শিল্প শৈলীর ছোঁয়ায় অনন্য লাল পাথরের শহর পেত্রা

মানব সভ্যতার এক বিস্ময়কর সৃষ্টি লাল পাথরের শহর পেত্রা। ১৯৮৫ সালে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষণা করেছে পেত্রাকে। এ ঘোষণায় পেত্রাকে বলা হয় “মানব সভ্যতার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদগুলোর একটি”। এছাড়াও ২০০৭-এ পৃথিবীর নতুন সাতটি আশ্চর্যের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে পেত্রা। দেখা যাক কেন পশ্চিম এশিয়ার এই শহরটিকে নিয়ে এত মাতামাতি।

মূলত, পেত্রা একটি নগর রাষ্ট্র। বর্তমান জর্দানের দক্ষিণ-পশ্চিমের গ্রাম ওয়াদি মুসা-র ঠিক পূর্বে হুর পাহাড়ের পাদদেশে এর অবস্থান। ইতিহাসের ধারণানুসারে এর পত্তন হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ বছর আগে। প্রাচীন এ নগর রাজ্যে ছয়তলা ভবন ছিল, যার ধ্বংসাবশেষ এখনো বিদ্যমান। এখানে খুব বড় মূর্তি স্থাপিত মন্দির, একসাথে ৩০০০ দর্শক ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন নাট্যশালা, লাইব্রেরি, ১০ থেকে ১৫ হাজার দর্শক ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন গ্যালারি সমৃদ্ধ ষ্টেডিয়াম ছিল।

রাজসভা, মন্ত্রিসভা, পরিষদবর্গের জন্য আলাদা সভাকক্ষ ছিল, ছিল প্রায় ১০,০০০ স্কয়ার ফিট আয়তনের একটি বিচারালয়। এ বিচারালয়ে ছিল বিচারকের বসার স্থান, যুক্তিতর্ক উপস্থানের জন্য নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গের (আজকের দিনের উকিল/ব্যারিষ্টার) জন্য নির্ধারিত জায়গা, বাদী/বিবাদীর জন্য আলাদা আলাদা জায়গা, বিচার দর্শনার্থীদের জন্য বসার স্থান ইত্যাদি। আধুনিক নাগরিক সুবিধা ছিল এ নগর রাজ্যে। এই নগররাজ্য অত্যন্ত সুরক্ষিত ছিল। ছিল নগর রক্ষক তথা সেনবাহিনীর জন্য ব্যারাক।

পেত্রা নগরী ছিল অত্যন্ত সুরক্ষিত ও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ। পেত্রার চারধারে ছিল উঁচু পাহাড় আর একটি অফুরন্ত ঝরণাধারা। পশ্চিমের গাজা, উত্তরের বসরা ও দামাস্কাস, লোহিত সাগরের পাশের আকুয়াবা ও লিউস এবং মরুভূমির উপর দিয়ে পারস্য উপসাগরে যাওয়ার প্রধান সব বাণিজ্যিক পথগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করত পেত্রা। ৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত এটি ছিল নবটিয়ান রাজ্যের রাজধানী। এটি বিখ্যাত এর অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতিস্তম্ভগুলোর জন্য। এটি তৈরি হয়েছে গুহার মধ্যে। এর কোথাও কোথাও মাত্র ১২ ফুট চওড়া। মাথার ওপরে পাথরের দেয়াল। গুহার পাশেই রয়েছে সবচেয়ে বিখ্যাত ‘খাজনেত ফিরাউন’ নামের মন্দিরটি। মন্দিরটি ফারাওদের ধনভাণ্ডার নামেও পরিচিত।

ফেরাউন মন্দিরের রাতের দৃশ্য পট

ফেরাউন মন্দিরের রাতের দৃশ্য পট

‘পেত্রা’ শব্দের অর্থ হল পাথর। লাল পাথর দিয়ে তৈরি বলে সম্ভবত এই শহরটির নাম করা হয় পেত্রা। এই শহরটিতে আছে প্রায় ৩,০০০ লাল পাথরের টুম্ব, থিয়েটার, ব্যাঙ্কোয়েট হল ছাড়াও বাড়িঘর। এগুলো শুধু বিশালতার দিক দিয়েই বিখ্যাত নয়, সাথে আছে স্থাপত্য-ভাস্কর্য এবং শিল্পশৈলীর ছোঁয়া।

