![](https://assets.roar.media/Bangla/2018/05/cabshelter3.jpg?w=1200)
লন্ডনের রাস্তায় হাঁটতে গেলে, হঠাৎ দুয়েকটা সবুজ রঙের ছোট্ট কাঠের ঘর চোখে পড়তে পারে। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই ভেতরে কী আছে। প্রথম দেখায় কুঁড়েঘরের মতো ঘরটিকে দেখে পাবলিক টয়লেট মনে হতে পারে। কেউ কেউ আবার ভাবতে পারেন, এটি হয়তো কোনো পুলিশ বক্স বা ট্রাফিক কন্ট্রোল রুম। কিন্তু আদতে এসব কিছুই না। এই ছোট্ট ঘরগুলো লন্ডনের প্রাচীন ঐতিহ্য গোপনে বয়ে চলেছে যুগের পর যুগ। যারা এই ঘরগুলো সম্পর্কে জানেন না, তাদের কাছে এই ঘরগুলোকে রহস্যময় মনে হতে পারে।
লন্ডনের কালো ট্যাক্সিক্যাব চালকরা (ব্ল্যাক ক্যাব ড্রাইভার বা ব্ল্যাক ক্যাবি) শহরের এই রহস্যময় ঘরগুলোর ঐতিহ্য ধারণ করে চলেছেন প্রায় ১৫০ বছর ধরে। কালো ট্যাক্সিক্যাব ড্রাইভাররা শহরের প্রতিটি অলিগলি, মোড়, লেনের হিসাব কোনো ধরনের নেভিগেটর ছাড়াই মনে রাখতে পারেন। এই রহস্যময় সবুজ ঘরগুলোতে শুধুমাত্র ব্ল্যাক ক্যাবিদের প্রবেশাধিকার আছে। তাই এই ঘরগুলোকে বলা হয় ক্যাবম্যান শেলটার।
![](https://assets.roar.media/Bangla/2018/05/p064pz11-680x365.jpg)
ক্যাবম্যান শেলটারের ভেতরকার চিত্র; Source: Getty Image
ইতিহাস
পুরো লন্ডনে এখন কেবলমাত্র ১৩টি ক্যাবম্যান শেলটার অবশিষ্ট আছে। কিন্তু ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, একসময় পুরো লন্ডন জুড়ে প্রায় ৬০টির মতো ক্যাবম্যান শেলটার ছিল। উনিশ শতকের শেষ দিকে, ক্যাবম্যান শেলটারের ধারণাটি সবার প্রথমে প্রকাশ করেছিলেন গ্লোব পত্রিকার সম্পাদক জর্জ আমস্ট্রং। গ্লোবের সম্পাদক হবার ১ বছর আগে একদিন, প্রচণ্ড তুষারপাতের সময় তিনি রাস্তায় কোনোভাবেই একটা ট্যাক্সি ক্যাব (তৎকালীন ঘোড়া চলিত টমটম গাড়ি) পাচ্ছিলেন না। কারণ টমটম চালকেরা তখন নিকটস্থ কোনো পানশালায় মদের আসরে মশগুল।
মদ্যপান থেকে টমটম চালকদেরকে তাদের কাজে অর্থাৎ রাস্তায় নিয়ে আসার জন্য, জর্জ আমস্ট্রং শ্যাফটব্যুরির কার্লকে সাথে নিয়ে ক্যাবম্যান শেলটার প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৭৫ সালে প্রথম ক্যাবমেন শেলটার এবং ক্যাবম্যান ফান্ড গঠন হবার পর থেকে এখনো, এই ছোট্ট কুটিরগুলো লন্ডনের ব্ল্যাক ক্যাব ড্রাইভারদেরকে সুলভে স্বাস্থ্যকর খাবারের নিশ্চয়তা দিয়ে আসছে।
![](https://assets.roar.media/Bangla/2018/05/http_2F2Fcdn.cnn_.com2Fcnnnext2Fdam2Fassets2F161230162500-cabmans-rest-680x383.jpg)
উনিশ শতকের একটি টমটম ক্যাবম্যান শেলটার; Source: Getty Image
