Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কানকুন পার্ক: সমুদ্রের নিচে ভাস্কর্যের এক মোহনীয় নগরী

পানির নিচে এ এক অদ্ভুত নগরী। যেখানে কেউ সাইকেল চালাচ্ছে, কেউবা রিমোট হাতে টিভি দেখছে। হাতে হাত ধরে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে একদল নারী। কেউ শুয়ে আছে, আবার কেউ আছে দাঁড়িয়ে। চেয়ারে বসে টেবিলে রাখা টাইপ মেশিনে একটানা টাইপ করে চলেছে একজন, আবার বেশ কিছু সন্তানসম্ভবা নারীকেও দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাবে সেখানে। একদিকে একটি শিশু মাথা তুলে তাকিয়ে রয়েছে উপরে, আবার অন্যদিকে রয়েছে বেশ কিছু নগ্ন প্রতিকৃতি। এ কোনো সাধারণ নগরী নয়, সাগরতলের স্বপ্নলোকের মতো এক জগত। শুনে গল্পের কাহিনী মনে হলেও বাস্তবে এর সত্যিকারের অস্তিত্ব রয়েছে মেক্সিকোর ক্যারিবিয়ান সমুদ্রসৈকতের কাছে, যেখানে একটি জাদুঘরে এই সমস্ত চরিত্র তুলে ধরা হয়েছে মূর্তির প্রতিকৃতি নির্মাণের মাধ্যমে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১০ মিটার নিচে মায়াবি ভূবনে অবস্থিত এই জাদুঘরের নাম ‘কানকুন মেরিন পার্ক‘।

‘কানকুন’ জাদুঘরে নির্মিত ভাস্কর্য; Source: wp.com

প্রায় ৪০০ প্রতিমূর্তি ধারণকৃত এই জাদুঘরের অভিনব প্রকল্পটি চালু হয়েছিল আরো চার-পাঁচ বছর পূর্বে। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, এই জাদুঘর পরিদর্শনে মানুষকে যেতে হবে আক্সিজেন মাস্কের সহায়তায় ডুবুরির পোষাকে। ভিন্ন আঙ্গিকে গড়ে ওঠা এই জাদুঘরে সামুদ্রিক মাছের অবাধ চলাচল এর সৌন্দর্যের বৃদ্ধি ঘটিয়েছে কয়েক গুণ বেশি। সমুদ্রের নিচের স্বাভাবিক পরিবেশ ও জলজ প্রাণীর চলাচল অব্যাহত রাখতে তৈরি হয়েছিল এই জাদুঘরটি।

মেক্সিকোর সাগর উপকূলীয় ‘কানকুন ইসলা মুজেরেস ন্যাশনাল মেরিন পার্ক‘-এ সারা বছরই থাকত মানুষের ভিড়। ফলে ২০০৯ সালে মানুষের সমাগমে সেখানকার উপকূলীয় জলজ প্রাণীর চলাচল ও সামুদ্রিক প্রবালের অস্তিত্ব পড়েছিল হুমকির মুখে। সমুদ্রের নিচের স্বাভাবিক পরিবেশ দিনে দিনে মলিন হয়ে পড়ছিল। মেক্সিকো সাগরের পশ্চিম উপকূলীয় এই সমস্যা নিয়ে অনেকদিন ধরেই চিন্তিত ছিল সেখানকার মানুষজন। তাদের প্রাকৃতিক ঐতিহ্য রক্ষায় এগিয়ে আসেন যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত ভাস্কর ‘জেসন দ্য ক্লেয়ার্স টেইলর‘। ৩৭ বছর বয়সী এই ভাস্কর দীর্ঘদিন ধরে নিয়োজিত ছিলেন এই শিল্পে। সমুদ্রের তলদেশে স্বাভাবিক পরিবেশ তৈরিতে তিনি নতুন ধারণার প্রবর্তন করেন।

ভাস্কর জেসন টেইলর; Source:Notun Somoy

মাছের বিচরণ, বংশবৃদ্ধি ও সামুদ্রিক পরিবেশ স্বাভাবিক রাখতে কৃত্রিম প্রবাল নির্মাণের উদ্যোগ নেন জেসন। তার পরিকল্পনার যথাযথ গুরুত্ব বুঝে এগিয়ে আসে মেক্সিকোর ‘দ্য মিউজিও সাব একুয়াটিকো ডি আর্ত’ নামক একটি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান। যৌথ পরিচালনায় শুরু হয় প্রকল্প ‘লাইফ কাস্টস‘। অতিরিক্ত জনকোলাহল নিরসন এই প্রকল্পের যে উদ্দেশ্য ছিল তা নয়। বরং বিলুপ্তপ্রায় প্রবাল প্রাচীর তৈরি করে জলজ প্রাণীর স্বাভাবিক চলাচল অব্যাহত রাখাই ছিল এর মূল উদ্দেশ্য।

