পাহাড়ের নান্দনিকতা এবং সবুজে ঘেরা বৃক্ষরাজির সৃষ্টিশীলতা প্রকৃতির এক অপরূপ নন্দনকানন যেন ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত রাজ্য মেঘালয়। পাহাড়, জঙ্গল, ঝর্ণা আর চারদিকে সবুজে ঘেরা আকর্ষণীয় এই শৈল শহরকে ভালবেসে ফেলেছিল ব্রিটিশরা। তাই তারা মেঘালয়কে অভিহিত করেছিল ‘স্কটল্যান্ড অফ ইস্ট’ নামে। এখানকার প্রকৃতিতে আকাশ আর মেঘের সাথে প্রতিনিয়ত চলে মান-অভিমানের পালা। সেই মান-অভিমানের খেলা কখনো বয়ে চলে শান্ত রিনিঝিনি নুপূরের মতো, আবার কখনো তীব্র অভিমানের আবেগে ঝরে পড়ে বৃষ্টি ধারা। আকাশ ও মেঘের এই ভালবাসায় প্রকৃতি মেতে ওঠে আপন সৃজনে। সে চারদিকে মেতে উঠে সবুজের খেলায়। বৃষ্টির জলধারা ও পাহাড়ী পথ বেয়ে নিচে নেমে আসা ঝর্ণার কলতানে প্রকৃতি প্রেমে মাতাল হয়ে ওঠে।
মাওলিনং ভারতের মেঘালয় রাজ্যে অবস্থিত প্রকৃতি ও মানুষের অপূর্ব মেলবন্ধনে তৈরি হওয়া সাজানো গোছানো এক পরিচ্ছন্ন গ্রাম। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে এক প্রবল খরস্রোতা পাহাড়ি নদী, থাইলাং। এই নদীর ওপরে তৈরি হয়েছে প্রকৃতি ও মানুষের যৌথ প্রয়াসের নিদর্শন এক বিস্ময়কর সেতু, যাকে অনেকে বলে থাকেন ‘জীবন্ত গাছের শিকড়ের সেতু’। মেঘালয়ে জীবন্ত শিকড়ের সেতু আরও রয়েছে। কোনোটি দুই ধাপের, কোথাওবা পাশাপাশি দুটি সেতু, আবার কোথাও শিকড়ের সিঁড়িও রয়েছে।
কীভাবে তৈরি হলো এই শিকড়ের সেতু? কার মস্তিষ্ক থেকে উদ্ভুত এমন অদ্ভুত সেতুর ভাবনা? প্রকৃতিই বা কীভাবে সাহায্য করলো মানুষের এই বিস্ময়কর সৃষ্টিতে? আজ সেই গল্পই শোনানো হবে আপনাদের।
জীবন্ত শিকড়ের সেতু নির্মাণের কারণ
বঙ্গোপসাগর থেকে ভেসে আসা উত্তরের হাওয়া এই পাহাড়ী উপত্যকায় বাধা পেয়ে জলীয় বাষ্পের আকার ধারণ করে। সেই জলীয় বাষ্পের নিয়মিত খেলা চলে সারা মেঘালয় জুড়ে। আর তা বৃষ্টি রূপে কখনো মাঝারি বা কখনো তীব্র হয়ে ঝরে পড়ে রাজ্যের চারপাশে।
বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ব্রিজ বা সেতুর গল্প বলতে গেলে চোখের সামনেই ভেসে উঠে ইট, কাঠ, ইস্পাত আর কংক্রিটের তৈরি কোনো অসাধারণ কাঠামো এবং সেসব শৈল্পিক স্থাপনার নান্দনিকতায় মুগ্ধ হয় সারা বিশ্বের মানুষ। সেসব সেতুর পিছনে মানুষের জ্ঞান, বুদ্ধিমত্তা, চিন্তা-চেতনা এবং দক্ষতাই দৃশ্যমান হয় বেশি। সেসব স্থাপনায় প্রকৃতির ভূমিকা থাকে না বললেই চলে। কিন্তু ব্যতিক্রম মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে অবস্থিত এই জীবন্ত শিকড়ের সেতু।
