এন্টিক বা প্রাচীন মূল্যবান বস্তু সংগ্রহ করার বাতিক অনেকেরই রয়েছে। বিশেষ করে প্রাচীন যুগের আসবাবপত্র, মুদ্রা, তৈজসপত্র, শিল্পকর্ম, অথবা যেকোনো রাজকীয় বস্তু বা জিনিসগুলোর চাহিদা অনেক বেশি। কিন্তু মানুষের এই শখ কতটা তীব্র হতে পারে? একটি কাঙ্ক্ষিত মূল্যবান বস্তুর জন্য একজন মানুষ সর্বোচ্চ কত খরচ করতে পারেন? কিছু কিছু ক্ষেত্রে আপাতদৃষ্টিতে অতি সাধারণ কিছু মূল্যবান বস্তু ক্রয় করতে গিয়ে চোখ কপালে তোলার মতো অর্থ খরচ করার নিদর্শনও রয়েছে। অথচ সেই বস্তুটি হয়তো তার সমসাময়িককালে ঠিক ততটা মূল্যবান ছিল না। এমন ২০টি প্রাচীন অথচ বর্তমান পৃথিবীতে মানুষের সংগ্রহে থাকা সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস নিয়ে এই লেখাটি।
২০. নেপোলিয়নের তলোয়ার
ফ্রান্সের দিগ্বীজয়ী বীর নেপোলিয়ন বোনাপার্টের কথা সবারই জানা। তারই ব্যবহৃত স্বর্ণখচিত একটি তলোয়ার প্রায় ৬.৫ মিলিয়ন ডলারে (৪.৮ মিলিয়ন ইউরো) বিক্রি হয়েছে। উল্লেখ্য, ১ মিলিয়ন ডলার প্রায় সাড়ে ৮ কোটি টাকার সমতুল্য।
ধারণা করা হয়, নেপোলিয়ন সেনাপতি থাকা অবস্থায় ১৮০০ সালের জুনে সংঘটিত ম্যারেঙ্গো’র যুদ্ধে এটি ব্যবহার করেন এবং সেই যুদ্ধে অস্ট্রিয় বাহিনীকে পরাজিত ও ইতালি থেকে বিতাড়িত করেন। যুদ্ধজয়ের নিদর্শন বলে একে বেশ মূল্যবান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অবশ্য পরবর্তীতে এটি তিনি তার ভাইকে দিয়ে দেন এবং তা বংশপরম্পরায় হাতবদল হতে থাকে। ১৯৭৮ সালে এটিকে ফ্রান্সের জাতীয় সম্পদ হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
এ তলোয়ারটির ক্রেতার পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি। তবে তিনি যে-ই হন না কেন, তাকে কিছু শর্ত মেনে এটি কিনতে হয়েছে। যেমন তাকে অবশ্যই দেখাতে হয়েছে যে, ফ্রান্সে তার অন্তত একটি নিজস্ব বাড়ি আছে এবং চুক্তি করতে হয়েছে, তিনি তলোয়ারটি বছরের কমপক্ষে অর্ধেক সময় ফ্রান্সের সীমানার ভেতর রাখবেন।
১৯. প্যানথার ব্রেসলেট
ব্রিটেনের রাজা অষ্টম এডওয়ার্ড প্রেমের জন্য সিংহাসন ত্যাগ করেছিলেন, ভালোবেসেছিলেন এক আমেরিকান নারীকে। তবে অন্যান্য রাজপরিবারের মতো ব্রিটিশ রাজপরিবারের সদস্যদের ক্ষেত্রেও রাজকীয় পরিবারের বাইরে, সাধারণ কোনো মানুষের সাথে প্রণয়ের সম্পর্ককে অপরাধের চোখে দেখা হতো। তদুপরি, সেই মার্কিন নারী, ওয়ালিস সিম্পসন ছিলেন বিবাহিতা। অর্থাৎ এডওয়ার্ডের সাথে তার পরকীয়ার সম্পর্ক ছিল। এ নিয়ে ব্রিটেনের তীব্র বিতর্ক সৃষ্টি হয় এবং এডওয়ার্ড স্বেচ্ছায় সিংহাসন ত্যাগ করেন।
