বুয়েট, বাংলাদেশের বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের অনেকের জন্য এক স্বপ্নের নাম, বিশেষ করে যারা প্রকৌশল ও স্থাপত্যবিদ্যা পড়তে চায় তাদের জন্য। বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই কোনো না কোনো বুয়েটিয়ানের পদচারণা রয়েছে। দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশেও বুয়েটের অ্যালামনাইরা তাদের মেধা আর মননের পরিচয় দিয়ে গিয়েছেন এবং যাচ্ছেন। আজকের এই বুয়েট কিন্তু একদিনে গড়ে ওঠেনি। আজকের অবস্থানে আসতে বুয়েট পাড়ি দিয়েছে অনেকটা পথ। সে চলার পথে এসেছে নানারকম পরিবর্তন, এসেছে নানা প্রতিকূলতা। কিন্তু সবকিছুকেই জয় করে বুয়েটিয়ানরা উড়িয়ে চলেছে তাদের বিজয়কেতন। চলুন জেনে নেয়া যাক বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষ এই বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে।
শুরুর কথা
বুয়েটের যাত্রাটা বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে শুরু হয়নি, বরং এর শুরুটা ছিল একটি সার্ভে স্কুল হিসেবে। ১৮৭৬ সালে ব্রিটিশ ভারতের বাংলা প্রদেশের সরকার পুরান ঢাকার নালগোলায় প্রতিষ্ঠা করে ‘ঢাকা সার্ভে স্কুল’। মূলত বাংলা অঞ্চলে ভূমি জরিপকারী তৈরি করাই ছিল এ স্কুলের মূল লক্ষ্য। সেসময় দু বছরের কোর্সে ভর্তি হতো ছাত্ররা। বিংশ শতাব্দীর শুরুতেই ঢাকার নবাব পরিবারের খাজা আহসানউল্লাহ এই সার্ভে কলেজে বেশ বড় অংকের অনুদান দেন। তার মৃত্যুর পর তার ছেলে খাজা সলিমুল্লাহও অনুদান দেয়া বন্ধ করেননি। মূলত তাদের প্রচেষ্টাতেই ১৯০৮ সালে ঢাকা সার্ভে স্কুল পরিণত হয় আহসানউল্লাহ স্কুল অব ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। খাজা আহসানউল্লাহর অবদানের কারণেই এই নামকরণ হয়। সিভিল, ইলেক্ট্রিক্যাল ও মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে তিন বছরের ডিপ্লোমা কোর্স চালু হয় সেসময় থেকে।
১৯১২ সালে পুরান ঢাকা থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলের ক্যাম্পাস আসে বর্তমান পলাশীর ক্যাম্পাসে। ১৯৩৮ সালে হাকিম আলী এই স্কুলের প্রিন্সিপাল হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা চলে যাবার পর আহসানউল্লাহ স্কুল অব ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে পরিণত হয় আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ হিসেবে। হাকিম আলীই হন এ কলেজের প্রথম প্রিন্সিপাল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল অনুষদের অধীনে থাকা এ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে চালু হয় চার বছরের বিএসসি কোর্স। সিভিল, ইলেক্ট্রিক্যাল, মেকানিক্যাল, কেমিক্যাল ও মেটালার্জিক্যাল- এ পাঁচটি বিভাগ ছিল সেসময়।