উত্তরপূর্ব ভারতের মেঘালয় প্রদেশের ‘চেরাপুঞ্জি’তে বসবাস করে খাসিয়া ও জৈন্তা নামক নৃ-জাতি গোষ্ঠী। শত শত বছর ধরে এ স্থানে তারা বসবাস করে আসছে। পাহাড়ই তাদের আবাসভূমি। এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে যেতে তাদের অতিক্রম করতে হয় ছোট ছোট জলধারা। এসব জলধারা থেকে সৃষ্টি হয় ছোট ছোট অনেক নদী। এসব জলধারা ও নদী পারাপারের জন্য এই জাতিগোষ্ঠী নিজেদের প্রয়োজনেই আবিষ্কার করে নেয় এমন একটি গাছের, যার শিকড় তাদেরকে একটি সেতু তৈরিতে সাহায্য করবে। কয়েকশ বছর আগে থেকে এই পাহাড়ী জনগোষ্ঠী জীবন্ত এসব গাছের শিকড় দিয়ে সেতু নির্মাণ করে আসছে।
ভাবতে অবাকই লাগে, এই পাহাড়ী জাতি-গোষ্ঠী কীভাবে শত শত বছর আগে এই গাছের সাহায্যে সেতু তৈরির কথা চিন্তা করেছিল। তবে এ কথা সত্য যে, প্রকৃতিই মানুষের বড় শিক্ষক। কোনো পাঠ্যবই তাকে এই শিক্ষার যোগান দিতে পারে না।
সেতু তৈরির ইতিহাস
মেঘালয়ের খাসিয়া আর জৈন্তা নৃগোষ্ঠীর জনগণই এ জীবন্ত শিকড়ের সেতু নির্মাণে পারদর্শীতা দেখিয়েছেন। তবে এর ইতিহাস সর্ম্পকে কিছুই জানে না এখানকার মানুষ। কখন থেকে তৈরি হলো এই সেতু, সে সম্পর্কে খুব একটা পরিস্কার ধারণা নেই স্থানীয় লোকদের। তবে এক তথ্য হতে জানা যায় যে, ১৮৪৪ সালে এশিয়া সোসাইটি অফ বেঙ্গল নামের এক জার্নালে ব্রিটিশ লেফট্যানেন্ট এইচ ইউল প্রথম এই সেতুর কথা উল্লেখ করেন।
কী কারণে তৈরি হলো এই সেতু?
বিশেষজ্ঞদের মতে, মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জি খুবই বৃষ্টিপ্রবণ এলাকা। বছরের অধিকাংশ সময়েই জায়গাটিতে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। বিরূপ আবহাওয়ার কারণে কোনো স্থায়ী সেতু তৈরি করা বেশ দুরূহ। কাঠের সেতু হলে তা অল্প দিনেই নষ্ট হয়ে যেতো কিংবা কংক্রিট বা ইস্পাতের ব্যবহার এই বৃষ্টিস্নাত জায়গায় করা অনেক ব্যয়সাপেক্ষ। তাই সরকারী কোনো উদ্যোগই ছিল না এলাকটিতে কোনো স্থায়ী সেতু তৈরীর ব্যাপারে। স্থানীয়দের দেয়া তথ্য মতে, সারা মেঘালয় জুড়ে এ ধরনের জীবন্ত শিকড়ের সেতু অনেক রয়েছে।
এর মধ্যে একটি সেতু কিন্তু অন্য সেতুগুলোর থেকে বেশ ভিন্ন। মনে করা হয় এ ধরনের সেতু বিশ্বে একটিই আছে। এই সেতুর রয়েছে দুটো স্তর। একই গাছের শেকড় থেকে একটি সেতুর ওপর দিয়ে নির্মিত হয়েছে অন্যটি। দুটি সেতুর মিলনস্থল একস্থানে হওয়ার কারণে একে দ্বিতল সেতু বা ডাবল ডেকার ব্রিজও বলা হয়ে থাকে। স্থানীয়রা এ সেতুকে চেনে ‘উমসিয়াং ডাবল-ডেকার রুট ব্রিজ’ নামে। যোগাযোগ ব্যবস্থার এক প্রাচীন আবিষ্কার এই জীবন্ত সেতু প্রাচীন যুগের মানুষদের অসাধারণ ইঞ্জিনিয়ারিং দক্ষতা এবং তাদের জ্ঞানের পরিধির ব্যাপকতা সম্পর্কে আমাদের সম্যক ধারণা দেয়।
কে এই সেতু তৈরির কারিগর?
