‘মসজিদ’ শব্দটি বাংলায় এসেছে আরবি শব্দ ‘মাসজিদ’ থেকে, যার আভিধানিক অর্থ উপাসনালয়, সেজদাহ করার স্থান। সাধারণ অর্থে ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষ যে স্থানে একত্র হয়ে সালাত আদায় করে, তা-ই মসজিদ। এই শব্দটি বিশ্বজুড়ে ১৮০ কোটি মুসলমানের বিশ্বাস, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা আর অনুভূতির সাথে মিশে আছে। যেকোনো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশেই প্রতিটি পাড়া, মহল্লায় কিংবা গলিতে একটি মসজিদের অস্তিত্ব থাকবে।
বাংলাদেশের রাজধানী শহর ঢাকার তো পরিচয়ই হয়ে গেছে মসজিদের শহর হিসেবে। বিশ্বে প্রাচীন স্থাপত্যের নিদর্শন ধারণ করে যেমন স্বমহিমায় টিকে আছে অনেক মসজিদ, তেমনি আধুনিককালেও মসজিদ নির্মিত হচ্ছে নিত্যনতুন চোখ ধাঁধানো স্থাপত্যশৈলী আর নির্মাণ কৌশলের মিশেলে। বিশ্বের নানা প্রান্তে রয়েছে এমন অসংখ্য মসজিদ, যেগুলো কিনা দেখতে একটি রাজ প্রাসাদের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়! এরকমই এক অনিন্দ্য সুন্দর স্থাপনা ব্রুনাইয়ের ওমর আলী সাইফুদ্দিন মসজিদ। ধর্মীয় উপাসনালয়ের পরিচয় ছাড়িয়ে এই মসজিদটি হয়ে উঠেছে স্থাপত্য শিল্পের এক অনন্য নিদর্শন। মসজিদটি সম্পর্কে জানবার আগে প্রথমেই চলুন পরিচিত হয়ে নিই এর নির্মাতা সুলতান ওমর আলী সাইফুদ্দিনের সাথে।
সুলতান হাজী ওমর আলী সাইফুদ্দিন সা’দুল খাইরি ওয়াদ্দিন ইবনে সুলতান মুহাম্মদ (দ্বিতীয়) জামালুল আলম তথা সুলতান তৃতীয় ওমর আলী সাইফুদ্দিন ব্রুনাইয়ের ২৮তম রাজা। বহুগুণে গুণান্বিত এই শাসক ১৯৫০ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত নিজের ১৭ বছরের শাসনামলে ব্রুনাইকে সাজিয়েছেন নিজের মতো করে। ফলে ব্রুনাইয়ের সাবেক প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ওমর আলীর খেতাব হয়ে যায় ‘আধুনিক ব্রুনাইয়ের স্থপতি’। এছাড়াও তিনি ‘রাজকবি’ এবং ‘স্বাধীনতার জনক’ হিসেবেও পরিচিত।
১৯৫০ সালে বড় ভাইয়ের মৃত্যুর পর ক্ষমতায় বসেন ওমর আলী। তিনি ক্ষমতায় বসেই ব্রুনাইকে স্বাধীন ও স্বনিয়ন্ত্রিত করার প্রক্রিয়া শুরু করেন। প্রথমে তিনি ব্রুনাইকে কলোনিয়াল শাসন থেকে মুক্ত করেন। তবে ব্রুনাইয়ের বৈদেশিক নীতি ও প্রতিরক্ষা তখনো ব্রিটিশদের হাতে ছিল। ১৯৫৯ সালে তিনি ব্রুনাইকে পুরোপুরি ব্রিটিশ শাসনের আগল থেকে মুক্ত করতে সক্ষম হন এবং ব্রুনাইয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় ব্রিটিশ হাইকমিশন। সুলতান হবার পাশাপাশি তিনি ব্রুনাইয়ের ইসলাম ধর্ম কাউন্সিলের প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং তার সময়ে ব্রুনাইয়ে ইসলাম ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য পুনরুজ্জীবন ফিরে পায়। তার সবচেয়ে বড় সাফল্য ছিল দেশে একাধিক দৃষ্টিনন্দিত স্থাপত্য নির্মাণ। অন্যদিকে দুটি ভিন্ন ‘ন্যাশনাল ডেভলাপমেন্ট প্ল্যান’ এর আওতায় তিনি একরকম ব্রুনাইয়ের চেহারা বদলে দিয়েছিলেন। ১৯৬৭ সালের অক্টোবর মাসে পদত্যাগ করার আগপর্যন্ত তিনিই ছিলেন ব্রুনাইয়ের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ শাসক। তার এক অমর কীর্তি এই ওমর আলী সাইফুদ্দিন মসজিদ।