পরবর্তীতে তিনি সকল ঝামেলা চুকিয়ে সিম্পসনকে বিয়ে করেন। তার ভালোবাসার মানুষটিকে উপহার দিয়েছিলেন অত্যন্ত দামী ও সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমধর্মী এক ব্রেসলেট। এটি চিতাবাঘের আদলে তৈরি করা এবং এর পুরো কাঠামো জুড়ে হীরা, চুনি, এমারেল্ডসহ আরও নানান দামী পাথর বসানো রয়েছে। ২০১০ সালে এক নিলামে এটি প্রায় ৭.২ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি হয়।
১৮. জার্মেইনের রাজকীয় স্যুপের পাত্র
এটি স্বনামধন্য ফরাসি রৌপ্যশিল্পী থমাস জার্মেইনের বানানো অপরূপ একটি শিল্পকর্ম। থমাস জার্মেইন ফ্রান্সের রাজা পঞ্চদশ লুইয়ের রাজদরবারে রৌপ্যশিল্পী হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন। তার কাজ ছিল রাজকীয় কাজে ব্যবহৃত মূল্যবান তৈজসপত্র ও অলংকার বানানো। তিনি ১৭৩৩ খ্রিস্টাব্দে রাজা পঞ্চদশ লুইয়ের জন্য প্রায় চৌদ্দ কিলোগ্রাম ভরের এ শৈল্পিক পাত্রটি তৈরি করেন।
এটি ১৯৯৬ সালে ১০ মিলিয়ন ডলারের বেশি মূল্যে বিক্রি হয়। বিক্রেতার পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি। এটি ফরাসি বিপ্লবের সময়কার এবং সম্ভবত এটিই ফ্রান্সের সবচেয়ে মূল্যবান শিল্পকর্ম।
১৭. সেক্রেটারি ডেস্ক
আপাতদৃষ্টিতে সাধারণ এই ডেস্কটি যুক্তরাষ্ট্রে সম্ভবত ১৭৬০ সালে তৈরি করা হয়। যতদূর জানা যায়, এর নির্মাতার নাম জন গডার্ড। তাই এটিকে গডার্ড সেক্রেটারি ডেস্কও বলা হয়।
এই ডেস্কটি ১৯৮৯ সালে প্রায় ১২ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি হয়। আপাতদৃষ্টিতে এটিকে সাধারণ মনে হলেও এ ডেস্কটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রাচীন অভিজাত নিদর্শন। কেননা, এত পূর্বে যুক্তরাষ্ট্রে এমন অভিজাত আসবাবের কথা আর শোনা যায় না। এছাড়া এই ডেস্কটি যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার পূর্বে তৈরি হয়েছে বলে এটির সাথে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতাসহ আরও বেশ কিছু ইতিহাস জড়িয়ে আছে। সম্ভবত এ কারণেই এর এত কদর।
১৬. এলিজাবেথ টেইলরের নেকলেস
হলিউডের একসময়কার ব্যাপক জনপ্রিয় অভিনেত্রী এলিজাবেথ টেইলরকে অনেকেই চেনেন। বিখ্যাত ঐতিহাসিক সিনেমা ‘ক্লিওপেট্রা’তে অভিনয় করা এ অভিনেত্রী ১৯৬৯ সালে তার স্বামী রিচার্ড বার্টনের কাছ থেকে অত্যন্ত দামী একটি মুক্তা উপহার পান, সেটির নাম ‘লে পেরেগ্রিনা’। ‘লে পেরেগ্রিনা’র সাথে জড়িত রয়েছে বিশাল বড় ইতিহাস। ধারণা করা হয়, ষোড়শ শতাব্দীতে মধ্য আমেরিকার পানামায় একজন কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাস সমুদ্রের তীর থেকে এটি কুড়িয়ে পায়। এরপর এটি তিনি তার স্প্যানিশ মনিবের কাছে হস্তান্তর করেন।