সমুদ্রের তলদেশে ভাস্কর্য তৈরি করে তার রক্ষণাবেক্ষণ নিতান্ত সহজ কাজ নয়। তাই অন্যান্য জাদুঘরের তুলনায় এই প্রকল্প বাস্তবায়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ পদ্ধতি তৈরি করা হয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে। আগে থেকেই জেসনের সমুদ্রের নিচে কাজ করার অভিজ্ঞতা ছিল। কানকুন মেরিন পার্ক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রবার্টো ডিয়াজ বলেন,

“জেসনের শিল্পকর্ম প্রথমে আমি ইন্টারনেটে দেখেছিলাম। সেটা আমাকে সত্যিই মুগ্ধ করেছিল। নান্দনিক দিক থেকে চিন্তা করলে এটা আসলেই অসাধারণ ভাস্কর্য।”

তাই কানকুন মেরিন পার্কের সিদ্ধান্তে জাদুঘর সাজানো হয়েছে জেসনের তৈরি ভাস্কর্যে। ভাস্কর্যগুলো নির্মিত হয়েছে লানযারোতের বাসিন্দাদের জীবনযাত্রা ও দৈনন্দিন কর্মকান্ডের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরার মাধ্যমে।

পানির নিচে ভাস্কর্য নির্মাণ; Source: theplaidzebra.com

এসব ভাস্কর্য তৈরিতে জেসন ব্যবহার করেছেন বিশেষ ধরনের সিমেন্ট, যা সাধারণ সিমেন্টের তুলনায় ১০ গুণ বেশি শক্তিসম্পন্ন। তাছাড়া সিমেন্টে পিএইচ এর মাত্রা প্রশমিত হওয়ায় সেগুলো প্রবাল জন্মানোর উপযোগী। প্রথমে এ প্রকল্পে ২০০টি ভাস্কর্য নির্মাণের পরিকল্পনা থাকলেও প্রয়োজনীয়তার কথা ভেবে পরবর্তীতে ৪০০টি ভাস্কর্য দিয়ে সেজেছে এই জাদুঘরটি। জানা গেছে,  ভাস্কর্য তৈরিতে এমন কোনো পদার্থ ব্যবহৃত হয়নি যা সমুদ্রের পানি বা জীববৈচিত্রের জন্য ক্ষতিকর।

জাদুঘর তৈরির পর থেকেই ভাস্কর্যের প্রাচীরে প্রবালের জন্ম বৃদ্ধি পেয়েছে, সাথে স্বাভাবিকতা লাভ করেছে জলজ প্রাণীর চলাচল। স্থলে গড়ে ওঠা যেকোনো জাদুঘরের তুলনায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অনন্য কানকুন মেরিন পার্ক, কেননা সমুদ্রের উপরিভাগে সূর্যালোকের কম-বেশি প্রভাবে প্রতিনিয়ত পানির নিচে ভাস্কর্যের রঙ পরিবর্তিত হচ্ছে।

Source: wp.com

সমুদ্রের নিচে কীভাবে এত বিপুল সংখ্যক ভাস্কর্য নানা ভঙ্গিমায় প্রতিষ্ঠিত হল জাদুঘর ভ্রমণের সময় এই ভাবনা চলে আসে দর্শনার্থীদের মনে। ভাস্কর্য প্রতিষ্ঠার পূর্বে বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন ড্রিল মেশিনের সাহায্যে সমুদ্রের তলদেশ ছিদ্র করে নেওয়া হয়েছিল প্রথমে। ভাস্কর্যে ব্যবহৃত উপাদানগুলোর সাহায্যে জেসন তৈরি করেছেন বিশেষ ধরনের শক্ত ফাইবার গ্লাস। এই ফাইবার গ্লাসের সহায়তায় পানির নিচে দাঁড় করানো হয়েছে ভাস্কর্যগুলো। তারপর সমুদ্রে স্থায়ীভাবে বসানোর সময় ভাষ্কর্যগুলো একত্রে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। আর এই কাজের জন্য নৌকার উপর ক্রেন বসিয়ে বেশ ঝুঁকি সামলে কাজ করতে হয়েছে তাদের। একত্রে ভাস্কর্যগুলোর ওজন ১২০ টনেরও বেশি। পানির নিচে এগুলো অনায়াসে ৩০০ বছর টেকার মতো করে বানানো হয়েছে। ব্রিটিশ ভাস্কর জেসন টেইলর ভাস্কর্যগুলোর নাম দিয়েছেন ‘দ্য সাইলেন্ট ইভ্যলুশন‘।