৩০০০ দর্শকের পেত্রা থিয়েটার

৩০০০ দর্শকের পেত্রা থিয়েটার

খ্রিস্টপূর্ব ৩১২-তে আরব আদিবাসী নবটিয়ানরা এই অঞ্চলে বসবাস শুরু করলে নবটিয়ান রাজা চতুর্থ এরাটাস পেত্রায় রাজধানী স্থাপন করেন। পেত্রার মসলা ছিল পৃথিবী বিখ্যাত। পেত্রা থেকে চিন, গ্রিস, ভারত ও ইজিপ্টে মসলা রপ্তানি করা হত। ধনী নবটিয়ানরা শহরটিকে নতুন করে সাজাতে লাগলেন। পেত্রায় কোষাগার, কাসার আল বিন আল ফারুন মন্দির, উইং লায়েন্সের মন্দির তৈরি ছাড়াও মরুভূমির মধ্যে কৃত্রিমভাবে জলের ব্যবস্থা এবং জল সংরক্ষণ করার জন্য বড়-বড় রিজার্ভার, বাঁধ তৈরি করা হয়। পেত্রার এমন অভূতপূর্ব উন্নতি দেখে ধীরে ধীরে এটি রোমান সম্রাটদের নজর পড়তে থাকে। ১০৬ খ্রিস্টাব্দে রোমান সম্রাট ট্রোজান পেত্রা অধিকার করেন। তবে বৃহৎ রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে আরও শ্রীবৃদ্ধি হতে থাকে পেত্রার।

সেই সময় ভৌগলিক অবস্থানভেদে পেত্রার উপর অনেক ধনী সম্রাটের নজর ছিল। কারণ যে এই জায়গাটিকে দখল করতে পারবে, সে-ই পেত্রা ও এর উপর দিয়ে যাওয়া বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বানিজ্যিক পথগুলোর দখল নিতে পারবে। এই পথ ধরেই বণিকরা মশলা, জামাকাপড় নিয়ে পাড়ি দিতেন গাজা, বোস্রা, দামাস্কাসের দিকে। তারপর রেড সি, মেডিটেরেনিয়ান সি পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়তেন নানা দেশে। আর সেই সময় পশ্চিম এশিয়ার বাসিন্দাদের প্রধান জীবিকা ছিল ব্যবসা। এতে করেই সকলের কাছে পেত্রার গুরুত্ব খুব সহজেই আন্দাজ করা যায়।

কারুকার্য সম্পন্ন পেত্রার স্থাপত্যশৈলী

কারুকার্য সম্পন্ন পেত্রার স্থাপত্যশৈলী

পেত্রার বাইরের স্থাপত্য যেমন সুন্দর তেমনি অন্দরমহল ও ছিল নজরকাড়া। বিভিন্ন কারুকার্য ও সুনিপুণ হাতের কাজ পুরো শহরটিতে ছড়িয়ে রয়েছে। নবটিয়ানদের ধর্ম নিয়ে কোথাও খুব বেশি চর্চা পরিলক্ষিত হয় না। ধারণা করা হয়ে থাকে এরা ‘দুশরা’ নামক এক দেবতা আর দেবী ‘আল উজা’র পূজা করতেন। পরবর্তীতে এখানকার অধিবাসীরা পেগান ধর্ম গ্রহণ করেন। এরা আরামাইক ভাষা ব্যবহার করতেন যা আমাদের ঠিক উল্টো অর্থাৎ ডান দিক থেকে বাঁ দিকে লেখা শুরু করা হত।

সূর্য ডোবার পর পাথরের বাড়ির খাঁজে-খাঁজে ব্রোঞ্জের তৈরি ল্যাম্পে আলো জ্বালিয়ে রাখা হত। খাওয়ার জন্য সিরামিকের থালা, বাটি ব্যবহার করতেন পেত্রার অধিবাসীরা। খাবারের প্লেটের কারুকার্য দেখে ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য করা হত। যিনি যত ধনী, তার প্লেটে তত কারুকাজ। পেত্রার স্থাপত্যে হেলিনিস্টিক গ্রিক স্থাপত্যশৈলীর সাথে মিশে গিয়েছে নবটিয়ান আর রোমান শিল্পশৈলী। প্রাচীনকাল থেকেই একের পর এক জাতিগোষ্ঠী রাজত্ব করেছে পেত্রায়। তাই বিভিন্ন জনগোষ্ঠী পেত্রাকে সাজিয়েছে তাদের মত করে। এর ফলেই শিল্পশৈলীর এই মিশ্রণ, যা অনেককেই খুব সহজে অবাক করে।