বিনিময়ে তিনি সম্ভবত মুক্তি লাভ করেছিলেন। আর ‘লে পেরেগ্রিনা’ পৌঁছে গিয়েছিল স্পেনের রাজ পরিবারের কাছে। এটি প্রায় তিনশ বছর স্প্যানিশ রাজপরিবারের অধিকারে ছিল। এরপর ইউরোপের যুদ্ধ-ঝঞ্জাময় সময়ে এটি বিভিন্ন রাজ্যের রাজাদের নিকট হাতবদল হতে থাকে এবং বেশ কয়েকবার হারিয়েও যায়। সর্বশেষ এর সত্ত্বাধিকারী ইংল্যান্ডের এক রাজকীয় পরিবার ১৯৬৯ সালে এটি নিলামে তুললে ৩৭,০০০ ডলারে রিচার্ড বার্টন এটি কিনে নেন। এখন পর্যন্ত পাওয়া সবচেয়ে বড় মুক্তা এটি। এর নাশপাতির মতো ও সমসত্ত্ব আকৃতি এটির আকর্ষণকে বহুগুণে বাড়িয়ে তুলেছে।
তবে মজার বিষয় হলো, এলিজাবেথ টেইলরও এটি পাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই হারিয়ে ফেলেন! পরবর্তীতে এটি ফিরে পাওয়ার পর এই ‘লে পেরেগ্রিনা’সহ আরো কিছু মূল্যবান পাথর ব্যবহার করে তিনি একটি নেকলেস তৈরি করে নেন। ২০১১ সালে এক নিলামে এটি ১১.৮ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি হয়।
১৫. শাহ তামাস্পের শাহনামা’র পৃষ্ঠা
দশম শতাব্দীর শেষভাগে মহাকবি ফেরদৌসীর রচিত মহাকাব্য ‘শাহনামা’র প্রেক্ষাপট ছিল অত্যন্ত বিস্তৃত। এতে ইতিহাস, সমসাময়িক সমাজ থেকে শুরু করে পারস্যের শাহ’দের (পারস্যের শাসনকর্তা বা রাজাদের উপাধী ছিল ‘শাহ’) বীরত্বগাঁথা তুলে ধরা হয়েছিল। উল্লেখ্য, এই ‘শাহানামা’ এককভাবে কোনো মানুষের রচিত সর্ববৃহৎ মহাকাব্য। ষোড়শ শতাব্দীতে শাহ প্রথম ইসমাইল এবং শাহ প্রথম তামাস্প এর শাসনকালে পারস্য সভ্যতার এই মহামূল্যবান সম্পদ ‘শাহনামা’য় লিখিত বর্ণনাকে চিত্ররূপে ফুটিয়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়; তৎকালীন সেরা চিত্রশিল্পীদের এ দায়িত্ব দেওয়া হয়।
অবশেষে মহাকাব্য ‘শাহনামা’র একটি ভিন্ন ও বিশেষ সংস্করণ বের হয়, যাতে শাহনামা’র সম্পূর্ণ কাহিনীকে চিত্রের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। এ সংস্করণটি ‘শাহ তামাস্পের শাহনামা‘ হিসেবে পরিচিত। এটিকে মানবসভ্যতার ইতিহাসে অন্যতম সুচারু ও মূল্যবান চিত্রায়িত-পান্ডুলিপি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যে চিত্রকর্মটি বলা হচ্ছে, সেটি এই তামাস্পের শাহনামারই একটি পাতা মাত্র। ২০১১ সালে এক নিলামে এর দাম উঠে ১২ মিলিয়ন ডলার! বস্তুত, ইসলামিক চিত্রকর্মগুলোর মধ্যে এটিই সবচেয়ে বেশি দামে বিক্রি হয়েছে।
১৪. ক্যাথারিনা হেনকেল এর মুকুট
অপূর্ব সুন্দর এ মুকুটটি ক্যাথারিনা তার স্বামী গুইদো হেনকেল ফন ডোনার্সমার্ক্স এর কাছ থেকে উপহারস্বরূপ পেয়েছিলেন। মুকুটটি উনবিংশ শতকের শেষভাগে বানানো হয়। তৎকালীন জার্মানীতে হেনকেল পরিবার ছিল শীর্ষস্থানীয় সম্পদশালী পরিবার। গুইদো হেনকেল তাই তার স্ত্রীর জন্য সৌন্দর্যমণ্ডিত এই মুকুটটি বানাতে কার্পণ্য করেননি। এতে হীরক ও এমারেল্ড ব্যবহার করা হয়েছে। ১১টি কলম্বিয়ান এমারেল্ড ক্রমান্বয়ে ছোট থেকে বড় ক্রমে সাজানো; সবগুলোর সম্মিলিত ভর ৫০০ ক্যারেট।
