‘তাজমহল’ শব্দটা শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে শ্বেত মর্মর পাথরের এক প্রকান্ড সমাধি। মনে পড়ে যায় নশ্বর পৃথিবীতে মরণশীল মানুষের ভালবাসাকে বাঁচিয়ে রেখার প্রয়াসে নির্মিত কালোত্তীর্ণ এক স্থাপত্যের কথা। কানে ভেসে আসে এক পরাক্রমশালী সম্রাটের প্রিয়াহারা বেদনার আর্তনাদকে স্থান-কালের ক্রমবহমান জড় কাঠামোতে এক চিলতে স্থান করে দেয়ার করুণ আকুতি। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় শুভ্র তাজমহল যেন ‘কালের কপোলতলে’ সমুজ্জ্বল হয়ে থাকা বিরহকাতর সম্রাটের একবিন্দু নয়নের জল।
শুরুর কথা
গত চার শতাব্দী জুড়ে মানব মানবীয় ভালবাসার অনন্য নিদর্শন হিসেবে যমুনার পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা তাজমহল যার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় নির্মিত, সেই সম্রাট শাহজাহানের উত্থান এবং জীবন উপাখ্যান কিন্তু মোটেও রোমান্টিক ছিল না। সম্রাট জাহাঙ্গীরের তৃতীয় পুত্র শাহজাহানের জন্ম ১৫৯২ খ্রিস্টাব্দের ৫ জানুয়ারী, তদানীন্তন মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত লাহোরে। অবশ্য তার প্রকৃত নাম শাহাব-উদ-দীন মুহাম্মদ খুররম। কৈশোরে শাহজাদা খুররম নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন তিনি। রাজ জ্যোতিষীদের গণনার সুবাদে হোক কিংবা তার মাতামহ সম্রাজ্ঞী রুকেয়া সুলতানা বেগমের অত্যাধিক স্নেহের কারণেই হোক, শাহজাদা খুররমের ভাগ্য যে ভবিষ্যতে সুপ্রসন্ন হতে চলেছে সেটা তার বাল্যকাল থেকেই ভালভাবে বোঝা যাচ্ছিল।
১৬০৭ খ্রিস্টাব্দে ১৫ তম হিজরি জন্মদিনে শাহজাদা খুররমের মিলল এক বিরল সম্মাননা। তাকে তার ওজনের সমপরিমাণ স্বর্ণ এবং রত্ন উপহার দিলেন তার পিতা সম্রাট জাহাঙ্গীর। অন্য শাহাজাদাদের চোখে ব্যাপারটা ছিল সত্যিই ঈর্ষণীয়। ঐ ঘটনার খুব কাছাকাছি সময়ে শাহজাদা খুররমের জীবনে ঘটে গেল আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। মসনদের শক্তিশালী দাবিদার এই শাহজাদার সাথে তার হবু সৎমা মেহেরুন্নিসার ভ্রাতষ্কন্যা আরজুমান্দ বানু বেগমের বাগদান সম্পন্ন হল। এই আরজুমান্দ বানু বেগমই পরবর্তীতে সম্রাট শাহজাহানের প্রেয়সী মুমতাজ মহল হিসেবে ভুবনখ্যাত হয়েছিলেন। আর ফুপু মেহেরুন্নিসা ভুবনবিখ্যাত হয়েছিলেন নুরজাহান নামে। তাই বলা যায়, মুমতাজ মহলের এই মোহিনী ব্যক্তিত্ব হয়ত তার উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত। কারণ সম্রাট শাহজাহানের উপর তার যতটা প্রভাব ছিল, তার ফুপু নুরজাহানেরও সম্রাট জাহাঙ্গীরের উপর প্রভাব এর চেয়ে কোনো অংশে কম ছিল না।
