পুরকৌশলের সংজ্ঞা অনুযায়ী কোনো ভবনের প্রস্থের তুলনায় এর উচ্চতা যদি ১০-১২ গুণ বা তার চেয়েও বেশি হয়, তবে তাকে সরু ভবন (Slender Building) বলা যায়। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের অসংখ্য বিল্ডিং ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এর মধ্যে কিছু আছে, সত্যি সত্যিই স্লেন্ডার, আবার কিছু আছে যাদের শুধু একপ্রান্ত অত্যন্ত সরু, কিন্তু মধ্যভাগ বা অপর প্রান্ত স্বাভাবিক প্রস্থ বিশিষ্ট। আবার এমন কিছু বিল্ডিংও আছে, যেগুলো উচ্চতা কম হওয়ার কারণে এই সংজ্ঞা অনুযায়ী সরু ভবন নয়, কিন্তু সেগুলোর প্রস্থ এতোই কম যে কোনো মানুষের পক্ষে সেখানে বসবাস করা সম্ভব, সেটি বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। চলুন দেখে নেওয়া যাক বিশ্বের বিখ্যাত কয়েকটি সরু বিল্ডিং।
ফ্ল্যাট্রিয়ন বিল্ডিং, নিউইয়র্ক
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানহাটনের নিউইয়র্ক সিটিতে অবস্থিত ফ্ল্যাট্রিয়ন বিল্ডিংটি ছিল বহুতল ভবনের ক্ষেত্রে অন্যতম পথিকৃত। এর নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছিল ১৯০২ সালে। নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের নাম অনুসারে বিল্ডিংটির পূর্ব নাম ছিল দ্য ফুলার বিল্ডিং। ২২ তলা বিশিষ্ট এই বিল্ডিংটি ছিল সে সময়ের সর্বোচ্চ বিল্ডিংগুলোর মধ্যে একটি। বিল্ডিংটিকে নিউইয়র্কের সবচেয়ে বিখ্যাত এবং বিশ্বের অন্যতম প্রতীকি বিল্ডিংগুলোর মধ্যে একটি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিল্ডিংটির নামানুসারে এর আশেপাশের এলাকাটি ফ্ল্যাট্রিয়ন ডিস্ট্রিক্ট নামে পরিচিত হয়।
নিউইয়র্কের দুটি রাস্তার মিলনবিন্দুতে অবস্থিত বিল্ডিংটি উপর থেকে দেখতে ত্রিভুজাকৃতির। ত্রিভুজটির সম্মুখভাগ অত্যন্ত সরু, মাত্র ২ মিটার। যদিও ক্রমশ প্রশস্ত হওয়া বিল্ডিংটির ত্রিভুজ আকৃতির ভূমির দৈর্ঘ্য ২৬ মিটার। ফলে বিল্ডিংটিকে সামনে এবং পাশের দিক থেকে দেখতে খুবই সরু মনে হয়, যদিও বাস্তবে পেছন দিকে ধীরে ধীরে এটি প্রশস্ত হয়ে গেছে। বিল্ডিংটির উচ্চতা নির্মাণকালীন সময়ে ছিল ৮৬ মিটার। পরবর্তীতে নতুন দুইটি তলা সংযোজন করার পর বর্তমানে এর উচ্চতা ৯৩ মিটার। বিল্ডিংটির কাঠামো স্টিলের তৈরি।
আইকন বিল্ডিং, নিউইয়র্ক
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে অবস্থিত আইকন বিল্ডিং নামক এই ভবনটি একটি আবাসিক ভবন। মোট ১২২টি অ্যাপার্টমেন্ট বিশিষ্ট ৪৩ তলা এই বিল্ডিংটি তার উচ্চতার তুলনায় অত্যন্ত সরু। এর সম্মুখভাগের সর্বনিম্ন প্রস্থ মাত্র ৭ মিটার, যদিও পশ্চাৎভাগের প্রস্থ ১৩ মিটার। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পরিভাষায় যেখানে প্রস্থের সাথে উচ্চতার অনুপাত (স্লেন্ডারনেস রেশিও) ১:১০ থেকে ১:১২ হলেই তাকে সরু বিল্ডিং হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়, সেখানে ১৭২ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট এই বিল্ডিংটির অনুপাত ১:২৪!
