১৪ মার্চ, ২০১৬। শনিবার সন্ধ্যা।
সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমের এরিকসন গ্লোব অ্যারেনাতে বসেছে ইউরোভিশন প্রতিযোগিতার ফাইনালের উৎসব। ইউরোপের ৪২টি দেশের অংশগ্রহণে জমজমাট এবারের আসর।
২০১৫ সালে আর্থিক দৈন্যের কারণে নিজেদের সরিয়ে নেয়া ইউক্রেন এবার যোগ দিয়েছে। তাদের প্রতিনিধিত্ব করছেন ক্রিমিয়ান তাতার বংশোদ্ভূত শিল্পী সুসানা আলিমিভনা জামালাদিনোভা, তবে জামালা নামেই সঙ্গীতজগতে পরিচিত তিনি।
নিজের পূর্বপুরুষদের জন্মভূমি থেকে বিতাড়নের ইতিহাস কেন্দ্র করে জামালা গাইলেন “১৯৪৪”। ভোটাভুটি শেষ হলে “১৯৪৪” সবচেয়ে বেশি ভোট পায়। ফলে জামালার হাতে উঠল শিরোপা, এই আসরের চ্যাম্পিয়নের স্থানে লেখা হলো ইউক্রেনের নাম।
তবে বিতর্ক শুরু হলো গানের কথা নিয়ে। রাশিয়া অভিযোগ করলো- ইউরোভিশনের নিয়ম ভেঙে রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপূর্ণ গান গেয়েছেন জামালা। বিষয়টি এত দূর গড়াল যে কর্তৃপক্ষ জামালার জয়ের বিষয়টি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করে। তারা জানিয়ে দেয়- রাশিয়ার অভিযোগ ভিত্তিহীন।
তবে এতে সমালোচনা বন্ধ হলো না। কারণ ক্রিমিয়া দখলে নেয়া রাশিয়ার সাথে ইউরোপের অধিকাংশ দেশেরই তখন সাপে-নেউলে সম্পর্ক। কাজেই কর্তৃপক্ষ নিজেই পক্ষপাতদুষ্ট কিনা সেটা নিয়েই সমালোচকেরা প্রশ্ন তুলতে শুরু করে। কিন্তু “১৯৪৪” নিয়ে এত কাহিনী কেন?
ইউরোভিশন
জামালার কাছে ফিরে যাবার আগে একটু দেখে নেয়া যাক ইউরোভিশনের ব্যাপারটা কী। দ্য ভয়েস, আইডল ইত্যাদির মতো এটিও একটি সঙ্গীত প্রতিযোগিতা। পার্থক্য হলো- ইউরোভিশনের প্রতিযোগী ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, ফলে ব্যক্তিগত নয়, বরং প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে।ইউরোভিশন চ্যাম্পিয়ন হওয়া অত্যন্ত মর্যাদার বলে ধরা হয়। এজন্য প্রতিটি দেশ অনেক যাচাই-বাছাই করে তাদের প্রতিনিধি প্রেরণ করে।
ইউরোভিশনের সূচনাকারী মার্সেল বেঞ্জেকন নামে এক সুইস সাংবাদিক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব। ১৯৫৪-৭০ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন ইউরোপিয়ান ব্রডকাস্টিং ইউনিয়নের প্রধান। সেসময় ইতালির সঙ্গীত প্রতিযোগিতা স্যানরেমো মিউজিক ফেস্টিভ্যালের আদলে তিনি ইউরোভিশনের কথা ভাবলেন। উদ্দেশ্য ছিলো টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারের নানা খুঁটিনাটি খতিয়ে দেখা।
মার্সেলের উদ্যোগে সুইজারল্যান্ডে ১৯৫৬ সালের ২৪ মে সাত দেশের অংশগ্রহণে সর্বপ্রথম অনুষ্ঠিত হয় ইউরোভিশন। রেডিওতেও প্রচারিত হয় আসর। এখান থেকে ক্রমে ক্রমে ইউরোপের প্রধানতম সঙ্গীত প্রতিযোগিতা হয়ে ওঠে এটি।
বিজয়ী নির্ধারণ
ইউরোভিশনের ভোটের নিয়মকানুন সময়ে সময়ে পরিবর্তন হয়। ২০১৬ সালে নিয়ম ছিল যে ইউরোপের যেসব দেশে অনুষ্ঠানটি সম্প্রচার হচ্ছে সেখানকার লোকেরা ভোট দিতে পারবে, যাকে বলে টেলিভোটিং। তবে নিজেদের প্রতিযোগীর জন্য ভোট দেবার নিয়ম নেই।