শাহজাহানের প্রেয়সী মুমতাজ মহলের জন্ম ১৫৯২ খ্রিস্টাব্দের ২৭ এপ্রিল উত্তর ভারতের আগ্রায়। জনশ্রুতি আছে, প্রথম দেখাতেই বালিকা মুমতাজ মহলের আকর্ষণে মুগ্ধ হন বালক শাহজাহান। সেই মুগ্ধতাই ধীরে ধীরে পরিণত হয়েছিল কালোত্তীর্ণ ভালবাসার মহাকাব্যে। বাগদানের প্রায় ৫ বছর পর ১৬১২ খ্রিস্টাব্দের ৩০ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে বিবাহ সম্পন্ন হয় তাদের। মুমতাজ মহলের বয়স তখন ১৯ বছর এবং শাহজাহানের ২০ বছর।
শাহজাহানের উত্থান
শাহজাহানের জন্মের সময় মুঘল সম্রাট ছিলেন মুঘলে আজম আকবর। পিতামহের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যেই বাল্যকাল কেটেছিল শাহজাদা খুররমের। ছোটবেলা থেকেই শাহজাদা খুররম ছিলেন বুদ্ধিমান, বিচক্ষণ এবং সাহসী। তবে জাহাঙ্গীরের সিংহাসন আরোহন পরবর্তী সময়ে দরবারের জটিল রাজনৈতিক দোলাচাল থেকে নিজেকে অত্যন্ত সতর্কভাবে সরিয়ে রেখেছিলেন শাহজাদা। ফলে জাহাঙ্গীরের শাসনামলের একদম শুরু থেকে দরবারের আমির ওমরাহ্দের কাছে যথেষ্ট গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি। তবে মুঘল রাজনীতির দৃশ্যপটে শাহজাদা খুররমের ধূমকেতুর মতো আবির্ভাব ঘটে ১৬১৪ খ্রিস্টাব্দে। দীর্ঘ এক বছর ধরে চলা অভিযানে ২২ বছর বয়সী এই শাহজাদা মেবারের রাজপুতদের অত্যন্ত শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন। এছাড়া ১৬১৭ খ্রিস্টাব্দে দাক্ষিণাত্যে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে আশাতীত সাফল্য তাকে এনে দেয় অভূতপূর্ব খ্যাতি। স্বয়ং সম্রাট জাহাঙ্গীর তাকে ‘শাহজাহান’ অর্থাৎ সারা জাহানের শাহ বা রাজা উপাধিতে ভূষিত করেন। একজন শাহজাদার জন্য মাত্র ২৫ বছর বয়সে এত মর্যাদাপূর্ণ উপাধি অর্জন করা কল্পনাতীত সম্মানের ব্যাপার ছিল। ফলে অল্প সময়েই শাহজাহান পরিণত হলেন দরবারের সকলের চোখে সমীহের পাত্রে।
তবে রাজক্ষমতার সমীকরণ কোনোদিনই সরল ছিল না। জাহাঙ্গীরের উপর ক্রমে প্রভাব বিস্তার করতে থাকা সম্রাজ্ঞী নুরজাহান একদিকে যেমন ছিলেন শাহজাহানের সৎ মা এবং অন্যদিকে ফুপু শাশুড়ি। কিন্তু তার পরিকল্পনা ছিল জাহাঙ্গীরের কনিষ্ঠপুত্র শাহরিয়ারকে পরবর্তীতে সিংহাসনে বসানো। সে উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের পথে অনেক দূর এগিয়েও গিয়েছিলেন নুরজাহান। তার আগের ঘরে জন্ম নেওয়া মেয়ে লাডলি বেগমকে বিয়ে দিয়েছিলেন শাহজাদা শাহরিয়ারের সাথে। তবে বিচক্ষণ শাহজাহান এবং তার শ্বশুর আসাফ খানের দাপটের সামনে নুরজাহানের মতো প্রতাপশালী সম্রাজ্ঞীও টিকে থাকতে পারেন নি, যদিও আসাফ খান ছিলেন নুরজাহানেরই আপন ভাই। জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর পর অনেক ঘাত-প্রতিঘাত, বিদ্রোহ-পাল্টা বিদ্রোহ পেরিয়ে অবশেষে ১৬২৮ সালে সিংহাসনে আরোহন করেন শাহজাহান। অন্যদিকে একসময়ের সাম্রাজ্য কাঁপানো দাপুটে নুরজাহান এবং তার কন্যা লাডলি বেগমকে রাজদরবার থেকে নির্বাসন দিয়ে লাহোরে নজরবন্দী রাখা হয়।