২০১১ সালে এক নিলামে এই মুকুটটির দাম ওঠে প্রায় ১২.৭ মিলিয়ন ডলার। অবশ্য এটির যে অপরূপ সৌন্দর্য এবং এর পেছনে যে প্রচেষ্টা ও শ্রম বিনিয়োগ করা হয়েছে, সে তুলনায় এ পরিমাণ অর্থকে আর যাই হোক, অন্তত অপচয় বলা চলে না।
১৩. মিং আমলের ত্রিপদী সোনার পাত্র
মহামূল্যবান এই ত্রিপদী সোনার পাত্রটি দেখে সহজেই অনুমান করা যায় যে, এটির মালিকানা পেতে চাইলে আপনাকে বেশ ভালো অংকের টাকাই গুণতে হবে। প্রায় ১৮ ক্যারেট স্বর্ণের তৈরি এই পাত্রের উপরিতল বিভিন্ন দামী পাথর ও মণি-মুক্তোয় খচিত এবং ড্রাগনের নকশা খোদাই করা। ঐতিহ্যবাহী মনোমুগ্ধকর চীনা শিল্প ও সংস্কৃতির এক অনন্য নিদর্শন এই পাত্রটি।
হংকং-এ অনুষ্ঠিত এক নিলামে এটি প্রায় ১৪.৮ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি হয়। মজার বিষয় হলো, এই চীনা শিল্পকর্মটির নিলাম শুরু হওয়ার আগে যখন অন্যান্য এন্টিকগুলো বিক্রি হচ্ছিল, তখন ক্রেতারা সেগুলোর প্রতি ততটা আগ্রহ দেখাচ্ছিলেন না। তারা বরং অর্থ বাঁচিয়ে রাখছিলেন যেন এই সোনার পাত্রটির জন্য উঁচু দর হাঁকা যায়।
১২. চীনা মুনফ্লাস্ক
প্রাচীন আমলে রাজা-বাদশাহদের ব্যবহার্য কিংবা রাজকীয় কোনো উপলক্ষে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন প্রকার মূল্যবান পানীয় জমা রাখার জন্য বিশেষ ধরনের পাত্র বা ফ্লাস্ক বানানো হতো। বিশেষ নকশায় বানানো পোর্সেলিনের তৈরি পানীয় জমা রাখার এসব পাত্রগুলোকে মুনফ্লাস্কও বলা হয়। কিয়ানলঙ শাসনামলে, অষ্টাদশ শতকের কোনো একসময় তৈরি হওয়া এই মুনফ্লাস্কটির পোর্সেলিন-নির্মিত মূল-কাঠামোর উপর বিভিন্ন সাদা, নীল ও গোলাপী রঙের এনামেলের অনবদ্য নকশা এর শিল্পগুণকে বাড়িয়ে তুলেছে।
এছাড়া এটির মূল্যবান হওয়ার পেছনে অন্যতম আরও একটি কারণ হলো এই ধরনের ভারী মুনফ্লাস্ক তৈরি করা খুব সহজ ব্যাপার নয়। এর জন্য প্রয়োজন অত্যন্ত দক্ষ কারিগর এবং উৎকৃষ্ট মানের উপাদান। কাদামটির সাথে উপযুক্ত উপাদান মিশিয়ে এর মূল কাঠামো তৈরি করার পর তাপ দিয়ে একে মজবুত করার সময় এটির ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। তাই এর নকশা হতে হয় অত্যন্ত নিঁখুত। ধারণা করা হয়, এ ধরনের মুনফ্লাস্ক কিয়ানলঙ আমলে শুধুমাত্র দুটি বানানো হয়েছিল।
২০১০ সালে হংকং-এ অনুষ্ঠিত এক নিলামে এই মুনফ্লাস্কটি প্রায় ১৬ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি হয়।
১১. একাদশ শতাব্দীর অলিফ্যান্ট
প্রাচীনকালে মানুষ শিকার করতে বা যুদ্ধে যাওয়ার সময় প্রায়ই শিঙ্গা বহন করতো এবং বিভিন্ন প্রয়োজনে সেটি ব্যবহার করতো। এর মধ্যে যেগুলো হাতির দাঁত থেকে তৈরি, সেগুলো অলিফ্যান্ট নামে পরিচিত এবং অত্যন্ত মূল্যবান। এধরনের মানানসই আকৃতির একটি শিঙ্গা তৈরি করতে প্রয়োজন হয় নিখুঁত আকৃতির হাতির দাঁত। এর উপর খোদাই করা নকশা ও রঙের ব্যবহার এর শিল্পমূল্যকে আরো বাড়িয়ে তোলে।