Source: twitter.com

ডুবুরি বা দর্শনার্থীদের জন্য কোনোরকম নিষেধাজ্ঞা নেই এই পার্কে। অবাধে সবাই সাঁতার কাটতে পারবে সেখানকার মাছেদের সাথে। জাদুঘরের বিশেষত্ব বোঝাতে জেসন বলেন,

”প্রতিবছর প্রায় সাড়ে সাত লাখ মানুষ কানকুনের এই উপকূলে বেড়াতে আসে। এখানে পানির নিচে অবস্থিত ইসলা মুজেরেস ন্যাশনাল মেরিন পার্ক ভ্রমণার্থীদের কাছে দারুণ জনপ্রিয়। কিন্তু এই জনপ্রিয়তাই উপকূলকে ঠেলে দিচ্ছিল ধ্বংসের মুখে। সেখানকার শৈলপ্রাচীর দারুণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল, ফলে সমুদ্রের স্বাভাবিক পরিবেশ নষ্ট হয়ে পড়ছিল দিনে দিনে। জনপ্রিয়তার সাথে প্রাকৃতিক ঐতিহ্য ও স্বাভাবিক পরিবেশ ধরে রাখতে এই বিশেষ আয়োজন।”

তবে জাদুঘর প্রতিষ্ঠার পর দ্বিগুণ হারে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে পার্কটি ভ্রমণপিয়াসীদের নিকট। পরিবেশ উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা এই জাদুঘর নির্মাণের পর জেসন তার শিল্পকর্ম নিয়ে বলেন,

”আমরা চেয়েছি এ প্রকল্পটিকে অন্যরকম, খুব উঁচু দরের রোমাঞ্চকর করতে। আর মূল কাজটি করতে গিয়ে আমি চেষ্টা করেছি মানুষ আর পানির নিচের পরিবেশের মিথস্ক্রিয়া ঘটানোর। সেই মিথস্ক্রিয়ায় সবাই যেন একই ছন্দে বাঁধা থাকতে পারে।”

ভাস্কর্যে প্রাবাল প্রাচীর উৎপন্ন হয়েছে; Source: BD MORNING

তবে জাদুঘরটির মূল প্রতিকূলতা সেখানকার আবহাওয়া। কারণ উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরে এবং আটলান্টিক মহাসাগরে সৃষ্ট হারিকেন ও ঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের তাণ্ডব সেখানে প্রায়ই আঘাত হানে। ফলে এসব দুর্যোগে যেকোনো সময় লণ্ডভণ্ড হয়ে যেতে পারে অনেক কষ্টে তৈরি স্বপ্নের এই জাদুঘর। তবে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী দল জানিয়েছে, ভাস্কর্যগুলো যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করে টিকে থাকতে পারবে। যদি সত্যি সত্যিই দুর্যোগ মোকাবেলায় সক্ষম হয় এই জাদুঘরের মূর্তিগুলো, তবেই তাদের সাথে বেঁচে থাকবে সমুদ্রের ঐতিহ্য রক্ষাকারী সেখানকার প্রবাল প্রাচীর।

বিশ্বের অভিনব ও মোহনীয় কারুকার্যের এই শিল্পকর্ম নিত্যনতুন রূপ পাচ্ছে সেখানকার জলজ প্রাণীর সংস্পর্শে। কখনো পানির মৃদুমন্দ ঢেউ মনোমুগ্ধকর পরিবেশ সৃষ্টি করছে, আবার কখনো জলজ প্রাণী মূর্তির গায়ে জন্মানো শেওলা ও প্রবাল ঠুকরে ক্ষয়ে দিচ্ছে মূর্তির এক অংশ। নীল জলরাশির তলদেশে বিভিন্ন আঙ্গিকে দাঁড়িয়ে থাকা এসব মূর্তির আশেপাশে বিচরণ করে বেড়ানো জলজ প্রাণীগুলোও বিস্ময়ে ঘুরে ফিরে দেখে মূর্তিগুলো। জনকোলাহলে উপকূলীয় পরিবেশ যে হুমকির মুখে পড়েছিল, ভাস্কর্য নির্মাণে পুনরায় হারানো সৌন্দর্য ফিরে পেয়েছে এই মহাসাগর। একইসাথে পর্যটন কেন্দ্রকে আকর্ষণীয় করে তুলতে ও প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে মেক্সিকোর ক্যারিবিয়ান সমুদ্রের তলদেশের এই জাদুঘর।

ফিচার ইমেজ: theplaidzebra.com

Related Articles