প্রথমেই বলে রাখি, শিরোনামটি সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা সিরিজের জনপ্রিয় চরিত্র জটায়ুর লেখা একটি কল্পিত উপন্যাসের নাম থেকে ধার করা। আজকের লেখাটি বিশ্বের এক গুরুত্বপূর্ণ শহর হংকংকে নিয়ে। হংকংয়ের সবকিছুতেই যেন রয়েছে রীতিমতো হিমশিম খাওয়ার মতোই ব্যাপারস্যাপার!
হংকং শহরের নাম শুনলে প্রথমেই যে দ্বিধা হয় সেটা হলো- এটা কি কোনো স্বতন্ত্র দেশ? নাকি চীনের কোনো শহর? না, হংকং কোনো সার্বভৌম রাষ্ট্র নয়। এটি গণচীনের একটি ‘বিশেষ প্রশাসনিক অঞ্চল’, যেটা ছিল একটি সাবেক ব্রিটিশ কলোনী। ব্রিটিশ সরকার চীনের কাছ থেকে শহরটি ৯৯ বছরের জন্যে লিজ নিয়েছিলো। ১৯৯৭ সালে লিজের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় শহরটি আবার চীনের হাতে ফিরে আসে, যদিও চীনের ‘এক দেশ, দুই নীতি’র ফলে শহরটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ স্বায়ত্ত্বশাসন ও আলাদা সরকার ব্যবস্থাসহ নানা রাজনৈতিক সুবিধা ভোগ করে যা এক প্রকার স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের মতোই। হংকং নামের অর্থটিও বেশ চমৎকার, এর অর্থ ‘সুবাসিত বন্দর’।
একনজরে ইতিহাস
১৮৩৯-৪২ পর্যন্ত চলা ‘প্রথম আফিম যুদ্ধ’-তে চিং সাম্রাজ্যের সাথে ব্রিটিশ সম্রাজ্যের যুদ্ধে চিং সাম্রাজ্যের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে হংকং ব্রিটেনের হাতে আসে। চিং শাসিত চীন হংকংয়ের নিয়ন্ত্রণ ছাড়তে বাধ্য হয় এবং ব্রিটেন আন্তর্জাতিক ‘Concession’ আইনের মাধ্যমে ৯৯ বছরের জন্যে লিজ নিয়ে নেয়। Concession আইনের মূল ব্যাপারটি হলো যখন দুর্বল সামরিক ও রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে কোনো দেশ তার কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চল অন্য কোনো দেশের হাতে সাময়িকভাবে তুলে দিতে বাধ্য হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান হংকং দখল করে নিলেও ব্রিটেন ১৯৪৫ সালে আবার তার নিয়ন্ত্রণ ফিরে পায়। ১৯৯৭ সালের ৯৯ বছর লিজের সময় পার হওয়ার পর চীন হংকংয়ের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে।
এক দেশ দুই নীতি
চীন একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র যেখানে সব ব্যাপারেই কঠোর বিধি-নিষেধ আরোপ করা আছে। চীন হংকং শহরকে ‘এক দেশ দুই নীতি’ এই আলোকে শাসন করে। অর্থাৎ হংকং সমাজতান্ত্রিক চীন থেকে উচ্চ পর্যায়ের স্বাধীন অর্থনৈতিক এবং সামাজিক স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্য ভোগ করবে তার ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক উন্নতিকে চলমান রাখার জন্যে। এই নীতি ১৯৯৭ সাল থেকে পরবর্তী ৫০ বছরের জন্য প্রযোজ্য হবে। হংকংয়ের আলাদা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং বিচার ব্যবস্থা থাকলেও সামরিক প্রতিরক্ষা ও