আলাদিন (বা আলাউদ্দিন) এবং তার আশ্চর্য প্রদীপের গল্প কে না জানে? আরব্য রজনীর রোমাঞ্চকর এই গল্পটি আমাদের প্রত্যেকের ছোটবেলার স্মৃতির সঙ্গে গেঁথে আছে। আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের ইচ্ছেপূরণ দৈত্য আলাদিনের জন্য একটি মনোরম প্রাসাদ তৈরি করে দিয়েছিল। আলাদিন বসবাস করত চীনে, তাই সেই প্রাসাদটিও ছিল চীনে। বাস্তবে চীনে সেরকম কোনো স্থাপনা নেই। কিন্তু আরব্য রজনীর যে উৎপত্তিস্থল, সেই আরবের মরুভূমির মাঝে সত্যি সত্যিই নির্মিত হচ্ছে এক রূপকথার স্থাপনা, যার নাম ‘আলাদিন সিটি’ বা ‘আলাদিনের শহর’। প্রশ্ন হচ্ছে, কোথায় তৈরি হচ্ছে রূপকথার সেই স্বপ্নপুরী?
সংযুক্ত আরব আমিরাত (আরবি ভাষায় সংক্ষিপ্ত নাম: আল–ইমারাত বা ইমারাত) পশ্চিম এশিয়ার অন্যতম একটি সমৃদ্ধ রাষ্ট্র। খনিজ তেলসমৃদ্ধ রাষ্ট্রটির অর্থনীতির চালিকাশক্তি তেল, কিন্তু রাষ্ট্রটি তেলের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে অর্থনীতির অন্যান্য খাতের উন্নয়নের প্রতি মনোনিবেশ করেছে। এর একটি খাত হচ্ছে পর্যটন শিল্প, আর ইমারাতের পর্যটন শিল্পের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে দুবাই।
দুবাই ইমারাতের সবচেয়ে জনবহুল নগরী এবং ইমারাতের সাতটি আমিরাতের মধ্যে একটির, অর্থাৎ দুবাই আমিরাতের রাজধানী। নান্দনিক শিল্পশৈলীতে নির্মিত বিচিত্র সব স্থাপত্যকীর্তির জন্য দুবাই বিশ্ববিখ্যাত। বিশ্বের দীর্ঘতম ভবন বুর্জ খলিফা, বিশ্বের একমাত্র ‘সাত–তারকা হোটেল’ হিসেবে পরিচিত বুর্জ আল–আরব, নিকটবর্তী পারস্যোপসাগরে অবস্থিত কৃত্রিমভাবে নির্মিত পাম দ্বীপপুঞ্জ, বিশ্বের বৃহত্তম প্রাকৃতিক বাগান ‘দুবাই মিরাকল গার্ডেন’, বিশ্বের তৃতীয় দীর্ঘতম চালকবিহীন মেট্রোরেল ‘দুবাই মেট্রো’– কী নেই সেখানে? যেন আরব্য রজনীর আধুনিক এক সংস্করণ হিসেবে দুবাইকে গড়ে তুলতে ইমারাতের শেখরা বদ্ধপরিকর। এই দুবাইয়েই আরব্য রজনীর গল্পের অনুকরণে নির্মিত হতে যাচ্ছে দৃষ্টিনন্দন ‘আলাদিন সিটি’!
