ক্লদ মোনে: ইম্প্রেশনিজমের প্রবাদপুরুষ

যেকোনো শিল্পবোদ্ধাকে যদি আপনি জিজ্ঞেস করেন ইম্প্রেশনিজম ধারার সেরা শিল্পী কে, তিনি নিশ্চিতভাবেই ক্লদ মোনের নাম বলবেন। উনিশ শতকের মাঝামাঝি প্যারিসে মোনে ও তার বন্ধুরা সেসময়ের প্রচলিত ছবি আঁকার নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না করে নতুন একটি রীতিতে ছবি আঁকতে শুরু করেন, যাকে বলা হয়  ইম্প্রেশনিজম । বিশেষ ধরনের ব্রাশস্ট্রোক ও উজ্জ্বল রঙের বৈশিষ্ট্য মন্ডিত এই ধারাকে ক্লদ মোনে তার দীর্ঘ শিল্প জীবনে অবিরাম চর্চার মাধ্যমে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। মোনে পরিবেশ ও প্রকৃতিকে নতুন আঙ্গিকে প্রত্যক্ষ করেছেন, তার অনুভূতিকে নতুন রূপে ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলেছেন। তার ছবিগুলো দেখলে দর্শক প্রকৃতির সতেজতা ও স্বতঃস্ফূর্ততাকে উপলব্ধি করতে পারে, অনুভব করতে পারে।

ক্লদ মোনের আঁকা একটি সেল্ফ পোট্রেট; Image Source: Biography.com

মোনের ছবিতে রহস্যময়তা ও প্রশান্তির ছাপও খুঁজে পাওয়া যায়। মোনের অভিনব আঁকার কৌশল এবং চিত্রকলা সংক্রান্ত ধ্যানধারণা বিশ শতকের আধুনিক চিত্রকলাকে অপ্রতিরোধ্য গতিতে সামনে এগিয়ে নিতে অনবদ্য ভূমিকা রেখেছে। আজ আমরা বিখ্যাত এই শিল্পীর জীবন ও শিল্পকর্ম সম্পর্কে জানব।

জন্ম ও শৈশব

ক্লদ মোনের জন্ম ১৮৪০ সালের ১৪ নভেম্বর, প্যারিসে। বাবার নাম ক্লদ এডফ মোনে, মায়ের নাম লুইস জাস্টিন মোনে। মোনের পরিবার ১৮৪৫ সালে নরম্যান্ডি এলাকার লা ভার শহরে চলে যান। সেখানে মোনের বাবা জাহাজের মালামাল বিক্রির ব্যবসা শুরু করেন, সাথে ছিল মুদির দোকানের ব্যবসাও। মোনের বাবা চাইতেন, ছেলে বড় হয়ে ব্যবসার হাল ধরবে। কিন্তু মোনে চাইলেন তিনি শিল্পী হবেন। তার মা ছিলেন গায়িকা এবং শিল্প মনস্ক। তিনি ছেলের শিল্পী হওয়ার ইচ্ছাকে সমর্থন করেন।

লা ভার শহরের একাংশ; Image Source: France.fr

অবশেষে তিনি ১৮৫১ সালে লা ভার সেকেন্ডারি স্কুল অব আর্ট এ ভর্তি হন। স্থানীয় লোকজনের কাছে তার চারকোলের ছবির বেশ সুনাম ছিল। তিনি সেগুলো দশ বা বিশ ফ্রাঙ্কে বিক্রি করতেন। স্কুলে তার শিক্ষক ছিলেন জ্যাকুয়িস ফ্রাঙ্কো অরচার্ড। ১৯৪৬ সালে নরম্যান্ডির সৈকতে তার সাথে পরিচয় হয় ইগুয়েন বদিনের সাথে।

খোলা আকাশে ছবি আঁকছেন একজন শিল্পী; Image Source: Artzline

বদিন তাকে en plein air বা খোলা আকাশের নিচে ছবি আঁকার কৌশল শেখান। তারা দুজনেই ডাচ শিল্পী জোহান বার্থহোল্ড জংকিন্ডের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন।

আবার প্যারিস

মনেট সম্ভবত তার মা মারা যাওয়ার পর প্যারিসে যান। সেখানে ল্যুভরে তিনি দেখতে পান, শিল্পীরা পুরনো শিল্পীদের ছবি নকল করছে। প্যারিসে থাকার সময়ে তার সাথে উদীয়মান শিল্পী এডওয়ার্ড ম্যানের পরিচয় হয়। ১৮৬১ সালে মোনে আফ্রিকান লাইট ক্যাভালরির প্রথম রেজিমেন্টে যোগ দিয়ে আলজেরিয়া চলে যান। ফলে সাময়িকভাবে তার চিত্রকলা শিখনে ব্যাঘাত ঘটে। আফ্রিকায় তিনি সামরিক জীবনের বেশকিছু ছবি এঁকেছিলেন, যার সবগুলোই হারিয়ে যায়। টাইফয়েডে আক্রান্ত হওয়ার কারণে সেনাবাহিনী থেকে ছুটি নিয়ে প্যারিস ফিরে আসেন তিনি। আর ফিরে যাননি। বরং পুরোপুরি ছবি আঁকায় মনোনিবেশ করেন।

