আজ থেকে হাজার হাজার বছর আগে মানুষ নিরেট পাথর কেটে এমন সব স্থাপনা তৈরি করেছিল, যেগুলো আজকের যুগে দেখলে বিশ্বাসই হতে চায় না যে, এগুলো সত্যিই বের করা হয়েছে কঠিন পাথরের বুক থেকে। স্থাপত্যকলার অনন্য নিদর্শন এই স্থাপনাগুলো মানুষের সমৃদ্ধ সৃষ্টিশীলতা ও দক্ষতার ইতিহাসের সাক্ষী। আজকের লেখায় তুলে ধরা হলো পৃথিবীর এমন চারটি স্থাপনার কথা যেগুলোর প্রতিটি তৈরি করা হয়েছে পাথর কেটে কেটেই, ইতিহাসের অমূল্য নিদর্শন হিসেবে যেগুলো আছে ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের তালিকায়।
আবু সিম্বেল
মিশরের দক্ষিণে নুবিয়ার আবু সিম্বেল গ্রামে রয়েছে দুটি বিশাল মন্দির যেগুলো পাথর কেটে তৈরি করা হয়েছিল আজ থেকে প্রায় তিন হাজার তিনশ বছর আগে। ‘নুবিয়ান মনুমেন্টস’ নামেও পরিচিত এ মন্দির দুটো। মিশরীয় সাম্রাজ্যের সবচেয়ে বিখ্যাত ও শক্তিশালী সম্রাট হিসেবে পরিচিত ফারাও দ্বিতীয় রামেসিসের আমলে তৈরি করা হয় এগুলো। কাদেশ এর যুদ্ধ জয়ের স্মৃতি হিসেবে এই মন্দিরগুলো নির্মিত হয়েছিল দ্বিতীয় রামেসিস ও তার রাণী নেফারতারির সম্মানে।
নীলনদের উপরে আসওয়ান বাঁধ তৈরির কারণে লেক নাসের নামের যে বিশাল জলাধারটি তৈরি হয়েছে, তার মধ্যে তলিয়ে যাবার আশঙ্কা ছিল এই প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানটির। সে কারণে গোটা মন্দির কমপ্লেক্সটিই ১৯৬৮ সালে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে কাছেই আরেকটি কৃত্রিম পাহাড়ের চূড়ায়।
পাথর কেটে মন্দির দুটোর নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১২৬৪ সালে এবং নির্মিত হতে সময় লেগেছিল অন্তত ২০ বছর। ‘দেবতা আমুনের প্রিয় রামেসিসের মন্দির’ নামে পরিচিত এই মন্দিরটি দ্বিতীয় রামেসিসের দীর্ঘ শাসনামলে নুবিয়া অঞ্চলের ছয়টি প্রস্তরনির্মিত মন্দিরের একটি। মিশরের দক্ষিণের প্রতিবেশী রাজ্যগুলোকে তাক লাগিয়ে দেয়া এবং সে অঞ্চলে মিশরীয় ধর্মকে শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যেই নির্মিত হয়েছিল এগুলো।
সময়ের সাথে সাথে এই মন্দিরটির ব্যবহার কমে যেতে শুরু করে। এক সময় এটি ঢাকা পড়ে যায় বালির মধ্যে। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকেই মন্দিরের মুর্তিগুলোর অনেকটুকু বালির নিচে চলে যায়। অনেক অনেক দিন পর, ১৮১৩ সালে এসে, সুইস পর্যটক ও প্রাচ্যবিদ জন লুডভিগ বুরখার্ট, যিনি প্রথম ইউরোপিয়ান হিসেবে আরেক বিখ্যাত পাথরের শহর পেত্রায় গিয়েছিলেন, তিনিই আবু সিম্বেলের এই মন্দিরের একটি অংশ দেখতে পান। তিনি তার বন্ধু ইতালীয় পর্যটক জিওভান্নি বেলজোনিকে জানান এই আবিস্কারের কথা। ১৮১৭ সালে বেলজোনি মন্দির কমপ্লেক্সে প্রবেশ করতে সমর্থ হন।
