
ইসলামিক স্টেট অব ইরাক এন্ড সিরিয়া যেটি পরিচিত আইসিস, আইএস, আইসিল কিংবা দায়িশ নামে, বর্তমান পৃথিবীর এক ভয়ঙ্কর আতঙ্কের নাম। এই জঙ্গী গোষ্ঠীর বর্বর কর্মকাণ্ডের সাথে ইতোমধ্যেই পরিচিত আমরা সবাই। মানুষ খুনের নির্মম খেলায় নামা আইসিসের প্রতিষ্ঠায় গোপন মার্কিন মদদ ও প্রকাশ্য বিরোধীতা, তাদের উপর রাশিয়ার ব্যাপক হামলা, গোটা বিশ্বের নানা প্রান্তে কদিন পরপর জঙ্গী হামলার দায় স্বীকার ইত্যাদি আলোচনা নিয়ে সর্বদাই সরগরম রয়েছে গণমাধ্যম।
আইসিসের উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন, তাদের বেছে নেওয়া ধ্বংসের পথ এর মধ্যেই অপূরণীয় ক্ষতি করে ফেলেছে মানুষের সভ্যতার ইতিহাসের। পৈশাচিক কায়দায় নিরীহ নিরস্ত্র মানুষ তো তারা মারছেই, সাথে ধ্বংস করে ফেলছে পৃথিবীর প্রাচীন ইতিহাসের অনন্য সব নিদর্শন। তাদের হাতে ধ্বংস হয়ে যাওয়া এমন অমূল্য কয়েকটি নিদর্শনের কথা থাকছে আজকের লেখায়।
নিনেভাহ, ইরাক
খ্রিস্টপূর্ব ৯০০ থেকে ৬০০ সালের মধ্যে প্রাচীন পৃথিবীর একটি বিশাল অংশ ছিল অ্যাসিরীয় সাম্রাজ্যের অধীনে। গোটা মধ্যপ্রাচ্য ছিল এই সাম্রাজ্যের অন্তর্গত। আজকের ইরাকের উত্তরাংশে নির্মিত বিভিন্ন শহর বিভিন্ন সময়ে ছিল এই সাম্রাজ্যের রাজধানী। সম্রাট সেনাশেরিবের আমলে নিনেভাহ ছিল তেমনই এক রাজধানী। খ্রিস্টপূর্ব ৬১২ সালে পরিত্যক্ত হবার আগ পর্যন্ত অন্তত ৫০ বছর ধরে এটি ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শহর।

এমনই ছিল নিনেভাহ শহরের দেয়াল; Image Source: news.nationalgeographic.com

আইসিসের গুঁড়িয়ে দেবার পর; Image Source: news.nationalgeographic.com
পৃথিবীর বিভিন্ন জাদুঘরে এই শহরের ধ্বংসাবশেষের নমুনা সংরক্ষিত আছে। এটি আইসিসের দখলে আসে ২০১৪ সালে। এরপর এখানে অবস্থিত অনেক ঐতিহাসিক স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেয় তারা। শহরের প্রাচীন প্রবেশদ্বারে অবস্থিত বিশাল মূর্তি বৈদ্যুতিক ড্রিল মেশিন ও হাতুড়ি দিয়ে ভাঙার দৃশ্য দেখা যায় আইসিসের প্রকাশিত ভিডিওতে। এ বছরের জানুয়ারিতে শহরটি আবার নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে ইরাকি বাহিনী।
নিমরুদ, ইরাক
নিমরুদ ছিল অ্যাসিরীয় সাম্রাজ্যের প্রথম রাজধানী। আজ থেকে প্রায় ৩,২০০ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত এ শহরটি ছিল প্রাচুর্য্যের অনন্য নিদর্শন। ১৮৪৫ সালে এখানে খনকাজ শুরু হবার পর এখানকার অনেক পাথর নির্মিত ভাস্কর্য পাঠানো হয় সারা পৃথিবীর বিভিন্ন যাদুঘরে।

নিমরুদে আইসিসের সৃষ্ট ধবংসস্তূপ; Image Source: www.dailymail.co.uk
২০১৫ সালে ঘোষণা দিয়ে নিমরুদে ধ্বংসযজ্ঞ চালায় আইসিস। স্যাটেলাইট ছবি থেকে দেখা যায়, এই শহরে অবস্থিত মেসোপটেমিয়ান সভ্যতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা হিসেবে বিবেচিত ‘জিগুরাত’ ধ্বংস করে দেয় আইসিস।