এ তো গেল পাবলিক ভোট। আর বাইরে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর প্রতিটিতে একটি করে জাতীয় জুরি গঠিত হয়। তাদের স্কোরও বরাদ্দ থাকবে ভিন্ন দেশের প্রতিযোগীদের জন্য।
টেলিভোটিংয়ের পর যে গান সবচেয়ে বেশি ভোট পাবে সেটি প্রথম, পরেরটি দ্বিতীয়- এভাবে তালিকা করা হয়। এরপর এ তালিকা মেলানো হয় জুরি ভোটের সাথে। প্রত্যেক জুরি বোর্ড তাদের পছন্দ অনুযায়ী প্রথম থেকে শেষ গানের একটি ক্রম সাজান, যে অনুযায়ী পয়েন্ট যোগ হয়। এই পয়েন্ট আর টেলিভোটিংয়ের তালিকা থেকে প্রাপ্ত পয়েন্ট একসাথে করে নির্ধারিত হয় বিজয়ী।
রাজনৈতিক বক্তব্য
ইউরোভিশনের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইউরোপিয়ান ব্রডকাস্টিং ইউনিয়ন বা ইবিইউ। প্রতিযোগিতার আইনকানুন ঠিক করে তারাই। সেই অনুযায়ী রাজনৈতিক, ধর্মীয় বা কাউকে হেয় করে গান, বক্তব্য, আচরণ ইত্যাদি বর্জনীয়। বিশেষ করে গানের মাধ্যমে রাজনৈতিক এজেন্ডা প্রচার সম্পূর্ণভাবে নিরুৎসাহিত করে ইবিইউ।
ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক ড. ডিন ভিউল্টিকের মতে, ‘রাজনৈতিক এজেন্ডা’ প্রতিযোগিতা থেকে নিষিদ্ধ করা খুব ভালো কথা, কিন্তু সমস্যা হলো ইউরোভিশনের ধারা-উপধারা কোথাও রাজনৈতিক এজেন্ডা বলতে কী বোঝানো হয়েছে, বা এর ব্যাপ্তি কতটুকু সেটা উল্লেখ নেই। ফলে এখানে আইনের প্রয়োগ অনেকটা ব্যক্তিগত পছন্দনির্ভর। ড. ভিউল্টিক বেশ কিছু ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন, যা তার মতে রাজনৈতিক বার্তা বহন করলেও ইবিইউ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
১৯৮৩ সালে ইসরায়েলের শিল্পী অফ্রা হার্যা পশ্চিম জার্মানিতে অনুষ্ঠিত ইউরোভিশনে ইহুদি জাতির টিকে থাকার শক্তি নিয়ে গান করেছিলেন, যার কিছু অংশ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ধরা যায়। ২০০৭ সালে ইসরায়েল ইউরোভিশনের জন্য যে গান নির্ধারণ করে তা ইরানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমদিনেজাদকে টার্গেট করে বলে সমালোচকেরা বলে থাকেন।
২০১৪ সালে অস্ট্রিয়ান কনচিটা উরস্ট ইউরোভিশন জেতেন। তার গানে রাজনৈতিক কথা না থাকলেও ইউরোভিশনের মঞ্চ ব্যবহার করে রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন আর তার কিছু আইনের ব্যাপারে প্রচণ্ড সমালোচনা করেন তিনি। ভিউল্টিকের এই তালিকায় জামালার “১৯৪৪” গানও চলে আসে।
জামালা
১৯৮৩ সালের ২৭ আগস্ট তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের কিরগিজ অঞ্চলের অশ শহরে মুসলিম ক্রিমিয়ান তাতার বাবা আর আর্মেনিয়ান মায়ের ঘরে জন্ম হয় জামালার। নয় বছর বয়সেই গানের দুনিয়ায় নাম লেখান তিনি। ইউক্রেনের এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অপেরা নিয়ে পড়াশোনা শেষ করলেও ঝুঁকে পড়েন পপ ঘরানার দিকে।
২০১১ সালে জামালার প্রথম অ্যালবাম বাজারে আসে। পরের চার বছরে আরো দুটি অ্যালবাম প্রকাশ করেন তিনি। ফলে ইউক্রেনে তার নাম ছড়িয়ে পড়ে। ২০১৬ সালের ইউরোভিশনের জন্য তাকেই দেশের পক্ষ থেকে মনোনীত করা হয়।
