ব্রিটিশ সাংবাদিক ও সাহিত্যিক গিলবার্ট কেইথ চেস্টারটন বলেছেন, “Architecture is a very good test of the true strength of a society”। চেস্টারটনের কথাটির সাথে দ্বিমত পোষণ করার কোনো উপায় নেই। একটি অঞ্চলের স্থাপত্য দেখলে খুব সহজেই সে অঞ্চলের সমৃদ্ধি, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি আর রুচিশীলতার পরিচয় পাওয়া যায়। আজ আমরা জেনে নেবো প্রতিবেশী দেশ ভারতের তেমনই কিছু অপূর্ব স্থাপত্য নিদর্শনের কথা। সময়-সুযোগ মিললে ঘুরে আসতে পারেন ঐতিহ্য, সংস্কৃতি আর ইতিহাসের সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা সেসব স্থাপত্যের দুনিয়া থেকে।
১) তাজমহল
পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্যগুলোর মাঝে তাজমহল অন্যতম। এটি একাধারে স্ত্রীর প্রতি সম্রাট শাহজাহানের ভালোবাসা এবং মুঘল স্থাপত্যের অপূর্ব নিদর্শন। ইন্দো-ইসলামিক স্থাপত্য নিদর্শনগুলোর মাঝে তাজমহলকে সেরা মনে করা হয়। প্রতি বছর সারা পৃথিবীর বহু সৌন্দর্যপিপাসু মানুষ তাজমহলকে একনজর দেখার জন্য আগ্রায় পাড়ি জমান। ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্যের আগ্রা জেলায় যমুনা নদীর তীরেই অবস্থিত অপূর্ব সুন্দর এই স্থাপত্য নিদর্শন। তাজমহল মূলত একটি সমাধি প্রাসাদ। সম্রাট শাহজাহান তার প্রিয়তমা স্ত্রী মমতাজ বেগমের স্মৃতিকে অমর করে রাখতে ১৬৩২ খ্রিস্টাব্দে তাজমহল তৈরির কাজ শুরু করেন। ১৬৪৮ সালে এর নির্মাণকাজ শেষ হয়। পরবর্তীতে ১৬৫৩ সালে সৌন্দর্যবর্ধনের অতিথিশালা, প্রাসাদ প্রাঙ্গন, দক্ষিণের মূল ফটক সংযুক্ত করা হয়। কথিত আছে , প্রায় ২০ লক্ষ শ্রমিকের পরিশ্রমের ফসল এই তাজমহল। আবার অনেকে মনে করেন, সম্রাট তাজমহল নির্মাণের পরে নির্মাণ শ্রমিকদের হাত কাটিয়ে ফেলেছিলেন। যদিও এর স্বপক্ষে কোনো যথার্থ প্রমাণ মেলেনি।
উস্তাদ আহমাদ লাহোরি তাজমহলের মূল স্থপতি। তৎকালীন সম্রাটের সমগ্র সাম্রাজ্য, মধ্য এশিয়া এবং ইরানের সেরা চিত্রকর, ক্যালিগ্রাফার, খোদাইকার এবং নির্মাণশিল্পীদের দীর্ঘদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল এই তাজমহল। এর নির্মাণশৈলীতে ইসলামিক ক্যালিগ্রাফি, স্থাপত্যরীতির বেশ ছাপ পাওয়া যায়। তাজমহলে প্রধান চারটি মিনার রয়েছে এবং এর অভ্যন্তরে রয়েছে মমতাজ বেগমের সমাধি, যদিও সেখানে দর্শকদের প্রবেশাধিকার নেই। পরবর্তীতে সম্রাটের মৃত্যুর পর তার শেষ ইচ্ছানুযায়ী তাকে স্ত্রীর সমাধির পাশেই তাকে সমাধিস্থ করা হয়। পর্যটকদের মতে, সূর্যোদয়ের সময়ে এবং সূর্যাস্তের সময়ে তাজমহলের সৌন্দর্য সবচেয়ে ভালো উপভোগ করা যায়। অক্টোবর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত আবহাওয়া শীতল থাকায় এ সময়ে তাজমহল ভ্রমণ করলে রোদের হাত থেকে বাঁচবেন।
যেভাবে যাবেন