আইকন বিল্ডিংটি নির্মাণ করার জন্য এর নির্মাতা প্রতিষ্ঠানকে দীর্ঘ পাঁচ বছর পর্যন্ত আইনী লড়াই চালিয়ে যেতে হয়েছিল। বিল্ডিংটি সরু হওয়ায় এবং প্রতিটি তলায় মাত্র তিনটি অ্যাপার্টমেন্ট হওয়ায় অধিকাংশ কক্ষকেই ভবনটির বিভিন্ন প্রান্তে স্থান দেওয়া সম্ভব হয়েছে। ফলে অধিকাংশ কক্ষ থেকেই প্রাকৃতিক আলো-বাতাস উপভোগ করা সম্ভব হয়।
গেটওয়ে বিল্ডিং, সিঙ্গাপুর
সিঙ্গাপুরে অবস্থিত গেটওয়ে বিল্ডিং মূলত পাশাপাশি অবস্থিত এক জোড়া বিল্ডিং- গেটওয়ে ইস্ট এবং গেটওয়ে ওয়েস্ট। তবে স্থানীয়ভাবে এরা কার্ডবোর্ড বক্স বিল্ডিং নামেই পরিচিত। ৩৭ তলা উঁচু বিল্ডিং দুটোর নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছিল ১৯৯০ সালে। এদের প্রতিটির উচ্চতা ১৫০ মিটার। বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানীর প্রধান কার্যালয় ছাড়াও মেক্সিকোর দূতাবাস সহ কিছু সরকারি প্রতিষ্ঠানেরও অবস্থান এই বিল্ডিং দুটোতে।
বিল্ডিং দুটো ট্রাপিজয়েড আকৃতির। নিখুঁত ট্রাপিজয়েডের মতোই এদের বিপরীত দেয়ালগুলোর মিলনস্থল এমনভাবে নির্মিত হয়েছে যে, নির্দিষ্ট কোণ থেকে দেখলে বিল্ডিংগুলোকে দ্বিমাত্রিক বলে ভ্রম হয়। বিল্ডিংগুলোর স্থাপত্য কৌশল বিশ্বমানের হিসেবে মর্যাদা পেয়েছে।
দ্য থিন বিল্ডিং, লন্ডন
লন্ডনের সাউথ কেনসিংটনে অবস্থিত দ্য থিন বিল্ডিং নামক এই বিল্ডিংটিও ফ্ল্যাট্রিয়ন বিল্ডিংয়ের মতো কীলক আকৃতির। অর্থাৎ এর সম্মুখভাগ অত্যন্ত সরু, কিন্তু পশ্চাৎভাগের প্রস্থ প্রায় স্বাভাবিক। এর সবচেয়ে সরু অংশের প্রস্থ দুই মিটারের চেয়েও কম। এটি লন্ডনের সবচেয়ে অস্বাভাবিক ব্যক্তিগত মালিকানাধীন ভবনগুলোর মধ্যে একটি হিসেবে পরিচিত। এক বেডরুম বিশিষ্ট এই বিল্ডিংয়ের ফ্ল্যাটগুলোতে একটি করে ড্রয়িংরুম, বাথরুম এবং রান্নাঘর আছে। বিল্ডিংটি তিন তলা বিশিষ্ট এবং ৬০০ বর্গফিট (৫৫ বর্গমিটার) জমির উপর অবস্থিত।
বিল্ডিংটির বাজারমূল্য প্রায় ১ মিলিয়ন পাউন্ড, যা লন্ডনের প্রচলিত মূল্যের তুলনায় প্রায় চার গুণ বেশি। এত চড়া মূল্যের কারণ হিসেবে এর এই সরু সম্মুখভাগ বিশিষ্ট আকৃতিকেই দায়ী করা হয়। বিল্ডিংটি লন্ডনের সবচেয়ে অদ্ভুত পাঁচটি বিল্ডিংয়ের একটি বলে এটি ট্যুরিস্টদের কাছেও আকর্ষণীয়। সেজন্যই এর মূল্য এত বেশি।
লা স্ট্রেচা, ভ্যালেন্সিয়া
