেল’। খ্রিস্টপূর্ব ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ফারাও দ্বিতীয় রামসেসের শাসনকালে নীল নদের তীরে পাথর কেটে এই মন্দির তৈরি করা হয়। মন্দিরটির দুটি অংশ; একটি ছোট, অন্যটি বড়। ঐতিহাসিকদের মতে, বড় মন্দিরটি রামসেস নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন এবং ছোটটি তার প্রিয় রানী নেফারতিতিকে। ৩৩ মিটার লম্বা এবং ৩৮ মিটার চওড়া এই মন্দিরটি পর্যটকদের কাছে খুবই আকষর্ণীয়।
স্থাপত্যটি তৈরির উদ্দেশ্য
প্রচলিত ধারণা হচ্ছে রামসেস নিজের মহত্ত্ব এবং অসাধারণত্ব প্রমাণ করার জন্যই মন্দিরটি তৈরি করেছিলেন। প্রজা ও পাশের রাজ্যগুলোর কাছে সম্মান বজায় রেখে মিশরীয় ধর্মের প্রতিপত্তি বাড়ানোই ছিল রামসেসের উদ্দেশ্য। বলা হয়, কাদেশ-এর যুদ্ধকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে প্রবল পরাক্রমশালী এই শাসক নিজের ও প্রিয়তমা রানী নেফারতারির মূর্তি খোদিত মন্দির দুটি নির্মাণ করেন। আনুমানিক ১২৬৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এর নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল। এই মন্দিরের নির্মাণ শেষ হতে সময় লেগেছিল প্রায় বিশ বছর।
দ্বিতীয় রামসেস তার সাহস ও যুদ্ধকৌশলে খুব কম সময়ের মধ্যে দক্ষিণে নুবিয়া পর্যন্ত রাজ্যের সীমানা বিস্তার করেন, ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন মিশরের একচ্ছত্র অধিপতি। শুধু রাজ্যবিস্তারেই নয়; স্থাপত্য, ভাস্কর্য, চিত্রশিল্প, কারিগরী প্রায় সবক্ষেত্রেই তার সময়কালে সব দিকেই উন্নতির ছোঁয়া লেগেছিল, যা পরবর্তীতে হয়ে ওঠে মানব সভ্যতার গর্ব, মিশরীয় সভ্যতা।
এহেন বীরপুরুষ রামসেসের কিন্তু পত্নীর সংখ্যাও ছিল শতাধিক। তাদের মধ্যে ফারাওয়ের প্রিয়তমা ছিলেন সুন্দরী ও অশেষ গুণের অধিকারিণী রানী নেফারতিতি। নেফারতিতিকেই রামসেসের বহু মূর্তির পাশে দেখা যায়; যেমন- আবু সিম্বেলের মন্দিরে। তবে, এ মন্দির স্ত্রীর প্রতি রামসেসের ভালবাসার প্রকাশ নয়, এ হলো বিশালত্বের মধ্যে দিয়ে প্রজা ও প্রতিবেশী রাজ্যের কাছে ফারাওয়ের আত্মাভিমান ও অহং প্রদর্শন।
মন্দিরের বৈশিষ্ট্য
দু’টি মন্দিরে সমন্বয়ে গঠিত আবু সিম্বেল মন্দিরটি। বড় মন্দির, যেটা রামসেসের নিজের নামে। মস্ত পাথরের বেদিতে পরপর চারটি মূর্তি রয়েছে। তিনটি মূর্তি রামসেসের পূজিত দেবতার। চতুর্থটি দেবপদে উন্নীত স্বয়ং রামসেস। মন্দিরটি এমনই কারিগরী উৎকর্ষতায় পরিপূর্ণ যে, সূর্যোদয়ের সঙ্গে-সঙ্গে সূর্যের প্রথম রশ্মি প্রতিটি দ্বার দিয়ে প্রবেশ করে দেবতাদের মুখমন্ডল আলোকিত করে।
সেই সময়ের অন্য ফারাওদের মতোই রামসেস নিজেকে ঈশ্বরের চেয়ে কম মনে করতেন না। বাইরের দেওয়ালে ২০ মিটার উঁচু রামসেসের নানা রূপের চারটে প্রকান্ড মূর্তি। এই চারটি মূর্তির পায়ের কাছে আছে আরো মূর্তি, সম্ভবত তা রামসেসের সন্তান ও তাদের মায়ের।
প্রবেশদ্বারের ঠিক উপরে রা-হারাখতির একটি মূর্তি, যাকে দু’পাশ থেকে পূজো করছেন রামসেস। দেওয়ালের উপর সার দিয়ে বেবুনের মূর্তি দু’হাত তুলে সূর্যের আরাধনা করছে। মিশরীয় স্থাপত্যের এক অদ্ভুত ব্যাপার হলো এর ত্রিকোণ আকৃতি। আবু সিম্বেলেও এর অন্যথা হয়নি। তাই বাইরের ঘরগুলোর তুলনায় ভিতরের ঘরগুলো ছোট।
প্রবেশদ্বার দিয়ে ঢুকেই যে বিশাল হলঘরটি (হাইপোস্টাইল হল) তার স্তম্ভ হিসেবে রয়েছে আটটি রামসেসের মূর্তি, যেখানে তাকে মিশরীয় দেবতা ওসাইরিস রূপে দেখানো হয়েছে। দেওয়াল ভর্তি রামসেসের যুদ্ধের ছবি। রয়েছে লিবিয়া, সিরিয়া, নুরিয়ার বিজয় এবং অবশ্যই বিখ্যাত কাদেশ যুদ্ধজয়ের প্রতিকৃতি। দ্বিতীয় হলের দেওয়ালে রামসেস, নেফারতারি ও দেবতাদের ছবিতে ভর্তি।