১৫ শতকে ব্রুনাইয়ে সে দেশের সুলতানদের হাত ধরে ইসলামের আগমন ঘটে। বর্নিও দ্বীপপুঞ্জের ব্রুনাইয়ের অংশে (উল্লেখ্য, দ্বীপটি মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং ব্রুনাই- এই তিন দেশ একত্রে ব্যবহার করে) তাই ইসলামিক ভাবধারায় অনুপম এক স্বদেশী জাতীয়তাবাদী পরিচয় গড়ে ওঠে, যার নাম হয় ‘মালয়’। তবে সুলতানদের সাথে স্থানীয়দের সম্পর্ক ধীরে ধীরে খারাপ হতে থাকে এবং এর ধারাবাহিকতায় ১৯ শতকের শেষ দিকে ব্রিটিশরা ব্রুনাইয়ের ক্ষমতা দখল করে নেয়। ফলে সুলতানদের ক্ষমতা নাটকীয়ভাবে কমে যায়। ব্রুনাইয়ের প্রতি ব্রিটিশদের আকর্ষণ আরো বাড়ে, যখন ১৯২০ এর দিকে ব্রুনাইয়ে তেলের খনি আবিষ্কৃত হয়। সে বছর থেকেই বৃহত্তর পরিসরে তেল উৎপাদন শুরু করে ব্রিটিশ সরকারি কোম্পানিগুলো। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হতেই নড়বড়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের আগল ছেড়ে বেরিয়ে আসার প্রক্রিয়া শুরু হয় ব্রুনাইয়ে। ব্রুনাইয়ের অর্থনীতি একইসাথে তেল এবং ব্রিটিশ নির্ভরতা থেকে বের করে আনার দুঃসাহসী কাজটি শুরু করেন তৃতীয় ওমর আলী সাইফুদ্দিন। তিনি ‘৫০ এর দশকে ব্রুনাইয়ে বেশ কিছু উচ্চাভিলাষী প্রকল্প হাতে নেন। এই প্রকল্পের প্রধান দুটি দিক ছিল হস্তশিল্পের উন্নয়ন এবং রাবার উৎপাদন। দুটি পরিকল্পনাই একরকম ব্যর্থ হয়। তবে ব্রুনাইয়ের নতুন যুগের শুরুটা ঠিক করে যায় এই প্রকল্পই।
এবার একটু পেছনে ফেরা যাক। ওমর আলী সাইফুদ্দিন মসজিদের আগে ব্রুনাইয়ের রাজধানী ও সবচেয়ে বড় শহর ‘বন্দর সেরি বেগাওয়েন’-এ আক্ষরিক অর্থেই স্বয়ংসম্পূর্ণ কোনো মসজিদ ছিল না। বিশাল শহরে ‘মারবুত পাক টুঙ্গাল’-ই ছিল কাঠের তৈরি একমাত্র ছোট্ট মসজিদ। তৃতীয় ওমর আলী সাইফুদ্দিনের দাদা সুলতান মুহাম্মদ জামালুল আলমের আমলে নির্মিত ৫০০ মানুষের ধারণক্ষমতা বিশিষ্ট মসজিদটির ছাদ তৈরি হয়েছিল পাম উদ্ভিদের বড় বড় পাতা দিয়ে!
তবে তেল উৎপাদন শুরু হলে ব্রুনাইয়ের অর্থনীতির চাকা সচল হয় এবং সুলতান সাইফুদ্দিনও উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রকল্প হাতে নিতে শুরু করেন। এর মধ্যে এই মসজিদটি অন্যতম। ক্ষমতায় আসার পরই সুলতান ওমর আলী সাইফুদ্দিন শহরে একটি মসজিদের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে লাগলেন। তাছাড়া দেশে ইসলামের পতাকা উন্নীত করতে রাজধানী শহরে একটি অভিজাত মসজিদ তৈরি তখন ছিল সময়ের দাবি। সুলতান তাই বেগাওয়েনকে দেশের ইসলামিক কেন্দ্র রূপে গড়ে তুলতে একটি বিশাল এবং ব্যয়বহুল প্রকল্প হাতে নেন। ১৯৫৪ সালে মসজিদের কাজ শুরু হয় এবং ১৯৫৮ সালে মসজিদের উদ্বোধন হয়। মসজিদের ডিজাইন করেন ইতালিয়ান স্থপতি ক্যাভালিয়ের রুডলফ নোলি যিনি তখন দক্ষিণ এশিয়ায় আরো বেশ কিছু প্রসিদ্ধ কাজের জন্য জনপ্রিয়। মসজিদের উপকরণগুলো আনা হয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে। ইতালি থেকে আনা হয় মার্বেল পাথর, গ্রানাইট আনা হয় চীন থেকে, আর ইংল্যান্ড থেকে আনা হয় মসজিদের ভেতরের সাজসজ্জার জন্য ঝাড়বাতি। পুরো মসজিদের মেঝে ছেয়ে দিতে সৌদি আরব থেকে আনা হয় সুদৃশ্য শতরঞ্জি। নির্মাণ শেষে মসজিদটি হয়ে ওঠে শহরের প্রতিচ্ছবি। আর এর নামকরণ হয় সুলতানের নামে।
