সময়টা ১৯৫৮ সাল। নিউ ইয়র্ক শহরের প্রাণকেন্দ্রে ৩৭৫ পার্ক এভিনিউতে একটি ভবনের কাজ শেষ হলো। দেখতে আপাতদৃষ্টিতে সাধারণ মনে হলেও, ৩৮ তলা ও ৫১৬ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট এই ভবন তৎকালীন পুরো আমেরিকা এবং পরবর্তীকালে পুরো বিশ্বে বাণিজ্যিক ভবনের নকশার ধারণাটাই পাল্টে দিয়েছিল।
সময়ের চেয়ে বহু এগিয়ে থাকা এই ভবনের নাম ‘সীগ্রাম বিল্ডিং (Seagram Building)’। আর এই ভবনের প্রধান স্থপতি হলেন পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ পাঁচ স্থপতির মধ্যে অন্যতম, মিস ভ্যান ডার রো । তার সাথে ছিলেন ফিলিপ জনসন।
১৯৫৪ সালে সীগ্রাম ইন্ডাস্ট্রিয়াল কোম্পানি ম্যানহাটনের ৫২ ও ৫৩ নম্বর সড়কের মাঝে প্রায় ষাট হাজার বর্গ ফুটের একটি জমি কেনে। এ কোম্পানিটি ছিল তখনকার সময়ে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ অ্যালকোহল প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান। তাদের উদ্দেশ্য ছিল ম্যানহাটনে তাদের কোম্পানির জন্য একটি দৃষ্টিনন্দন হেডকোয়ার্টার স্থাপন করা। সেটির নকশার জন্যেই নিয়োগ দেওয়া হয় মিস ভ্যান ডার রো-কে।
নকশা করার পূর্বে মিস ভ্যান ডার রো জাত-স্থপতির মতোই জমির আশেপাশে পুরো এলাকা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। তিনি লক্ষ করেন, জমির আশেপাশে যতগুলো ভবন রয়েছে, তার কোনোটারই আশেপাশে তেমন কোনো খালি জায়গা নেই। সে সময়ে বরং সেটিই ছিল স্বাভাবিক, ভবনগুলো তৈরিই করা হতো অনেকটা ফুটপাত ঘেঁষে, বড়জোর সামান্য একটু জায়গা ছেড়ে।
সবদিক ভেবেচিন্তে উনি ওনার নকশা প্রস্তুত করেন। কিন্তু যখন তিনি তার নকশা মালিকপক্ষের সামনে উপস্থাপন করলেন, তাদের চোখ কপালে ওঠার যোগাড়!
ভ্যান ডার রো রাস্তা থেকে ভবনটাকে ডিজাইন করেছেন প্রায় ১০০ ফুট পেছনে বসিয়ে। রাস্তা এবং ভবনের মাঝে বিশাল এক প্লাজার জন্য তিনি জায়গা ছেড়ে দিয়েছেন। প্লাজাটাকে ডিজাইন করেছেন রাস্তা থেকে কিছুটা উঁচু করে, গ্রানাইটের স্ল্যাব দিয়ে ঢেকে। চারপাশে নিচু, সবুজ মার্বেলের বাউন্ডারি, যেখানে মানুষ বসতে পারে। আর দু’পাশে বিশাল দুটো জলাধার, যার সাথে ছোট ফোয়ারা।
মালিকপক্ষের আপত্তি ছিল এই প্লাজাটাকে নিয়েই। কারণ মিস ভ্যান ডার রো যে জমির প্রায় অর্ধেকটাই প্লাজার জন্য দিয়ে দিয়েছেন! এত টাকা দিয়ে জমি কিনে যদি অর্ধেকটাই ব্যবহার করা না যায়, তাহলে লাভটা কী হলো! তারা প্লাজাটাকে বাদ দিতে চাইলেন, কিন্তু রো রাজি হলেন না। তিনি মালিকপক্ষকে বোঝালেন, এতে আখেরে তাদেরই অর্থাৎ মালিকপক্ষেরই লাভ। কারণ, বাণিজ্যিক ভবনগুলোর অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হলো মানুষকে আকর্ষণ করা।