কোনো শিক্ষিত প্রকৌশলী এই সেতুর নকশা করেননি, ব্যবহৃত হয়নি কোনো কারিগরী বিদ্যা ও আধুনিক প্রযুক্তিগত যন্ত্রপাতি, নেয়া হয়নি আধুনিক বিজ্ঞানের কোনোরকম কলা-কৌশল সাহায্য। প্রকৃতির সৃষ্টিশীলতা বাধা পায় সেরকম কোনো উপাদানও ব্যবহৃত হয়নি এই সেতুতে। মূলত প্রকৃতি এই সেতুর কারিগর। শতাব্দীর পর শতাব্দী জুড়ে প্রকৃতির নিবিড় ভালবাসায় বসবাস করা নৃ-জাতিগোষ্ঠিদের মস্তিষ্কপ্রসূত চিন্তা-ভাবনা এবং প্রকৃতি প্রদত্ত গাছের সাহায্যে তৈরি হয়েছে এই সেতু।
এ কারণেই বলা হয়ে থাকে, এই অনন্য সেতুর মূল স্থপতি মেঘালয়ের মানুষ এবং এই স্থাপত্যের প্রধান উপকরণ হচ্ছে ফাইকাস ইলাস্টিকা নামের এক ধরনের রাবার গাছ। চেরাপুঞ্জি ও তার আশেপাশের অঞ্চলগুলোতে এই রাবার গাছ প্রচুর পরিমাণে জন্মাতে দেখা যায়। দুই ধরনের শিকড় গজায় এই গাছে। একটি থাকে মাটির গভীরে। আরেকটি গাছের গা বেয়ে বেরিয়ে আসে বাইরে।
কীভাবে তৈরি হয় এই সেতু?
সাধারণত ‘ফাইকাস ইলাস্টিকা’ নামের গাছগুলো নদীর ধারে প্রচুর পরিমাণে জন্মাতে দেখা যায়। এই গাছের শিকড় মাটির অনেক গভীর পর্যন্ত বিস্তৃত। ফলে ভূমিক্ষয় কিংবা প্রাকৃতিক বিপর্যয়েও এই গাছ অবলীলায় বেঁচে থাকতে পারে। এই গাছের শিকড় যেমন খুব শক্ত, এই গাছের ঝুড়িমূল তেমনি মোটা ও শক্ত-পোক্ত।
শিকড়ের ন্যায় বের হতে থাকা এই ঝুড়িমূলগুলো বাড়তে এবং শক্ত হতে সুযোগ করে দেয়ার জন্য কচি ঝুড়িমূলগুলো একসঙ্গে বেঁধে রাখা হয় যাতে ঝুড়িমূলগুলো শক্তিশালী হতে পারে। তারপর সুপারি গাছের কান্ড মাঝ বরাবর ছিদ্র করে খোলের ন্যায় নল তৈরি করা হয় এবং ঝুড়িমূলগুলো নলের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দেয়া হয়। ফলে ঝুড়িমূলগুলো সেই নলের খোলের মধ্য দিয়ে বাড়তে দেয়া হয়। নলের মধ্যে বাড়তে থাকা ঝুড়িমূলগুলো একসময় নদীর অন্য পাড়ের পাথরের মাটিতে পৌঁছে যায়। এরপর ঝুড়িমূলগুলোকে মাটির গভীরে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হয়। এভাবে ঝুড়িমূলগুলো মাটির অভ্যন্তরে পৌঁছে গেলে সময়ের সাথে হয় শিকড়গুলো আরো শক্ত ও মজবুত হয়ে গড়ে ওঠে।
গাছগুলোর জীবনকাল দীর্ঘ হওয়ায় দিন যত গড়ায়, সেতুগুলো ততই মজবুত হতে থাকে। সময়ের সাথে বাড়তে থাকে শিকড়ের গাঁথুনি। ফলে অন্য সব কংক্রিটের ব্রীজের মতো না হওয়ায় এই সেতুর সময়ের সাথে সাথে আরো শক্তিশালী হতে থাকে। হাঁটার সুবিধার্থে ঝুড়িমূলগুলোর ওপর বাঁশের ফালি কিংবা মাটি বা পাথরের চাক রাখা হয়। এই জীবন্ত গাছের সেতু কখনো কখনো প্রায় একশ ফুট পর্যন্ত দীর্ঘ হতে পারে। এই ধরনের সেতুর ওপর হাঁটতে পারে প্রায় পঞ্চাশ জনের অধিক মানুষ। জীবন্ত শিকড়ের এই সেতু পূর্ণতা পেতে প্রাত ১৫ বছরের বেশি সময় লাগে।