আইসিস সেনা চালাচ্ছে নির্মম ধ্বংসযজ্ঞ; Image Source: www.dailymail.co.uk
নিমরুদ শহরের পুরোটা এখনও খননের মাধ্যমে উদ্ধার করা হয়নি। তাই আশার কথা হল, আইসিস বাহিনী এখানে বুলডোজার চালালেও মুছে ফেলতে পারেনি সব ঐতিহাসিক নিদর্শন। ২০১৬ সালে ইরাকি বাহিনী নিমরুদ পূনর্দখল করে।
দুর-শারুকিন, ইরাক
দুর-শারুকিন ছিল একটি প্রাচীন শহর যার বর্তমান নাম খোরসাবাদ। সম্রাট দ্বিতীয় সারগন এর আমলে এটি ছিল অ্যাসিরীয় সাম্রাজ্যের রাজধানী। নিমরুদের পর রাজধানী হয় দুর শারুকিন, এরপর রাজধানী হয়েছিল নিনেভাহ শহর। ৩ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে এই শহরটিতে ছিল সাতটি প্রবেশমুখ ছিল বিভিন্ন দিক থেকে। শহরটি ছিল উঁচু দেয়ালঘেরা এবং ১৫৭টি টাওয়ার ছিল এর নিরাপত্তা বিধানের জন্য।

দুর শারুকিনের একটি প্রাচীন মন্দির, এটি গুঁড়িয়ে দিয়েছে আইসিস; Image Source: btimes.com
২০১৫ সালে দুর-শারুকিনে ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করে আইসিস। বুলডোজার দিয়ে তারা গুঁড়িয়ে দেয় শহরের ঐতিহাসিক সব স্থাপনা।
হাতরা, ইরাক
রোমান ও পার্থিয়ান সাম্রাজ্যের মধ্যবর্তী একটি শহর ছিল হাতরা। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে নির্মিত এই শহরটি প্রথম স্বাধীন আরব রাজধানী ছিল বলে ধারণা করা হয়। এই শহরের স্থাপনাগুলোতে গ্রিক ও রোমান প্রভাব থাকার কারণে বোঝা যায়, এটি ছিল সিল্ক রুট ভিত্তিক বাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্র। ১৯৮৫ সালে এই শহরটিকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

শহরের দেয়াল, অক্ষত ছিল যখন; Image Source: gatesofnineveh.wordpress.com

ভাঙছে আইসিস; Image Source: gatesofnineveh.wordpress.com
২০১৪ সালে শহরটি দখল করে আইসিস। ২০১৫ এর শুরুতেই তারা ঘোষণা দেয় হাতরার ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো তারা ধ্বংস করে দেবে কেননা এগুলো অনৈসলামিক। এগুলোর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। এমন ঘোষণা দেবার পর, হাতুড়ি ও অটোমেটিক অস্ত্র দিয়ে হাতরার বিভিন্ন স্থাপনা ধ্বংস করার ভিডিও প্রকাশ করে তারা। অন্তত ১,৪০০ বছর জুড়ে বিভিন্ন ইসলামী শাসকের আমলে যে স্থাপনাগুলোর কোনো ক্ষতিসাধন হয়নি, সেগুলো এক লহমায় গুঁড়িয়ে দেয় আইসিস বাহিনী। ইউনেস্কো এবং ইসেসকো’র যুক্ত বিবৃতিতে বলা হয়, এই বর্বর কাজ দ্বারা প্রমাণিত হয় আরবের ইতিহাস ও মানুষের প্রতি আইসিস কেবল ঘৃণাই পোষণ করে।
মসুল জাদুঘর ও লাইব্রেরি, ইরাক
বাগদাদে অবস্থিত জাতীয় যাদুঘরের পর ইরাকের দ্বিতীয় বৃহত্তম যাদুঘর হল মসুল যাদুঘর। ১৯৫২ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। অ্যাসিরীয় সাম্রাজ্যের বিভিন্ন নিদর্শনের সমৃদ্ধ সংগ্রহ ছিল এই যাদুঘরের। ২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন বাহিনীর আক্রমণের পর সৃষ্ট যুদ্ধে বিপুল পরিমাণ লুটপাট হয়েছিল এটিতে।
২০১৪ সালে যাদুঘরটি দখল করে আইসিস। এর মধ্যে সংরক্ষিত মূর্তিগুলো ইসলামের বিরুদ্ধে, এমন ঘোষণা দিয়ে সেগুলো ধ্বংস করে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয় তারা।