সীগ্রাম বিল্ডিং যদিও হেডকোয়ার্টার, তবে তখন সীগ্রামের অফিসের পরিধি ছিল নিচতলা থেকে তেরতলা অবধি। বাকি ফ্লোরগুলো বাণিজ্যিক কাজেই ব্যবহার হবে। কাজেই মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইলে এমন একটা নকশা করতে হবে, যা সীগ্রাম বিল্ডিংকে করে তুলবে অন্য সকল ভবনের চেয়ে আলাদা।
এক্ষেত্রে রো-এর নকশায় প্লাজাটাই ছিল, যাকে বলে ‘একমাবেদ্বিতীয়ম্’! কারণ, তখন সীগ্রামের আশেপাশে তো বটেই, পুরো নিউ ইয়র্কেই এমন সুউচ্চ ভবন ছিল না, যার সামনে এত বড় কোনো প্লাজা রয়েছে। তাছাড়া ফুটপাতের পাশেই যদি উঁচু কোনো ভবন থাকে, সেটি দেখতে হলেও মানুষকে যথেষ্ট ঘাড় উঁচু করে দেখতে হয়। ভবনটা একটু দূরে সরিয়ে বসালে, স্থাপত্যের ভাষায় যাকে বলে ‘Eye Level’-এ রাখলে, রাস্তা থেকে খুব সহজেই ভবনটা পথচারীদের চোখে পড়বে।
ভ্যান ডার রো-এর যুক্তি মেনে নিয়ে সীগ্রাম কর্তৃপক্ষ প্লাজাসহই ভবন তৈরির অনুমতি দিলেন। যখন ভবনটি চালু হলো, তখন ফলাফল পাওয়া গেল প্রত্যাশার চেয়েও বেশি।
সীগ্রাম বিল্ডিংয়ের আশেপাশে কোনো ভবনের সামনেই এত বড় জায়গা ছিল না। কাজেই, পথচারী থেকে শুরু করে আশেপাশের বাণিজ্যিক ভবন ও অফিস-আদালতের কর্মীরাও কাজের ফাঁকে একটু খোলা হাওয়ার জন্য সীগ্রাম বিল্ডিংয়ের প্লাজায় এসে জমায়েত হতে লাগল।
ভবনের বাউন্ডারিও তৈরি হয়েছে মানুষের বসার উচ্চতাকে প্রাধান্য দিয়েই। কাজেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে কোনো বাধা নেই। সর্বক্ষণ মানুষের আনাগোনায় সীগ্রাম বিল্ডিংয়ের বাণিজ্যিক মূল্যও বেড়ে গেল বহুগুণ। পরবর্তীকালে নিউ ইয়র্ক তথা আমেরিকার বহু ভবনও তৈরি হতে লাগল সীগ্রামের অনুকরণে।
পাবলিক প্লেসের গুরুত্ব অনুধাবন করে ১৯৬১ সালে নিউ ইয়র্কে আইন করা হলো, ব্যক্তিগত জমির কিছু অংশ অবশ্যই সাধারণ জনগণের জন্য ছেড়ে দিতে হবে। এভাবে মিস ভ্যান ডার রো তার একটিমাত্র উঁচু ভবন দিয়ে পুরো আমেরিকার প্রধান শহরগুলোর চেহারাই বদলে দিলেন।
এমন কিন্তু নয় যে, মিস ভ্যান ডার রো কেবল প্লাজা দিয়েই বাজিমাত করেছিলেন। গঠনগত দিক দিয়েও ভবনটি অনবদ্য। তিনি ভবনটিকে যেভাবে তৈরি করবেন বলে চিন্তা করেছিলেন, স্থাপত্যের ভাষায় তাকে বলা যায় ‘Less is more’, অর্থাৎ খুব সাধারণ জিনিসকেই অসাধারণ রূপ দেওয়া।
তখনকার সময় সুউচ্চ ভবনের বিম-কলামগুলো কংক্রিটের আবরণে ঢেকে দেয়া হতো। বাইরে থেকে দেখলে মনে হতো, মোটা মোটা সব পাথরের ফ্রেমের মাঝখান দিয়ে জানালাগুলো উঁকি মারছে।