কুটনৈতিক বা পররাষ্ট্র ব্যবস্থা নেই, এদিকটা চীনই সামলায়। ১৯৯৭ সালে ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীকে প্রত্যাহার করে পিপলস লিবারেশন আর্মি অব চায়নার হাতে হংকংকে তুলে দেয়া হলে চীন সেখানে তাদের নিজস্ব সামরিক ঘাঁটি তৈরী করে। এ বছরের ১লা জুলাই হংকং হস্তান্তরের ২০ বছর পূর্তিতে পিপলস লিবারেশন আর্মি সেখানে নতুন ডেস্ট্রয়ার এবং যুদ্ধজাহাজ সংযোজন করে সাফ জানিয়ে দেয় যে এই ঘাঁটি শুধু হংকংয়ের প্রতীকী সার্বভৌমত্বের জন্য নয়, এটি একটি পূর্ণাঙ্গ সামরিক ঘাঁটি।
বিশ্বের ব্যবসাকেন্দ্র: এশীয় বাঘ
পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় বিশ্বের এক জমজমাট ব্যবসাকেন্দ্র হংকং, সমাজতান্ত্রিক চীনের ভেতরের এক শহরে যা ভাবতেও কষ্ট হয়। কিন্তু চীন তার নিজ স্বার্থেই মুক্ত বাজার অর্থনীতি চালু করেছে এই শহরে যা থেকে তারা সুফল ভোগ করে সমাজতন্ত্রের ঝান্ডা উড়িয়েও। হংকংয়ে রয়েছে মুক্ত বাজার এবং খুবই অল্প ট্যাক্সের সুবিধা। মুক্তবাজার সুবিধার অর্থ পণ্য যেকোনো দেশে রপ্তানি বা আমদানীতে কোনো বাধা; যেমন কোটা, উচ্চহারে শুল্ক, ব্যাপক কঠোর নিয়ম-কানুন ইত্যাদি না থাকা। সেই সাথে এখানে রয়েছে খুবই অল্পহারের ট্যাক্স যা ব্যবসাবান্ধব। বিশ্বের সমস্ত বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তাদের ব্যবসা পরিচালনা করে থাকে এখান থেকে। ফলে ১৯৭০ এর দশকে হংকং পরিচিত পায় ‘এশিয়ান টাইগার’ হিসেবে।
হংকংয়ের শেয়ার বাজার বিশ্বের ৭ম বৃহৎ শেয়ার বাজার। এটি পুঁজি বাড়ানোর জন্যে সবচেয়ে উপযুক্ত জায়গাগুলোর ভেতর একটি। হংকংয়ের মুদ্রা ‘হংকং ডলার’ বিশ্বের ১৩তম বহুল ব্যবহৃত মুদ্রা। মাথাপিছু আয়েও হংকং শীর্ষ দেশগুলোর কাছাকাছি, যদিও আয়ের ভারসাম্যহীনতা রয়েছে প্রচুর, অর্থাৎ ধনী-গরিবের ব্যবধান অনেক।
হংকংয়ের জীবনযাত্রা
হংকং পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোর ভেতর একটি। হংকংয়ের আকাশচুম্বী ভবনগুলো বিশ্বের অন্যতম অসাধারণ স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন। ক্রমাগত চলে আসা স্থান সংকটের কারণে স্থপতিদের প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়। অল্প জায়গার ভেতরে বসবাস উপযোগী ফ্ল্যাট বানাতে হংকংয়ে অনেক উদ্ভট বাড়িও দেখা যায়।
এখানে আনুভূমিকভাবে ফ্ল্যাট না বানিয়ে এখন উল্লম্বভাবে ফ্লাট বানানো হচ্ছে, কারণ সমতলে আর জায়গা নেই। ফলে এখন আকাশের দিকে ওঠা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। এসব চ্যালেঞ্জের কারণে হংকং Contemporary Architecture-এর স্বর্গ হয়ে উঠেছে। এমনকি ওখানে এমন সব ভবনও গড়ে উঠেছে যেখানে বাসিন্দাদের কেনাকাটা, খাওয়া-দাওয়া, বিনোদন ইত্যাদির জন্যে কোথাও যাওয়ারও দরকার পড়ে না। কারণ এক ভবনের ভেতরই গড়ে উঠেছে দোকানপাট, জিমনেশিয়াম, রেষ্টুরেন্ট ইত্যাদি!
