বর্তমানে উন্নত প্রযুক্তির যুগে মনে করা হয়, পৃথিবীর প্রায় সবকিছুই হয়তো আবিষ্কার করা হয়ে গেছে। কিন্তু তবুও আমাজনের গভীর কোনো এলাকায় বা কোনো বৃহৎ পর্বতে অথবা সাইবেরিয়ার কোনো বন্য পরিবেশে এখনো কিছু হারিয়ে মানুষ রয়েছে, যারা এখনো উন্নত যুগের ছোঁয়া থেকে নিজেদের আলাদা করে রেখেছে।
চলুন জানা যাক এমনই ১০টি আদিবাসী গোত্র সম্পর্কে, যারা এখনো উন্নত প্রযুক্তির সুবিধাকে প্রত্যাখ্যান করে, প্রাকৃতিক জীবনকে আলিঙ্গন করে, হাজার বছরের পুরনো, নিজের বাপ-দাদার ঐতিহ্য, সংস্কৃতি বুকে লালন করে জীবনযাপন করে আসছে।
১) সুরমা জাতি
সুরমা জাতি অনেক প্রাচীন এক জনগোষ্ঠী। তাদের দেখা মেলে ইথিওপিয়াতে। তাদের প্রধান পেশা মূলত গৃহপালিত পশুপাখি পালন করা। তারা উন্নত বিশ্ব থেকে নিজেদের খুব সফলভাবেই সব ধরনের যোগাযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পেরেছে। ইউরোপীয় কলোনাইজেশন বা যেকোনো প্রকারের যুদ্ধ বা যা-ই ঘটুক না কেন, কিছুই তাদের জীবনযাত্রাকে এতটুকুও বাধাগ্রস্ত করতে পারেনি।
১৯৮০ সালে সর্বপ্রথম কয়েকজন রাশিয়ান ডাক্তার সুরমা আদিবাসীদের সাক্ষাৎ পান। আদিবাসী লোকেরা রাশিয়ানদের এমন সাদা চামড়া দেখে তারা ভেবেছিলো এরা নিশ্চিত ‘হেঁটে বেড়ানো মৃত মানুষ’! সুরমা আদিবাসী গোত্রের লোকজন তাদের পুরুষদের লাঠিখেলা এবং বিবাহ উপযোগী মেয়েদের নিচের ঠোঁটে মাটির ছোট থালা লাগিয়ে রাখার জন্য সুপরিচিত।
২) পেরুভিয়ান গোত্র
পেরুর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় একটি ভ্রমণকারী দল হঠাৎ করেই এক অজানা আদিবাসী দলের মুখোমুখি হয়ে যায়। ভ্রমণের সব কিছুই ভিডিও ক্যামেরাতে ধারণ করা হচ্ছিল। আদিবাসী দলটি ভ্রমণকারী দলের সাথে কথা বলার চেষ্টা করে। কিন্তু যেহেতু তারা কেউই স্প্যানিশ বা ইংরেজি জানতো না, তাই তারা শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে বনের ভেতর চলে যায়।
পেরুর কর্তৃপক্ষ যখন ভিডিও ফুটেজটি পরীক্ষা করে, তখন তারা বুঝতে পারে এই মানুষগুলো ছিল নৃবিজ্ঞানীদের কাছে অজানা শেষ যে কয়েকটি আদিবাসী বর্তমান, তাদের মধ্যে একটি। বিজ্ঞানীরা তাদের সম্পর্কে জানতেন এবং বছরের পর বছর তাদের খোঁজ পাওয়ার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন, কিন্তু সফল হচ্ছিলেন না। শেষে কিনা একদল ভ্রমণকারী দল তাদের দেখা পেলো কোনোরূপ চেষ্টা ছাড়াই!
৩) একাকী ব্রাজিলিয়ান
তাকে বলা হয় ‘পৃথিবীর সবচাইতে একা মানুষ‘। আমাজনের কোনো এক জায়গায় একটি জাতি আছে, যা কিনা মাত্র একটি মানুষ নিয়েই গঠিত! যখনই মনে হয় তাকে এই বুঝি দেখা গেলো, রহস্যময় লোকটি সাথে সাথেই উধাও হয়ে যায়।
তো কেন তাকে নিয়ে এত আগ্রহ, এত খোঁজ? কেন তাকে একা শান্তিতে, নিজের মতো করে থাকতে দেয়া হচ্ছে না? কারণ, যেহেতু তাকে ধরা হচ্ছে তার আদিবাসীর মধ্যে একমাত্র এবং সর্বশেষ ব্যক্তি, সেহেতু তিনিই একমাত্র মানুষ যে কিনা তার জাতির সংস্কৃতি, জীবনযাপন, রীতিনীতি এবং ভাষা সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্যের উৎস হতে পারবেন। সেই সাথে এটাও বিজ্ঞানীদের তুমুল অগ্রহের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, এত বছর এই মানুষটি একা একা কীভাবে বেঁচে আছেন?