দুবাই শহর কর্তৃপক্ষ ২০১৪ সালে এই স্থাপনাটি তৈরি করার অনুমতি প্রদান করে এবং ২০১৬ সালের শেষভাগে স্থাপনাটির নির্মাণ কাজ আরম্ভ হয়। স্থাপনাটি নির্মিত হচ্ছে ঐতিহাসিক দুবাই খাঁড়ির নিকটে ৪,০০০ একর বিস্তৃত একটি স্থানে। দুবাই খাঁড়ি ইমারাতের একটি ঐতিহাসিক অঞ্চল, যেখানে এখনও কাঠের তৈরি পালতোলা নৌকা চলে এবং যেখানে বণিকরা পণ্য বিনিময় করে। উল্লেখ্য, ঐতিহাসিক দুবাই খাঁড়ি অঞ্চলটি ইউনেস্কোর কাছ থেকে ‘বিশ্ব ঐতিহ্য’ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, কিন্তু ‘আলাদিন সিটি’ যে স্থানে নির্মিত হচ্ছে, সেই স্থানটি দুবাই খাঁড়ির কাছাকাছি হলেও এ অঞ্চলের অন্তর্গত নয়।
নির্মাণাধীন আলাদিন সিটিতে ছ’টি সুবৃহৎ টাওয়ার থাকবে। এদের মধ্যে তিনটি টাওয়ারের আকৃতি হবে আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের অনুরূপ। এই টাওয়ার তিনটি হবে যথাক্রমে ৩৪, ২৬ এবং ২৫ তলাবিশিষ্ট। আলাদিনের জাদুকরি গালিচার পরিবর্তে টাওয়ারগুলো পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে একটি ৪৫০ মিটার দীর্ঘ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পথচারী সেতু এবং হাঁটাপথের মাধ্যমে। পথচারী সেতু এবং হাঁটাপথগুলোর আকৃতি হবে রূপকথার গল্পে বর্ণিত ড্রাগন এবং অন্যান্য সরীসৃপ জাতীয় প্রাণীর মতো।
আলাদিন সিটির টাওয়ারগুলোর মধ্যে একটিতে হোটেল এবং অন্য টাওয়ারগুলোতে বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় স্থাপিত হবে। ইমারাতের বাণিজ্যিক হৃদভূমি দুবাইয়ের একটি সম্প্রসারিত অংশ হবে এই আলাদিন সিটি। এখানে থাকবে একটি সুপ্রশস্ত পার্কিং লট, যেখানে ৯০০ গাড়ি অনায়াসে রাখা যাবে। পুরো স্থাপনাটির আয়তন হবে ১ লক্ষ ১০ হাজার বর্গ মিটার।
দুবাই নগর কর্তৃপক্ষ আলাদিন সিটির নকশা প্রণয়নের জন্য তিনটি কোম্পানিকে বাছাই করেছিল। এদের মধ্যে সিঙ্গাপুর–ভিত্তিক নির্মাণ প্রকৌশল কোম্পানি মেইনহার্ডট গ্রুপকে এ কাজের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। প্রাথমিকভাবে এই প্রকল্পের জন্য কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় হবে, সেটি প্রকাশ করা হয় না হলেও পরবর্তী সময়ে জানানো হয়েছে, আলাদিন সিটি নির্মাণে সর্বমোট ব্যয় হবে ১.৮৩৫ বিলিয়ন (বা ১৮৩ কোটি ৫০ লক্ষ) আমিরাতি দিরহাম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রায় যার মান প্রায় ৫০০ মিলিয়ন (বা ৫০ কোটি) মার্কিন ডলার, আর বাংলাদেশি মুদ্রায় যার মান প্রায় ৪,২২৫ কোটি টাকা। আলাদিন সিটির নির্মাণব্যয় পৃথিবীর আটটি ছোট ছোট রাষ্ট্রের মোট বাৎসরিক আয়ের চেয়ে বেশি!
রূপকথার আদলে নির্মাণাধীন এই স্থাপনাটির নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৮ সালের শেষার্ধে। কিন্তু নানা কারণে সেটি সম্ভব না হওয়ায় ২০২০ সালের অর্থাৎ বর্তমান বছরের শেষার্ধে এটির নির্মাণকাজ শেষ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তবে সাম্প্রতিক কোভিড-১৯ মহামারিতে পশ্চিম এশিয়ার অন্যান্য রাষ্ট্রের মতো ইমারাতও আক্রান্ত হয়েছে, যদিও সেখানে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম (এই নিবন্ধ লেখার সময় পর্যন্ত ইমারাতে কোভিড-১৯ আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা ৬,৭৮১ জন এবং আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করা ব্যক্তির সংখ্যা ৪১ জন)। ধারণা করা যায়, কোভিড-১৯ মহামারির কারণে আলাদিন সিটির নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার চূড়ান্ত সময়সীমা আরো পিছিয়ে যেতে পারে।
পর্যটনশিল্পে দুবাই ইতোমধ্যে ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে। রূপকথার আলোকে নির্মিত অনিন্দ্যসুন্দর আলাদিন সিটি এই সাফল্যের মাত্রাকে আরো উচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাবে, বলাই বাহুল্য। পাঠক কি যাবেন, মরুর বুকে আরব্য রজনীর রূপকথার স্বপ্নকে বাস্তবে অনুভব করতে?