শাহজাহান ও মুমতাজ মহলের প্রণয়ের প্রগাঢ়ত্ব
বিদ্রোহ দমনে কঠোরহস্ত, ক্ষমতার রাজনীতিতে সুকৌশলী এবং শক্ত হাতে সাম্রাজ্য চালানো সম্রাট শাহজাহানের শাসক পরিচয় তার প্রেমিক পরিচয়ের নিচে চাপা পড়ে গেছে। কারণ শাসক শাহজাহানের পরাক্রম তার সিংহাসনচ্যুতির সাথে হারিয়ে গেলেও, প্রেমিক শাহজাহান তাজমহলের মাধ্যমে আজও জনগণের মানসপটে প্রবল পরাক্রমে বেঁচে আছেন। কেন প্রেমিক শাহজাহান ইতিহাসে অনন্য? এর পেছনের কারণ কি শুধুই মৃত প্রেয়সীর স্মৃতি জাগরূক রাখতে কল্পনাতীত ব্যয়বহুল এক সমাধি নির্মাণ? নাকি জীবদ্দশায়ও মুমতাজ-শাহজাহানের প্রেমের উপাখ্যান কোনো অংশে কম ছিল না? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে আমাদের ফিরে যেতে হবে আজ থেকে ঠিক চারশ বছর আগে।
সেই সময়ে রাজপুরুষদের বহুগামিতা সর্বজনবিদিত এবং স্বীকৃত। মুঘলরাও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। প্রত্যেক শাহজাদা এবং সম্রাট ছিলেন আলাদা আলাদা মহলের মালিক, যেখানে থাকতেন তাদের স্ত্রী এবং পরিচারিকাগণ। সেই ধারাবাহিকতায় ভবিষ্যত সম্রাট শাহাজাদা খুররমের সান্নিধ্য লাভের জন্যও ব্যাকুল ছিলেন বহু নারী। তবে শাহজাহান একটি জায়গায় অন্যদের চেয়ে একদম আলাদা ছিলেন। সেটা ছিল মুমতাজের সাথে তার ব্যক্তিগত প্রণয়। মধ্যযুগে ভারতীয় রাজপরিবারে দাম্পত্য সম্পর্ক আবর্তিত হত জৈবিক প্রয়োজন, উত্তরাধিকার জন্ম দেয়ার আকাঙ্ক্ষা এবং অন্যান্য রাজনৈতিক উদ্দেশ্যকে ঘিরে। ব্যক্তিকেন্দ্রীক ভালবাসার অস্তিত্ব রাজপরিবারগুলোতে ছিল বিরল। কিন্তু মুমতাজ মহল এবং শাহজাহানের ক্ষেত্রে এই সবকিছুকে ছাপিয়ে প্রাধান্য পেয়েছিল পারস্পরিক সম্পর্ক এবং সুগভীর রোমান্টিসিজম।
মুমতাজ মহল ছাড়াও শাহজাহানের অন্য দুজন স্ত্রী ছিলেন। কিন্তু সেই বিয়েগুলো ছিল শুধু রাজনৈতিক প্রয়োজনে। অন্যদিকে মুমতাজ মহল শুধু তার সহধর্মিণীই ছিলেন না, ছিলেন একান্ত পরামর্শক এবং সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এককথায়, মুমতাজ মহল ছিলেন শাহজাহানের আদর্শ জীবনসঙ্গিনী এবং সার্বক্ষণিক সহচর। সম্রাট হওয়ার পর শাহজাহানের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে মুমতাজ মহলের যথেষ্ট প্রভাব ছিল। শুধু তা-ই নয়, অভিযানগুলোতে শাহজাহানের সঙ্গী হিসেবে থাকতেন তিনি। উনিশ বছরের দাম্পত্য জীবনে মুমতাজ মহলের গর্ভে জন্ম নিয়েছিল শাহজাহানের চৌদ্দজন সন্তান, যদিও তাদের মধ্যে মাত্র সাতজন শৈশব অতিক্রম করতে পেরেছিলেন। শাহজাহানের উত্তরসূরি সম্রাট আওরঙ্গজেব এই রাজদম্পতিরই সন্তান। আর তাই তো আরজুমান্দ বানু বেগম ধীরে ধীরে হয়েছিল শাহজাহানের মহলের সেই বিশেষ একজন, যার এককথায় প্রকাশ হলো মুমতাজ মহল। মুমতাজ মহল প্রকৃতপক্ষেই এই উপাধির যোগ্য ছিলেন।