বাংলাদেশ থেকে তাজমহল দেখতে যেতে চাইলে রেলপথ হতে পারে দারুণ সহজ এবং সাশ্রয়ী মাধ্যম। তবে ট্রেনের ঝক্কি পোহাতে না চাইলে বিমান পথেও যেতে পারেন। আর হ্যাঁ, তাজমহল গেলে অবশ্যই আগ্রা ফোর্ট, ফতেহপুর সিক্রি, যমুনা নদী, সম্রাট আকবরের সমাধি দেখে আসতে ভুলবেন না। এগুলো খুব কাছাকাছিই অবস্থিত।
২) কোনারকের সূর্যমন্দির
ভারতের ওড়িশা রাজ্যের পুরীর উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত কোনারকের সূর্যমন্দির খুবই বিখ্যাত। মূলত সূর্যদেবতার উদ্দেশ্যে প্রণতি জানাতেই এই মন্দির নির্মাণ করা হয়। এটি প্রাচীন ভারতীয় স্থাপত্যের ঐশ্বর্য এবং রুচিশীলতার এক উজ্জ্বল সাক্ষী। মন্দিরটি প্রায় ২২৮ ফুট উঁচু। ওড়িশার রাজা নরসিংহ দেব ১২৪৩ থেকে ১২৫৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে এই মন্দির নির্মাণ করেন। প্রায় ১,২০০ শ্রমিক টানা ১২ বছরের পরিশ্রমে এই মন্দির গড়ে তোলে। মন্দিরটিকে সূর্য দেবতার রথ ভাবা হত এবং সেই আদলেই এটি তৈরি।
মন্দিরের তিনদিকে সূর্য দেবতার তিনটি প্রতিকৃতি এমনভাবে স্থাপন করা হয়েছে যার উপর সকাল, দুপুর এবং সন্ধ্যাবেলা সূর্যরশ্মি পড়ে। মন্দিরের চারদিকে রয়েছে চারটি দরজা। মন্দিরটি পূর্বমুখী। পূর্বের প্রধান দরজায় রয়েছে বিরাট সিংহমূর্তি। মন্দিরের দুইপাশের দেয়ালে পাথরে খোদাই করে আঁকা হয়েছে ১২টি করে মোট ২৪টি চাকা। চাকাগুলো মূলত সূর্যঘড়ি। প্রতি চাকার ব্যাস ১০ ফুট এবং সাতটি করে ঘোড়া চাকাগুলোকে টানছে। এই সূর্য মন্দিরের জ্যামিতিক নকশা এবং নির্মাণশৈলী দেখলে সে সময়কার মানুষের গাণিতিক জ্ঞান সম্পর্কে ধারণা করে নিতে মোটেও বেগ পেতে হয় না। এছাড়াও মন্দিরের গায়ে রয়েছে দারুণ সব শিল্পকর্ম। ভাস্কর্যের দিক থেকেও মন্দিরটি বেশ সমৃদ্ধ। এই মন্দির পরিদর্শন করে নোবেলজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “এখানে পাথরের ভাষা মানুষের ভাষাকে ছাড়িয়ে গেছে।”
যেভাবে যাবেন
বাংলাদেশ থেকে সরাসরি কলকাতা গিয়ে সেখান থেকে ট্রেনে করে পুরী। পুরী থেকে ওড়িশা ট্র্যাভেল বাসে করে কোনারকের সূর্যমন্দির।
৩) টিপু সুলতানের প্রাসাদ
ব্রিটিশ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে দারুণ প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন মাইসোরের সম্রাট টিপু সুলতান। মাইসোর বর্তমান কর্ণাটক রাজ্যে অবস্থিত। ব্যাঙ্গলোর শহরে রয়েছে টিপু সুলতানের গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ। এটি ফরাসি স্থাপত্যরীতিতে তৈরি একটি কাঠের দোতলা প্রাসাদ। বর্তমানে এটির সাথে একটি ছোট্ট জাদুঘর রয়েছে যাতে সংরক্ষিত আছে সুলতানের ব্যবহৃত তরোয়াল, টাইগার অর্গান সহ বেশকিছু নিদর্শন।
যেভাবে যাবেন
গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ ব্যাঙ্গালোর শহরের ভেতরেই। অটো, উবার বা বাসে করে যেতে পারেন।
৪) খাজুরাহোর ভালোবাসার মন্দির