জানা যায়, এই মন্দিরটি আবিষ্কারে পর্যটকদের সহায়তা করেছিল স্থানীয় আবু সিম্বেল নামক এক কিশোর। সে-ই বালির মধ্যে ডুবে যাওয়া এই মন্দিরের অংশবিশেষ প্রথমবার দেখতে পেয়েছিল। এরপর তার নামেই এই প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানের নামকরণ করা হয়।
দুটি মন্দিরের মধ্যে বড়টি নির্মিত হয়েছে মিশরের সে সময়ের তিন দেবতা আমুন, রা-হারাখতি ও পেতাহ’র উদ্দেশ্যে। এতে রয়েছে দ্বিতীয় রামেসিসের চারটি বিশালাকার মুর্তি। ছোট মন্দিরটি নির্মিত হয়েছে দেবী হাথোরের উদ্দেশ্যে। রাণী নেফারতারির সম্মানে নির্মিত এই মন্দিরটি ছিল মিশরের ইতিহাসে নেফারতিতির পর দ্বিতীয়বারের মতো একজন রাণীর সম্মানে নির্মিত মন্দির।
১৯৬৪ সালে ইউনেস্কোর উদ্যোগে প্রত্নতাত্ত্বিক, প্রকৌশলী এবং দক্ষ কর্মীদের একটি দল আবু সিম্বেলের গোটা কমপ্লেক্স একটু দূরে সরিয়ে নেয়ার কাজ শুরু করে। ৪ বছরে গোটা কমপ্লেক্সকে বিশাল বিশাল ব্লকে কাটা হয়। প্রতিটি ব্লকের ওজন ছিল গড়ে ২০ টন করে। নদী থেকে ২০০ মিটার দূরে এবং ৬৫ মিটার উঁচুতে কৃত্রিম পাহাড়ের উপর ব্লকের গায়ে ব্লক বসিয়ে পুরো স্থাপনাটি অবিকল আগের মতো করে বসিয়ে দেয়ার কাজটি ছিল প্রত্নতাত্ত্বিক প্রকৌশলের ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন কাজগুলোর একটি। আজকের হিসেবে প্রায় সাড়ে আটাশ কোটি মার্কিন ডলার খরচ হয়েছিল এই স্থানান্তরের কাজে।
এখন আবু সিম্বেলের পাশের শহর আসওয়ান থেকে প্রতি দিন দু’বার করে গাড়ি ছাড়ে এর উদ্দেশ্যে, শত শত পর্যটককে নিয়ে যায় মানুষের হাতে গড়া এই বিশাল কীর্তি উপভোগ করতে।
লালিবেলা
ইথিওপিয়ার উত্তরে আমহারা প্রদেশের একটি শহর হলো লালিবেলা। ইতিহাসে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণকারী প্রথম জাতিগুলোর একটি ছিল ইথিওপিয়ানরা। খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকের প্রথম ভাগে তারা খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে। ইতিহাসে খ্রিস্টধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করার ক্ষেত্রে কারও মতে আর্মেনিয়ার পরেই ছিল ইথিওপিয়া। কোনো কোনো ইতিহাসবিদের মতে ইথিওপিয়াই প্রথম। এই শহরের প্রতিটি চার্চ নির্মাণ করা হয়েছে একটি করে বিশাল পাথরখণ্ড কেটে কেটে।
লালিবেলা শহরটি ইথিওপিয়ার খ্রিস্টানদের একটি তীর্থস্থান। এর নকশা এবং প্রধান স্থাপনার নামগুলো জেরুজালেমের প্রতীকি নিদর্শনরূপে দেয়া হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। অনেক বিশেষজ্ঞদের মতে, ১১৮৭ সালে সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর জেরুজালেম বিজয়ের পরেই এই স্থাপনাগুলো নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়।