১৯৫১ সালে প্রিন্সিপাল হন টিএইচ ম্যাথিউম্যান। মাত্র তিন বছর পরেই তার স্থলাভিষিক্ত হন ড. এম. এ. রশীদ। তিনি ছিলেন এ কলেজের প্রথম বাঙালি প্রিন্সিপাল। ১৯৫৪ সাল থেকে পরের ১৬ বছর তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বেই আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ এগিয়ে গেছে দেশের অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয় হবার পথে। ১৯৫৬ সালে পুরাতন পাঠ্যসূচি পাল্টে নতুন পাঠ্যসূচি চালু হয় কলেজে।
উচ্চতর শিক্ষা এবং গবেষণার লক্ষ্যে পাকিস্তান সরকার ১৯৬২ সালে আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজকে পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করে। ১৯৬২ সালের ১ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আলাদা হয়ে পথ চলা শুরু হয় ইস্ট পাকিস্তান ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজির (ইপুয়েট)। এ দিনটিকেই বুয়েটের জন্মদিন হিসেবে পালন করা হয় প্রতিবছর। সার্ভে স্কুল থেকে পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হতে পাড়ি দিতে হয় ৮৬ বছর। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর ইপুয়েটের ইস্ট পাকিস্তান বদলে হয় বাংলাদেশ, ইপুয়েট পরিণত হয় বুয়েটে। প্রায় একশ বছর আগে প্রতিষ্ঠা হওয়া সার্ভে স্কুলটি পরিণত হয় সদ্য স্বাধীন একটি দেশের প্রকৌশল ও স্থাপত্যবিদ্যার অগ্রপথিক। আজ থেকে প্রায় একশত চল্লিশ বছর আগের ছোট্ট স্কুলটি আজ পরিণত হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে, যা মুখরিত থাকে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার ছাত্র-ছাত্রীর কলকাকলিতে।
অনুষদ ও বিভাগসমূহ
১৮৭৬ সালে শুধুমাত্র জরিপ কাজের সুবিধার্থে চালু হলেও সময় ও প্রয়োজনের খাতিরে বুয়েটে যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন বিভাগ। বর্তমানে পাঁচটি অনুষদের অধীনে রয়েছে মোট ১৮টি বিভাগ। অবশ্য এই ১৮টি বিভাগের সবগুলোতেই স্নাতক পর্যায়ে ভর্তি করানো হয় না। স্নাতক পর্যায়ে ১২টি বিভাগে ছাত্র-ছাত্রীরা ভর্তি হতে পারে এবং স্নাতকোত্তর পর্যায়ের জন্য স্নাতক পর্যায়ের বিভাগগুলো ছাড়াও আরো পাঁচটি বিভাগ এবং কয়েকটি ইন্সটিটিউটে ছাত্র-ছাত্রীরা ভর্তি হতে পারে। অনুষদ অনুসারে বুয়েটের বিভাগগুলো জেনে নেয়া যাক:
- Faculty of Architecture and Planning
- Department of Architecture (Arch)
- Department of Urban and Regional Planning (URP)
- Department of Humanities (Hum)
- Faculty of Civil Engineering
- Department of Civil Engineering (CE)
- Department of Water Resources Engineering (WRE)
- Faculty of Engineering
- Department of Chemical Engineering (ChE)
- Department of Materials and Metallurgical Engineering (MME)
- Department of Chemistry (Chem)
- Department of Mathematics (Math)
- Department of Physics (Phys)
- Department of Petroleum and Mineral Resources Engineering (PMRE)
- Department of Glass and Ceramic Engineering (GCE)
- Faculty of Electrical and Electronic Engineering