মসুল যাদুঘরে চলছে আইসিসের ধ্বংসযজ্ঞ; Image Source: malayalamlive.co
২০১৪ সালে মসুল দখলের পর এর লাইব্রেরি ও বিশ্ববিদ্যালয় হতে শতাব্দী প্রাচীন পাণ্ডুলিপি ও হাজার হাজার বই চোরাই বাজারে বিক্রি করে দেয় আইসিস। মসুল বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিটি তারা পুড়িয়ে দেয় সে বছরেই। ২০১৫ এর ফেব্রুয়ারিতে মসুলের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিটি বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দেয় তারা। ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত এই লাইব্রেরিতে ছিল হাজারও পাণ্ডুলিপি এবং আরব বিজ্ঞানীদের ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি।

পুড়িয়ে দেয়া মসুল সেন্ট্রাল লাইব্রেরি; Image Source: thetab.com
লাইব্রেরিটি পুড়িয়ে দেবার পরদিনই তাদের প্রকাশিত একটি ভিডিওতে দেখা যায় মসুলের যাদুঘরে অবস্থিত নিদর্শনগুলোও নষ্ট করে ফেলছে আইসিস বাহিনী। ভিডিওটি প্রকাশের পর জানা যায়, কেবল দুটি বাদে যাদুঘরের ধ্বংস করা বাকি নিদর্শনগুলো ছিল রেপ্লিকা। মূল নিদর্শনগুলো ১৯৯১ এর গালফ ওয়ার ও ২০০৩ সালের মার্কিন আগ্রাসনের পর বাগদাদে স্থানান্তরিত হয়েছিল। তবে মসুল যাদুঘরের পাখাযুক্ত ষাঁড়ের মূর্তি এবং ‘গড অব রোজান’ এর মূর্তিগুলো ছিল আসল এবং সেগুলো বাদ যায়নি আইসিসের ধবংসযজ্ঞ থেকে।
উপাসনালয়
নিনেভা শহরের ধবংসাবশেষের উপর গড়ে তোলা হয়েছিল ইউনুস নবীর মসজিদ। এর আগে এখানে একটি অ্যাসিরীয় চার্চ ছিল। বিশ্বাস করা হয় এখানেই কবর দেয়া হয়েছিল হজরত ইউনুস (আ) কে। বাইবেলে তাকে সম্বোধন করা হয় জোনাহ হিসেবে। মসুলের সবচেয়ে ঐতিহাসিক মসজিদগুলোর একটি ছিল এটি। ২০১৪ সালের জুলাই মাসে আইসিস বাহিনী মসজিদটি গুঁড়িয়ে দেয়। প্রথমে এর দরজা আটকে করে সবার প্রবেশ বন্ধ করে দেয়া হয়। এরপর বিস্ফোরক দিয়ে ভেঙে ফেলা হয় গোটা মসজিদ।

ধ্বংস করে ফেলা ইউনুস নবীর মসজিদ; Image Source: ibtimes.com
জার্জিস মসজিদটিতে ছিল চতুর্দশ শতকের ঐতিহাসিক নিদর্শন। অভিযাত্রী ইবনে জুবায়ের ১২ শতকেও এর কথা উল্লেখ করেছেন তার ভ্রমণলিপিতে। ২০১৪ সালের জুলাইয়ে আইসিস ধ্বংস করে এই মসজিদটিও।
গোটা ইরাক জুড়ে আইসিস আরও গুঁড়িয়ে দেয় আল-কুব্বা হুসেইনিয়া মসজিদ, অটোমান আমলের হামু কাদো মসজিদ, জাওয়াদ হুসেইনিয়া মসজিদ, আল আরবাইন মসজিদ, খুদর মসজিদ।

আল-কুব্বা হুসেইনিয়া মসজিদ বিস্ফোরিত হচ্ছে; Image Source: huffingtonpost.com
এছাড়া ইরাকের সাদ বিন আকিল হুসেইনিয়ার সমাধি, আহমেদ আল-রিফাই’র সমাধি, মাশাদ ইয়াহিয়া আবুল কাশেমের সমাধি, ফাতিহ আল-কাইন এর সমাধি ধ্বংস করে আইসিস। ইমাম অউন আল-দ্বিন এর সমাধি যেটি মঙ্গোলীয় আক্রমণের হাত থেকে রেহাই পেয়েছিল সেটিও গুঁড়িয়ে দেয় তারা। পালমিরার কাছেই মুহাম্মদ বিন আলি এবং নিজার আবু বাহাইদ্দিনের সমাধি ধ্বংস করে তারা।
এছাড়াও ইহুদি ধর্মমতের নবী সেথ এর সমাধি ও চারটি ধর্মে বর্ণিত নবী দানিয়েল এর সমাধিও ধ্বংস করে আইসিস। চতুর্থ শতকে অ্যাসিরীয় সম্রাট সেনাশেরিব নির্মিত মার বেনহাম আশ্রমের অবস্থিত সেইন্ট বেনহামের সমাধিস্থলটিও গুঁড়িয়ে দেয় তারা। এসব মসজিদ থেকে যাবতীয় সৌন্দর্য বর্ধনকারী নকশা, এমনকি কুরানের আয়াত লেখা ফলকও ইসলাম-বিরোধী আখ্যা দিয়ে আইসিস।