হংকংয়ের সাবেক বিমানবন্দর ‘কাই টাক’ বিশ্বের ৬ষ্ঠ বিপদজনক বিমানবন্দর। এখানে টেক অফ আর ল্যান্ডিং করতে পাইলটের যথেষ্ঠ কেরামতির দরকার হয়। যেকোনো বিমানের ক্যাপ্টেনের এখানে ল্যান্ড করার অনুমতি নেই, বিশেষ প্রশিক্ষণ নিয়ে ফ্লাইট সিমুলেটরে অনুশীলনের পরই কোনো পাইলটের কাই টাকে টেক অফ, ল্যান্ডিংয়ের অনুমতি মেলে। আর হবেই না বা কেন? অসংখ্য বহুতল ভবন এড়িয়ে, দুটি বহুতল ভবনের মাঝখান দিয়ে উড়ে গিয়ে বিমানকে ল্যান্ড করাতে হয় চিকন একচিলতে রানওয়েতে, যে রানওয়ের কিছু অংশ আবার হারবার পোর্টের ভিতর গিয়ে পড়েছে। মড়ার উপর খাড়ার ঘাঁয়ের মতো আরো বাধা তৈরী করে ক্রস উইন্ড এয়ার। ১৯৯৮ সালে বিমান বন্দরটি অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়।
চীনের সাথে হংকংয়ের এক অন্যতম দ্বন্দ্বের কারণ হলো ‘বার্থ ট্যুরিজম’। ধারণাটার সাথে আমরা হয়তো একদমই পরিচিত নই। হংকংয়ের সংবিধান অনুযায়ী মূল চীনা ভূখন্ডের কোনো দম্পতির সন্তানের জন্ম যদি হংকংয়ে হয়, তাহলে সেই সন্তান এখানকার পূর্ণ বাসিন্দা হিসেবে গণ্য হবে এবং নাগরিকত্বের অধিকার ভোগ করবে। এমনকি যদিও তার বাবা-মা’র কেউ এখানকার স্থানীয় বাসিন্দা না হয় তবুও। ফলে চীনের ‘এক সন্তান নীতি’ এড়ানোর জন্যে বিপুল সংখ্যক চীনা গর্ভবতী মহিলা হংকংয়ে এসে সন্তান জন্ম দেয়।
অবস্থা এমনই বেগতিক হয়ে দাঁড়ায় যে, ২০১১ সালের দিকে পত্রিকায় খবর বেরোয় হংকংয়ের সব হাসপাতালের প্রসূতি বিভাগের সব শয্যা ২০১২ সালের অক্টোবর পর্যন্ত অগ্রিম ভাড়া হয়ে গেছে! এ খবর জানাজানি হওয়ার পর তীব্র গণ-অসন্তোষের ফলে হংকং সরকার চীনা মূল ভূখন্ডের নাগরিকদের অগ্রীম প্রসূতি সেবা বাতিল করতে বাধ্য হয়।
হংকংয়ের স্থান সংকটের কারণে সেখানে রয়েছে আরেক অদ্ভুত সমস্যা। হংকংয়ে সম্প্রতি বর্জ্য নিষ্কাশনের সমস্ত জায়গা ফুরিয়ে গিয়েছে। ফলে সরকারকে প্রতি বছর ৬.৪ মিলিয়ন টন পরিমাণ বর্জ্য নিষ্কাশন করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। নিচু জায়গা ভরাট করার কাজে কিছুদিন বর্জ্য ব্যবহার করা হয়েছিল। কিন্তু এখন আর সে জায়গাও অবশিষ্ট নেই। ফলে বর্জ্য কিউবিক আকারে কম্প্রেস করে বাইরের দেশে পাঠিয়ে দিতে হচ্ছে। পৃথিবীতে হংকংই একমাত্র দেশ যেখানে নাগরিকদের আলাদা করে সমুদ্রের পানি সরবরাহ করা হয় শুরু টয়লেট ফ্লাশ করার জন্য! ১৯৫০ সাল থেকে চালু হওয়া এই সার্ভিসের মাধ্যমে দৈনিক ৭,৪৬,২৪০ কিউবিক মিটার সমুদ্রের পানি সরবরাহ করা হয় টয়লেট ফ্লাশ করতে। এর উদ্দেশ্য হলো টয়লেট ফ্লাশের মতো কাজে পরিষ্কার বিশুদ্ধ পানি অপচয় না করা।
হংকংকে মোকাবেলা করতে হয় প্রচুর রাজনৈতিক সমস্যাও। শাসনের কেন্দ্রে চীনের অযাচিত হস্তক্ষেপ নিয়ে হংকংয়ের মানুষের মনে রয়েছে ক্ষোভ। এ নিয়ে অনেকদিন ধরেই চলে আসছে আন্দোলন। এমনকি চীন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার দিকেও এই আন্দোলন মোড় নিতে পারে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা। এতসব প্রতিকূলতা সত্ত্বেও হংকং, বিশ্বের বিজনেস হাব, তার অদ্ভুত সমস্যাগুলো মোকাবেলা করে এগিয়ে চলেছে।