- Department of Electrical and Electronic Engineering (EEE)
- Department of Computer Science and Engineering (CSE)
- Department of Biomedical Engineering (BME)
- Faculty of Mechanical Engineering
- Department of Mechanical Engineering (ME)
- Department of Industrial and Production Engineering (IPE)
- Department of Naval Architecture and Marine Engineering (NAME)
এ আঠারোটি বিভাগের মধ্যে Humanities বিভাগে কোনো পর্যায়েই ছাত্ররা ভর্তি হতে পারে না। গণিত, পদার্থ, রসায়ন, গ্লাস ও সিরামিকস ইঞ্জিনিয়ারিং এবং পেট্রোলিয়াম ও মিনারেল রিসোর্স ইঞ্জিনিয়ারিং- এ পাঁচটি বিভাগে শুধুমাত্র স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ভর্তি হওয়া যায়। অন্য বিভাগগুলোতে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ভর্তি হওয়া যায়। অবশ্য সম্প্রতি চালু হওয়া বায়োমেডিক্যাল বিভাগে এখনো স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ভর্তি চালু হয়নি।
বুয়েটের প্রতিটি ডিপার্টমেন্টের রয়েছে নিজস্ব স্বকীয়তা, রয়েছে নিজস্ব ঐতিহ্য। ১৯৪৭ সালে যখন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পরিণত হয় তখন বিভাগ ছিল মাত্র পাঁচটি, সেখানে আজ রয়েছে ১৮টি, যার মধ্যে ১৪টিই প্রকৌশল কিংবা স্থাপত্যবিদ্যার। সময়ের সাথে সাথে যুক্ত হয়েছে নতুন বিভাগ আবার অনেক বিভাগের নাম পাল্টে গিয়ে হয়েছে আরো আধুনিক।
গবেষণার জন্য বুয়েটে রয়েছে বেশ কয়েকটি ইন্সটিটিউট। স্নাতকোত্তর পর্যায়ের ছাত্র-ছাত্রীরা এগুলোতে ভর্তি হতে পারে। বুয়েটের ইন্সটিটিউটগুলো হলো:
- Institute of Water and Flood Management (IWFM)
- Institute of Appropriate Technology (IAT)
- Institute of Information and Communication Technology (IICT)
- Accident Research Institute (ARI)
- BUET-Japan Institute of Disaster Prevention and Urban Safety (BUET-JIDPUS)
- Institute of Nuclear Power Engineering (INPE)
বুয়েট ক্যাম্পাস
বুয়েটে ঢোকার মুখেই রয়েছে বুয়েটের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। প্রধান ফটক দিয়ে সামনে এগুলো হাতের ডানদিকে পড়বে ইএমই ও সিভিল বিল্ডিং। একটু এগুলেই বামদিকে চোখে পড়বে অডিটোরিয়াম আর ক্যাফেটেরিয়া। সেইসাথে বুয়েটের বিখ্যাত হাফ ওয়ালের বসা শিক্ষার্থীদের কোলাহল। বুয়েট ক্যাম্পাসের প্রাণকেন্দ্র এই অডিটোরিয়াম আর ক্যাফেটেরিয়ার প্রাঙ্গণ। ক্যাফেটেরিয়ায় ঢোকার পথে হাতের ডানদিকে দেখতে পাবেন মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুয়েটিয়ানদের নামের তালিকা। ক্যাফেটেরিয়ার ঠিক পাশেই রয়েছে বুয়েটের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরী।
