চীনের হেইলংজিয়াং প্রদেশটি ছিল কম্যুনিস্ট নিয়ন্ত্রিত চীনের প্রথম প্রদেশ। প্রদেশটি পূর্বে জাপানের দখলে থাকলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সোভিয়েত বাহিনীর কাছে হেরে গিয়ে চীনাদের কাছে সমর্পণ করতে বাধ্য হয় জাপান। চীনের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত এই প্রদেশটির রাজধানী শহর হলো হার্বিন।
হার্বিন শহরের খুব কাছেই সাইবেরিয়ার অবস্থান। সাইবেরিয়া হলো উত্তর এশিয়া নিয়ে গঠিত একটি বিস্তৃত অঞ্চল, যা রাশিয়ার অংশ হিসেবে অন্তর্ভূক্ত আছে। সাইবেরিয়ার দক্ষিণে কাজাখস্তান, মঙ্গোলিয়া ও চীনের সীমান্ত। তাই সাইবেরিয়ার হিম শীতল বাতাস বয়ে যায় হার্বিন শহরের উপর দিয়ে। গ্রীষ্মে হারবিনের গড় তাপমাত্রা ২১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো থাকলেও শীতকালে এই তাপমাত্রা নেমে আসে প্রায় -১৫ ডিগ্রির নিচে। শীতের তীব্রতা বেড়ে গেলে এই তাপমাত্রা -৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত নেমে আসতে পারে।
তবে শীতের আধিক্য বেশি বলে যে এই শহরের অধিবাসীরা গুটিশুটি দিয়ে ঘরে বসে থাকে এমনটা কিন্তু মোটেও নয়। তুষারপাতের আধিক্যকে তারা নিজেদের মতো করে নিয়েছে এক অসাধারণ চমকপ্রদ এবং জাঁকজমকপূর্ণ উৎসবে। উৎসবটি ‘হার্বিন ইন্টারন্যাশনাল আইস এন্ড স্নো স্কাল্পচার ফেস্টিভল’ নামে পরিচিত। একে অনেকে হারবিন বরফ উৎসবও বলে থাকে। বরফের উপর বিভিন্ন আকৃতির স্থাপত্য ও অট্টালিকা এই উৎসবের প্রধান আকর্ষণ। এছাড়াও এ উৎসবে বরফ দিয়ে বিভিন্ন পৌরাণিক দেবদেবী, উপকথা বা লোককথার চরিত্র, পুরনো প্রাসাদ, বিভিন্ন পশু-পাখির অবয়ব এবং এ ধরনের আরো হাজারো বৈচিত্র্যপূর্ণ ভাস্কর্য তৈরি করা হয়।
এ তো গেলো বিভিন্ন ভাস্কর্যের কথা। কিন্তু ভাস্কর্যের মধ্যে বিভিন্ন আলোর খেলাও বেশ চোখে পড়ার মতো। ভাস্কর্য ছাড়াও এ শহরের বিভিন্ন উদ্যান, রাস্তা, এমনকি ঘরবাড়িও সাজে নতুন রুপে। শহরের চারপাশে বিভিন্ন আকৃতির ও নকশার লন্ঠন ঝোলানো হয়, যা পুরো শহরকেই আলোকিত করে রাখে। এই উৎসবের অন্যতম আয়োজন হলো ইয়াবুলি আলপাইন স্কিইং, সংহুয়া নদীতে সাঁতার কাটা এবং জাওলিন উদ্যানে আলোকবর্তিকার খেলা প্রদর্শন। এছাড়াও বরফের উপর হকি খেলা ও মোটরসাইকেল চালানোর মতো উত্তেজনাপূর্ণ খেলারও আয়োজন করা হয়।
হার্বিন শহরের ‘জিনগুয়েতান ন্যাশনাল ফরেস্ট’ নামের হ্রদে ঘেরা উদ্যানে এ উৎসবের আয়োজন করা হয়ে থাকে। প্রতিবছর জানুয়ারি মাসের শুরুর দিকে উৎসবটি শুরু হয়ে ফেব্রুয়ারির শেষ পর্যন্ত চলে। তবে আবহাওয়ার অবস্থা বুঝে অনেক সময় নির্দিষ্ট সময়ের আগেই শুরু হয়ে যায় প্রদর্শনী।
পুরো হার্বিন শহর জুড়ে ভাস্কর্য তৈরি করা হলেও, অনেকগুলো প্রদর্শনীর মধ্যে দুটি প্রদর্শনীর ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে। একটি হলো সূর্য দ্বীপের বিশাল এলাকা জুড়ে গড়ে ওঠা বরফের তৈরি বিশাল আকৃতির সব ভাস্কর্যের প্রদর্শন। হার্বিন নদীর পাশ দিয়ে বয়ে গেছে সংহুয়া নদী। এই নদীর পাড় ঘেঁষে একটি বিনোদনমূলক জায়গার নামই হলো ‘সান আইল্যান্ড’ বা সূর্য দ্বীপ।
অন্যটি হলো ‘আইস এন্ড স্নো ল্যান্ডে’র বিভিন্ন বরফের অট্টালিকা ঘিরে অসাধারণ আলোকবর্তিকার খেলা প্রদর্শন। জায়গাটি শুধুমাত্র রাতে উন্মুক্ত করা হয়। রাতে জায়গাটি পুরো আলোকিত হয়ে থাকে। বিভিন্ন রঙের ও বিভিন্ন ভাবের উপর আলোর ব্যবস্থা করা হয়। এগুলোর অনেকগুলোর রঙ আবার সময়ে সময়ে পরিবর্তন হয়ে যায়।