প্রতিটি শেলটারের আয়তন একটি মালবাহী ঘোড়ার গাড়ির সমান। তৎকালীন ট্রাফিক আইনের সাথে সামঞ্জস্যতা বজায় রেখে রাস্তার উপরেই এই ঘরগুলো নির্মাণ করা হয়েছিল। টমটম চালকদেরকে খাবার এবং আশ্রয় দিয়ে; তাদেরকে মদ, জুয়া, নারী থেকে দূরে রাখার জন্যই এই ব্যবস্থার জন্ম। তারপর হঠাৎ শুরু হলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধ।
ঘোড়ার টমটম ক্যাব চালকরা কাজ বন্ধ করে দিলো। ক্যাব ব্যবসায় মন্দা লাগতে শুরু করলো এবং এই শেলটারগুলোও ধীরে ধীরে বন্ধ হতে থাকলো। অনেকটা অব্যবহৃত, অরক্ষিত এবং অবহেলিত এই ক্যাব ড্রাইভার শেলটারগুলোর উপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অনেক ঝড়ঝাপ্টা বয়ে গিয়েছিল। বোমা বিস্ফোরণে কয়েকটি বিধ্বস্ত হয়েছিল। কিছু কিছু আবার নগর পরিকল্পনা এবং রাস্তাঘাট নির্মাণের স্বার্থে ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে।
বর্তমান অবস্থা
অবশিষ্ট ১৩টি মধ্যে কেবল ১০টি শেলটার এখন সক্রিয় রয়েছে এবং প্রতিটি গ্রেড-২ এর অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ এগুলো বিশেষ স্থাপত্য নিদর্শন এবং এদেরকে সংরক্ষণের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। এই কুটিরগুলো এখন ওরশিপফুল কোম্পানি অব হ্যাংকি কেরিজ ড্রাইভার এর অধীনস্থ। এগুলোর দেখাশোনা এবং রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ক্যাবম্যান শেলটার তহবিলের উপর ন্যস্ত রয়েছে। ক্যাবম্যান শেলটার তহবিলের একজন ট্রাস্টি এবং ৪৪ বছর ধরে একজন ক্যাব চালক কলিন্স ইভান অনেকটা বিষণ্ণতা নিয়েই বলেন,
ক্যাব চালানো খুব নিঃসঙ্গতার একটি কাজ। আপনি যদি একজন ক্যাব চালক হন, তাহলে এটি একমাত্র জায়গা যেখানে গিয়ে আপনার ক্যাবি বন্ধুদের (চালকদের) দেখা পাবেন, কথা বলতে পারবেন, দু’দণ্ড জিরিয়েও নিতে পারবেন।
![](https://assets.roar.media/Bangla/2018/05/p064q07h-680x370.jpg)
শেলটারের ভেতরের দেয়ালে ক্যাবম্যান শেলটার ফান্ডের নোটিশ; Source: BBC
ঐতিহ্যগত দিক দিয়ে এই ক্যাবি শেলটারগুলো এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, এদেরকে গ্রেড টু ক্যাটাগরির অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এমনকি এই ছোট্ট কুটিরের রঙ যেন সেই ১৮৭৫ সালে প্রতিষ্ঠিত প্রথম শেলটারের মতো হয় সেদিকে খেয়াল রাখা হয়।
কিন্তু স্থানভেদে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে এই ঐতিহ্যবাহী কুটিরগুলো তাদের নিজস্বতা হারাচ্ছে। কোনো কোনো ক্যাবম্যান শেলটার আবাসিক এবং পার্কিং সীমাবদ্ধতা কারণে বন্ধ হয়ে আছে। চেলসি এমব্যাংকমেন্টের শেলটারটি গত ৫ বছর ধরে বন্ধ হয়ে আছে। ক্যাবম্যান শেলটার তহবিল একে লন্ডন পরিবহন জাদুঘরের অধীনে দেওয়ার কথা ভাবছে।
![](https://assets.roar.media/Bangla/2018/05/cabbie-shelters-in-chelsea-embankment-680x453.jpg)