মূল ফটক থেকে ক্যাফেটেরিয়ার সামনে দিয়ে এগিয়ে গেলে বাম দিকে চোখে পড়বে আর্কিটেকচার বিল্ডিং আর ডান দিকের রাস্তা দিয়ে এগুলে বামদিকে পাবেন ‘বুয়েটের গোলকধাঁধা’ নামে পরিচিত ওল্ড একাডেমিক বিল্ডিং বা ওএবি। আর্কিটেকচার বিল্ডিংয়ের সাথেই রয়েছে ইউআরপি বিল্ডিং। ওএবির ঠিক সামনে রয়েছে মেশিন শপ। পলাশীর পশ্চিম প্রান্তে রয়েছে ইসিই বিল্ডিং। পলাশীতে অবস্থিত হবার কারণে এই ক্যাম্পাসটি বুয়েটের ছাত্রদের কাছে ‘পুয়েট ক্যাম্পাস’ নামে পরিচিত।
দাপ্তরিক কাজের জন্য রয়েছে রেজিস্টার ভবন, যা ড. এম. এ. রশীদ ভবন নামে পরিচিত। এছাড়াও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এবং এ সংক্রান্ত আলাদা একটি ভবনও রয়েছে। রেজিস্টার ভবনের সাথেই আছে বুয়েটের উপাচার্যের বাসভবন। ক্যাম্পাসের পেছন দিকে রয়েছে ছাত্র কল্যাণ সংস্থার অফিস আর খেলার মাঠ। এসব ছাড়াও বুয়েটের নিজস্ব মেডিকেল সেন্টার রয়েছে, যেখানে শিক্ষার্থীরা বিনা পয়সায় চিকিৎসা সেবা ও ওষুধ নিতে পারে। বর্তমানে সেখানে কিছু প্যাথোলজিকাল পরীক্ষাও বিনা পয়সায় করিয়ে নিতে পারে শিক্ষার্থীরা। মেডিকেল সেন্টারে যাবার আগেই হাতের ডানদিকে পড়বে বুয়েটের সাব পোস্ট অফিস। স্মার্টফোনের যুগে যদিও চিঠি কেউ লেখে না, তবুও অনেক দাপ্তরিক কাজে অল্প খরচে কাজ করার জন্য বেশ ভালো জায়গা এই পোস্ট অফিস।
বুয়েট মাঠের উল্টো দিকে রয়েছে শিক্ষকদের একটি কোয়ার্টার। মূল ক্যাম্পাসের রাস্তার উল্টো দিকে রয়েছে বুয়েটের ছাত্রাবাসগুলো, রয়েছে কেন্দ্রীয় মসজিদ এবং শিক্ষকদের আরো একটি কোয়ার্টার। কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশেই রয়েছে বুয়েটের স্টাফদের কোয়ার্টার।
হল লাইফ
বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে হল। অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতোই বুয়েটেরও রয়েছে বেশ কয়েকটি হল। স্নাতক পর্যায়ের ছাত্রদের জন্য রয়েছে ছয়টি হল, স্নাতকোত্তর পর্যায়ের ছাত্রদের জন্য রয়েছে একটি হল। ছাত্রীদের জন্য রয়েছে একটি হল। বর্তমানে ছাত্রীদের জন্য ১২ তলা নতুন একটি হলের নির্মাণকাজ চলছে। ছাত্রীহলের আলাদা কোনো নাম না থাকলেও ছাত্রহলগুলো বাংলাদেশের বিভিন্ন বিখ্যাত ব্যাক্তিদের নামে নামকরণ করা হয়েছে।
নবাব আহসানউল্লাহ অবদানের কারণে এখনো বুয়েটের একটি হলের নাম রয়েছে আহসানউল্লাহ হল। এছাড়াও ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনকারী তিতুমীর, বাংলার দুই বিখ্যাত রাজনীতিবিদ শের-ই-বাংলা ও সোহরাওয়ার্দী হল, রয়েছে নজরুল ইসলাম হল। বুয়েটের প্রথম ভিসি ড. এম. এ. রশীদের নামের রয়েছে ড. এম. এ. রশীদ হল। এছাড়াও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের হলটির নাম শহীদ স্মৃতি হল।
বুয়েটের তিতুমীর হলের সাথে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের প্রথম পতাকা তৈরির গর্বের ইতিহাস। পাকিস্তান আমলে তিতুমীর হলের নাম ছিল কায়েদ-এ-আজম হল। বাংলাদেশের প্রথম পতাকায় সবুজ আর লাল ছাড়াও ছিল হলুদ রঙের মানচিত্র। সবুজের মাঝে লাল বৃত্তের পতাকা তৈরি হবার পর ইউসুফ সালাউদ্দিন আহমেদ এবং হাসানুল হক ইনু কায়েদে আজম হলের (বর্তমান তিতুমীর হল) ৩১২ নং কক্ষের