১৯৪৪
জামালা বসবাস করতেন ক্রিমিয়াতে। ২০১৪ সালে রাশিয়া ক্রিমিয়া দখল করে নেবার পর তিনি আর সেখানে ফিরে যাননি। যদিও তার পরিবার এখনো সেখানেই আছে।
ইউরোভিশনের জন্য জামালা নিজেই লেখেন “১৯৪৪”। নিজের তাতার পূর্বপুরুষদের কথা স্মরণ করে তার এই গান। ১৯৪৪ সালে স্ট্যালিন ক্রিমিয়া থেকে তাতার জাতিগোষ্ঠীকে উচ্ছেদ করেন, যাদের মধ্যে ছিলেন জামালার দাদা-দাদিও। বিশেষ করে বাবার মুখ থেকে শোনা নিজের প্রপিতামহীর গল্প জামালাকে প্রভাবিত করেছিল। জন্মভূমি থেকে বিতাড়িত হবার সময়ে তিনি হারিয়েছিলেন তার এক কন্যাকে।
ইংরেজিতে লেখা হলেও গানের কিছু কিছু অংশে জামালা ব্যবহার করেছেন তাতারদের ভাষা। ক্রিমিয়ান তাতার লোকগীতি “”Ey, güzel Qirim” থেকে কিছু ছত্র নিয়েছেন তিনি। ২০১৬ সালের ফেভারিট ছিল রাশিয়া, যারা ক্রিমিয়া দখল করে নেয়ায় ইউরোপে তখন উত্তেজনা চলছে। এই পরিস্থিতিতে “১৯৪৪” রাশিয়াকে যে প্রচণ্ডভাবে ক্ষুব্ধ করেছিল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
ক্রিমিয়ান তাতার ও “১৯৪৪”
“১৯৪৪” গানের মূল উপজীব্য স্ট্যালিন কর্তৃক ক্রিমিয়া থেকে তাতার জনগোষ্ঠীকে জোরপূর্বক বের করে দেয়া। এই তাতাররা মূলত মুসলিম। তারা ক্রিমিয়ান উপদ্বীপ এলাকার জনসংখ্যার প্রায় ২০%, বাকিদের মধ্যে রাশিয়ানরা ৫০%।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি জার্মানি ক্রিমিয়াসহ রাশিয়ার বিশাল অংশ দখল করে নিয়েছিল। পাল্টা অভিযানে তাদের হটিয়ে ধীরে ধীরে নিজেদের এলাকা ফিরিয়ে নিতে থাকে রেড আর্মি। ১৯৪৪ সালের এপ্রিলে মুক্ত হয় ক্রিমিয়া।
জার্মান দখলদারিত্বের সময় ক্রিমিয়ান তাতারদের অনেককে জোর করে জার্মানরা তাদের পক্ষে কাজ করতে বাধ্য করে। এই উসিলা দেখিয়ে স্ট্যালিন ও তার উপদেষ্টারা সিদ্ধান্ত নেন এখান থেকে তাদের উঠিয়ে দেয়া হবে। সোভিয়েত সংস্থা এনকেভিডি’র (NKVD/People’s Commissariat for Internal Affairs, কেজিবি’র পূর্বসূরি) কমিশনার বেরিয়া ১০ মে স্ট্যালিনকে টেলিগ্রাম করেন। পুরো পরিকল্পনার একটি রূপরেখা তুলে ধরেন তিনি।
পরদিন স্ট্যালিন সম্পূর্ণ তাতার জনগোষ্ঠীকে ক্রিমিয়া থেকে সরিয়ে নেবার আদেশ জারি করেন। কারণ হিসেবে নাৎসিদের সাথে তাদের হাত মেলানোর দোষ দেয়া হয়। যদিও স্ট্যালিন আর তার সঙ্গীরা বেমালুম চেপে যান যে লাখখানেক তাতার রেড আর্মিতে থেকে নাৎসিদের বিরুদ্ধে লড়েছে, প্রাণও দিয়েছে। তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল ক্রিমিয়াতে কেবল রাশিয়ানরাই বসবাস করবে, ফলে তাতারদের তাড়িয়ে সেখানে রাশিয়া থেকে লোক পাঠানো হবে।
১৯৪৪ সালের ১৮ মে ভোরবেলা সশস্ত্র সৈন্যরা হানা দেয় তাতারদের বাসস্থানে। সদ্য ঘুম থেকে ওঠা মানুষগুলোকে নির্দেশ দেয়া হয় বাক্সপেটরা গুছিয়ে নিতে। যে জন্মভূমিতে সারাজীবন বাস করে এসেছে তারা, মাত্র আধঘণ্টার নোটিশে সেখান থেকে উচ্ছেদ করা হয় তাদের। এই অল্প সময়ে যা পারে তা-ই গুছিয়ে নিতে হয় তাতারদের। পরিবারপ্রতি মাত্র ৫০০ কেজি মালামাল বহনের অনুমতি দেয় সৈন্যরা।
