তারকাদের জনপ্রিয়তা, তারকাবহুল ব্যক্তিত্ব আমাদের মধ্যে অনেককেই আকৃষ্ট করে। আমাদের মধ্যে অনেককেই খুঁজে পাওয়া যাবে যাদের জীবনের কোনো না কোনো সময়ে রুমের দেয়ালে নিজের পছন্দের তারকার ছবি ছিলো। প্রতিদিন পত্রিকায় কোনো তারকার জীবনে নতুন কী ঘটলো তা পড়তে আমরা কমবেশি সকলেই মজা পাই।
অবশ্য বেশির ভাগেরই তা পছন্দের তারকাকে ভালো লাগার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু অনেকেই এই পছন্দের বিষয়কে খুব বেশি গুরুত্ব দিয়ে ফেলেন। কোনো বিখ্যাত তারকাকে পছন্দ করা এক জিনিস আর রীতিমতো পূজা করা আরেক জিনিস। অথচ এই তারকা অথবা বিখ্যাত মানুষদের পুরোপুরি পূজা করবার পর্যায়ে নিয়ে যাবার অনেক ঘটনাই রয়েছে।
বিখ্যাত মানুষদের প্রতি এতটা অনুরক্তিকে চিকিৎসাবিদ্যাতে মানসিক রোগ হিসেবে গণ্য করা হয়, যার নাম সেলেব্রেটি ওরশিপ সিনড্রোম (CWS)। বিখ্যাত মানুষদের নিজস্ব জীবনের প্রতি প্রবলভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়াই এই রোগের লক্ষণ।
সমাজে এরকম অনেক মানুষ খুজে পাওয়া যাবে যারা এই সমস্যায় ভয়াবহভাবে আচ্ছন্ন। পছন্দের তারকার নিজস্ব জীবনের কিছু পেতে তারা যেকোনো কিছু করতেই রাজি হবে।
তারকাদের প্রতি অনুরক্তি বহু আগে থেকেই সমাজে বিদ্যমান ছিলো। নথিপত্রে উনিশ শতকেরও আগে এরকম একটি ঘটনার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। তৎকালীন হাঙ্গেরির বিখ্যাত পিয়ানোবাদক ফ্রাঞ্জের অনেক ভক্ত ছিলো, যারা তারকা ভক্তিকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যেত, যা আগে কখনো দেখা যায়নি।
একবার ফ্রাঞ্জ এক ভক্তের সামনে একটি সিগারেটের মোড়ক ফেলেন। সেই নারী ভক্ত সিগারেটের মোড়কটি নর্দমা থেকে উঠিয়ে তাতে ডায়মন্ডে পিয়ানোবাদকের নাম খোদাই করে নিজের লকেট বানায়!
আবার ষাটের দশকের বিটল ম্যানিয়ার কথা অনেকেরই জানা আছে! দ্য বিটল ব্যান্ডের চার সদস্য নারীদের জন্য এক বৈশ্বিক উম্মাদনার সৃষ্টি করেন।
অনেক আগে থেকেই বিখ্যাত মানুষদের জন্য মানুষের অনুরক্তি থাকলেও একে মানসিক রোগ হিসেবে গণ্য করা হয় আরো অনেক পরে। এই ধারণা নিয়ে বহুদিন গবেষণা করে একুশ শতকের শুরুতে এই রোগকে সেলেব্রেটি ওরশিপ সিনড্রোম (CWS) নাম দেন গবেষক জন মাল্টবি আর জেমস হুরান।