এনামুল হকের কাছ থেকে মানচিত্রের বই নেন এবং তারা ট্রেসিং পেপারে পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র আঁকেন। ছাত্রনেতা শিবনারায়ণ দাস অতঃপর হলুদ রং এবং ম্যাচের কাঠি ব্যবহার করে মানচিত্রটি পতাকার লাল বৃত্তের মাঝে আঁকেন। এভাবেই প্রস্তুত হয় বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় পতাকা, যা কিনা ১৯৭১ সালের ২রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় প্রথম উত্তোলিত হয়।
হল লাইফের অন্যতম আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে কারণে-অকারণে বাইরে খেতে যাওয়া। দিনে বা রাতে যখনই হোক না কেন, চাঁনখারপুল আর পুরান ঢাকার রেস্টুরেন্টগুলোতে গেলে কোনো না কোনো পরিচিত মানুষের সাথে দেখা হবেই।
ক্যাম্পাস লাইফ
বুয়েটের বাইরের বেশিরভাগ মানুষের ধারণা বুয়েটের ছেলেমেয়েরা সারাদিন ক্লাস করে আর ক্লাসের পর হলে বা বাসায় ফিরে পড়াশোনা করে! এককথায় বলতে গেলে, মানুষের ধারণা বুয়েটের ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা ছাড়া আর কিচ্ছু বোঝে না। কিন্তু ক্লাস চলার সময়ে ক্যাম্পাসে পা দিলে আপনার ধারণা পাল্টে যেতে বাধ্য। পুরো ক্যাম্পাস মেতে আছে নানা উৎসবে। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে ক্যাফেটেরিয়া, অডিটোরিয়ামের সামনে আড্ডা, র্যাগ কর্নারের গান কিংবা কোনো বিভাগ বা ক্লাবের কোনো ফেস্টিভাল লেগেই রয়েছে, বিশেষ করে বুধবারে। ক্যাফেটেরিয়ার দেয়াল আর র্যাগ কর্নারের আঁকা ছবি আপনাকে মুগ্ধ করেই ছাড়বে। ভাগ্যে থাকলে ফ্ল্যাশ মবের সামনেও পড়ে যেতে পারেন। ক্যাফেটেরিয়ার সামনে হাফ ওয়ালে বসে থাকতে দেখবেন অনেককেই। এই হাফ ওয়ালেই রচিত হয় বুয়েটের অসংখ্য গল্প, যার অনেকগুলোই হয়তো আমরা জানতেও পারি না।
র্যাগ কর্নারের কথা আলাদা করে বলতেই হয়, কেননা অনেকেই নাম শুনে ভুল বোঝে যে এখানে নবাগতদের র্যাগ দেয়া হয়। কিন্তু মজার ব্যাপার এটি আসলে সবচেয়ে সিনিয়র ব্যাচের অর্থাৎ র্যাগ ব্যাচের ছাত্র-ছাত্রীদের নিজেদের আলাদা একটি জায়গা। প্রতিটি সিনিয়র ব্যাচ নিজেদের মতো করে ক্যাফেটেরিয়ার সামনের অংশটি সাজিয়ে নেয়, রাঙিয়ে দেয় ক্যাফেটেরিয়ার দেয়ালটি নিজেদের রঙে। বুয়েটের প্রতিটি ছাত্রছাত্রীর কাছে র্যাগ কর্নার একটি আবেগের নাম।
বুয়েটের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হচ্ছে বিভিন্ন বিভাগের বা ক্লাবের নিজস্ব অনুষ্ঠান। বুয়েটের ‘পড়ুয়া’ ছেলেমেয়েগুলো পড়াশোনার বাইরেও নাচ, গান, অভিনয় সহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডেও নিজেদের মেলে ধরে। প্রতিটি বিভাগের অনুষ্ঠান যেন অন্যদের হারিয়ে দেয়ার প্রতিযোগিতা, প্রতিবছরের অনুষ্ঠানগুলো যেন আগের বছরেরগুলোকে হারানোর প্রতিযোগিতা। সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের বাইরেও বিভিন্ন ক্লাবের উদ্যোগে বিভিন্ন কর্মশালাও হয়ে থাকে। বুয়েটের ক্লাবগুলো, বিশেষ করে ডিবেটিং ক্লাব, অনেকগুলো