ভ্যান ডার রো সীগ্রাম বিল্ডিংয়ের পুরো কাঠামোর নকশা করলেন ব্রোঞ্জের ফ্রেমে, এমনকি বিম কলামেও ব্রোঞ্জ ব্যবহার করলেন। ভবনের কাঠামোগুলো যখন ঢেকে দেওয়াই রেওয়াজ, তিনি করলেন ঠিক উল্টো কাজ। ভবনের পুরো কাঠামো নকশা করলেনই এমনভাবে, যেন বাইরে থেকে সহজেই দেখা যায়। আর জানালাগুলো রাখলেন একটু ভেতরের দিকে ঢুকিয়ে। দেখে যেন মনে হয়, চারকোণা ফ্রেমের মধ্যে জানালাগুলো বসানো।
এতে ভবনের পুরো চেহারাই গেল পাল্টে। আগে যেখানে ভারী পাথুরে একটা অনুভূতি দিত ভবনগুলো, সীগ্রাম বিল্ডিং সেখানে দেখতে মনে হয় যেন গ্লাস-ফ্রেমের তৈরি, যা দেখে সকলেরই বেশ হালকা একটা অনুভূতি হতো।
তৎকালে এটি ছিল বিশ্বের সবচেয়ে দামী হাইরাইজ, যার প্রধান কারণ ছিল এর ইন্টেরিয়র ডিজাইন। ভবনটির ইন্টেরিয়র করা হয়েছিল বাইরের কাঠামোর সাথে মিল রেখে। ব্যবহার করা হয়েছিল প্রচুর ব্রোঞ্জ, ট্রাভেরটাইন এবং মার্বেল।
এরপর থেকে হাইরাইজ নির্মাণের ক্ষেত্রে বিশাল এক পরিবর্তন আসল। সবাই সীগ্রাম বিল্ডিংয়ের অনুকরণে ভারী কংক্রিটের ভবনের বদলে হালকা ধাতব ফ্রেমে ভবন তৈরি করতে লাগল। প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে তৈরি হতে লাগল আরো উঁচু এবং সুন্দর স্কাইস্ক্র্যাপার।
বর্তমানে অনেক নতুন নতুন ভবন তৈরি হচ্ছে সারা বিশ্বে, এসব হয়তো সব দিক থেকেই সীগ্রাম বিল্ডিং-এর চেয়ে অনেক বেশি উন্নত এবং দৃষ্টিনন্দন। তবে ভুলে গেলে চলবে না যে, সীগ্রাম বিল্ডিংয়ের মাধ্যমেই কিন্তু মিস ভ্যান ডার রো ভিন্ন পদ্ধতিতে হাইরাইজ তৈরির কৌশল শিখিয়েছেন। এ ব্যাপারে নিউ ইয়র্ক স্কাইস্ক্র্যাপার মিউজিয়ামের প্রতিষ্ঠাতা ক্যারল উইলিস বলেন,
অবকাঠামো নির্মাণে পাথুরে রূপ থেকে কাচের দিকে মোড় নিতে থাকা একটা শহরকে এক ধরনের আধুনিক কর্পোরেট পরিচিতি এনে দিয়েছে সীগ্রাম বিল্ডিং।
আজকের দিনে যদি কেউ সীগ্রাম বিল্ডিং পরিদর্শনে যান, তাহলে তার হয়তো মনে হতে পারে, এ আর এমন কী! এ তো অন্য ভবনগুলোর মতোই! তবে সত্যি কথা বলতে, সীগ্রাম বিল্ডিং অন্য ভবনের মতো দেখতে নয়, বরং অন্য ভবনগুলোই সীগ্রাম বিল্ডিং-এর মতো দেখতে!
সীগ্রাম বিল্ডিং হাইরাইজ তথা ভবন নির্মাণের চিন্তাধারার ক্ষেত্রে এক নতুন যুগের সূচনা করেছিল আজ থেকে প্রায় ষাট বছর আগে। দুঃখের বিষয়, আমাদের দেশে আমরা এখনও সেই নতুন যুগের সুর ধরতে পারিনি। এখনও আমরা বাড়ি তৈরির ক্ষেত্রে আমাদের অধিকৃত জমি থেকে কোনো জায়গাই ছাড়তে চাই না। অথচ আমাদের বোঝা উচিত, বাড়ির সামনে অতিরিক্ত জায়গা থাকলে তা যেমন বসবাসকারীদের জন্যও ভালো, তেমনি কোনো এলাকা তথা শহরের জন্যও কল্যাণকর।