৪) জ্যাকসন হোয়াইটস
১৭০০ সালের দিকে ঔপনিবেশিকরা উত্তর আমেরিকার পূর্ব-উপকূলে তাদের উপনিবেশ গুছিয়ে এনেছিল। সেই সময়ের ভেতর আটলান্টিক মহাসাগর এবং মিসিসিপি নদীর মধ্যে বসবাস করা প্রত্যেক আদিবাসী সম্পর্কে জানা হয়ে গিয়েছিল, শুধুমাত্র একটি আদিবাসী গোত্র বাদে।
১৭৯০ সালে ন্যাটিভ আমেরিকানদের অজানা এক আদিবাসী দল বন থেকে বের হয়ে আসে। সেভেন ইয়ারস ওয়ার, রেভ্যলুশনারি ওয়ার ইত্যাদি হওয়া সত্ত্বেও যেকোনোভাবেই হোক, তারা সব সময়েই ঔপনেবিশেকদের সাথে তাদের দূরত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিল।
শেষের দিকে তারা ‘জ্যাকসন হোয়াইটস’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে, কারণ তাদের দেহের রঙ ছিল হালকা সাদা এবং ধরা হতো তারা ‘জ্যাক’দের (বৃটিশদের তুচ্ছার্থক নাম) বংশধর।
৫) রুক
ভিয়েতনাম যুদ্ধে প্রচুর বোমাবর্ষণ হয়েছিল দেশটির নির্জনতম এলাকাতেও। এরকমই এক আমেরিকান বোমাবর্ষণের পর উত্তরে থাকা ভিয়েতনামী সৈন্যদল অবাক হয়ে গিয়েছিল জঙ্গল থেকে বের হওয়া কয়েকটি দলে বিভক্ত কিছু আদিবাসীকে দেখে। এটাই ছিল রুক জাতির সাথে প্রথম সভ্য মানুষের সাক্ষাৎ। বন ধ্বংসের কারণে পুরনো আবাসস্থলে ফেরত যাবার পরিবর্তে তারা সিদ্ধান্ত নেয় ‘উন্নত ভিয়েতনামে’ থাকার। ভিয়েতনাম সরকার বার বার চেষ্টা করেছে রুক আদিবাসীদের উন্নত ভিয়েতনামের অংশ করার। কিন্তু তারা বার বার তার বিরোধিতা করেছে। এই জাতির কিছু সদস্য এখনও দুর্গম জঙ্গলের বিভিন্ন গুহায় বসবাস করছে, যার হদিস একমাত্র জাতিটির বয়স্ক সদস্যরাই জানেন।
৬) নিউ গিনির আদিবাসী গোত্র
ধরা হয়, নিউ গিনির কোথাও কোথাও এখনো প্রায় ডজনখানেক ভাষা, সংস্কৃতি এবং আদিবাসীয় রীতিনীতি রয়েছে। কিন্তু মানচিত্রে অপ্রদর্শিত ভূখণ্ড, আদিবাসীদের অজানা বৈশিষ্ট্য ও চরিত্র এবং তাদের নরমাংসভক্ষণ রিপোর্টের জন্য নিউ গিনির গ্রামীণ এলাকাগুলো খুব কমই অনুসন্ধান করা হয়। যদিও অতীতে অনেক অনুসন্ধান করা হয়েছে, তবে হয় সেগুলো সফল হয়নি, নয়তো যারা অনুসন্ধানে গেছেন তাদের আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
উদাহরণস্বরূপ, আমেরিকান কোটিপতি রকফেলার এরকমই উদ্দেশ্য নিয়ে নিউ গিনি গিয়েছিলেন হারিয়ে যাওয়া আদিবাসীদের খুঁজতে। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি তার গ্রুপ থেকে আলাদা হয়ে যান। ধারণা করা হয়, তিনি কোনো এক আদিবাসী দলের হাতে ধরা পড়েছিলেন এবং তাকে তারা খেয়ে ফেলেছিল।
৭) করোওয়াই গোত্র
ইন্দোনেশিয়ার ঘন বন্য অঞ্চলে, পাহাড়গুলোর পাদদেশ ঘেঁষে করোওয়াই নামক এক বন্য আদিবাসী গোত্রের বসবাস রয়েছে। ১৯৭০ সালে তাদের প্রথম সাক্ষাত হয় বাইরের বিশ্বের মানুষের সাথে।
বর্তমানে পরিস্থিতি অনেকখানি বদলে গেছে। এখন করোওয়াই গ্রামগুলো পরস্পর থেকে এতটাই বিচ্ছিন্ন যে তাদের নিজেদের ভেতরে এবং বাইরের বিশ্বের সাথে কোনো যোগাযোগ নেই বললেই চলে। তারা এখনো বিশ্বাস করে, তাদের ঐতিহ্যে যদি সামান্যতম পরিবর্তনও আসে, তবে তা একটি বড় ভূমিকম্পের সৃষ্টি করবে, যা পুরো পৃথিবী ধ্বংস করে দেবে। ফলে তারা বাইরের বিশ্বের সমস্ত সংস্পর্শ এড়িয়ে, নিজেদের মাঝে, নিজেদের সংস্কৃতি নিয়েই জীবনযাপন করে আসছে।
৮) ব্রাজিলীয় আদিবাসী