জন মাল্টবির নেতৃত্বাধীন গবেষক দল এই রোগকে তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করেন। সেগুলো হলো– সামাজিক বিনোদন, তীব্র ব্যক্তিগত এবং আবেগপ্রবণ।
সামাজিক বিনোদনকে মূলত এই রোগের প্রাথমিক ধাপ বলা যায়। এই ঘরে যারা আছে তারা তারকাদের সহজেই বিনোদন দেয়ার ক্ষমতার উপর আকৃষ্ট হয়। বিখ্যাত মানুষদের চলাফেরা, দৈনন্দিন জীবনের আকর্ষণীয় ঘটনায় বিনোদন পায়। এই ধাপের মানুষজন ব্যক্তিগতভাবে বহির্মুখী হয়। বন্ধুবান্ধবদের আড্ডায় তারকাদের জীবন নিয়ে কথা বলতে পছন্দ করে। সব মিলিয়ে সামাজিক বিনোদন ধাপ তেমন ক্ষতিকর নয়।
প্রবল ব্যক্তিগত ভাগে এই রোগের ক্ষতিকর দিকের দেখা পাওয়া যায়। নাম শুনেই বোঝা যায় যে, এরা তারকাদের ব্যক্তিগত জীবনের প্রতি প্রবলভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। তারকাদের প্রতি এরা অমোঘ আকর্ষণ বোধ করে। তারকাদের জন্য নিজেদের বিপদের মধ্যে নিয়ে যেতে এরা পিছপা হয় না। গবেষণায় দেখা যায় যে, এই মানুষগুলোর উদ্বেগ, বিষণ্ণতা, পীড়ন, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ার মতো সমস্যা দেখা দিয়ে থাকে।
শেষমেশ তিন নম্বর ধাপ অর্থাৎ আবেগপ্রবণ ধাপের কথা বলা যাক। এই ধাপের ক্ষতিকর দিক অনেক বেশি বলেই এই রোগে আক্রান্ত মানুষগুলো সমাজে ক্ষতি সৃষ্টি করে। এরা প্রচন্ড একান্তিক, আবেগপ্রবণ, অসামাজিক আর ঝামেলাপূর্ণ হয়ে থাকে। এই ধাপের মানুষরা মনে করে, তাদের পছন্দের তারকার সাথে ব্যক্তিগতভাবে বন্ধন আছে, যে বন্ধনের জন্য তারা যেকোনো কিছু করতে প্রস্তুত। তাদের ভালোবাসার পাত্রের জন্য মিথ্যা থেকে মৃত্যুকে পর্যন্ত বরণ করে নিতে রাজি তারা! পুরো পৃথিবীর শতকরা দুই ভাগ মানুষ এই ভাগের অর্ন্তভুক্ত। পাগলামির চূড়ান্ত পর্যায়ে এরা নিজেদের পরিবার এবং বন্ধুদের জায়গা তাদের উপাস্য তারকাকে দেয়। নিজেদের সম্পর্কের বদলে তারকাদের প্রতি একদিকের অসম ভালোবাসা প্রকাশ করে। তারকাদের জন্য যেকোনো কিছু করতে প্রস্তুত তারা!
জেসি জে টুক নামে এক গায়িকা গানের রিহার্সালের সময় দুর্ঘটনায় নিজের পা ভেঙে ফেলেন। তার এক ভক্ত ইচ্ছা করে নিজের পা ভাঙেন যাতে নিজের পছন্দের তারকার মতো হতে পারেন!