মধ্যপ্রদেশের অন্তর্গত চত্তরপুর জেলার খাজুরাহো গ্রামটি মন্দিরের জন্য বিখ্যাত। খ্রিস্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতকে খাজুরাহো গ্রামে বহু সংখ্যক মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়। মন্দিরগুলো ইন্দো-আর্য স্থাপত্যরীতির। প্রতিটি মন্দিরের কেন্দ্রস্থলে রয়েছে একজন করে পূজ্য দেবতার প্রতিমূর্তি। বেশিরভাগ মন্দিরই প্রাকৃতিক দুর্যোগ, শত্রুর আক্রমণসহ বিভিন্ন কারণে ধ্বংস হয়ে গেছে। বর্তমানে সর্বসাকুল্যে প্রায় ২০টি মন্দির টিকে আছে।
মিথ প্রচলিত আছে যে, বিধবা ব্রাহ্মণ কন্যা এবং চন্দ্রদেবতার মিলনে জন্ম নেন এক সিংহপুরুষ। নাম রাখা হয় চন্দ্রবর্মণ। চন্দ্রবর্মণকে বলা হয় চান্দেলা রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। চন্দ্রবর্মণ চন্দ্রদেবতার আশীর্বাদে এ অঞ্চলের রাজা হন এবং মায়ের ইচ্ছায় এই মন্দিরগুলো নির্মাণ করেন। মন্দিরগুলোর মধ্যে বিশ্বনাথ মন্দির, জগদম্বি মন্দির, কান্দারি মহাদেব মন্দির ইত্যাদি খুব বিখ্যাত। বিখ্যাত মুসলিম পর্যটক ইবনে বতুতার ভ্রমণ বিবরণীতে এই মন্দিরগুলোর কথা উল্লেখ আছে।
খাজুরাহোকে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত করেছে। প্রতি বছর দেশ বিদেশের বহু পর্যটক খাজুরাহো ভ্রমণে আসেন। শিল্পের দিক থেকে বিবেচনা করলে এই মন্দিরগুলোর মূল্য অসীম। মন্দিরগুলোর গায়ে উৎকীর্ণ আছে অসংখ্য চিত্রকর্ম। চিত্রকর্মগুলোর প্রধান উপজীব্য বিষয় হলো দেবতাদের ভালবাসা। এই জন্যই এখানকার মন্দিরগুলোকে ‘টেম্পল অব লাভ’ বা ‘ভালোবাসার মন্দির’ বলা হয়। খাজুরাহো মন্দির সম্পর্কে প্রচলিত আরেকটি মিথ হলো সন্ধ্যার পর মানুষ এখানে পাথর হয়ে যায়। যদিও এই মিথের কোনো ভিত্তি বা প্রমাণ নেই।
যেভাবে যাবেন
অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি খাজুরাহো ভ্রমণের উপযুক্ত সময়। কেননা এ সময় আবহাওয়া শীতল থাকে। খাজুরাহো যেতে পারেন আকাশ পথে কিংবা ট্রেনে করে। খাজুরাহো বিমানবন্দরটি নিদর্শন স্থান থেকে খুব বেশি দূরে নয়। শহরে পৌঁছে সেখান থেকে ট্যাক্সি বা অটো করে যেতে পারেন। খাজুরাহো গেলে অজয়গড় দুর্গ আর বান্ধবগড় জাতীয় উদ্যান ঘুরে আসতে পারেন। এগুলোর দূরত্ব খাজুরাহো থেকে খুব বেশি দূর নয়।
এছাড়াও ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, কুতুব মিনার, দাক্ষিণাত্যের মহাবলিপুরমের মন্দির, তাঞ্জোরের মন্দির সহ সমগ্র ভারতে আরও অনেক প্রাচীন স্থাপত্য সমৃদ্ধ নিদর্শন রয়েছে। সময় সুযোগ মিলে গেলে ঘুরে আসতেই পারেন।
ভ্রমণ টিপস
ভারতের বেশিরভাগ দর্শনীয় স্থানগুলোতে সার্কভুক্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশীদের জন্য টিকিটের দাম বিদেশিদের তুলনায় কম। একটু খোঁজ রাখুন। ট্র্যাভেল অ্যাপ থেকে জায়গাটি সম্পর্কে আগে থেকে ভালোমতন পড়াশোনা করে যান। কোথায় খাবেন, কীসে চড়ে যাবেন এবং ফিরবেন তা ঠিক করে রাখুন। এতে করে উটকো খরচ এবং ঝামেলা থেকে বাঁচবেন। কোথাও গেলে তার আশেপাশে কী কী দেখার মতো স্থান আছে এবং দূরত্ব কত তা জেনে নিন। এতে করে একসাথে অল্পখরচায় বেশ কিছু জায়গা ঘুরে আসতে পারবেন।