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্রাজিলীয় সরকার অনেক আগে থেকেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলো তাদের নির্জন আমাজন অঞ্চলে কতজন মানুষ বসবাস করছে সেটা বের করতে। সেখানকার কিছু উড়োজাহাজ প্রায়ই ছবি তোলার সরঞ্জাম সহ আমাজন অঞ্চলে উড়ে বেড়াতো মানুষের খোঁজ এবং তাদের হিসেব বের করার আশায়।
২০০৭ সালে আমাজনের উপর দিয়ে অপেক্ষাকৃত নিচু দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় এরকমই একটি উড়োজাহাজ একটি অজানা আদিবাসী গোত্রের আক্রমণের শিকার হয়। মজার ব্যাপার হলো, তারা উড়োজাহাজটিকে অজানা কোনো শত্রু মনে করে তীর-ধনুক দিয়ে আক্রমণ করছিল। তারপর ২০১১ সালে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে দেখা যায় যে, আমাজনের কিছু দুর্গম জায়গা, যেখানে কেউ ভাবেনি কোনো মানুষ বসবাস করতে পারে, সেখানে কিছু আদিবাসী এখনও দিব্যি জীবনযাপন করছে।
৯) ইয়াহিয়া
১৯১১ সালে আপাদমস্তক উপজাতীয় সাজে সজ্জিত হয়ে এক আমেরিকান আদিবাসী ক্যালিফোর্নিয়ার জঙ্গল থেকে বের হয়ে আসেন, যাকে তৎক্ষণাৎ পুলিশ আটক করে। তার নাম ইশি এবং তিনি ইয়াহিয়া উপজাতির সদস্য।
পরে স্থানীয় এক কলেজ থেকে একজন দোভাষী এনে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। সেখান থেকে পুলিশ জানতে পারে, তিন বছর আগে ঔপনিবেশিকদের চালানো আক্রমণের পর ইশিই তাদের আদিবাসী সদস্যদের মধ্যে একমাত্র বেঁচে থাকা মানুষ। তারপর তিনি তার জন্মভূমিতে একা একা বেঁচে থাকার সংগ্রাম করে গেছেন। কিন্তু দিন দিন তার জন্য এটি অসহনীয় হয়ে ওঠায় তিনি শেষে সিদ্ধান্ত নেন সভ্য মানুষদের সাহায্য নেয়ার। বার্কলে ইউনিভার্সিটির এক গবেষক তাকে গ্রহণ করেন। ইশি তাকে তাদের সংস্কৃতি, রীতিনীতি, জীবনধারা, ভাষা সম্পর্কে অনেক তথ্য দেন, যার অনেক কিছুই অজানা ছিল এতদিন।
১০) সেন্টিনেলিজ
সেন্টিনেলিজরা হলো প্রায় ২৫০ জন সদস্যের একটি আদিবাসী দল, যারা ইন্ডিয়া এবং থাইল্যান্ডের মাঝখানে নর্থ সেন্টিনেল দ্বীপে বসবাস করে। এর থেকে বেশি কিছু জানা সম্ভব হয়নি তাদের সম্পর্কে, কারণ তারা যখনই কোনো আগন্তুক দেখে, তখনই তাকে অজস্র তীর ছুঁড়ে অভ্যর্থনা জানায়!
১৯৬০ সালে বেশ অভিনব উপায়ে, শান্তিপূর্ণভাবে তাদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তাদের কাছে নারিকেল পাঠানো হয়েছিল উপহারস্বরূপ, যা আবাদ করার পরিবর্তে তারা খেয়ে ফেলেছিল। জীবন্ত শূকর পাঠানো হয়েছিল, যেগুলো খাওয়া বাদ দিয়ে তারা হত্যা করে মাটিতে পুঁতে ফেলেছিল। তবে যে জিনিসটা তারা গ্রহণ করেছিলো তা হলো লাল বালতি। একই বালতি সবুজ রঙের দেয়া হলে তারা সেটি গ্রহণ করেনি।
একবার ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের একটি দল সেখান থেকে ফিরে আসতে বাধ্য হয়। কারণ তাদের দলের নেতা তীরবিদ্ধ হন এবং দুজন লোকাল গাইড নিহত হয়। সেন্টিনেলিজরা দুর্যোগ মোকাবেলায় বেশ সুপরিচিত। তারা এমন সব প্রাকৃতিক দুর্যোগে টিকে ছিল, যেগুলো সেই অঞ্চলের আশেপাশেই বাসকারী সভ্য মানুষেরা পারেনি। উদাহরণস্বরূপ, এই সৈকত ঘেঁষা লোকগুলো ২০০৪ সালের সুনামি, যা ইন্দোনেশিয়া এবং শ্রীলঙ্কায় ভয়াবহ তাণ্ডব চালিয়েছিল, তার প্রভাব খুব সফলভাবেই এড়িয়ে বেঁচে ছিল।