চেলসি এমব্যাংকমেন্ট এর পরিত্যক্ত ক্যাবম্যানস শেলটার; Source: cabmensshelterfund.weebly.com
যে শেলটারগুলো এখনো পরচালিত হচ্ছে, আবাসিক এলাকায় শব্দ দূষণের দায়ে এগুলো রাত পর্যন্ত খোলা রাখতে পারেন না মালিকেরা। বেশিরভাগ ক্যাব শেলটার সকাল ৭টায় খোলে এবং দুপুর ১টায় বন্ধ হয়ে যায়। ইভান কলিন্স অনেকটা আক্ষেপের সুরেই বলেন,
এই ক্যাবি কুটিরগুলোকে হারিয়ে যেতে দেওয়া তো যাবেই না, বরং এগুলোর ইতিহাস এবং ঐতিহ্যও ভুলে যাওয়া চলবে না। এগুলো অনন্য! এই ছোট্ট ঘরগুলো আপনাকে নিমিষেই অতীত থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসতে পারবে।
খাবারদাবার
বেশিরভাগ শেলটারে সসেজ, বেকন এবং ডিম দিয়ে সকালের নাস্তা পরিবেশন করা হয়। কখনো কখনো বিশেষ উপলক্ষে কেক বা পাস্তা পরিবেশন করা হয়। এসব খাবার শেলটারের মালিক ঘরোয়াভাবে প্রস্তুত করে শেলটারের ভেতর গরম করে তারপর পরিবেশন করেন। ক্যাব ড্রাইভার ব্যতীত এই শেলটারে আর কারো প্রবেশাধিকার নেই। তবে কেউ যদি বিশেষ কোনো নিমন্ত্রণ পেয়ে থাকে তবে তিনি ভেতরে প্রবেশ করতে পারেন এবং যে কেউই শেলটারের বাইরে দাঁড়িয়ে জানালা দিয়ে খাবার কিনতে পারে।
![](https://assets.roar.media/Bangla/2018/05/meat-and-veg-680x383.jpg)
ক্যাবম্যান শেলটারের খাবার, সবজি এবং সসেজ; Source: CNN
রাসেল স্কয়ারের শেলটার ম্যানেজার জুড হোমস বলেন,
আমরা এভাবেই একটু বাড়তি উপার্জন করি। একজন ক্যাবি এক কাপ চা পান করতে করতে আমি শত শত মানুষের কাছে খাবার বিক্রি করতে পারি। তবে আমার এখানে যারা নিয়মিত আসেন, তাদের মধ্যে কেউ একদিন না আসলে আমার দুশ্চিন্তা হয়। আমার মতে, এটি তাদের দ্বিতীয় আবাসস্থল! কেউ কেউ তো এসে নিজেই চা বানিয়ে খায়! তবে নতুন যারা ক্যাব চালায়, তারা ভেতরে আসার ব্যপারে অতটা উৎসাহী নন। তারা বাইরে দাঁড়িয়েই স্যান্ডউইচ অর্ডার করে থাকে।
শেলটারের ভেতরে রান্নাঘরটি খুবই ছোট। বেকন এবং সসেজ ভাজার জন্য একটি স্টোভ, ছোট্ট একটি রেফ্রিজারেটর ভর্তি স্যান্ডউইচ ফিলিং এবং একটি শেলফে ক্যাব ড্রাইভারদের চা পরিবেশন করার জন্য আছে মগ এবং গ্লাস। মগগুলোতে ক্যাব ক্যাব ড্রাইভারদের সমর্থিত প্রিয় ফুটবল ক্লাবের ছবি ও লোগো আঁকা থাকে। যেসব ক্যাব ড্রাইভার নিয়মিত আসেন তাদের কাছে ক্যাবম্যান শেলটার পরিবারেরই একটি অংশ। ওয়ারিক এভেনিউর পরিচালক ট্রেসি বলেন,
ওরা আমাকে ওদের বড় বোনের মতো সম্মান করে। আমি যদি কোনোদিন অসুস্থ থাকি তাহলে আমাকে প্রায় ২০ জনকে জানাতে হয় যে, সেদিন শেলটার বন্ধ থাকবে। তারা অগত্যা শেলটার বন্ধ দেখলে খুব বিচলিত বোধ করে।
![](https://assets.roar.media/Bangla/2018/05/image-2-680x383.jpg)
ভেতরে ক্যাব ড্রাইভারদের প্রিয় ফুটবল দলের লোগো আঁকা মগ; Source: unusualplaces.org