স্পেনের ভ্যালেন্সিয়া শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত লা স্ট্রেচা বিল্ডিংটিকে বিশ্বের সবচেয়ে সরু বিল্ডিংয়ের মধ্যে একটি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পাশাপাশি দুটো বিল্ডিংয়ের মধ্যবর্তী ফাঁকা স্থানে অবস্থিত এই বিল্ডিংটি এতই সরু যে অধিকাংশ সময়ই মানুষ বুঝতে পারে না এখানে একটি বিল্ডিং আছে। মাত্র ১ মিটার ৫ সেন্টিমিটার প্রস্থ বিশিষ্ট এই বিল্ডিংটির কক্ষগুলোকে আড়াআড়ি স্থান দেওয়া সম্ভব না, ফলে সেগুলোকে লম্বালম্বি এবং একটির উপরে আরেকটিকে স্থান দেওয়া হয়েছে।
ভ্যালেন্সিয়ার লোপে দে ভেগা স্কয়ারে সান্তা কাতালিনা চার্চের ঠিক পেছনে অবস্থিত এই বিল্ডিংটি পাঁচ তলা উচ্চতা বিশিষ্ট। গিনেজ বুক অফ ওয়ার্ল্ডে বিল্ডিংটিকে ইউরোপের সবচেয়ে সরু বিল্ডিং হিসেবে স্থান দেওয়া হয়েছে। এই বিল্ডিংটি স্পেন ভ্রমণকারী পর্যটকদের অন্যতম প্রিয় একটি স্থান। পর্যটকদের আকর্ষণ করার জন্য বিল্ডিংটির মালিক এর প্রবেশপথের দরজার উপরে একটি সাইনবোর্ডে এর প্রস্থ (১০৫ সেন্টিমিন্টার) উল্লেখ করে রেখেছেন।
কেরেট হাউজ, পোল্যান্ড
কেরেট হাউজ নামে বিশ্বের অন্যতম সরু এই বাড়িটির সর্বনিম্ন প্রস্থ মাত্র ৭২ সেন্টিমিন্টার এবং সর্বোচ্চ প্রস্থ ১ মিটার ২২ সেন্টিমিটার। পোল্যান্ডের ওয়ারসতে অবস্থিত এই বাড়িটি পাশাপাশি দুটো বিল্ডিংয়ের মধ্যবর্তী ফাঁকা স্থানে অবস্থিত। বাড়িটির নকশা করেছেন স্থপতি জ্যাক স্কেজনি, যিনি বাড়িটিকে ভ্রাম্যমাণ লেখকদের কাছে ভাড়া দেওয়ার জন্য উপযোগী করে তৈরি করেছেন।
জ্যাক স্কেজনি যখন প্রথম ফাঁকা স্থানটি লক্ষ্য করেন, তখনই তিনি সেটিকে কাজে লাগানোর জন্য পরিকল্পনা করেন। এরকম সরু স্থানে দীর্ঘদিন বসবাস করা সম্ভব না, তাই তিনি চিন্তা করেন, বাড়িটিকে এমন কারো জন্য উপযোগী করে নির্মাণ করতে হবে, যে অল্প কিছুদিনের জন্য এখানে থাকবে এবং একা একা নিরিবিলি কোনো কাজ করতে পছন্দ করবে। সেই পরিকল্পনা থেকেই তিনি এবং ইসরায়েলি লেখক এডগার কেরেট মিলে বাড়িটির নকশা সম্পন্ন করেন। লেখক কেরেটের নামানুসারেই বাড়িটির নাম রাখা হয় কেরেট হাউজ।
কেরেটের এই বাড়িটির ক্ষেত্রফল মাত্র ১৪.৫ বর্গ মিটার। বাড়িটি লম্বালম্বিভাবে উপরে উঠে গেছে। স্টিল ফ্রেমের সিঁড়ি বেয়ে এক তলা থেকে অন্য তলায় যাওয়া যায়। নিচ তলার সিঁড়িকে রিমোট কন্ট্রোলের সাহায্য উপরে তুলে ধাপগুলোকে বন্ধ করে বর্ধিত করিডোর হিসেবেও ব্যবহার করা যায়। বাড়িটির বিছানা, টেবিল, চেয়ার, ডেস্ক সব আসবাবপত্রকেই বাড়িটির জন্য উপযোগী করে বিশেষ মাপে তৈরি করা হয়েছে। বাড়িটি পর্যটকদের কাছে অন্যতম আকর্ষণীয় একটি স্থান হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছে।
বিশ্বের সবচেয়ে সরু বাড়ি, ব্রাজিল