বাসা থেকে বের করে তাতারদের সবাইকে খেদিয়ে আনা হয় ট্রেন স্টেশনে। সেখানে গবাদি পশু বহন করা ট্রেনে চড়িয়ে পাঠানো হয় রাশিয়ার নানা প্রান্তে। মাত্র তিন দিনে প্রায় দু’লাখ তাতারকে নির্বাসিত করা হয় ক্রিমিয়া থেকে।
ট্রেনের পরিবেশ ছিল অত্যন্ত খারাপ। তদুপরি যাত্রা ছিল দীর্ঘ। তাতারদের এক বড় অংশ ছিল নারী, শিশু ও বয়োবৃদ্ধ। তাদের পক্ষে এই ধকল সহ্য করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। প্রায় ৮,০০০ তাতার মারা যায় ট্রেনেই, যাদের বেশিরভাগই নারী ও বয়স্ক।
সেনাবাহিনীতে কাজ করা তাতারদেরও পাঠিয়ে দেয়া হয় সাইবেরিয়ার লেবার ক্যাম্পগুলোতে। স্ট্যালিনের মৃত্যুর পর ১৯৫৩ সালে মুক্তি দেয়া হয় তাদের। তবে ক্রিমিয়াতে ফেরার অনুমতি ছিল না, তাই পরিবারের সাথে নির্বাসিত জীবনই বেছে নিতে হয় তাদের।
প্রায় দেড় লাখের মতো তাতারকে পাঠানো হয় বর্তমান উজবেকিস্তানে। বাকিদের ঠিকানা হয় কাজাখস্তান, তাজিকিস্তান, উরাল পর্বতসহ নানা অঞ্চলে। মস্কোর পার্শ্ববর্তী এলাকাতেই জায়গা হয় কারো কারো।
নির্বাসিত জীবনও স্ট্যালিন তাতারদের জন্য যথাসম্ভব কঠিন করে রেখেছিলেন। নতুন জায়গাতে তাদের পুনর্বাসিত করবার প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ছিল না। খাবার ও বাসস্থানের অভাব, আবহাওয়ার পরিবর্তন ইত্যাদি কারণে প্রথম বছরেই মারা যায় বহু তাতার। পরিসংখ্যান অনুযায়ী নির্বাসনকালের প্রথম তিন বছরে ২০-৪৬% ক্রিমিয়ান তাতার রোগে-শোকে মারা যান। প্রথম বছরে মারা যাওয়াদের প্রায় অর্ধেকই ছিল শিশু।
তাতারদের রাখা হয় অনেকটা বস্তি তৈরি করে, যার চারপাশে কাঁটাতার আর প্রহরী। নিজেদের ঘর থেকে পাঁচ কিলমিটারের বেশি যাবার অনুমতি ছিল না তাদের। মাসে দুবার হাজিরা দিতে হতো স্থানীয় এনকেভিডি অফিসে। সরকারি ফার্মে জোর করে তাদের কাজে লাগিয়ে দেয়া হয়, বিনিময়ে দেয়া হতো যৎসামান্য মজুরি।
৪ঠা জুলাই এনকেভিডি স্ট্যালিনকে জানায় তাদের কাজ সফলভাবে শেষ হয়েছে। এর দশ দিন পরেই নতুন করে ৫১,০০০ মানুষকে পাঠানো হয় ক্রিমিয়াতে তাতারদের স্থান দখল করতে, এদের সিংহভাগ রাশিয়ান।
ক্রিমিয়া থেকে তাতারদের নাম মুছে ফেলতেও হাতে নেয়া হয় বড় প্রকল্প। রাস্তাঘাট আর দালানকোঠার নাম পরিবর্তন করে রাশিয়ান নাম দেয়া হয়। লাইব্রেরি থেকে উঠিয়ে নেয়া হয় তাতার লেখকদের বই। ১৯৪৬ সালের ২৫ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে ক্রিমিয়াকে রাশিয়ান সোভিয়েত ফেডারেটিভ সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকের অধীনে একটি প্রশাসনিক অঞ্চল বা অব্লাস্টে (oblast) পরিণত করেন স্ট্যালিন।
১৯৫৩ সালে স্ট্যালিন মারা গেলে তাতাররা আশা করে নতুন সরকার তাদের জন্মভূমিতে ফিরে যাবার সুযোগ দেবে। কিন্তু নিকিতা ক্রুশ্চেভের তেমন ইচ্ছে ছিল না। ফলে রাজনৈতিকভাবে শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে তাতাররা।