এমনই একটি অলিফ্যান্ট বিক্রি হয় প্রায় ১৭ মিলিয়ন ডলারে। ধারণা করা হয়, এটি একাদশ শতকে স্ক্যান্ডিনেভিয়ায় বানানো হয়েছিল।
১০. রথসচাইল্ড পরিবারের ফেবার্গ এগ
‘হাউজ অব ফেবার্গ’ রাশিয়ার প্রসিদ্ধ ও ঐতিহ্যবাহী জুয়েলারি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। এটি প্রায় ১৮০ বছর ধরে হরেক রকম দামী পাথর, হীরা-মণি-মুক্তা-জহরতের সমাহারে বিভিন্ন মূল্যবান সামগ্রী তৈরি করে আসছে। ১৮৮৫ সালে রাশিয়ার জার তৃতীয় আলেক্সান্ডার তার স্ত্রীর জন্য ব্যতিক্রমধর্মী একটি উপহার বানাতে ফেবার্গকে দায়িত্ব দেন। হাউজ অব ফেবার্গ তখন বিশেষ এক প্রকার উপহার তৈরি করে দেয়, যা ছিল একটি ডিম্বাকার খোলসে মুড়ানো ক্ষুদে আকৃতির ঘোড়সওয়ারের মূর্তি।
মূল উপহারটা যেমন মূল্যবান, তেমনি এর ডিম্বাকৃতির খোলসটিও ছিল অত্যন্ত দামী উপাদানে তৈরি এবং উন্নত রুচিমত্তার পরিচায়ক, যা দেখতে রাজকীয়ও বটে। এই ঘটনার পর থেকে সমাজের অভিজাত শ্রেণীর নিকট ফেবার্গের তৈরি এধরনের উপহারের জনপ্রিয়তা ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। ফেবার্গের তৈরি এই ধাচের সামগ্রীগুলো ‘ফেবার্গ এগ’ নামেই পরিচিত হয়ে উঠে।
প্রভাবশালী রথসচাইল্ড পরিবারের কথা অনেকেরই জানা। ১৯০২ সালে রথসচাইল্ড পরিবারের জন্য এমনই একটি ফেবার্গ এগ বানানো হয়। তবে সেটি ছিল অনন্য। অন্যান্য ফেবার্গ এগের মতো এর ভেতরে কিছু লুকোনো ছিল না। বরং এটি ছিল বিশেষ ধরনের একটি ঘড়ি। ২০০৭ সালে এটি ১৮.৫ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি হয়। এটি হয়তো আরো বেশী দামে বিক্রি করা যেতো, কিন্তু এর রাশিয়ান সত্ত্বাধিকারী ঘোষণা দিয়েছেন, এটি রাশিয়ান শিল্পকর্ম। তাই রাশিয়ার ভেতরেই থাকবে, আর বিক্রি হবে না।
৯. উইটেলসবাখের হীরক
নীলচে আভাযুক্ত দামী এ হীরকখন্ডটি বিভিন্ন সময়ে কয়েকটি স্প্যানিশ ও জার্মান রাজপরিবারের অধিকারে ছিল। এমনিতেই নীলচে আভাযুক্ত হীরা অত্যন্ত দুর্লভ, তার উপর এর আকৃতি তুলনামূলক বড় হওয়ায় এর কদর অনেক বেশি। ধারণা করা হয়, এ হীরকখন্ডটি ভারত থেকে পাওয়া। সর্বশেষ এটি উইটেলসবাখ রাজপরিবারের অধিকারে ছিল। ২০০৮ সালে লরেন্স গ্রাফ নামক একজন ব্রিটিশ মণিকার প্রায় ২৪.৩ মিলিয়ন ডলারে এটি কিনে নেন।
৮. সুপারকমপ্লিকেশন
এ অদ্ভুত নামটি একটি পকেট ঘড়ির। বিখ্যাত সুইস ঘড়িনির্মাতা প্রতিষ্ঠান প্যাটেক ফিলিপের তৈরি এ ঘড়িটি আজ পর্যন্ত বিক্রি হওয়া সবচেয়ে দামী ঘড়ি। যদিও অর্থমূল্যের হিসেবে এরচেয়ে দামী ঘড়ি শুধুমাত্র একটি রয়েছে, তবে সেটি বিক্রি হয়নি, বরং যাদুঘরে রাখা আছে প্রদর্শনীর জন্য।