হার্বিনের এই ঐতিহ্যবাহী উৎসবটি প্রথম শুরু হয় ১৯৬৩ সালে। কিন্তু ১৯৬৬ চীনের কম্যুনিস্ট নেতা মাও সে তুং এর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা সামাজিক আন্দোলন, যা ‘সাংস্কৃতিক বিপ্লব’ নামে অধিক পরিচিত, শুরু হওয়ার কারণে প্রায় ১৮ বছর অনুষ্ঠানটি বন্ধ থাকে। পরবর্তীতে ১৯৮৫ সালের ৫ জানুয়ারি জাহলিন পার্কের একটি বার্ষিক অনুষ্ঠানে উৎসবটি পুনরায় শুরু করার অনুমতি দেয়া হয়। সেই থেকে প্রতিবছর এই নির্দিষ্ট সময়ে বেশ জাঁকজমকভাবেই পালিত হয়ে আসছে উৎসবটি।
আয়তনের হিসেবে প্রায় ৮০ হাজার বর্গ মিটার এলাকা জুড়ে উৎসবটি পরিচালিত হয়ে থাকে। এই উৎসবে ২ হাজারেরও অধিক বরফের ভাস্কর্য তৈরি করা হয়। আর এতসব ভাস্কর্য তৈরি করার জন্যে অন্তত ১ লাখ ৮০ হাজার ঘন মিটার বরফ এবং ১ লাখ ৫০ হাজারের মতো তুষারের প্রয়োজন হয়।
হার্বিন শহরের উপর বয়ে চলা সংহুয়া নদীই মূলত এত বিশাল পরিমাণ বরফপ্রাপ্তির একমাত্র উৎস। প্রায় ১ হাজারের বেশি শ্রমিক সক্রিয়ভাবে সংহুয়া নদী থেকে বরফ সংগ্রহের কাজে নিযুক্ত থাকে। নদী থেকে ২-৩ ফুটের বরফের টুকরো কেটে নিয়ে আসা হয় ভাস্কর্য তৈরির স্থানে। তারপর বিভিন্ন আকৃতির ভাস্কর্যের অনুসারে বরফ কেটে নেয়া হয়। আর এসকল বরফ কাটার জন্যে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে বাটালি, কুঠার ও বৈদ্যুতিক করাত। উৎসব শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকেই ভাস্কর্য তৈরি করার কাজ শুরু হয়ে যায়।
বরফগুলোর মধ্যে আলোর কাজ করার জন্যে অনেক ভাস্কর্য স্বচ্ছ হয়ে থাকে। আর ভাস্কর্য স্বচ্ছ করার জন্যে ব্যবহার করা হয় বিশুদ্ধ পানি। অট্টালিকা বা ভাস্কর্য তৈরি হয়ে গেলে এর মধ্যে ব্যবহার করা হয় বিভিন্ন আলোর সরঞ্জাম যাতে করে রাতের অন্ধকারে পুরো ভাস্কর্য এক অপরূপ সাজে সজ্জিত হয়। এছাড়াও এখানকার আরেকটি চোখ ধাঁধানো প্রদর্শনী হলো লেজারের প্রদর্শন। এখানে আরো রয়েছে তুষারের জাদুঘর।
পূর্বে এই উৎসবটি মূলত চীনা অধিবাসীদের মধ্যেই জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে এর প্রচার-প্রচারণা বাড়তে থাকে। বর্তমানে উৎসবটি আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানের খ্যাতি অর্জন করেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান হতে অসংখ্য পর্যটক প্রতি বছর উপভোগ করতে আসেন এই বরফ আর তুষারের আয়োজন। এই উৎসবকে ঘিরে দর্শকদের আগ্রহের কমতি নেই। অনুষ্ঠানের শুরু হয় ব্যাপক আতশবাজি প্রদর্শনের মাধ্যমে।
হার্বিনের পথে হাঁটতে হাঁটতে দর্শনার্থীরা চোখ জুড়ায় অসাধারণ সব বরফের অট্টালিকা আর আলোর খেলা দেখতে দেখতে। এলাকাভেদে ভিন্ন ভিন্ন প্রদর্শনীর জন্য প্রবেশমূল্য ভিন্ন। এছাড়াও দর্শনার্থীরা নির্দিষ্ট টিকেট মূল্যের বিনিময়ে বিভিন্ন খেলায় অংশগ্রহণ করতে পারেন।
চীনের সরকারি হিসেব মতে, ২০১৭ সালে প্রায় ১৮ মিলিয়ন দর্শনার্থী ভিড় করেছিলেন এই উৎসবে। আর বলাই বাহুল্য, চীনের পর্যটন সংস্থা এর জন্যে বেশ ভালো পরিমাণ আয় করেছিল। ফলে এই উৎসবকে ঘিরে চীনের আগ্রহ দিনকে দিন আরো বেড়ে চলেছে।
ফিচার ইমেজ- fredsullivan.com