১২ শতকের শেষে এবং ১৩ শতকের শুরুতে ইথিওপিয়ার শাসক ছিলেন সেইন্ট গ্যাব্রি মেসকেল লালিবেলা। এই শহরটি তখন রোহা নামে পরিচিত ছিল। লালিবেলা তার যৌবন কাটিয়েছিলেন জেরুজালেম ও পবিত্র স্থানে, জর্ডান নদী ও ভূমধ্যসাগরের মাঝখানে যেখানে ফিলিস্তিন, ইসরাইল এবং জর্ডান, লেবানন ও সিরিয়ার কিছু অংশ রয়েছে সেই মুসলমান, খ্রিস্টান ও ইহুদিদের নিকট পবিত্র ভূমি হিসেবে বিবেচিত স্থানেই। অনেকের মতে, তার সে সময়ের অভিজ্ঞতারই প্রতিফলন ঘটেছে এই শহরের বিভিন্ন স্থান এবং পাথর কেটে তৈরি করা চার্চগুলোর নাম ও নকশায়। লালিবেলা শহরের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীটিও পরিচিত জর্ডান নদী হিসেবে।
মুসলমানদের জেরুজালেম বিজয়ের পর তার নিজের রাজধানী হিসেবে ‘নতুন জেরুজালেম’ তৈরির চিন্তা করেন লালিবেলা। সে চিন্তা থেকেই শহরের অনেকগুলো স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
অবশ্য চার্চগুলোর নির্মাণকাল নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। কারও মতে, বারো ও তেরো শতকে লালিবেলার আমলেই এর অধিকাংশ নির্মাণ করা হয়েছে। ডেভিড বাক্সটনের মতে পাথর কেটে নির্মাণ যেহেতু সময়সাপেক্ষ ব্যাপার, এগুলোর নির্মাণকাল ছিল তাই বারো থেকে শুরু হয়ে চৌদ্দ শতক পর্যন্ত। ডেভিড ফিলিপসনের মতে, এর মধ্যে কয়েকটি চার্চের নির্মাণকাল শুরু হয়েছিল অন্তত ৫০০ বছর আগেই। গেটাচিও ম্যাকনেন এর মতে, অন্তত একটি চার্চ নির্মিত হয়েছে লালিবেলার মৃত্যুর পর তার স্ত্রী মাসকাল কিবরার উদ্যোগে।
ভূমি থেকে উঠে আসা প্রস্তরখণ্ড কেটে তৈরি করা এই চার্চগুলোর জন্যই সারা পৃথিবীতে বিখ্যাত লালিবেলা শহর। ইউনেস্কোর তালিকা অনুসারে এখানে চার্চের সংখ্যা ১১। নিরেট পাথর কেটে বিরাট স্থাপনা নির্মাণের অমন নিখুঁত স্থাপত্যশৈলী পর্যটকদের বিস্মিত করবেই।
অজন্তা
ভারতের অজন্তা অবস্থিত মহারাষ্ট্রের আওরঙ্গবাদ জেলায়। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকে খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকের মধ্যে তৈরি হয়েছে অজন্তার গুহাগুলো। এগুলোতে পাথর কেটে তৈরি করা হয়েছে বৌদ্ধ ধর্মের মূর্তি ও অন্যান্য শিল্পকর্ম।
এখানে আঁকা ছবিগুলো এখনও পর্যন্ত টিকে থাকা প্রাচীন ভারতীয় শিল্পকলার সবচেয়ে শৈল্পিক নমুনা হিসেবে বিবেচিত হয়। বৌদ্ধ ধর্মকেন্দ্রিক এই ছবিগুলো পরবর্তীতে ভারতীয় চিত্রকলাকে অনুপ্রাণিত করেছে বলে ধারণা করেন ইউনেস্কোর গবেষকরা। ১৮১৯ সালে ব্রিটিশ আর্মির মাদ্রাজ রেজিমেন্টের এক অফিসার শিকারে বের হয়ে এই গুহাগুলো আবিস্কার করেন।
বৌদ্ধ ধর্মের আশ্রম ও উপাসনালয় নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে অজন্তার ৩০টি গুহা, এর মধ্যে একটির কাজ শেষ করা হয় নি। সাতবাহন, মৌর্য এবং ভক্তক সাম্রাজ্যের আমলে তৈরি করা হয়েছে গুহাগুলো। এদের মধ্যে পাঁচটি হল চৈত্যগৃহ এবং বাকিগুলো ব্যবহৃত হত বৌদ্ধ বিহার হিসেবে। গৌতম বুদ্ধের জীবন ও নবজন্ম নিয়ে আঁকা চিত্রকলা রয়েছে গুহার ভেতরে।