আহমেদ আল-রিফাই এর সমাধি গুঁড়িয়ে দেয়া হচ্ছে বুলডোজার দিয়ে; Image Source: huffingtonpost.com
ইরাকের সর্বপ্রাচীন আশ্রম ‘দেইর মার এলিয়া’, দশ শতকে নির্মিত সেইন্ট মার্কোরকাস চার্চ, সা’আকাদিমা চার্চ, ভার্জিন মেরি চার্চ, সপ্তম শতকে নির্মিত গ্রিন চার্চ, সিরিয়ার আর্মেনিয়ান জেনোসাইড মেমোরিয়াল চার্চ ধ্বংস করে আইসিস বাহিনী।
দুরা-ইউরোপোস, সিরিয়া
ইউফ্রেটিস নদীর তীরে প্রায় ৩০০ ফুট উঁচু পাহাড়ের উপর গড়ে ওঠা এক শহর ছিল দুরা-ইউরোপোস। ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে হেলেনীয়, পার্থীয় এবং রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল এই শহরটি। সাসানীয়দের দখলের পর খ্রিস্টিয় ২৫৬ সালের দিকে এই শহরটি পরিত্যক্ত হয়ে যায়। বালি ও কাদায় ঢাকা পড়ে যায় দুরা-ইউরোপোস।

দুরা ইউরোপস শহরের প্রবেশদ্বার, ২০১০; Image Source: npr.org
এই শহরটির ঐতিহাসিক গুরত্ব ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যময়। কারণ পরিত্যক্ত হবার পর এখানে আর কোনো রকম স্থাপনা গড়ে উঠেনি। তাই এখানকার সুপ্রাচীন আমলের স্থাপনাগুলোর কোনো পরিবর্তনও ঘটেনি। দুই রাজ্যের সীমান্তবর্তী শহর হবার কারণে এখানে তৈরি হয়েছিল সাংস্কৃতিক মিথস্ক্রিয়া যার প্রকাশ ঘটেছিল শহরের স্থাপনাগুলোর মধ্যে। পৃথিবীর সর্বপ্রাচীন খ্রিস্টিয় চার্চটি অবস্থিত ছিল এই শহরে।

বামের ছবিটি ২০১১ সালের, ডানেরটি ২০১৪ সালের, গোটা শহর খনন করে প্রাচীন নিদর্শন উঠিয়ে নিয়েছে আইসিস; Image Source: npr.org
এই শহরের অমূল্য সম্পদগুলোর কারণে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ চলাকালীন লুটতরাজ হয়েছে প্রচুর পরিমাণে। আইসিস বাহিনী এখানকার প্রাচীন নিদর্শনগুলো লুট করে বিক্রি করে দেয় তাদের যুদ্ধের ফান্ডের অর্থের জন্য। স্যাটেলাইটের ধারণকৃত ছবি থেকে দেখা যায়, আইসিসের করা খনকাজের পর শুধু গর্তে ভরা বিস্তীর্ণ জায়গা পড়ে রয়েছে এখন সেখানে।
মার এলিয়ান আশ্রম, সিরিয়া
সিরিয়ার আল-কারইয়াতাইন শহরে পালমিরা ও দামাস্কাসের একটি বাণিজ্যপথের পাশেই ছিল মারএলিয়ান আশ্রম। সিরিয়ার ক্যাথোলিক খ্রিস্টানদের একটি আশ্রম ছিল এটি। ক্যাথোলিকদের অন্যতম তীর্থস্থান ছিল এই আশ্রমটি। এর ভিত্তি নির্মিত হয়েছিল আজ থেকে অন্তত দেড় হাজার বছর আগে। এই আশ্রমের কিছু কিছু অংশও সে সময়েই তৈরি হয়েছিল। এর মধ্যে ছিল খ্রিস্টিয় পঞ্চম শতকের একটি সমাধি।