দ্বিতীয় এবং ছোট মন্দিরটি রানি নেফারতারি ও সৌন্দর্য, ভালবাসার দেবী হাথোরকে উৎসর্গ করা। এর সামনের দেওয়ালে রয়েছে ছ’টি মূর্তি। চারটে রামসেসের এবং দু’টি নেফারতারির। সব মূর্তির উচ্চতা এক। সমান উচ্চতার ব্যাপারটি উল্লেখযোগ্য এই কারণেই যে , মিশরে রানীদের উচ্চতা ফারওদের মূর্তির হাঁটুর চেয়ে বেশি হতো না। তবু নেফারতারি ও রামসেসের মূর্তির উচ্চতা এক হওয়ার একটাই মানে হতে পারে, ফারাও রানীকে যোগ্যতায় ও সম্মানে নিজের সমান মনে করতেন।
এই মন্দিরে প্রবেশ পথের দু’ধারে খোপের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে ছয়টি পঁয়ত্রিশ ফুট উঁচু মূর্তি। এখানে দুটি রামসেসের মূর্তির মাঝখানে রানীর মূর্তি খোদিত। মন্দিরের গর্ভগৃহেও রয়েছে রানীর একটি মূর্তি। প্রাণহীন এই প্রস্তর অবয়বে লাবণ্য, কমনীয়তা ও বীরত্বের মতো মানব অনুভূতির যে অপূর্ব প্রকাশ রয়েছে, তার শিল্পকুশলতা সকলকে বিস্মিত করে।
প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে আক্রান্ত আবু সিম্বেল মন্দির
সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার, মন্দিরটি আবিষ্কারের পর ফের হারিয়ে যেতে বসেছিল। আসওয়ান হাই ড্যাম নামে পরিচিত বিশাল বাঁধের কারণে চারশো মাইল বিস্তৃত বিশাল হ্রদের সৃষ্টি হয়েছিল। কৃত্রিম হ্রদ ‘নাসের’-এর পানির স্তর বাড়তে থাকায় নদীর তীরে অবস্থিত মন্দিরটি ডুবে যাওয়ার উপক্রম হয়। হ্রদের পানি ক্রমশই বেড়ে আবু সিম্বেলকে গ্রাস করবে, এই আশঙ্কায় সমগ্র পৃথিবীর পর্যটকেরা একসময় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল।
নীল নদের প্রভাব থেকে মন্দির উদ্ধার করার কার্যক্রম
মানুষের এই অবিস্মরণীয় পুরাকীর্তিকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে ইউনেস্কো এগিয়ে আসে। ১৯৬৪ সালে ইউনেস্কো ও মিশর সরকারের যৌথ উদ্যোগে শুরু হয় উদ্ধার কার্য। বিভিন্ন দেশের ইঞ্জিনিয়ারদের পাঠানো মন্দির সংরক্ষণের নকশার মধ্যে সুইডিশ প্রস্তাব সর্বজনগ্রাহ্য হয়, যা বাস্তবে রূপ পায় ১৯৬৮ সালে। শুরু হলো এ কালের স্থপতিদের কেরামতি। মন্দিরটি নতুনভাবে নির্মাণ করা হয় আসওয়ান হাই ড্যাম রিজার্ভারের উপর। পরিকল্পনা অনুসারে, মন্দির দু’টিকে টুকরো-টুকরো করে কেটে হাজারের বেশি অংশে ভাগ করা হয়। প্রত্যেকটি টুকরোকে নম্বর দিয়ে চিহ্নিত করে, কাছের একটি পাহাড়ের উপর তোলা হয়।
একেকটা অংশের ওজন প্রায় ত্রিশ টন। প্রত্যেকটি অংশকে তুলে তীরের চেয়ে ৬৫ মিটার উঁচুতে হুবহু মূল মন্দিরের অনুকরণে সাজিয়ে তাদের বসানো হয়। মূল মন্দির ও পাহাড়ের চূড়ার মাঝখানে যে হাজার-হাজার টনের পাথর ছিল, নতুন স্থাপিত মন্দিরে সেই পাথরের পরিবর্তে তৈরি করা হয় কংক্রিটের বিশাল ডোম। উল্টানো হাঁড়ির মতো দেখতে এই ডোমের ছাদের উপর লক্ষ-লক্ষ টন বালি ফেলে, তাকে পাহাড়ের আকৃতি দেওয়া হয়। হিসেব কষে সূর্যের কক্ষপথের সঙ্গে মন্দিরের অবস্থানকে আগের মতোই মিলিয়ে দেওয়া হলো। কাজটায় সময় লেগেছিল প্রায় চার বছর।
বর্তমানে মন্দিরটির ‘নতুন’ কলেবরে তৈরি, কিন্তু অবিকল পুরানো চেহারার মতো। তফাৎ শুধু একটাই যে, আধুনিক যুগে যন্ত্রের সাহায্যে যে কাজ করা হয়েছে, বহু যুগ আগে লক্ষ-লক্ষ টন ওজনের পাথর কাটা ও বসানোর মতো অতিমানবীয় কাজ সেসময়কার মানুষ তাদের আপন হাতে ও বুদ্ধিমত্তার জোরে সম্পন্ন করেছিল যা সত্যিই অবিশ্বাস্য।
এভাবে এ যুগের নামকরা স্থাপত্যদের সার্বিক প্রচেষ্ঠায় প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব হলো প্রাচীনকালের স্থপতিদের কলা-কৌশলে তৈরি পৃথিবীর এক বিস্ময়কর পাথুরে স্থাপত্য ‘আবু সিম্বেল মন্দির’।
ফিচার ইমেজ- Found The World