পুরষ্কার জিতেছে। ফটোগ্রাফি, শর্ট ফিল্ম, ছবি আঁকার মতো কাজগুলোও বুয়েটিয়ানরা এখন বেশ ভালোই করছে। বুয়েটের সেলফ ডিফেন্স ক্লাব বুয়েটের শিক্ষার্থীদের কারাতে, জুডোর মতো দরকারি শিক্ষার ব্যবস্থাও করেছে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা শিক্ষার্থীদের এলাকাভিত্তিক কিছু সংগঠন রয়েছে, যারাও অনেক অনুষ্ঠান করে থাকে। গত কয়েক বছর ধরে হলগুলোতেও শুরু হয়েছে অনুষ্ঠান। এখন এমন দিনও যায়, যেদিন একদিনে একাধিক অনুষ্ঠান থাকে বুয়েটে! বুয়েটের আরেকটি আকর্ষণ হচ্ছে সিনিয়র ব্যাচের শেষ সপ্তাহের র্যাগ কনসার্ট। প্রতিটি র্যাগ কনসার্টেই দেশের বিভিন্ন নামিদামি ব্যান্ড এসে মাতিয়ে দেয় ক্যাম্পাস। তবে র্যাগ কনসার্টগুলো শেষ হয় তুহিনের ‘ক্যাফেটেরিয়া’ আর ‘পুরোনো সেই দিনের কথা’ গানের সাথে কাঁদতে কাঁদতে। বিদায়ী ব্যাচের সাথে জুনিয়র আর অ্যালামনাইদেরও চোখও সেদিন ছলছল করে ভবিষ্যৎ কিংবা অতীতের কথা ভেবে। স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, নববর্ষে ক্যাম্পাস এক অন্য রঙ ধারণ করে। এসব দিবস উপলক্ষে নানারকম আয়োজন হয়ে থাকে বুয়েটে। বর্তমান ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের মিলনমেলায় পরিণত হয় ক্যাম্পাস।
বুয়েটে রয়েছে খেলাধুলারও বেশ ভালো সুযোগ। দাপ্তরিকভাবে ক্রিকেট, হকি, ফুটবল, বাস্কেটবল, ব্যাডমিন্টন প্রতিযোগিতা প্রতিবছরই হয়। এর বাইরেও বিভিন্ন বিভাগের নিজেদের খেলা থাকে, সিনিয়র ব্যাচের নিজেদের ক্রিকেট, ফুটবল টুর্নামেন্ট হয়। প্রায় প্রতিদিনই বুয়েট মাঠে আর ক্যাফেটেরিয়ার সামনে কোনো না কোনো খেলা লেগেই থাকে। রাতের অন্ধকারও বুয়েটিয়ানদের খেলাধুলা আটকে রাখতে পারে না। আলোর ব্যবস্থা করে শীতকালে ব্যাডমিন্টন তো রয়েছেই, হলের সামনে বা পাশের ফাঁকা জায়গায় ক্রিকেট টুর্নামেন্ট পর্যন্ত হয় রাতে! হলগুলোর কমনরুমে টেবিল টেনিস তো প্রায় চব্বিশ ঘন্টাই লেগে থাকে।
বুয়েটের শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে বিভীষিকাময় সময় হচ্ছে ‘১৪তম সপ্তাহ’ আর ‘টার্ম ফাইনাল’। টার্মের শেষ সপ্তাহই ১৪ তম সপ্তাহ। পুরো টার্মের ফাঁকিবাজিগুলো এই সপ্তাহে একসাথে এসে ছোবল মারে। বাকি থাকা সকল ক্লাস টেস্ট, কুইজ, ভাইভা, অ্যাসাইনমেন্ট যেন এই এক সপ্তাহেই এসে জড়ো হয়। ‘হেল উইক’ বললেও যেন কম হয়ে যায় এই এক সপ্তাহ। আর এই হেল উইকের পরেই আসে টার্ম ফাইনাল। পাঁচটি কোর্সের পাঁচটি পরীক্ষা শেষ হবার পর মনে হয় যেন পাঁচটি বিশ্বযুদ্ধ জয় করা হলো। আর এরপরেই শুরু হয় টার্ম ব্রেক। ঘোরাঘুরি করা কিংবা ঘুমানোর জন্য আদর্শ এক সময়।
বিখ্যাত বুয়েটিয়ানদের কথা
বুয়েটের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত এফ. আর. খান। তাঁর হাত ধরেই পৃথিবী সুউচ্চ দালান নির্মাণের কথা ভাবতে পেরেছে। তাঁর নকশা করা সিয়ারস টাওয়ার (উইলস টাওয়ার) ১৯৭৩ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু দালান ছিল। তিনি আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক ডিগ্রী নেন। যদিও সেসময় বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না, কিন্তু প্রতিষ্ঠান তো একই ছিল। তাই এফ. আর. খানকে বুয়েটেরই প্রাক্তন শিক্ষার্থী বলা হয়।