তবে নশ্বর মানুষের জীবনে ভালবাসা চিরদিন মিলনাত্মক থাকে না। মৃত্যুর অনিবার্যতাকে এড়াতে পারে না পৃথিবীর কোনো জীবিত সত্ত্বা। শাহজাহান ও মুমতাজ মহলের মত রাজকীয় দম্পতিও সেই নির্মম সত্যের মুখোমুখি হলেন অনেকটা আকস্মিকভাবে। ১৬২৯ খ্রিস্টাব্দে দাক্ষিণাত্যে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা বিদ্রোহ দমনের উদ্দেশ্যে অভিযান শুরু করলেন সম্রাট শাহজাহান। সাথে নিয়ে গেলেন মুমতাজ মহলকেও। দীর্ঘ দুই বছর ধরে চলা এই অভিযানের মাঝখানে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লেন সম্রাজ্ঞী। দীর্ঘ যাত্রায় দিনে দিনে ক্লান্ত হয়ে পড়ছিলেন তিনি। এদিকে দ্রুত ঘনিয়ে আসছিল সন্তান জন্ম দেয়ার সময়। দুঃখজনকভাবে, সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় ঘটল চূড়ান্ত বিপত্তি।
দীর্ঘ ৩০ ঘন্টার অসহনীয় প্রসব বেদনার পর, মুমতাজ মহল অবশেষে কন্যাসন্তান জন্ম দিলেন। কিন্তু অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে চৌদ্দতম সন্তান জন্মদানের ধকল সামলাতে পারল না সম্রাজ্ঞীর ভঙ্গুর শরীর। কথিত আছে, প্রসব বেদনায় কাতর মুমতাজ মহলের অবর্ণনীয় যন্ত্রণা দেখে হতবিহবল শাহাজাদী জাহানারা নাকি মায়ের আরোগ্যের জন্য অকাতরে দান-সদকাহ করতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু সম্রাজ্ঞীর তক্বদীরে লিখা ছিল অন্য কিছু। পরাক্রমশালী শাহজাহানের জাহান কাঁদিয়ে ১৬৩১ সালের ১৭ জুন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন সম্রাটের মহলের অমূল্য রত্ন ‘মুমতাজ মহল’। মুমতাজের মৃত্যুতে শাহজাহান এতটাই শোকাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলেন যেন আচমকা তার রং, রূপ ও সৌন্দর্যের জাঁকজমকমন্ডিত পৃথিবীতে বেদনার জলোচ্ছ্বাস এসে সবকিছু লন্ডভন্ড করে দিয়ে গেল। এক বছরের শোক ঘোষণা করলেন সম্রাট নিজে, চলে গেলেন লোজচক্ষুর অন্তরালে। ঠিক এক বছর পর সম্রাট যখন জনসম্মুখে হাজির হলেন, ততদিনে তার চুল এবং শ্মশ্রুতে পাক ধরে গেছে, চোখে-মুখে বার্ধক্য এবং বিরহের ছাপ ছিল সুস্পষ্ট।
তাজমহল নির্মাণের সূচনা