১৯৩২ সালে এ ঘড়িটি হেনরি গ্র্যাভস নামক এ মার্কিন ধন্যাঢ্য ব্যক্তির জন্য বানানো হয়েছিল। বলা হয়, তিনি অপর এক মার্কিন শিল্পপতির সাথে প্রতিযোগীতায় লিপ্ত হন। প্রতিযোগীতার বিষয়বস্তু, কে কত দামী ঘড়ি সংগ্রহ করতে পারে। এরই ধারাবাহিকতায় প্যাটেক ফিলিপে কোম্পানিকে দিয়ে এটি বানিয়ে নেন। তবে বেচারা হেনরি গ্র্যাভসের দুর্ভাগ্যই বলতে হবে, এই ঘড়িটার নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার আগেই তার প্রতিযোগী সেই শিল্পপতি মারা যান।
২০১৪ সালে এক নিলামে এই ‘সুপার-কমপ্লিকেশন’ নামক এই পকেট ঘড়িটি ২৪ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি হয়।
৭. ড্রাগনস আর্মচেয়ার
এই আর্মচেয়ার বা আরামকেদারাটি প্রায় এক শতাব্দী পূর্বে বানানো। এর নির্মাতা আইরিশ নকশাকার আইলেন গ্রে। যারা পুরোনো বা ঐতিহাসিক জিনিসপত্র সংগ্রহ করে থাকেন, তারা সাধারণত অনেক প্রাচীন আসবাবপত্রের পেছনে অনেক অর্থ ঢালতে আগ্রহী হন। প্রায় এক শতাব্দী ধরে মালিকানা বদল হতে থাকা অনন্য এ কেদারাটি ২০১৭ সালে এক নিলামে প্রায় ২৮ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি হয়।
৬. আর্টেমিসের ব্রোঞ্জ মূর্তি
গ্রিক মিথোলজির অন্যতম এক চরিত্র আর্টেমিস। আর্টেমিসকে শিকারী দেবী (Goddess of Hunting) মনে করা হয়। খ্রিস্টপূর্ব ১০০ সাল থেকে খ্রিস্টিয় ১ম শতাব্দীর মধ্যবর্তী কোনো এক সময়ে রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে আর্টেমিসের একটি ব্রোঞ্জের মূর্তি তৈরি করা হয়। এতে দেবী আর্টেমিসের পাশে একটি হরিণ অবস্থান করছে। ধারণা করা হয়, যখন মূর্তিটি বানানো হয়, তখন এমন একটি দৃশ্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল যেখানে আর্টেমিস শিকার করার জন্য সবেমাত্র তার ধনুক থেকে তীর ছুঁড়েছেন।
অর্থাৎ, তার একহাত খালি থাকলেও অপর হাতে একটি ধনুক থাকার কথা। কিন্তু এ ব্রোঞ্জ মূর্তিটির সুদীর্ঘ জীবনকালের কোনো এক সময়ে ধনুকটি হাত থেকে আলাদা হয়ে পড়ে এবং হারিয়ে যায়। ২০০৭ সালে এ মূর্তিটি প্রায় ২৮.৬ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি হয়।
৫. কোডেক্স লেস্টার
লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির অনেকগুলো পরিচয় রয়েছে। তন্মধ্যে শিল্পী ও বিজ্ঞানী হিসেবে তার পরিচয়টা সম্ভবত সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আসে। জীবদ্দশায় তিনি তার যুগান্তকারী চিন্তাভাবনাসমূহকে বেশ কয়েকটি বই ও পান্ডুলিপিতে প্রকাশ করে গেছেন। এর মধ্যে কোডেক্স লেস্টার অন্যতম। এতে তার বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনাগুলো এক বিশেষ আঙ্গিকে ফুটে উঠেছে এবং সেই চিন্তাভাবনাগুলোকে চিত্রের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে গিয়ে তিনি তার শিল্পী-সত্ত্বার পরিচয়ের স্বাক্ষরও রেখেছেন।
বলা হয়ে থাকে ‘রতনে রতন চেনে’; ১৯৯৪ সালে বিল গেটস এই পান্ডুলিপিটি ৩০ মিলিয়ন ডলারে কিনে নেন। এমনিতেও বিল গেটসের বইপড়ুয়া হিসেবে বেশ সুনাম রয়েছে।