বেশিরভাগ ড্রাইভারই ক্যাব চালনো ছাড়াও অন্য কাজ করে থাকেন। কেউ হয়তো অভিনেতা, কেউ শ্যুটার, কেউ ব্যবসায়ী, এমনকি টিভি প্রযোজকও আছেন এই তালিকায়। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে তাদের আসল পরিচয় তারা ক্যাবি (ব্ল্যাক ক্যাব ড্রাইভার)। একবার যিনি ক্যাবি হিসেবে নাম লিখিয়েছেন, তিনি আজীবন একজন ক্যাবি। ক্যাব চালনা থেকে অবসর নেওয়া মানেই একপ্রকার নিজেরই অস্তিত্ব হারানো।
স্মৃতিময় ক্যাবম্যানস শেলটার
এই সবুজ ছোট্ট চার দেয়ালের ঘরে সত্যি সত্যি অনেক গল্প, অনেক ইতিহাস আবদ্ধ হয়ে আছে। গ্লুচেস্টারের শেলটারটিকে ‘ক্রেমলিন’ নামে ডাকা হতো। কারণ এই শেলটারে একসময় প্রচুর বামপন্থী চালক আসতেন। গঠনগত দিক দিয়েও এই শেলটারগুলো ব্রিটিশদের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যকে বয়ে বেড়াচ্ছে। ঘরগুলোর নিচের দিকে খুঁটি দেখা যায়, এই খুঁটিতে তৎকালীন টমটম চালকেরা ঘোড়া বেঁধে ভেতরে প্রবেশ করতো। পাখিদের পানি পানের জন্য যে মার্বেল পাত্র রাখা হয়েছিল, সেগুলো এখন কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। শেলটারের ছাদের দিকে এখনো চিমনি দেখা যায়, পূর্বে খাবার গরম করার জন্য যে কয়লার চুলা ব্যবহার হতো, সেই চুলার ধোঁয়া এই চিমনি দিয়ে বের হয়ে যেত। কখনো কখনো বিখ্যাত ব্যক্তিরাও এখানে খাবার নিতে আসতেন। ওয়ারিক এভেনিউ শেলটারের পরিচালক ট্রেসি ট্রাকার বলেন,
ব্রিটিশ রক গায়ক এবং দ্য জ্যাম ব্যান্ডের ভোকালিস্ট পল ওয়াকার, প্রায়ই এখানে এসে, বাইরের জানালা দিয়ে সসেজ এবং ডিম স্যান্ডউইচ নিয়ে যেতেন।
![](https://assets.roar.media/Bangla/2018/05/take-away-from-cabmen-shelter-dm-680x458.jpg)
লাইন ধরে জানালা দিয়ে ক্যাবম্যান শেলটার থেকে খাবার কিনছেন সাধারণ জনগণ; Source: Getty Image
এই ছোট্ট চার দেয়ালের ভেতরেও কিছু জীবন চলছে, কিছু জীবন জীবিকা খুঁজে পাচ্ছে; আর কিছু জীবন খুঁজে পাচ্ছে স্বস্তি, বন্ধু এবং অবসরের রসদ। এই কুটিরগুলো শুধুমাত্র সাধারণ কোনো স্থাপনা নয়, নয় কোনো সাধারণ প্রতিষ্ঠান। এগুলো লন্ডনের বর্ণাঢ্য ইতিহাসের অংশ। এই ক্যাবম্যান শেলটার যদি কখনো হারিয়ে যায়, তাহলে লন্ডনের ঐতিহ্য এবং ইতিহাসের একটি অংশ ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে যাবে।
এই ক্যাবম্যান শেলটারগুলো যারা চালান, তারাও এই ছোট্ট ঘরের প্রতি অনেক বেশি আবেগী এবং কাজের প্রতি অনেক বেশি নিবেদিতপ্রাণ। তারা সকলেই বুঝতে পারেন, তাদের এই ব্যবসা হয়তো আর বেশিদিন চলবে না। কিন্তু তবুও তারা চালিয়ে নিচ্ছেন। এই ক্যাবম্যান শেলটারগুলো বন্ধ হয়ে গেলে হয়তো তারা অন্য কোনো কাজ নেবেন, কিন্তু তাদের চিন্তা-চেতনায় সবসময় এই রহস্যময় কুটিরগুলো থেকে যাবে বছরের পর বছর।