কথিত আছে, মৃত্যুশয্যায় মুমতাজ মহল শাহজাহানকে তার শেষ ইচ্ছা হিসেবে জানিয়েছিলেন যেন তাকে এমন এক সমাধিস্থলে সমাহিত করা হয় যার সৌন্দর্য গোটা পৃথিবীর মানুষ মুগ্ধ নয়নে দেখবে। তবে মুমতাজ মহল অন্তিম সময়ে এমন ইচ্ছার কথা সত্যিই ব্যক্ত করেছিলেন কিনা সেটা নিশ্চিতভাবে জানা না গেলেও, সম্রাট শাহজাহান যে এই আকস্মিক মৃত্যুতে অসম্ভব প্রভাবিত হয়েছিলেন সেটা নির্দ্বিধায় বলা যায়। প্রেয়সীর স্মৃতি চিরস্মরণীয় করে রাখতে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন এমন এক সমাধি নির্মাণ করার যা দুনিয়ার মানুষ আগে কখনও দেখেনি, যা নির্মাণ করার দুঃসাহস দেখাতে যুগের সবচেয়ে ক্ষমতাবান মানুষটিও ভয় পাবে। দুনিয়ার সকল মহলের ‘তাজ’ বা মুকুট হবে যে মহল, মুমতাজ মহলের স্মরণে সেই তাজমহল নির্মাণের মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করলেন শাহজাহান।
তাজমহলের স্থাপত্যশৈলীর বিভিন্ন দিক
তাজমহলের নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল ১৬৩২ খ্রিস্টাব্দে। প্রায় ২১ বছর ২০,০০০ শ্রমিকের নিরলস প্রচেষ্টায় ১৬৫৩ সালে অবশেষে নির্মাণ শেষ হয়েছিল তাজমহলের, যদিও মূল কাঠামো নির্মাণ করতে মাত্র ১০ বছর সময় লেগেছিল। বাকি এক যুগ ব্যয় হয়েছিল মার্বেল পাথরের কাজ এবং তাজমহল কমপ্লেক্সের অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণ করতে। প্রায় ১,০০০ হাতি নিয়োজিত ছিল মালামাল পরিবহনের জন্য। সাদা মার্বেল পাথর আনা হয়েছিল আগ্রা থেকে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত রাজস্থানের মাকরান থেকে। এছাড়া তাজমহলের মোজাইকের জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল মহা মূল্যবান এবং অপেক্ষাকৃত কম মূল্যবান ২৯ ধরনের পাথর, যেগুলো আনা হয়েছিল সুদূর শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান, তিব্বত, আরব এবং ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে। অধিকাংশ গবেষকের মতে, তাজমহলের প্রধান স্থপতি ছিলেন পারস্য বংশোদ্ভূত ওস্তাদ আহমদ লাহোরী, যদিও অনেকে ওস্তাদ ঈসা সিরাজিকে তাজমহলের প্রধান স্থপতি হিসেবে দাবি করেছেন। তবে দরবারের নথি এবং ওস্তাদ আহমদ লাহোরীর উত্তরাধিকারদের লিখিত বিবরণী ওস্তাদ আহমদের দিকে পাল্লা ভারি হওয়ার ইঙ্গিত দেয়। অন্যদিকে তাজমহলের বিশাল গম্বুজটির স্থপতি ছিলেন অটোম্যান গম্বুজ বিশেষজ্ঞ ইসমাইল ইফেন্দি।
তাজমহলে সমন্বয় ঘটানো হয়েছিল শাহজাহানের পূর্বপুরুষদের সকল চমৎকার চমৎকার সব সমাধির উৎকৃষ্টতম অংশগুলো। বিশাল গম্বুজটির অনুপ্রেরণা ছিল মুঘলদের আদিপিতা দুর্ধষ বিজেতা আমির তিমুর বা তৈমুর লং এর সমাধি থেকে। তাজমহলের মূল কাঠামো তৈরি করা হয়েছিল শাহজাহানের প্রপিতামহ সম্রাট হুমায়ুনের সমাধি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে। মূল তাজমহলে প্রবেশেদ্বারটির অনুপ্রেরণা নেওয়া হয়েছিল তার পিতামহ সম্রাট আকবরের সমাধি থেকে এবং মিনারগুলোর অনুপ্রেরণা ছিল তার পিতা সম্রাট জাহাঙ্গীরের সমাধির মিনারগুলো।