৪. পারসিয়ান কার্পেট
পারস্যের (বর্তমান ইরান) সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের গর্বিত অংশীদার এর কার্পেট শিল্প। একসময় দেশে দেশে এবং বিভিন্ন রাজদরবারে এই কার্পেটের চাহিদা ও কদর ছিল আকাশচুম্বী। সপ্তদশ শতাব্দীতে তৈরি এমনই একটি কার্পেট ২০১৩ সালে এক নিলামে বিক্রি হয় ৩৩.৭ মিলিয়ন ডলারে! যদিও ক্রেতার পরিচয় প্রকাশিত হয়নি, তবে ধারণা করা হয় তিন মধ্যপ্রাচ্যেরই কেউ।
৩. ব্যাডমিন্টন ক্যাবিনেট
অত্যন্ত দামী এই ক্যাবিনেট বা আলমারীবিশেষের নাম শুনলে অনেকেই ভাববেন, এটির সাথে কোনো না কোনোভাবে হয়তো ব্যাডমিন্টন খেলার সম্পর্ক আছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ‘ব্যাডমিন্টন’ ইংল্যান্ডের একটি জায়গার নামও বটে। সেখান থেকেই এ নামটি এসেছে। সারা কাঠামো জুড়ে দুর্লভ ও অত্যাধিক দামী বিভিন্ন পাথর বসানো এ ক্যাবিনেটটির প্রথম ব্যবহারকারী ছিলেন বিউফোর্টের ডিউক হেনরি সমারসেট। এটি বানাতে প্রায় ৩০ জন কারিগরের ৬ বছর লেগে গিয়েছিল। ২০০৪ সালে এক নিলামে এটি ৩৬ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি হয়।
২. রু গুয়ানইয়াও ব্রাশ ওয়াশার
একে একটি ছোটখাটো গামলার সাথে তুলনা করা যায়। গামলায় যেমন পানি রেখে সে পানিতে কোনোকিছু ধোয়া হয়, এটির কাজও ছিল অনেকটা সেরকমই। তবে অন্যান্য গামলার সাথে এর পার্থক্য হচ্ছে, এটি রাজকীয় জিনিস। সিরামিকের তৈরি এই ক্ষুদে গামলাটি প্রায় ৯০০ বছর পূর্বে চীনা সোঙ রাজবংশের আমলে বানানো হয়। এর মূলত কী কী উপাদান দিয়ে বানানো হয়েছে, তা আজও রহস্যাবৃত।
নীলচে-সবুজ আভাযুক্ত অসাধারণ এই পাত্রটি দেখলে প্রথমে দৃষ্টিভ্রম হয়, মনে হয় যেন এর উপর ছড়িয়ে আছে অনেকগুলো নীলচে বরফের টুকরো। রাজদরবারে নিয়োজিত পান্ডুলিপিকার ও চিত্রকরদের তুলি বা ব্রাশ ধৌত করার পাত্র হিসেবে এটি ব্যবহৃত হতো।
২০১৭ সালে এই ব্রাশ ওয়াশার’টি ৩৮ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি হয়।
১. কিয়ানলঙ আমলের চীনা ফুলদানী
অনুমান করা হয়, বিচিত্র নকশা ও অত্যন্ত কারুকার্যময় পোর্সেলিনের এই ফুলদানীটি কিয়ানলঙ আমলে প্রায় অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে তৈরি করা হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে এর মতো এমন সুচারু নকশা করা কোনো পাত্র বা ফুলদানী আর দেখা যায় না। ধারণা করা হয়, ১৮৬০ সালে দ্বিতীয় আফিম যুদ্ধের সময় এটি চীন থেকে ব্রিটেনে স্থানান্তরিত হয়। এটির ঐতিহাসিক মূল্যমানের সাথে এর নিদারুণ কারুকার্য যুক্ত হয়ে একে করে তুলেছে সবচেয়ে মূল্যবান প্রাচীন বস্তু।
২০১০ সালে এক নিলামে এই ফুলদানীটি ৮০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশী দামে বিক্রি হয়!