বুয়েটের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের মধ্যে রয়েছেন বাংলাদেশের বিনোদন জগতের অন্যতম সেরা অভিনেতা আবুল হায়াত ও তার জামাতা তৌকির আহমেদ। বাংলাদেশের গণিত অলিম্পিয়াডের অন্যতম পথিকৃত মুনীর হাসানও বুয়েটের প্রাক্তন শিক্ষার্থী। বাংলাদেশের জনপ্রিয় অভিনেত্রী অপি করিম বুয়েটের স্থাপত্যবিদ্যা বিভাগ থেকে পাশ করেছেন। ‘আহা!’ চলচ্চিত্রের জন্য বাংলাদেশ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার পেয়েছেন বুয়েটের এনামুল করিম নির্ঝর। সম্প্রতি শিরোনামহীন থেকে বের হয়ে আসা গায়ক তুহিনও ছিলেন বুয়েটেরই ছাত্র। লেখক আনিসুল হক ছিলেন বুয়েটের প্রাক্তন শিক্ষার্থী। হলিউডেও রয়েছে বুয়েটিয়ানের পদধূলি। ওয়াহিদ ইবন রেজা ভিজ্যুয়াল ইফেক্টের কাজ করেছেন Batman v Superman: Dawn of Justice, Doctor Strange Captain America: Civil War এর মতো সিনেমাতে।
বাংলাদেশের বর্তমান মন্ত্রিসভাতেও রয়েছেন বুয়েটিয়ান। তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান বুয়েটেরই সাবেক শিক্ষার্থী। ইয়াফেস ওসমান একসময় কাজ করেছেন বিখ্যাত এফ. আর. খানের অধীনে। বিভিন্ন মন্ত্রনালয়ের সচিব পর্যায়েও রয়েছেন বুয়েটিয়ানরা। এছাড়াও বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং দপ্তরে কাজ করেন অসংখ্য বুয়েটিয়ান।
প্রকৌশল ও স্থাপত্য সম্পর্কিত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বাইরের জগতে বিখ্যাতদের কথাই বলা হলো এতোক্ষণ। তার মানে এই না যে আসল কাজের জায়গাতে তারা নেই। প্রকৌশল জগতে জামিলুর রেজা চৌধুরী বাংলাদেশের একজন অত্যন্ত সম্মানিত একজন ব্যক্তি, যিনি বুয়েটের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ছিলেন। বসুন্ধরা সিটি, ওয়েস্টিন হোটেল সহ বেশ কয়েকটি বড় বড় প্রকল্পে কাজ করেছেন বুয়েটের স্থাপত্যবিদ মুস্তফা খালিদ পলাশ। গুগল, ইন্টেল, মাইক্রোসফটের মতো বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বিদেশেও অসংখ্য বুয়েটিয়ান কাজ করছেন। আসলে নাম আর প্রকল্প ধরে ধরে লেখতে গেলে আলাদা একটি আর্টিকেল হয়ে যাবে, তাই সেদিকে আর না যাওয়াই ভালো।
বুয়েটের শিক্ষার্থীদের কাছে বুয়েট শুধু একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না, বরং জীবনের অন্য আরেকটি নাম। বুয়েটের শিক্ষার্থীরা পেশাগত জীবনে অনেক ভালো ভালো জায়গায় থাকে কিন্তু জীবনের সবচেয়ে রঙিন সময়গুলো কাটে বুয়েটের ক্যাম্পাসে আর হলে। বুয়েট ছেড়ে দেশ বিদেশেই যেখানেই বুয়েটের শিক্ষার্থীরা ছড়িয়ে পড়ুক না কেন, তাদের জীবনের একটি অংশ তারা এই ক্যাম্পাসে চিরদিনে জন্য রেখে যায়। এ কারণেই বুয়েটকে বলা হয়- দ্য ল্যান্ড অব লিভিং।