আজকের প্যারিস; Image Source: RTS

প্যারিসে প্রচলিত চিত্রকলা দেখে মুগ্ধ হয়ে তিনি চার্লস গ্লেয়ারের ছবি আঁকার ক্লাসে ভর্তি হন। সেখানে তার পরিচয় হলো রেনোয়াঁ, আলফ্রেড সিসলি, ফ্রেড্রেরিক বাজিলদের সাথে। তারা পরবর্তীতে ইম্প্রেশনিজম আন্দোলনে তার সহযোগী হয়েছিলেন। ১৮৬৫ সালে মোনে তার আঁকা ছবি প্যারিসের বিখ্যাত স্যালনে প্রদর্শনীর জন্য জমা দেন। তারমধ্যে “ওম্যান ইন গ্রিন ড্রেস” ছবিটিও ছিল। এই ছবিতে মডেল হয়েছিলেন তার হবু স্ত্রী ক্যামিল ডসি। ছবিটি স্যালনে প্রদর্শনীর অনুমতি পায়নি। যদিও পরের বছর ক্যামিলকেই মডেল বানিয়ে আঁকেন “ওম্যান ইন দ্য গার্ডেন”- ছবিটি গৃহীত হয়। ক্যামিল ১৮৬৭ সালে মোনের প্রথম সন্তান জিয়ানের জন্ম দেন। ১৮৭০ সালে মোনে ক্যামিলকে বিয়ে করেন।

বিদেশের মাটিতে

১৮৭০ সালে ফ্রাঙ্কো-প্রুশিয়ান যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধ থেকে বাঁচতে মোনে পরিবারসহ পাড়ি জমান ইংল্যান্ডে। সেখানে তিনি পার্লামেন্ট হাউজ, ওয়াটারলু ব্রিজ প্রভৃতির ছবি আঁকেন। তিনি কিছু সময় নেদারল্যান্ডসেও ভ্রমণ করেন। তারপর ফ্রান্সে ফিরে সীন নদীর তীরের গ্রাম আর্জনতায়ুতে বসবাস করা শুরু করেন। এই সময়টাতে তিনি বেশকিছু বিখ্যাত ছবি এঁকেছিলেন। যেমন- “পপি ফিল্ড নিয়ার আর্জনতায়ু”।

আর্গেনতায়ুতে মনেটের বাড়ি, এঁকেছেন মনেট; Image Source: art-monet.com

ইম্প্রেশনিজম ও ক্লদ মোনে

স্যালনে মোনের বেশ কিছু ছবি গৃহীত হলেও তার সবচেয়ে উচ্চাভিলাষী ছবিগুলোই প্রদর্শনীর অনুমোদন পায়নি। তাছাড়া মোনে ও তার বন্ধুরা চাচ্ছিলেন একাডেমির কড়া নিয়ম-কানুনের শৃঙ্খল ভেঙে দিতে। তাই তারা নতুন পদ্ধতিতে আঁকা ছবিগুলো নিয়ে নিজেরাই একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। তাদের সাবলীল কম্পোজিশন আর বিচিত্র ব্রাশস্ট্রোকে আঁকা ছবিগুলো তখনকার চিত্রকলার বোদ্ধারা ভালোভাবে নেননি, বরং কড়া সমালোচনা করেছিলেন।

মনেটের বিতর্কিত, পরে বিখ্যাত ছবি “ইম্প্রেশন, সানরাইজ”; Image Source: masterpizes

মোনের ছবি “ইম্প্রেশন, সানরাইজ” ছবির সমালোচনা থেকেই ইম্প্রেশনিজম শব্দটির উদ্ভব ঘটে। কিন্তু একসময় ঠিকই মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে তাদের চিত্রকলার কলাকৌশলগুলো। ইংল্যান্ডে থাকার সময় মোনে জন কনস্ট্যাবল ও জে.এম.ডব্লিউ টার্নারের ল্যান্ডস্কেপ অঙ্কন ও রঙের ব্যবহারে আকৃষ্ট হন। নেদারল্যান্ডসে থাকাকালীন জাপানিজ কাঠের প্রিন্টের সৌন্দর্যও তাকে মুগ্ধ করে। বার্বিজন স্কুলের শিল্পীদের খোলা আকাশের নিচে ছবি আঁকার কৌশল দ্বারাও ইমপ্রেশনিস্টরা প্রভাবিত হয়েছিলেন। পরবর্তীতে এইসবের প্রতিফলন পরিলক্ষিত হয় তার অঙ্কন শৈলীতে। ইমপ্রেশনিস্টদের ঐক্যে পরে ফাটল ধরলেও তিনি নিজের মতো করে ইম্প্রেশনিজমের চর্চা করে গেছেন।