তাজমহলে সুচতুরভাবে আলোকীয় বিভ্রম (Optical Illusion) ব্যবহার করা হয়েছে। ঢোকার সময় সুবিশাল তোরণের ভেতর দিয়ে তাজমহল দেখতে দেখতে প্রবেশ করলে হঠাৎ করে মূল আঙিনায় তাজমহলকে বিশাল মনে হয়। তাই আপনি মনে মনে যত প্রস্তুতি নিয়েই তাজমহল দেখতে যান না কেন তাজমহলের বিশালতা আপনাকে মুগ্ধ করবেই। এছাড়া তাজমহলের চারটি মিনার বাইরের দিকে একটু হেলানো। ফলে মিনারগুলোকে দেখলে মনে হয় যেন একদম সোজা। এর আরও একটি বিশাল সুবিধা হলো বাইরের দিকে কিছুটা হেলানো হওয়ায় ভূমিকম্পের ফলে মিনারগুলো ভেঙ্গে পড়লে মূল তাজমহলের উপর পড়ার সম্ভাবনা নেই। ফলে অক্ষত থাকবে সম্রাটের প্রিয়তমা মুমতাজের সমাধি। অন্যদিকে তাজমহল থেকে বের হওয়ার সময় প্রধান ফটক দিয়ে তাকালে মনে হয় আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে তাজমহল। এখানেও ব্যবহার করা হয়েছে আলোকীয় বিভ্রমের সূক্ষ্ম কেরামতি। তাই অনেকে বলেন, চলে যাওয়ার সময় তাজমহলকে আপন অন্তরে ধারণ করে নিয়ে যান দর্শনার্থীরা।
বাগানহীন কোনো মুঘল স্থাপত্য যেন কল্পনাই করা যায় না। তাজমহলের ক্ষেত্রেও সেই ঐতিহ্যকে ধরে রাখা হয়েছে কোনো ব্যতিক্রম ছাড়াই। তবে আকর্ষণীয় ব্যাপার হলো এই বাগানের ডিজাইনে স্থপতিরা ব্যবহার করেছেন চমৎকার সিম্বোলিজম। নিখুঁত বর্গাকার ৩০০ X ৩০০ মিটারের বিশাল বাগানটি চারটি কৃত্রিম নালা দ্বারা চারভাগে বিভক্ত। তাই এই বাগানকে বলা হয় চারবাগ। এই চারবাগ যেন তাজমহলের অবিচ্ছেদ্য অংশ। চারটি নালা পবিত্র কুরআনে বর্ণিত জান্নাতের চারটি নহর থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তৈরি করা হয়েছে। নালাগুলোর মিলনস্থলে পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হাউজে কাওসার থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে একটি হাউজ বা জলাধার নির্মাণ করা হয়েছে।
তাজমহলের হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া সৌন্দর্যের রহস্য এবং মানব হৃদয়কে আকৃষ্ট করার মোহিনী জাদুর পেছনের কারণ মূলত দুটি। প্রথমত, এর অকল্পনীয় প্রতিসাম্য এবং দ্বিতীয়ত, শ্বেতশুভ্র মার্বেল পাথরের মোড়ানো তাজের স্নিগ্ধ আবহ। তাজমহল নিখুঁতভাবে প্রতিসম। এর ডানপাশে আরও দুটি স্থাপনা আছে। যাদের মধ্যে একটি মসজিদ এবং অপরটি তৈরি করা হয়েছিল প্রতিসাম্য রক্ষার খাতিরে। তবে বিভিন্ন সময়ে এর অন্যান্য ব্যবহারও ছিল। দুঃখজনকভাবে, বর্তমানে ভারতীয় সরকারের পক্ষ থেকে মসজিদটির ইমাম এবং মুয়াজ্জিনদের কোনো ধরনের বেতন বা অর্থিক সাহায্য প্রদান করা হয় না। মসজিদটির ইমামের সাথে কথা বলে জানা যায়, তিনি মসজিদটি বাঁচিয়ে রাখার তাড়নার বিনে পয়সায় এখানে নামাজ পড়ান। তার মৃত্যুর পর এই মসজিদের ভবিষ্যৎ কী হবে? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, তার ছেলে হয়ত হাল ধরবে।