বর্ষাকালে অজন্তার শান্ত সবুজ নির্জন পরিবেশে আশ্রয় নিতেন বৌদ্ধ ভিক্ষুরা। এখানে তারা আলোচনা করতেন ধর্মীয় বিষয়ে, গুহার পরিবেশ তাদের সহায়তা করতে নিবিড় চিন্তায়। স্রোতধারা বয়ে যাবার চিহ্ন থেকে বোঝা যায়, পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝর্ণার সাথে সংযুক্ত ছিল প্রতিটি গুহা। আওরঙ্গবাদ শহর থেকে ১০৪ কিমি দূরে এবং মুম্বাই থেকে ৩৫০ কিমি পূর্ব-উত্তর পূর্বে অবস্থিত পাথর কেটে তৈরি করা অনন্য অজন্তা।
ইলোরা
ভারতের মহারাষ্ট্রে অবস্থিত ইলোরাকে বলা যায় মানুষের শৈল্পিক সৃষ্টির এক অসাধারণ উদাহরণ। পাথর কেটে তৈরি করা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় স্থাপনাগুলোর একটি এটি। খ্রিস্টীয় ৬০০ থেকে ১০০০ সালের মধ্যে তৈরি করা হয়েছিল এখানকার অপরূপ সুন্দর গুহাগুলো।
ইলোরাতেই রয়েছে কৈলাসনাথ মন্দির, যেটিকে বলা হয়, পৃথিবীতে একটিমাত্র বিরাট পাথর কেটে তৈরি করা স্থাপনাগুলোর মধ্যে বৃহত্তম।
ইলোরাতে রয়েছে প্রায় ১০০টি গুহা। চরনন্দ্রী পাহাড় কেটে তৈরি করা হয়েছিল এই গুহাগুলো। এদের মধ্যে ৩৪টি গুহা সবচেয়ে বিখ্যাত এদের মধ্যে অবস্থিত স্থাপনার জন্য। বৌদ্ধ, হিন্দু ও জৈন ধর্মের মন্দির পাশাপাশি রয়েছে এই গুহাগুলোর ভেতরে।
১ থেকে ১২ নম্বর বৌদ্ধ ধর্মের, ১৩ থেকে ২৯ নম্বর হিন্দু ধর্মের এবং ৩০ থেকে ৩৪ নম্বর হলো জৈন ধর্মের গুহা। প্রতিটি গুহায় রয়েছে সংশ্লিষ্ট ধর্মের মন্দির ও দেবমূর্তি। হিন্দু রাজাদের শাসনামলেই তৈরি হয়েছিল সবগুলো গুহা। ভক্তক, ত্রৈকুটক, কালাচুরি, চালুক্য, রাষ্ট্রকূট ও যাদব সাম্রাজ্যের অধীনে তৈরি হয়েছিল এগুলো।
ভারতে এককালে যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিরাজ করত তারই প্রমাণ মেলে পাশাপাশি তিন ধর্মের উপাসনালয় নির্মাণ থেকে। গুহাগুলো ছিল ভিক্ষু এবং ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের আশ্রম। থাকা-খাওয়ার যাবতীয় ব্যবস্থাই ছিল এখানে। মন্দিরগুলো ব্যবহৃত হতো উপাসনালয় হিসেবে। তীর্থযাত্রীদের বিশ্রামস্থল হিসেবেও ব্যবহৃত হতো গুহাগুলো।
প্রাচীন এলাপুরা শব্দ থেকে এসেছে ইলোরা নামটি। অজন্তা থেকে ১০০ কিমি দূরেই এই অনন্য সৌন্দর্যময় প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানটির অবস্থান। এর কাছেই রয়েছে আরেক বিখ্যাত স্থান অজন্তা। বর্ষাকালের প্রচণ্ড বৃষ্টিতে যখন পাহাড়ের ঝর্ণাগুলোতে প্রচণ্ড বেগে স্রোতধারা নামে আর প্রকৃতি ভরে উঠে সবুজে, তখন ইলোরা হয়ে উঠে অপরূপ স্বর্গীয় সৌন্দর্যময়। এই সময়টাতেই পর্যটকদের ভীড় সবচেয়ে বেশি হয় এখানে।