বিখ্যাত র্যাপার এমিনেমের এক ভক্ত তাকে চিঠি লেখার পর উত্তর না পেয়ে নিজের বান্ধবীকে খুন করে নিজে আত্মহত্যা করে! এরকম অনেক উন্মত্ত ঘটনা খুঁজে পাওয়া যায়।
ডক্টর মাল্টবি তার দলের গবেষণার তত্ত্ব বিবিসির সাক্ষাতকারে তুলে ধরেন এভাবে,
৩,০০০ মানুষের থেকে নেয়া ডাটার মধ্যে শতকরা মাত্র একভাগ মানুষের আগে থেকেই আবেশকারী প্রবণতা ছিলো। শতকরা ১০ ভাগ মানুষ (যারা আবেগময়, বিষণ্ণ, পাগলাটে) বিখ্যাত তারকাদের প্রতি প্রবল আকর্ষণ দেখয়েছে।
শতকরা ১৪ ভাগ বলেছে তারা বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে হলেও পছন্দের তারকাকে নিয়ে খবর পড়তে চায় এবং একই ধরনের মানুষের সাথে এ নিয়ে আলোচনা করতে চায়। অন্য শতকরা ৭৫ ভাগ মানুষ তারকাদের জীবন নিয়ে তেমন আকর্ষণ দেখাননি।
সাধারণত অধিকাংশ মানুষেরই কিছু পছন্দের তারকা থাকে, কিন্তু তারা সবসময় তারকাদের নিয়ে ভাবে না। এই আকর্ষণ অন্যান্য জিনিসের মতোই ততক্ষণ পর্যন্ত ঠিক যতক্ষণ তা ব্যক্তিগত জীবনে ব্যাঘাত না ঘটায়।
পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে এই রোগ অন্য একমাত্রায় চলে গিয়েছে। পছন্দের তারকাকে রীতিমতো পূজা করার অনেক ঘটনাই ঘটে সেখানে। রজনীকান্তের প্রত্যেক সিনেমা বের হবার সময় পুরো দক্ষিণ ভারতে হাজার হাজার লিটার দুধ শুধুমাত্র পোস্টারে ঢালা হয় শুভকামনার জন্য!
গত বছর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর জন্য গুজরাটে একটি মন্দির বানায় তার ভক্তরা এবং দ্বিতীয় মন্দিরের কাজ পুরোদমে চলছে! অমিতাভ বচ্চনের জন্য কলকাতাতে একটি মন্দির রয়েছে।
২০১১ সালে রজনীকান্ত কিডনির রোগ থেকে সেরে ওঠায় ১,০০৮ জন ভক্ত মাথা কামিয়ে ফেলে স্রষ্টাকে ধন্যবাদ জানাতে!
এই বিরল রোগে আক্রান্ত হওয়ার অনেক কারণ রয়েছে। যেমন-
১) বিনোদন – এটি একদম সাধারণ একটি কারণ। তারকাদের ব্যক্তিগত জীবনের চিত্তাকর্ষক ঘটনা বিনোদনের একটি মাধ্যমই বলা যায়।
২) একই অহংবোধ – তারকাদের নিজস্ব ভালো লাগা, চালচলন, অহংবোধ এগুলোর সাথে অনেকের ব্যক্তিগত জীবনের ভালো লাগা মিলে যায় কিছু ক্ষেত্রে। তখন ভক্তরা চিন্তা করতে থাকে তারকাদের জীবন আর তাদের জীবন একই।
৩) সামাজিক কারণ – সামাজিক কারণ হলো একই ধর্ম-বর্ণ-জাতি-ভাষা ইত্যাদি তারকার সাথে মিলে যায়। এই মিলগুলোই তারকার জন্য আলাদা আকর্ষণ গড়ে তোলে।
৪) অসম ভালোবাসা – আকর্ষণীয় তারকার প্রতি একদিকের অসম প্রেম একটি কারণ।
৫) আত্মসম্মানবোধের অভাব – আত্মসম্মানবোধের অভাবের কারণে তারকাদের অর্জনকে ভক্তরা তাদের ব্যক্তিগত অর্জন বলে মনে করতে থাকে।
৬) যৌন আকর্ষণ – বিভিন্ন আবেদনময়ী তারকার প্রতি যৌন আকর্ষণ এই রোগের একটি কারণ।
তারকা এবং সফল মানুষরা আমাদের সবার জীবনের প্রেরণা। আমরা অনেক ভালো কিছু শিখতে পারি তাদের জীবনের সফলতা থেকে এবং নিজেদের জীবনের সুখ খুঁজে নিতে পারি। শেষতক বলা যায়, বিখ্যাত তারকাদের জীবন নিয়ে পড়ে আনন্দ নেয়া আর তা নিয়ে আলোচনা করাটা নিজের ব্যক্তিগত জীবনে যাতে খারাপ প্রভাব না ফেলে সেদিকে সবারই লক্ষ্য রাখা উচিত।