‘ভেনিস অব দ্য ইস্ট’ খ্যাত ব্রুনাইয়ের রাজধানী শহরের ‘ক্যাম্পং আইয়ার’ গ্রামের কৃত্রিম হ্রদের ধারে নির্মিত হয় বিখ্যাত এই মসজিদটি। মসজিদের সর্বোচ্চ মিনারের উচ্চতা ৫২ মিটার যা সম্পূর্ণ মার্বেলের তৈরি। ৩ হাজার মানুষ ধারণক্ষমতা বিশিষ্ট এর মূল নামাজঘরের প্রতিটি স্তম্ভও তৈরি হয়েছে সম্পূর্ণ শ্বেত মার্বেলে। অন্যদিকে হ্রদ থেকে মসজিদের প্রবেশপথ হিসেবে তৈরি করা হয়েছে মনোরম একটি বজরা। এই বজরাটি মূলত ১৬ শতকে নির্মিত একটি বজরার অনুরূপ। প্রাচীন সেই বজরাটি তৎকালীন ব্রুনাই সালতানাতের সুলতান বলকিয়াহ তার জলযাত্রায় ব্যবহার করতেন। পবিত্র কুরআন নাজিল হবার ১,৪০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে এই বজরাটি তৈরি করা হয়। বজরা থেকে মসজিদ পর্যন্ত সর্পিল সেতুটি সম্পূর্ণ পাথরের তৈরি। আর মসজিদের বিশালাকায় দরজাগুলো তৈরি করা হয়েছিল ফিলিপাইন থেকে আমদানি করা উৎকৃষ্ট কাঠ দিয়ে।
মুঘল এবং ইতালিয়ান স্থাপত্যশৈলীর মিশ্রণে এই অসাধারণ স্থাপনাটি নির্মাণ করে ‘এ. ও কোল্টম্যান অব বুটি অ্যান্ড এডওয়ার্ড চার্টার্ড’ নামক স্থাপত্য নির্মাণ কোম্পানি। মসজিদের সবচেয়ে বড় গম্বুজটি, যা কিনা অনেক দূর থেকে দেখা যায়, সম্পূর্ণ স্বর্ণ দ্বারা আচ্ছাদিত। এছাড়াও প্রতিটি ছোট ছোট মিনারের উপরের গম্বুজ সদৃশ অংশগুলোও স্বর্ণ দ্বারা আচ্ছাদিত করা হয়েছে। মসজিদের ভেতরের দেয়াল এবং স্তম্ভগুলো মুঘল ধাঁচের কারুকার্জ খোদিত। পুরো মসজিদ কমপ্লেক্স ঘিরে আছে মনোরম বাগান ও ফোয়ারা। দূর থেকে কোনো দর্শনার্থী যদি মসজিদের গম্বুজ লক্ষ্য না করেন, তাহলে মসজিদটিকে একটি রাজদরবারও মনে করতে পারেন! মসজিদটির বেশ কিছু সংস্কার কাজ করা হলেও মূল নকশার কোনোরূপ পরিবর্তন করা হয়নি। অনুপম নির্মাণ শৈলীর এই মসজিদের নির্মাণ খরচ ১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, বাংলাদেশি হিসেবে সাড়ে ৮২ কোটি টাকা।
রবি থেকে বুধবার পর্যন্ত সপ্তাহে চারদিন মসজিদটি দর্শনার্থীদের জন্য তিনটি ভিন্ন সেশনে উন্মুক্ত থাকে। সকালে ৮টা থেকে দুপুর ১২ টা পর্যন্ত, দুপুর ২-৩টা পর্যন্ত এবং বিকাল ৫-৬টা পর্যন্ত। মসজিদে ঢোকার পূর্বে অবশ্যই জুতা খুলে সাথে থাকা ফোন, ক্যামেরা রেখে ভেতরে যেতে হবে। অন্যদিকে নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই রয়েছে বিশেষ ধরণের গাউনের মতো লম্বা পোশাক, যা গায়ে দিয়ে সমগ্র শরীর আচ্ছাদিত করে মসজিদে প্রবেশ করতে হবে।
ব্রুনাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে মাত্র আট কিলোমিটার দক্ষিণেই আপনার জন্য অপেক্ষা করছে ওমর আলী সাইফুদ্দিন মসজিদ। মসজিদের আশেপাশে আরো রয়েছে পৃথিবীর বৃহত্তম প্রাসাদ তথা সুলতানের বাসভবন ইস্তানা নুরুল ইমান, রয়্যাল রিগেলিয়া মিউজিয়াম, ব্রুনাই মিউজিয়াম। আর পৃথিবীর বৃহত্তম ‘ওয়াটার ভিলেজ’ বা ভাসমান গ্রাম ক্যাম্পং আইয়ার তো আছেই। ফলে মসজিদ ঘুরে দেখতে গেলে যদি এই স্থানগুলো হাতছাড়া না করতে চান তাহলে অবশ্যই আপনাকে সেখানে রাত্রিযাপন করতে হবে। সেক্ষেত্রে মসজিদের এক কিলোমিটারের মধ্যেই আপনি পাবেন আপনার সাধ্যের মধ্যে থাকার হোটেল, যেখানে খরচ পড়বে প্রতি রাতে ৮০০ থেকে ৮,০০০ পর্যন্ত। অতএব ভ্রমণপিপাসু হলে একবার ঘুরে আসতেই পারেন ব্রুনাইয়ের ওমর আলী সাইফুদ্দিন মসজিদ।