তাজমহলের সৌন্দর্য সময়ের সাথে সাথে বদলে যেতে থাকে। পদার্থবিজ্ঞান বলে, কোনো বস্তু থেকে যে বর্ণের আলো প্রতিফলিত হয়, আমরা ঐ বস্তুর রং হিসেবে সেটাই দেখতে পাই। শ্বেতবস্তু সকল বর্ণের আলো প্রতিফলন করে, কিন্তু কোনো বর্ণের আলো শোষণ করে না। ফলে আপতিত আলোর সাথে সাথে শ্বেত পাথরের নির্মিত তাজমহলের রঙের আভা বদলাতে থাকে। সকালের সোনা রোদে ধূপছায়ার খেলায় তাজমহলে যে আনন্দ আবহের সৃষ্টি হয়, গোধূলিবেলায় পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়া রবির বিরহ দ্যোতনায় সে আনন্দ বিচ্ছেদের বেদনায় রূপান্তরিত হয়। আর জোছনা রাতে তাজমহলের স্বর্গীয় সৌন্দর্যের বিবরণ উপেক্ষা করে গেলে তাজমজল উপাখ্যান তো অসম্পূর্ণই রয়ে যাবে। জ্যোৎস্নাস্নাত রাতে তাজমহলের অপার্থিব দৃশ্যের বিবরণ হয়ত কোনো সাহিত্যের সাহায্যে বর্ণনা করা সম্ভব নয়। সে দৃশ্যকে উপভোগ করতে হয় অনুভবের শক্তিতে। শব্দের জাদুতে নয়, সেই সৌন্দর্যকে বুঝতে হয় নিঃশব্দের রোমান্টিসিজমে।
তাজমহলের ব্যাপারে প্রচলিত কিছু মিথ এবং কিছু কঠিন বাস্তবতা
তাজমহল সম্পর্কে একটি বহুল প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণা হলো, তাজমহল নির্মাণের পর সম্রাট শাহজাহান নাকি এর নকশাকারক এবং স্থপতিদের হাতের কব্জি কেটে দিয়েছিলেন, যাতে আর কেউ কোনোদিন তাজমহল বানাতে না পারে। এই কাহিনীটি সম্পূর্ণ বানোয়াট এবং ভিত্তিহীন। শুধু তাজমহল নয়, পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত স্থাপনার ক্ষেত্রেও এই রকম মিথ প্রচলিত আছে। এছাড়া ফরাসি পর্যটক জ্যাঁ ব্যাপ্টিস্ট ট্যাভিয়ের বর্ণনা অনুসারে, শাহজাহান নাকি যমুনা নদীর অপর পাড়ে তাজমহলের মতো হুবহু আরও একটি কৃষ্ণবর্ণের সমাধি নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন, যার নাম লোকমুখে প্রচলিত আছে কালাতাজ হিসাবে। কিন্তু তার আগেই ছেলে আওরঙ্গজেব তাকে ক্ষমতাচ্যুত করায় তিনি নাকি সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে যেতে পারেন নি। আধুনিক গবেষকদের মতে, ট্যাভিয়ে এর কালাতাজের দাবি অসত্য এবং মিথ ছাড়া কিছু নয়।
তাজমহলের চোখ ধাঁধানো রূপ এবং রোমান্টিসিজমের আড়ালে কিছু রূঢ় বাস্তবতা ইতিহাসের পাতায় অনেকটা হারিয়ে গিয়েছে, যেগুলোর দিকে এই ফিচারে আলোকপাত করার চেষ্টা করা হয়েছে।