বেদনা বিধুর দিনগুলি

১৮৭৬ সালে মোনের স্ত্রী ক্যামিল যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। মোনের দ্বিতীয় সন্তান মিশেলকে জন্ম দিতে গিয়ে তিনি মারা যান। স্ত্রীর মৃত্যুতে মোনে খুব ভেঙে পড়েন। ক্যামিল অসুস্থ হলে তিনি পরিবার নিয়ে ভিতেই চলে আসেন। সেখানে তারা আর্নেস্ট হোশদি নামের একজন শিল্প সমালোচকের বাড়িতে থাকতেন। হোশদির স্ত্রী এলিস মোনের পরিবারের পাশে থেকেছেন সবসময়। একসময় আর্নেস্ট দেউলিয়া হয়ে বেলজিয়াম চলে যান। তার স্ত্রী এলিসকে পরে মোনে বিয়ে করেন। মোনে এখানে বেশকিছু ল্যান্ডস্কেপ ও সমুদ্রের ছবি এঁকেছেন।

গিভার্নিতে স্বর্গ

১৮৮৩ সালে ট্রেনের জানালা থেকে মোনে গিভার্নি এলাকা দেখতে পান। সেখানে ১৯৯০ সালে তিনি বাড়ি কেনেন এবং বিশাল বাগান তৈরি করেন।

গিভার্নিতে মনেটের বাড়ি ও বাগান; Image Source: paris trip

সেই সময়ে মোনে অর্থনৈতিকভাবে যথেষ্ট সচ্ছল ছিলেন। গিভার্নিতে তিনি পুকুর কেটে শাপলা ফুলের চাষ করেন। এই ফুলগুলোর ছবিই তিনি দিনের বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন রঙ ব্যবহার করে এঁকেছেন। মোনের স্ত্রী এলিস ১৯১১ সালে মারা যান। ছেলে জিয়ানও মারা যান ১৯১৪ সালে। শোকে আচ্ছন্ন মোনের চোখে এই সময় ছানি পড়তে শুরু করে। তার ছেলে মিশেল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে যুদ্ধে যোগ দেন। মোনে মৃত ফরাসী সৈনিকদের স্মরণে এঁকেছেন “উইপিং উইলো ট্রি”।

শেষ দিনগুলি

বিশ শতকে এসে মোনে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন। মিউজিয়ামের প্রদর্শনীগুলোতে গেলে তাকে দেখার জন্য লোকের ভিড় উপচে পড়ত। মোনে জীবনের শেষ দিনগুলোতে ক্ষীণ দৃষ্টিশক্তি নিয়ে ক্রমাগত বাগানের ছবি এঁকে গেছেন। অবশেষে ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন চিত্রকলার এই মহান সাধক।

মোনের ছবি আঁকার কৌশল ও চিত্রশিল্পে মোনের অবদান

মোনের ইম্প্রেশনিজম ধারার ছবিতে মধ্যবিত্ত জীবনের অবসরযাপন চিত্রিত হয়েছে। তার ছেলে ও স্ত্রীকে মডেল বানিয়ে তিনি বেশকিছু গৃহস্থালির ছবিও আঁকেন। যেমন – ” ওমেন উইথ প্যারসল”, ” ক্লিফটপ ওয়াক এট পোরভিল” ইত্যাদি। তবে মোনে ইতিহাসে স্মরণীয় তার একই বস্তুর ছবি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে আঁকার মাধ্যমে তিনি প্রকৃতিকে উপলব্ধি এবং রঙের ব্যবহারে যে মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন সেজন্য।

মোনের মতে, “একটি ল্যান্ডস্কেপের আলাদা কোনো অস্তিস্ত্ব নেই। কারণ এর চেহারা সবসময় পরিবর্তিত হয়। পারিপার্শ্বিকতার কারণেই এটি সতেজতা লাভ করে। আলো বাতাস সবসময়ই বদলায়। আশেপাশের পরিবেশটাই একটা ল্যান্ডস্কেপকে সত্যিকার অর্থে রূপ দান করে”।

মনেটের আঁকা শাপলা ফুল; Image Source: museums of the world

মোনে তার বিখ্যাত জাপানিজ ব্রিজ ও শাপলা ফুলের ছবিগুলোতে পরিবর্তিত সময়কে ধরে রাখতে চেষ্টা করেছেন।

ভিন্ন সময়ে শাপলা ফুল; Image Source: Wallpaper access

শাপলা ফুল ছাড়াও তার বেশকিছু সিরিজ ছবি আছে, যেগুলোতে তিনি ছবিতে সময় ধরে রাখার চেষ্টা করেছেন। যেমন- রুয়ান ক্যাথেড্রাল, পপলার, সীন নদীতে ভেসে যাওয়া বরফের চাঁই প্রভৃতি। শেষের দিকে মোনের ছবি কিছুটা বিমূর্ত রূপ লাভ করে, যদিও তখনো বিষয়বস্তু তখনো বোঝা যাচ্ছিল। মোনের কম্পোজিশন, রঙের ব্যবহার, টোন সবকিছুই ছিল অনন্য। তার দেখানো পথ পরবর্তীতে পিকাসোদের মতো চিত্রকলার প্রবাদ পুরুষদের অনুপ্রাণিত করেছিল।

 

This is a Bangla article on French artist Claude Monet. Life and artworks of Monet are discussed in this article. All the informations are hyperlinked inside the article.

Feature Image - Sahilbihari.com

Related Articles

Exit mobile version