নিচে, বামে সেইন্ট এলিয়ানের সমাধি, ডানে আশ্রমের ছবি। উপরে, বামে সমাধিস্থলের ধবংসস্তুপের মাঝে আইসিস সেনা, ডানে বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়া হচ্ছে আশ্রম; Image Source: express.co.uk
২০১৫ সালের আগস্টে এই আশ্রমটি ধ্বংস করে দিয়ে টুইটারে ছবি প্রকাশ করে আইসিস। বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছিল এটি। ২০১৬ তে সিরীয় বাহিনী এলাকাটির নিয়ন্ত্রণ নেবার পর উদ্ধার করা হয় আশ্রমের মধ্যকার সমাধিস্থলের ধ্বংসাবশেষ এবং মাথার খুলি ও হাড়। ধারণা করা হয়, ২৮৪ সালে ধর্মত্যাগ করতে রাজি না হওয়ায় নির্মম হত্যার শিকার সেইন্ট জুলিয়ানের দেহাবশেষ এগুলো।
মারি, সিরিয়া
খ্রিস্টপূর্ব ২৯০০ সালে নির্মিত হয়েছিল সিরিয়ার শহর মারি। এরপর প্রায় ১,২০০ বছর ধরে চলেছিল এই শহরের কার্যক্রম। ব্রোঞ্জ যুগের শহর মারিতে প্রত্নতাত্ত্বিকেরা আবিস্কার করেন প্রাসাদ, মন্দির এবং মাটির ফলকে লেখা সে আমলের ইতিহাস। মেসোপটেমীয় আমলের অনেক তথ্য জানা যায় এখানে আবিস্কৃত প্রায় ২৫,০০০ ফলক থেকে।

স্যাটেলাইট ছবি, ২০১১ সালে মারি শহর; Image Source: aaas.org

২০১৪ সালের ছবি, আইসিস লুটপাট করে গর্ত করে ফেলেছে গোটা শহর; Image Source: aaas.org
ইতিহাসের এই গুরুত্বপূর্ণ শহরটিতেও লুটতরাজ চালায় আইসিস বাহিনী। বিশেষত এখানকার প্রাসাদগুলো থেকে মূল্যবান সামগ্রী নিয়ে বিক্রি করে দেয় তারা। স্থানীয় রিপোর্ট ও স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া ছবি থেকে জানা যায় আইসিসের এই ভয়াবহ লুটপাটের কথা।
পালমিরা, সিরিয়া
আইসিসের হাতে যে নিদর্শনটি বিধ্বস্ত হওয়ায় মানব সভ্যতার ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ ক্ষতি হয়ে গেছে, সেটি হল সিরিয়ার পালমিরা।
পালমিরা ছিল সিরিয়ায় অবস্থিত একটি প্রাচীন শহর। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে এই শহরটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ব্রোঞ্জ যুগে নির্মিত হওয়া শহরটি সচল ছিল মানব সভ্যতার আধুনিক যুগের আগমনের পরেও।

বালশামিন মন্দির, পালমিরা, ২০০৭; Image Source: cnn.com

বালশামিন মন্দির গুঁড়িয়ে দেয়ার পর, হেঁটে যাচ্ছে এক সিরীয় সেনা; Image Source: cnn.com
পালমিরা বিভিন্ন সময়ে ছিল বিভিন্ন সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। খ্রিস্টিয় প্রথম শতকে এটি রোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। রোমান আমলে পালমিরা বিখ্যাত হয়ে উঠে এর বাণিজ্যের জন্য। চীনের পূর্ব-পশ্চিম হতে ভারতবর্ষ ও আরব অঞ্চল হয়ে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত স্থাপিত বিখ্যাত সিল্ক রুটের সুবিধা নিয়েই এখানকার বণিকেরা ব্যবসা পরিচালনা করত। সিল্ক রুটের আশপাশে তারা গড়ে তুলেছিল কলোনি।
পালমিরা শহরটি সম্পদশালী হয়ে উঠবার কারণে তাদের স্থাপত্যশৈলীরও দারুণ উন্নতি হয়েছিল। গ্রেট কলোনেড কিংবা বেল এর মন্দিরের মত দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য নির্মিত হয়েছিল এখানে। এবং যুগের পর যুগ ধরে সারিবদ্ধ খিলান নির্মিত স্থাপনা কিংবা মন্দিরগুলো টিকে ছিল মরুভূমির জলবায়ুর কারণেই। ইমোরিয়, অরামীয় এবং আরবীয় জাতিগুলোর সংমিশ্রণ ছিল পালমিরার অধিবাসীদের মধ্যে। গ্রিক ও রোমান সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত ছিল এ শহরের সংস্কৃতি।