নিঃসন্দেহে তাজমহল ছিল সেই যুগের সবচেয়ে বড় প্রজেক্ট এবং মুঘল ভারত ছিল তৎকালীন বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধ সাম্রাজ্যগুলোর অন্যতম। তা সত্ত্বেও কল্পনাতীত ব্যয়বহুল এই মেগা প্রজেক্টের ভার বহন করার মতো ক্ষমতা শাহজাহানের সাম্রাজ্যের ছিল কিনা সেটা বিতর্কের বেশ বড়সড় বিষয়। তাজমহল এবং অন্যান্য ব্যয়বহুল প্রজেক্ট হাতে নেওয়ার ফলে শাহজাহানের আমলের শেষের দিকে মুঘল রাজকোষ হয়ে পড়েছিল অনেকটা শূন্য। শুধু তা-ই নয়, তাজমহলের শ্রমিকদের খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে গিয়ে কৃত্রিম দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি হয়েছিল মুঘল সাম্রাজ্যের কোনো কোনো জায়গায়। একজন শাসকের ব্যক্তিগত ভালবাসা বহিঃপ্রকাশের মাশুল যদি জনগণকে এত বাজেভাবে দিতে হয়, সেই স্থাপত্যের নির্মাণের যথার্থতা অবধারিতভাবে প্রশ্নবিদ্ধ নয় কি? এছাড়া একজন সম্রাটের ব্যক্তিগত খেয়াল খুশির সামনে জনগণ যে কতটা নাজুক অবস্থানে ছিল সেটারও সুস্পষ্ট ইঙ্গিত এই ঘটনা বহন করে।
শাহজাহানের শেষ জীবন এবং কাহিনীর পরিসমাপ্তি
শাহজাহানের বিলাসী জীবনযাপন এবং তদাপেক্ষা উচ্চাভিলাষী সব মহাপরিকল্পনার ভারে ধুঁকতে থাকা মুঘল সাম্রাজ্যকে আশু পতনের হাত থেকে বাঁচাতে তাকে ক্ষমতাচ্যুত এবং আগ্রা দুর্গে গৃহবন্দী করেন তারই পুত্র আওরঙ্গজেব। পিতা এবং ভাইদের প্রতি কঠোরতা এবং পূর্ববর্তী মুঘলদের তুলনায় অধিক অনমনীয় নীতির জন্য আওরঙ্গজেব নিজেও হয়ত সমালোচনা এড়িয়ে যেতে পারবেন না কখনও। কিন্তু এ ব্যাপারে ঐতিহাসিকদের দ্বিমত নেই যে, তিনিই শেষ গ্রেট মুঘল। কারণ তার মৃত্যুর পর অর্ধ শতাব্দীর মধ্যে বালির বাঁধের মতো ভেঙ্গে পড়েছিল মুঘল সাম্রাজ্য। সে যা-ই হোক, ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আরও ৮ বছর বেঁচে ছিলেন শাহজাহান। সেই বন্দী দিনগুলোতে দুর্গের ছাদ থেকে তিনি দেখতেন তার জীবনের এই শ্রেষ্ঠ কীর্তি। শেষ বিকেলের বিরহ বেলায় তার হৃদয়ে হয়ত বেজে উঠত প্রিয়হারা বেদনার করুণ সুর। যৌবনের প্রেম-ভালবাসায় ভরা জৌলুসের দিনগুলো স্মরণ করে তার চোখ হয়ত ছলছল করে উঠত। মৃত্যুর পর শাহজাহানকে সমাহিত করা হয়েছিল মুমতাজ মহলের সাথে স্বপ্নের তাজমহলের ভেতরে।
হয়ত চারশ বছর আগের একজন সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে চিন্তা করলে মনে হতেই পারে, তাজমহল সাধারণ মানুষের ট্যাক্সের কোটি কোটি টাকার নিদারুণ অপব্যয় ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু আজকে চারশ বছর পর তাজমহল শুধু মুমতাজ মহল ও শাহজাহানের ভালবাসার একক সম্পত্তি নয়, বরং সারা বিশ্বের সৌন্দর্যপিপাসু মানুষের চোখের তৃষ্ণা নিবারক। আর তাই তো প্রতি বছর পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অর্ধ কোটিরও বেশি পর্যটক বেড়াতে আসেন তাজমহলে, আর মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে দেখেন একটি সকাল, একটি গোধূলি কিংবা একটি ভরা জোছনা।
ফিচার ইমেজ- তন্ময় তাহমিদ