তাদের প্রচেষ্টায় ১৯৬৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ক্রিমিয়াতে একসময় বসবাস করা তাতারদের নামে জারিকৃত একটি ডিক্রিতে নাৎসিদের সাথে তাদের সহযোগিতার অভিযোগ তুলে নেয়া হয়। আরো অনেক পর ১৯৮৯ সালে তাদের অনুমতি দেয়া হয় ক্রিমিয়াতে ফিরে যাবার। ১৮ মে ক্রিমিয়া থেকে তাতারদের নির্বাসনের স্মরণে আলাদা দিবস ঘোষিত হয় ইউক্রেনে।
২০১৬ ইউরোভিশন আসর
ক্রিমিয়া নিয়ে উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে এই আসরকে দেখা হয় রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে। ইউরোপ ছাড়াও চীন, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র ইত্যাদি দেশে সম্প্রচারিত হচ্ছিল সেবছরের ইউরোভিশন। প্রতিযোগিতার আগে জামালা এক সাক্ষাৎকারে জানান- তিনি মনে করেন ইউরোপ এখন তার জাতির দুঃখের কথা শুনতে প্রস্তুত।
জামালা যখন তার গান পরিবেশন করেন, তখন অনেকেই ধরে নেন ক্রিমিয়া নিয়ে রাশিয়ার সমালোচনা করাই “১৯৪৪” এর অন্তর্নিহিত অর্থ। তবে জামালা দাবি করেন- এখানে কোনো রাজনৈতিক স্বার্থ লুকায়িত নেই, তিনি কেবল তার পরিবারের গল্প বলেছেন। ইবিইউ কর্তৃপক্ষ পরবর্তীতে তার দাবি মেনে নেয়। ৫৩৪ পয়েন্ট পেয়ে শেষ অবধি জামালাই প্রথম হন। ইউক্রেনিয়ান পতাকা নিয়ে শিরোপা গ্রহণ করার সময় শান্তি আর সৌহার্দ্যের ডাক দেন তিনি।
বিতর্ক
জামালার বিজয়ের প্রায় সাথে সাথেই তাকে নিয়ে শুরু হয় রাজনীতিবিদদের চাপান-উতোর। ইউক্রেনের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট পোরোশেঙ্কো তাকে অভিবাদন জানান। ওদিকে রাশিয়া ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। রাশিয়ান সংসদ সদস্য এলেনা দ্রাপেকো দাবি করেন- জোর করে রাশিয়াকে হারানো হয়েছে। তিনি দাবি করেন রাশিয়ার বিরুদ্ধে মিথ্যে প্রোপাগান্ডা চালানোর।
জামালার জয় পুনর্বিবেচনার কথাও বলে রাশিয়া। অন্য কিছু পর্যবেক্ষক তাদের এই দাবির সাথে একমত হন যে জামালার গানে রাজনৈতিক বক্তব্য ছিল। তবে ইবিইউ কর্তৃপক্ষ এই অভিযোগ উড়িয়ে দেয়। তারা জানায়- ঐতিহাসিক সত্যের উপর ভিত্তি করে গাওয়া এই গান প্রতিযোগিতার নীতিমালা লঙ্ঘন করে না।
রাশিয়া আর ইউক্রেনের মধ্যে পারস্পরিক শত্রুতা প্রতিযোগিতা চলার সময়েই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। দুই দেশের জুরি বোর্ড একে অপরের গানকে কোনো পয়েন্টই দেয়নি। এর বিপরীত চিত্র প্রস্ফুটিত হয় টেলিভোটিংয়ে। অনেক রাশিয়ান আর ইউক্রেনিয়ান তাদের পরস্পরের গানকে ভোট দিয়েছিল।
অনেকে অবশ্য নতুন ভোটিং পদ্ধতির সমালোচনা করেন। তাদের মতে, অসামঞ্জস্যতায় পূর্ণ ভোটিংয়ের কারণেই ইউক্রেন জিতেছে। কারণ জুরি ভোটে অস্ট্রেলিয়া ইউক্রেনের থেকে ২১১ পয়েন্টে এগিয়ে ছিল। কিন্তু টেলিভোটিং যোগ হলে ভোজবাজির মতো সব পাল্টে যায়।
তবে সবকিছুর পরেও “১৯৪৪” জামালার অন্যতম সেরা কাজ- এ কথা অস্বীকার করার জো নেই। ইউরোভিশন জয়ের ব্যাপারে বিতর্ক থাকলেও সমালোচকেরা একমত যে নিজের পূর্বপুরুষদের কষ্ট নিয়ে এমন শক্তিশালী বক্তব্য জামালার প্রতিভারই বহিঃপ্রকাশ।