আর্চ অব ট্রায়াম্ফ, ২০০৬; Image Source: cnn.com

আইসিসের ধ্বংসযজ্ঞের পর; Image Source: cnn.com
রোমের বিরুদ্ধে পালমিরার বিদ্রোহের পর ২৭৩ সালে রোমান সম্রাট অরেলিয়ান এই শহর ধ্বংস করে ফেলেছিল। পরবর্তীতে সম্রাট ডায়োক্লেটিয়ান এটি আবার নির্মাণ করেন, তবে একটু ছোট আকারে। খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকে পালমিরার অধিবাসীরা খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হয়। এরপর পঞ্চম শতাব্দী থেকে প্রথম সহস্রাব্দের মধ্যে তারা ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়। সে সময় শহরে প্রচলিত পালমিরিয়ান ও গ্রিক ভাষার বদলে শুরু হয় আরবী ভাষার প্রচলন।
১৪০০ সালে এসে আবার ধ্বংসের শিকার হয় পালমিরা, এবারে তৈমুর লং এর বাহিনীর হাতে। সেই ধবংসযজ্ঞের পর এটি পরিণত হয় একটি ছোট গ্রামে। অবশেষে ১৯৩২ সালে শহরটি পরিত্যক্ত হয়ে যায়, এর অধিবাসীরা সরে যায় অন্যত্র।
দীর্ঘ আট দশক পর আধুনিক যুগের আরেক বর্বর বাহিনীর হাতে পড়ল পালমিরা। ইউনেস্কো ঘোষিত এই ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটটি ২০১৫ সালে দখলে নেয় আইসিস। ২০১৬ সালে সিরিয়ার আর্মি একবার আইসিসের নিয়ন্ত্রণ থেকে উদ্ধার করে পালমিরাকে। কিন্তু চলতি বছরেই আবার এটি দখল করে আইসিস।

বেল মন্দির, ২০০৮; Image Source: cnn.com

আইসিসের ধ্বংসযজ্ঞের পর; Image Source: cnn.com
পালমিরা দখলের পর আইসিস বাহিনী ঘোষণা করেছিল, তারা এই ঐতিহাসিক স্থানের কোনো ক্ষতিসাধন করবে না। দখলের তিন মাস পর তাদের ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হয় সিরীয় প্রত্নতাত্ত্বিক খালেদ আল আসাদকে হত্যার মধ্য দিয়ে। পালমিরার দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা খালেদের মস্তকবিহীন শরীরটি আইসিস ঝুলিয়ে রেখেছিল শহরের স্থাপনাগুলোর মধ্যে একটি খিলানের গায়ে।

পালমিরার যাদুঘরে সংরক্ষিত নিদর্শন ভেঙে ফেলার পর, হাতে ধরে রাখা পুরনো ছবি; Image Source: জোসেফ ইড/ independent.co.uk
২০১৫ সালের আগস্টে পালমিরার বালশামিন মন্দির বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দেয়ার ছবি প্রকাশ করে আইসিস। এরপর তারা ধ্বংস করে দেয় বেল মন্দির। তারপর এলাহবেল টাওয়ার সহ তিনটি টাওয়ার গুঁড়িয়ে দেয় আইসিস। ধর্মীয় কারণে এই ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে ঘোষণা দিলেও, এরপর তারা ধ্বংস করতে থাকে ধর্মীয় সম্পৃক্ততাবিহীন স্থাপনাগুলোও, যার মধ্যে ছিল পালমিরার সবচেয়ে বিখ্যাত আর্চ অব ট্রায়াম্ফ। এ বছরেই স্যাটেলাইট ছবি থেকে দেখা গেছে আইসিস বাহিনী সর্বশেষ ধ্বংস করেছে দ্বিতীয় শতকে নির্মিত ও ইউনেস্কো কর্তৃক ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে স্বীকৃত রোমান থিয়েটার। একই সাথে গুঁড়িয়ে দিয়েছে পালমিরার দৃষ্টিনন্দন ঐতিহাসিক স্থাপত্য টেট্রাপাইলন। পালমিরা যাদুঘরে অবস্থিত যাবতীয় নিদর্শনও শিকার হয় এই বর্বর বাহিনীর ধবংসযজ্ঞের।