৩৩০ খ্রিস্টাব্দে রোমান সম্রাট কন্সটান্টাইনের হাত ধরে পেত্রায় খ্রিস্টধর্মের প্রবেশ ঘটে। ‘দ্য মনাস্ট্রি’ টুম্বকে ভেঙে তৈরি করা হয় চার্চ। দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতকে শহরটির কিছুটা উন্নতি সাধন করা হলেও, পরবর্তীতে পেত্রার প্রতিদ্বন্দ্বী শহর ‘পামিরা’ পেত্রার অধিকাংশ বাণিজ্য দখল করে ফেললে এর গুরুত্ব একেবারেই কমে যায়। সপ্তম শতকের দিকে মুসলমানরা এটিকে দখল করলেও দ্বাদশ শতকে ক্রুসেডারটা একে পুনর্দখল করে।

কালের পরিবর্তনে পেত্রার অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে পড়তে থাকে। এই ধ্বংসের শেষ প্রমাণস্বরূপ ধরা হয়ে থাকে এক ভয়াবহ ভুমিকম্পের। ৩৬৩ খ্রিস্টাব্দের মে মাসের ভূমিকম্পে ভেঙে পড়ে শহরের ঘরবাড়ি, চার্চ, মন্দির। ভেঙে পড়ে জল সরবরাহ ব্যবস্থা। স্তব্ধ হয়ে পড়ে পেত্রার জীবনযাত্রা। এক সময়ের জমজমাট পেত্রা পড়ে থাকে ইতিহাসের বই এর পাতায়।

ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত পেত্রা

ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত পেত্রা

অনেক বছর অজানা থাকার পর এই প্রাচীন শহরটিকে পশ্চিমা বিশ্বের কাছে উম্মোচন করেন সুইস পরিব্রাজক জোহান লুইডইগ বুর্কহার্ট। তবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের চাইতেও ঐতিহাসিক ধ্বংসাবশেষের প্রতি তার ছিল বিশেষ আকর্ষণ। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে আরবি ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা শেষ করেই রওনা হয়ে যান পশ্চিম এশিয়ায়। পশ্চিম এশিয়ায় ঢোকার জন্য বুর্কহার্ট ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেন। ১৮১২ খ্রিস্টাব্দে তিনি বেরিয়ে পড়লেন জর্ডানের উদ্দেশ্যে। সেই বছরই ঘুরতে ঘুরতে একদিন মরুভূমির মধ্যে এক প্রাচীন শহরের ধ্বংসাবশেষের সামনে এসে শহরটির স্থাপত্য-ভাস্কর্য দেখে মুগ্ধ হন জোহান।

পেত্রায় দর্শক সমাগম

পেত্রায় দর্শক সমাগম

ঐতিহাসিক জোহান বুঝে গেলেন তিনি চলে এসেছেন এক আশ্চর্য প্রাচীন শহর পেত্রায়। তার হাত ধরেই ইতিহাসের অতল গহ্বরে হারিয়ে যাওয়া পেত্রা উঠে এল সকলের চোখের সামনে। ধীরে ধীরে শহর পেত্রা হয়ে ওঠে পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। প্রতি বছর অসংখ্য লোক এই শহরে পাড়ি জমান পুরোনো এই প্রাচীন নিদর্শন দেখতে, অনেক অনেক বছর আগে কিভাবে একটি সভ্যতা গড়ে উঠেছিল তার প্রত্যক্ষ সাক্ষী হতে। পর্যটকরা ভালোবেসে তাই এই শহরকে ‘রেড রোজ সিটি’ নামেই ডাকতে বেশি পছন্দ করেন।

 

This article is in Bangla language. It's about the historical city petra.

References:

1.http://science.nationalgeographic.com/science/archaeology/lost-city-petra/

2.http://www.visitpetra.jo/DetailsPage/VisitPetra/LocationsInPetraDetailsEn.aspx?PID=6

3.http://whc.unesco.org/en/list/326

Featured Image: mishka.travel

Related Articles

Exit mobile version