ব্রাজিলের এল সালভাদর থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরবর্তী শহর মাদ্রে দে দিউসে অবস্থিত এই বাড়িটিকে কিছু কিছু বর্ণনায় বিশ্বের সবচেয়ে সরু বাড়ি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এর প্রস্থ মাত্র ১ মিটার। বিল্ডিংটির মালিক হেলেনিতা কুইরোজ যখন তার মালিকানায় থাকা অত্যন্ত সরু এক টুকরা জমিতে এই বাড়িটি নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন, তখন সিটি কর্পোরেশন প্রথমে তাকে অনুমতি দেয়নি। পরে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তিনি বিল্ডিংটি নির্মাণের অনুমতি জোগাড় করেন, যা কালক্রমে শহরটির পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণীয় স্থানে পরিণত হয়েছে।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, অত্যন্ত সরু এই বাড়িটিতে ৩টি বেডরুম, ২টি লিভিংরুম, একটি রান্নাঘর, একটি লন্ড্রি, একটি টয়লেট এবং একটি বারান্দা আছে। তবে স্বাভাবিকভাবেই এর রুমগুলো লম্বালম্বি এবং খাড়াখাড়িভাবে অবস্থিত। তিন তলা বিশিষ্ট এই বিল্ডিংটির উচ্চতা ১০ মিটার।
আমস্টারডামের সরু বাড়ি
নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডামের সিঙ্গেল ৭ এলাকায় একটি খালের তীরে অবস্থিত এই বিল্ডিংটি ইউরোপের অন্যতম সরু বিল্ডিং। এর সম্মুখভাগের প্রবেশপথের প্রস্থ মাত্র ১ মিটার ১০ সেন্টিমিটার। তবে এর মধ্যভাগ এর পশ্চাৎদিকের প্রস্থ আরেকটু বেশি। দোতলা এই বাড়িটির সর্বাধিক প্রস্থ ২ মিটার এবং উচ্চতা ৫ মিটার। এটি অত্যন্ত পুরাতন একটি বাড়ি। ধারণা করা হয়, ষোড়শ শতাব্দীতে এটি নির্মিত হয়েছিল। বাড়িটির প্রতিটি তলায় মাত্র একটি করে রুম আছে, যা বসবাসের জন্য খুবই অনুপযোগী। বর্তমানে এটি চায়ের দোকান হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
স্কিনি হসম্যান বিল্ডিং, প্যারিস
হসম্যান বিল্ডিং হচ্ছে ১৮৫৩-১৮৭০ পর্যন্ত সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়ানের সময় ব্যারন হসম্যানের তত্ত্বাবধানে নির্মিত ফ্রান্সের অনেকগুলো বিল্ডিংয়ের সাধারণ নাম। প্যারিস জুড়ে ছড়িয়ে থাকা এই বিল্ডিংগুলো মধ্যযুগীয় স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন। তার মধ্যে এটি অন্যতম সরু একটি বিল্ডিং। এটি প্রচলিতভাবে স্কিনি হসম্যান বিল্ডিং নামে পরিচিত।
স্লিভার বিল্ডিং, টোকিও
টোকিও বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ শহর। প্রতিটি ইঞ্চি জায়গা এখানে অত্যন্ত মূল্যবান। তাই টোকিওর বিভিন্ন জায়গায় সরু বহুতল ভবন একটি পরিচিত দৃশ্য। স্লিভার বিল্ডিং নামে এই বিল্ডিংটি তারই মধ্যে একটি। বিল্ডিংটি ১২ তলা বিশিষ্ট।
ফিচার ইমেজ- boweryboyshistory.com