সেতুর স্থায়িত্বকাল
শত বছরেও সেতুগুলোর খুব একটা ক্ষতি হয় না। সময়ের নির্দিষ্ট পরিক্রমায় শিকড়ের গাঁথুনি হয় আরো মজবুত। তাছাড়া রাবারের গাছগুলোর সহজে নষ্ট হয় না। এই সেতুর কোনোটির বয়স ৫০০ বছরও অতিক্রম করেছে। রাবার গাছের শিকড়ের আকৃতি ও ধরনের ওপর নির্ভর করে সেতুগুলোর স্থায়ীত্ব। তবে ধারণা করা হয় এক একটি জীবন্ত শিকড়ের সেতু শত বছরের ওপর টিকে থাকতে সক্ষম। কারণ শিকড়গুলো নিজেরাই প্রয়োজন অনুসারে বৃদ্ধি হয় এবং শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
পর্যটন ও বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ এই সেতু
দৃষ্টিনন্দন এই সেতুর কথা দীর্ঘদিন বাইরের মানুষের অগোচেরেই ছিল। শুধুমাত্র স্থানীয়রাই এই সেতু তৈরির কৌশল ও ব্যবহার জানতো। চেরাপুঞ্জির সৌন্দর্য দেখতে আসা পর্যটকদেরকে প্রথমে স্থানীয় গাইডরা এই সেতুর তথ্য দেয়। এভাবেই ছড়িয়ে পড়তে থাকে এই সেতুর কথা। বর্তমানে তথ্য-প্রযুক্তি আর ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ব্যাপক প্রসারের ফলে এই সেতুর খ্যাতি, সুনাম আর সৌন্দর্য ছড়িয়ে পড়েছে সমগ্র বিশ্বব্যাপী। এই অনিন্দ্য সুন্দর সেতুকে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে ঘোষণা করেছে। স্বভাবতই রিওয়াই গ্রামটি পর্যটন স্পট হিসেবে পর্যটন মানচিত্রে স্থান করে নিয়েছে। দেশ-বিদেশের বহু দর্শনার্থী নিয়মিত ডাবল ডেকার সেতুটি দেখতে ছুটে আসেন এই প্রত্যন্ত দুর্গম পাহাড়ি জনপদে। ফলে প্রাচীন জনপথ রিওয়াই গ্রামের সুখ্যাতির সাথে সাথে এই এলাকার জীবনধারায়ও এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন।
বছরের অধিকাংশ সময় এই এলাকার আবহাওয়া থাকে সুন্দর এবং কুয়াশাচ্ছন্ন। সারা বছরই ভ্রমণের জন্য এসব এলাকায় পর্যটকদের ভিড় থাকে। তবে বর্ষা মৌসুম বিশেষত জুন থেকে আগস্ট মাস বাদ দিয়ে অন্য সময়টা বেড়ানোর জন্য আদর্শ। কারণ ঐ সময়টা রাস্তাঘাট পিচ্ছিল হয়ে থাকে। যাতায়াতের অনুপযুক্ত থাকে অনেক রাস্তা। কারো সাহায্য ছাড়া সেতুর ওপর হাঁটা এবং পাহাড়ী ঢালু পথ দিয়ে নিচে নামা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এই সেতু সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানতে চাইলে নিচের ভিডিওটি দেখতে পারেন।
ফিচার ইমেজ: Wikimedia Commons